E-Paper

আমি শুনেছি সেদিন তুমি...

যে সময়টা আমরা ফোনের জন্য খরচ করি না, তখনও কি আমাদের ব্যক্তিগত পরিসর জরিপ করে চলেছে এই গ্যাজেট? 

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:১৪
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ইস্কুলের বন্ধুদের জমায়েত। বহু বছর পরে দেখা। কথাবার্তা চলছিল টুকটাক—

“কাছাকাছি যতগুলো জায়গা আছে, তার মধ্যে মন্দারমণিই বেস্ট।”

“উইকএন্ড ডেস্টিনেশনের জন্য বকখালিও দারুণ একটা অপশন।”

“মন্দারমণির হোটেলগুলো খুব আধুনিক। সব ফেসিলিটি আছে।”

“শান্তিনিকেতনই বা কম কী?”

“না না, মন্দারমণি।”

“বেড়ানোর জন্য কিন্তু অ্যামেনিটিসও জরুরি।”

কথার পিঠে কথা উঠল। শহরের কাছে-দূরে যত জায়গা আছে তা তর্ক করে চষে ফেলা হল। বেড়ানোর যে এমন পরিকল্পনা হবে, তা আগে থেকে ঠিক করা ছিল না। হঠাৎ কিছু ঘটিয়ে ফেললে তার মধ্যে রোমাঞ্চ থাকে। কথাবার্তার মধ্যে ফোন বাজছিল মাঝেমধ্যে। ‘ধ্যাত্তেরিকা’, বলে যাবতীয় কল আমরা রিজেক্ট করে দিয়েছিলাম। ফলে ফোন ছিল একেবারে চুপচাপ।

এর পরে যা ঘটল তাকে ভৌতিক কাণ্ড বলা যেতে পারে। আড্ডাপর্ব শেষ করে, ফোনটা কাছে টেনে নিই। কিছু ক্ষণ অন্তর সমাজমাধ্যমে ঢুঁ না মারতে পারলে অসুস্থ লাগে। রোগটা প্রকট হচ্ছে ক্রমশ। ফেসবুক খুলে অবাক হয়ে যাই। সামান্য স্ক্রল করেই দেখি, বিজ্ঞাপনে ভেসে উঠল, ‘উইকএন্ড ডেস্টিনেশনস অ্যারাউন্ড কলকাতা’। তাজ্জব বনে যাই। একটু পরে ফের দেখি, একটি হোটেল হাতছানি দিয়ে বলছে, ‘অ্যামেজিং স্টে অ্যাট মন্দারমণি। এনজয় লাইফ।’ চন্দ্রবিন্দুর গানের মতো, এ সব দেখে ব্রেনে ঝিলমিল লেগে গেল। তখন আমি বাড়ি ফেরার পথে, অ্যাপ-ক্যাবে। আট জন বন্ধুর জমায়েত ছিল। সাত জনের সঙ্গে কথা বললাম। দু’জন জানাল, ওদের ফোনেও ঘটে চলেছে একই জিনিস। এমনটা নাকি আকছার ঘটেই থাকে!

এক জনের থেকে আবার যা শুনলাম, তাকে ভৌতিক সিরিজ়ের দ্বিতীয় পর্ব বলা যেতে পারে। ও আমার থেকে অবাক হয়েছে ঢের বেশি। বলল, “আরে ঘরের অন্য কোণে তো আমাদের বেটার হাফেরা আড্ডায় মেতেছিল। শুনলাম দারুণ কিছু রেসিপি আর ফ্যাশনের নতুন ট্রেন্ড নিয়ে জমাটি আলোচনা হয়েছে। শ্রাবণী তো চিংড়ির একটা রেসিপি প্রায় মুখস্থ করে এসেছে। ও তো আবার অনলাইনে খবর পড়ে খুব। একটা ইংরিজি খবরের কাগজের ওয়েবসাইট খুলেছে জাস্ট, বিজ্ঞাপনের স্ট্রিপে দুম করে চলে এসেছে, ‘অথেনটিক বেঙ্গলি প্রন রেসিপিজ়’। সঙ্গে কারও ইউটিউব চ্যানেলের লিংক। কী হচ্ছে বল তো? শ্রাবণী বলল, ‘জীবনেও কখনও চিংড়ি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি ইন্টারনেটে।” রাখছি রে! ফোনটাকে আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।”

আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরেও কি আঁকশি বাড়িয়ে ধরছে মোবাইল ফোন? যে সময়টা আমরা ফোনের জন্য খরচ করি না, তখনও কি আমাদের ক্রমাগত জরিপ করে চলেছে এই গ্যাজেট? এক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বন্ধুকে এই কথা বলায় ও চোখ নাচিয়ে বলল, “আমাদের লাইফ ইজ় বিয়িং রেকর্ডেড ফর কোয়ালিটি অ্যান্ড ট্রেনিং পারপাসেস।” এত সংক্ষিপ্ত উত্তরে সাধ মেটে না। আমার চোখের তারায় প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল অনেক। ও আন্দাজ করে বলল, “সব সত্যি জানতে নেই। সব প্রশ্ন করতে নেই। সব উত্তর দিতে নেই।”

এই তো। আমার ল্যাপটপ থেকে ফুট তিনেক দূরে, বিছানার উপরে চুপচাপ শুয়ে রয়েছে সাধের মোবাইল ফোন। মোডটা সাইলেন্ট করে দিয়েছি, আপাতত। কালো পর্দায় মাখামাখি স্তব্ধতা। ওয়্যাটস্যাপ এলে ক্ষণিকের জন্য স্ক্রিনে ফুটে উঠছে মৃদু আলো। তার পরেই ফের শান্ত। কী নিরীহ এক যন্ত্র! যে আমার পরানসখা ছিল কিছু দিন আগেও, তাকে এমন ভয় করে কেন আজকাল?

বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে, আন্তর্জালে বাহারি সফর করে, বহু ব্যক্তিগত ব্লগ পড়ে যা জানতে পেরেছি তা হল, এই ভয় আমার একার নয়। এক জন লিখেছেন, “হায় রে কপাল আমার। দূরকে কাছে আনার জন্য একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলাম। সেটা তো ও করেইছে, কিন্তু করতে চাইছে আরও অনেক কিছু যা আমি চাই না। সুচের মতো আমার শরীরে ঢুকে রক্ত টানতে চাইছে। ফোন বন্ধ রাখলে উপায় নেই। আর চালু রাখলে মনে হয় শুয়ে আছি বিরাট কোনও হাসপাতালের মহার্ঘ আইসিইউ বিছানায়, সারা শরীরে নল জড়িয়ে। অজস্র যন্ত্র হিসাব রাখছে আমার প্রতিটি সেকেন্ডের বেঁচে থাকার, কর্ণভেদী বিপ-বিপ ধ্বনি হাতুড়ি মারছে আমার মাথায়। মাথা চিরে দিচ্ছে। নল ঢুকিয়ে রাখা রয়েছে আমার মনেও। আমায় শুষছে।”

ফোন যখন ব্যবহৃত না হয়, তখনও কি ও আমার কথা শোনে? বিশ্ব জুড়ে কয়েকশো কোটি মানুষ এই প্রশ্ন করলেও, এর কোনও ঠিকঠাক উত্তর নেই আপাতত। যে কোনও স্মার্টফোনের সফ্টওয়্যারের মধ্যেই এখন রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যাপ। ফোনের দাবি, ও আমাদের বন্ধু। নাম ধরে ডেকে উঠলেই ও জবাব দেয় চকিতে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে যে প্রশ্নের উদয় হল তা হল, এক বার নাম ধরে ডাকলেই যে উত্তর দিয়ে ফেলে ঝটপট, সে যে আমার যাবতীয় কথা শুনছে না তার প্রমাণ কোথায়? এমন সফ্টওয়্যারের নির্মাতারা কলার তুলে জানান দেন, “ক্রেতাদের প্রাইভেসি আমাদের কাছে সবচেয়ে দামি। এর সঙ্গে আমরা কখনও আপস করি না।” কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাস্তব অন্য কথা বলে। হয়তো আমাদেরই মনের ভুল। হয়তো পুরো বিষয়টাই কাকতালীয়। এই ‘হয়তো’ শব্দটা গভীর অন্ধকারে হঠাৎ জ্বলে ওঠে, ফ্লাডলাইটের মতো। মাথা ঝিমঝিম করে। আলো মিলিয়ে যায় ফের, একঝাঁক রহস্য নিয়ে।

বহু মানুষকে বলতে শুনেছি, “আমারে তুমি অশেষ করেছ। তাই তোমারে আমার সর্বস্ব দিয়েছি, গুগল। তুমি তো জানো আমার সব কিছুই। এ নিঃস্ব বেঁচে থাকায় তোমার থেকে লুকোব কী আর? সবাই যারে সব দিতেছে, তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।” যন্ত্রের কাছে নিজেদের ক্রমশ উন্মুক্ত করে দেওয়ার আগে তাঁরা কিছুই ভাবছেন না। ফোনের প্রতিটা অপশন ‘এনেবলড’ করে দিয়ে তাঁরা দিব্যি আছেন। তবে যাঁরা এতটা করে উঠতে পারছেন না এখনও, তাঁরা ক্রমশ ফোনের থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, মনের মধ্যে ভয়ের পাহাড় নিয়ে। ফোনের পাশে বসে ব্যক্তিগত কথা বলার আগে দশ বার ভাবছেন। কপালে ভাঁজ— “ও শুনছে না তো?”

ব্যবহার করার সময়টুকুর বাইরে আর কোনও কথা যেন ফোনের কানে না যায়, তা নিয়ে পরামর্শেরও শেষ নেই। ভয়েস অ্যাসিন্ট্যান্ট, মানে ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘বন্ধু’কে চিরতরে ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য অনেকে নিদান দিচ্ছেন। সেটিংস-এ গিয়ে কিছু কারিকুরি করতে হয়। কোনও অ্যাপ ডাউনলোড করে ইনস্টল করার সময় আমাদের শরীরে অ্যাড্রিনালিনের ঝড় ওঠে। ক্রমাগত ‘ওকে’ কিংবা ‘আই অ্যাগ্রি’ লেখায় আঙুল ছুঁইয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় দিয়ে দিই ভয়েস রেকর্ড করার ‘পারমিশন’। হয়তো ডাউনলোড করছি কোনও বাজার করার অ্যাপ। আমার কণ্ঠস্বর রেকর্ড করার অনুমতি ওই অ্যাপের কেন চাই, তা নিয়ে আমরা প্রশ্ন করি না কখনও। এগুলো সব খুঁটিয়ে দেখার জন্য, পড়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা আমাদের ক্রমাগত অনুরোধ করছেন। আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে কিছু মানুষের পরামর্শ, ফোনের মাইক্রোফোনের উপরে আচ্ছা করে সেঁটে দিন সেলোটেপ। দুষ্টুটাকে জব্দ করুন! শুধু ফোনে কথা বলার সময় সেলোটেপটা হালকা করে উঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কথা শেষ হলেই ফের বন্দি করুন ওকে।

আমরা পড়েছি মহা বিপাকে। কী ভাবে যে এর থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, তাও অজানা। ঢোক গিলে বলি, এত পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। দেখলাম, কিছু মানুষ আন্তর্জালে প্রশ্ন করছেন, ‘আচ্ছা, আমার মোবাইল ফোন অফ করা থাকলেও কি সেটি আমার কথা শুনতে পায়?’

কিছু প্রযুক্তিবিদ উত্তর দিয়েছেন। দৈববাণী। অক্ষরগুলো স্ক্রিন চৌচির করে বেরিয়ে এসেছে। লিখেছেন, “শুনতে পায় না, এটাও বা হলফ করে বলা যায় কী করে!”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Artificial Intelligence AI

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy