Advertisement
E-Paper

বেঁচে থেকে বুঝিয়ে গিয়েছেন, জীবন মানে কী

হিরোশিমা আর নাগাসাকি, দুটো শহরেই পরমাণু বোমার শিকার তিনি। দু’বারই বেঁচে গিয়েছেন কপালজোরে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলেছেন, তৃতীয় বোমাটা যেন আর দেখতে না হয়। শিশির রায় হিরোশিমা আর নাগাসাকি, দুটো শহরেই পরমাণু বোমার শিকার তিনি। দু’বারই বেঁচে গিয়েছেন কপালজোরে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলেছেন, তৃতীয় বোমাটা যেন আর দেখতে না হয়। শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৭ ০৮:৩০
সুতোমু ইয়ামাগুচি ।

সুতোমু ইয়ামাগুচি ।

আজ থেকে ঠিক ৭২ বছর আগে, এই দিনেই অফিসের কাজে বেরোতে হয়েছিল সুতোমু ইয়ামাগুচিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা, জাপানের আকাশে ক্ষণে ক্ষণে যুদ্ধবিমানের পাখসাট। মানুষ যুদ্ধেও অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাই তারই মধ্যে চলছে জনজীবন। মিৎসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ-এর তরুণ ইঞ্জিনিয়ার সুতোমু, হিরোশিমা স্টেশনে নেমে হনহন হাঁটছিলেন। মাথার ওপর দিয়ে একটা মার্কিন বম্বার প্লেন উড়ে গেলেও গা করেননি। তেমন হলে তো ‘এয়ার রেড শেলটার’ আছেই!

কয়েক মুহূর্ত পরেই, চোখ-ধাঁধানো সাদা একটা আলো। আকাশ-কাঁপানো একটা বিকট শব্দ। সুতোমু কিছুক্ষণের জন্য যেন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলেন, বোমা! ধাতস্থ হতে দেখলেন, আকাশে বিরাট একটা ধোঁয়ার মাশরুম, কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে আগুন আর ধোঁয়া। আর কিছু, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না শহরের।

‘ইনোলা গে’, ‘লিটল বয়’, ইউরেনিয়াম বোমা, কিলোট্রন, রেডিয়েশন— এ সব তো ইতিহাস মানুষকে জানিয়েছে অনেক পরে। ৬ অগস্ট ১৯৪৫-এর সেই সকালে সুতোমু শুধু দেখছিলেন, তাঁর শরীরের উপরের দিকটা পোড়া, বাঁ কানটা ভোঁ-ভোঁ করছে, কিন্তু বেঁচে আছেন তিনি! রাতটা কোনও মতে কাটিয়ে, পর দিন ফের স্টেশনমুখো। যদি একটা ট্রেন মেলে, বাড়ি ফেরার ট্রেন! হিরোশিমার রাস্তা যেন নরক। যে দিকে চোখ যায়, মৃতদেহ। রাস্তায় চিৎকার করে হাঁটছে জ্বলন্ত শব। শবই তো, তাদের মুখ-বুক-হাতের মাংস গলে গিয়ে ঝুলছে শরীর থেকেই। জীবন্ত শবের মিছিল ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীতে, তার পর মরে ভেসে থাকছে সেখানেই। সুতোমু বুঝলেন, হিরোশিমার বোমার পরও বেঁচে-থাকা এক ভাগ্যবান তিনি।

ভাগ্যবান? বটেই তো। বাড়ির ট্রেন পাওয়া গেল। ঘরে ফিরে স্ত্রী, শিশুপুত্রকে জড়িয়ে কান্নাকাটি। দু’শো কিলোমিটার দূরে নাগাসাকিতে থাকা ওরা বুঝতেই পারছে না, কী ঘটে গেছে হিরোশিমায়। ৯ অগস্ট সকালে সুতোমু হেড-অফিসে এলেন। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা তাঁকে ভিড় করে দেখতে এলেন অফিসের বস, সহকর্মীরা। হাঁ করে গিলতে লাগলেন ৬ অগস্টের গল্প। আর সেই সময়েই হঠাৎ, নাগাসাকির আকাশেও সেই এক চোখ-ঝলসানো আলো! সেই কান-ফাটানো শব্দ! সুতোমুর মনে হল, বোমাটা কি তাঁর পিছু নিয়েছে? না মেরে ছাড়বে না? হিরোশিমার পর এই নাগাসাকিতেও তাই...?

এ বার প্লুটোনিয়াম বম্ব ‘ফ্যাট ম্যান’। পাহাড়ে ঘেরা শহর নাগাসাকি, তাই বোমার প্রতিক্রিয়া হলো আরও কেন্দ্রীভূত। ৭০০০০ মানুষ মরে গেলেন, ‘ছিল’ থেকে ‘নেই’ হয়ে গেল শহর। কিন্তু আশ্চর্য, ধূলিসাৎ নাগাসাকিতে এ বারও বেঁচে গেলেন সুতোমু। স্ত্রী-পুত্র সমেত!

জাপান আত্মসমর্পণ করল, যুদ্ধও শেষ হল এক দিন। পৃথিবী জানতে পারল হিরোশিমা-নাগাসাকির লক্ষ লক্ষ মৃত ও অগুনতি জীবন্মৃতের কাহিনি। জীবন্মৃত, কেননা ওঁরা রেডিয়েশনের শিকার। সুতোমু যেমন। ওঁর মেয়ে তোশিকোর স্মৃতিতে ভাসে, ১২ বছর বয়স অবধি বাবাকে দেখেছেন পুরো গজ-ব্যান্ডেজে মোড়া। ন্যাড়ামাথা। তোশিকোর মা ৮৮ বছর বেঁচেছিলেন, দাদা ৫৯ বছর। সুতোমু আজ বেঁচে থাকলে শতায়ু হতেন, মারা গেছেন ২০১০-এ। তিন জনেরই ক্যান্সার হয়েছিল। তোশিকো নিজেও আজন্ম অসুস্থ।

নিশ্চিত মৃত্যুমুখ থেকে প্রাণে বাঁচলে লোকে বলে, ভাগ্য। কিন্তু দু’দিনের ব্যবধানে দু’বার বাঁচলে? মির‌্যাক্‌ল! হাতে-গোনা ক’জন মাত্র মানুষ আছেন বা ছিলেন (মতান্তরে সুতোমুই একমাত্র), যাঁরা হিরোশিমা আর নাগাসাকি, দু’যাত্রাতেই রক্ষা পেয়েছেন। সুতোমু নিজের মুখে কিছু বলতেনই না। ৯৪ বছরের দীর্ঘ জীবনের অন্তিম লগ্নে জাপান সরকারের ‘হিবাকুশা’ (সারভাইভার) মর্যাদা পেয়েছেন, ওঁর কথা জেনেছে বিশ্ব। নইলে ১৯৫৭ সালে সরকার থেকে দেওয়া বেগুনি রঙের, ঝ্যালঝেলে একটা পাসবই শুধু সাক্ষী ছিল, ওটা দেখালে ওষুধপত্র, চিকিৎসার খরচ মিলত কিছু।

কত গান, কাব্য, শিল্প-সিনেমা হয়েছে সার্ভাইভাল স্টোরি থেকে। সুতোমুর জীবন থেকে হয়নি, কারণ ওঁর স্বেচ্ছাবৃত নীরব যাপন। হাতে-গোনা ইন্টারভিউ, ‘টোয়াইস বম্বড, টোয়াইস সার্ভাইভ্‌ড’ একটা তথ্যচিত্র, এটুকুই। রাষ্ট্রপুঞ্জে দেখানো হয়েছিল ছবিটা, হুইলচেয়ারে-বসা সুতোমু শুধু বলেছিলেন, আমি দুটো বোমা দেখেছি, দোহাই আপনাদের, তৃতীয়টা যেন আর দেখতে না হয়। ‘আমার অলৌকিক জীবন’ গোছের বই লেখেননি, বরং একটা কবিতার বই আছে ওঁর, ‘অ্যান্ড দ্য রিভার ফ্লোজ অ্যাজ আ র‌্যাফ্ট অব কর্পসেস’। আর একটা কথা বলতেন। ‘‘পরমাণু অস্ত্রওয়ালা দেশগুলো শাসন করার ক্ষমতা থাকা দরকার শুধুু মায়েদের হাতে। সেই সব মায়েরা, যাঁরা এখনও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান।’’

Tsutomu Yamaguchi Bomb Blasts Atomic Bomb Attacks Atomic bombings of Hiroshima and Nagasaki Hiroshima Nagasaki হিরোশিমা সুতোমু ইয়ামাগুচি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy