Advertisement
E-Paper

সিন্ধু দেবতার বাহন বাংলার ইলিশ

বাংলার বটতলা থেকে ইস্টবেঙ্গলি ময়দান পর্যন্ত ইলিশের রুপোলি গল্পে ঝলমল। কিন্তু ইলিশ কখনও কখনও পাকিস্তানের নাগরিকও বটে!গৌরবর্ণ মুখে বুক-লুটোনো তাঁর ধবধবে সাদা দাড়ি, ইলিশের রুপোলি পিঠে বিছানো পদ্মে তাঁর আসন, তিনি ঝুলেলাল! আরব সাগরে নামা সিন্ধুনদের ইষ্টদেবতা তিনি। আপাতত পাক নাগরিক!

সোমেশ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
ইলিশবাহন: সিন্ধুপ্রদেশের দেবতা ঝুলেলাল

ইলিশবাহন: সিন্ধুপ্রদেশের দেবতা ঝুলেলাল

বর্ষা এসেছে ঝমঝমিয়ে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ‘এই ভরা বর্ষায় বাজার থেকে ইলিশ হাতে কেউ যদি রাজসভা পর্যন্ত আসতে পারে আর কোনও লোক যদি তার দাম জিজ্ঞেস না করে, তবে সে মোটা পুরস্কার পাবে।’ গোপাল ভাঁড় বলল, ‘আমি পারব মহারাজ।’ বলে, দিগম্বর হয়ে বেরিয়ে পড়ল ইলিশ আনতে।

বাংলার বটতলা থেকে ইস্টবেঙ্গলি ময়দান পর্যন্ত ইলিশের গল্পে ঝলমল। গুমো বাতাস ভিজতে না-ভিজতেই পদ্মার ইলিশের জন্য প্রাণ আনচান। কিন্তু ইলিশ-বাহন দেবতাটি যে বাংলার নন!

গৌরবর্ণ মুখে বুক-লুটোনো তাঁর ধবধবে সাদা দাড়ি, ইলিশের রুপোলি পিঠে বিছানো পদ্মে তাঁর আসন, তিনি ঝুলেলাল! আরব সাগরে নামা সিন্ধুনদের ইষ্টদেবতা তিনি। আপাতত পাক নাগরিক!

কিন্তু ঝুলেলালকে (যাঁর আর এক নাম উদেরোলাল) ভূগোল বা ধর্মের সীমানায় বাঁধে কার সাধ্যি! বিশ্বের যেখানেই সিন্ধিদের বাস, সেখানেই তিনি। তবে পাকিস্তানের সুফি রাজধানী সিন্ধ প্রদেশেই তাঁর রমরমা। তাতে হিন্দু-মুসলিম ভেদ নেই। মুসলমানের চোখে তিনি জিন্দা পির, দরিয়াপির!

সেই যে রুনা লায়লার কণ্ঠে, ‘দমাদম মস্ত কলন্দর... হো লাল মেরি পত রখিয়ো বলা ঝুলেলালন’, ওতেই তো সিন্ধুতীরের সেহওয়ানে শাহবাজ কলন্দরের দরগায় বেজে ওঠে সুফি নাচ বা ধামাল! নুসরত ফতে আলি খানের গলায় সে যে ‘ঝুলা ঝুলেলাল দম মস্ত কলন্দর,’ তাতেও সেই দেবতা আর পির মিলেমিশে একাকার। কলন্দরের সমাধি ফলকেই তো স্পষ্ট লেখা ‘ঝুলেলাল’। রোজ জাতধর্ম নির্বিশেষে লাখো মানুষের বান ডাকে সেই দরগায়। যতই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটাক মৌলবাদীরা, বাস-ট্রাক-ট্যাক্সির গায়ে যে ‘ঝুলেলাল’ লেখা থাকবেই, তাতে আর আশ্চর্যের কী!

সিন্ধুর দু’পাশ ছাপিয়ে বহু দূর যাঁর এমন বিস্তার, সেই ঝুলেলালের বাহন ইলিশ। যাদের নাকি ইলিশ ছাড়া জামাইয়ের মুখে ভাত রোচে না, বউয়ের মুখের ঝাল মরে না, সেই বাংলায় কিন্তু তার এই মর্যাদা জোটেনি। পদ্মার দেবীত্ব নেই, কিন্তু তার সোদর বোন গঙ্গারও বাহন মকর। ইলিশ সেখানে ব্রাত্য।

পুরাণ মতে ইলিশ বরুণ দেবতার বাহন। আর কী আশ্চর্য, সিন্ধি বিশ্বাসে ঝুলেলাল সেই বরুণদেবেরই অবতার! বিপন্ন মৎস্যজীবীদের ডাকে মানবদেহ ধরেছিলেন জলের দেবতাই।

সিন্ধ অবশ্য ইলিশকে ইলিশ নামে চেনে না, চেনে ‘পাল্লা’ বলে। সিন্ধুর বুড়ো জেলেরা বলেন, আরব সাগর থেকে মিঠে জলে ঢোকার সময়ে পাল্লার গা থাকে কুচকুচে কালো। উজান বেয়ে যত সে তার মুর্শিদের (গুরু) থানের দিকে এগোয়, তত বাড়তে থাকে তার জেল্লা। আরব সাগর থেকে খািনক উপরে উঠলে হলদে পাথরে ছাওয়া লক্ষ পিরের কবরিস্তান থাট্টা। একটা সময় ছিল, যখন থাট্টার হলুদ পাথরে মাথা ছুঁইয়ে পাল্লার ঝাঁক এগোত উত্তরে। জামশোরো হয়ে সেহওয়ানে শাহবাজ কলন্দরের দরগায় মাতন দেখে উজানে, ঝুলেলালের সুক্কুরে গিয়ে যখন সে পৌঁছত, পাল্লার শরীর তখন রুপোয় মোড়া।

জোয়ানেরা অবশ্য সে সব দিন দেখেননি। এক সময়ে নাকি মোহনা থেকে হাজার কিলোমিটার উজিয়ে পঞ্জাবের মুলতান পর্যন্ত চলে যেত পাল্লা। ফরাক্কা ব্যারাজ হওয়ার আগে যেমন গঙ্গা-পদ্মার ইলিশ যেত কাশীদর্শনে। এখন পথ রুখেছে বাঁধের পর বাঁধ। সুক্কুরেই বিশাল বাঁধ রয়েছে, তার আগে রয়েছে কোটরিতেও। তার উপরে গত দু’দশক ধরে সিন্ধুতে মরসুমি জলের ধারা শুকিয়েছে। ফলে সাগর ছেড়ে আর নদে ঢুকছে না ইলিশের ঝাঁক। নয়ের দশকের মাঝামাঝিও যেখানে মরসুমে ১৮ হাজার টন মাছ উঠত, এখন উঠছে মেরে-কেটে ১০০ টন। জাল ছেড়ে অন্য কাজ খুঁজতে যাচ্ছেন জেলেরা।

তা বলে পাল্লার কদর কিন্তু এতটুকুও কমেনি! বাড়িতে কুটুম এলেই পাতে পাল্লা চাই, যে কোনও পরবে চাই পাল্লা। সিন্ধি বিশ্বাস আর রুচির পরতে-পরতে জড়িয়ে ঝুলেলাল। তার জন্য যদি ইরান বা মায়ানমার থেকে আমদানি করতে হয়, তবে তা-ই হোক!

তবে সিন্ধিরা মোটেই সর্ষে দিয়ে ইলিশ ভাপান না। কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে বেগুন চিরে রাঁধেন না ইলিশের ঝোল। তেল-ইলিশ? উঁহু! মোটেই না।

বাংলাদেশে পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে ইলিশের ঝাল রাঁধার চল আছে বহু দিন ধরে। কিন্তু সিন্ধিরা মাছ টুকরোই করেন না। বরং গোটাটাই ডানার পাশ দিয়ে চিরে ভিতরে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ধনেগুঁড়ো, টক দই, আমচুর বা তেঁতুলের পুর দিয়ে ভাজেন, যতক্ষণ না তেল ছাড়ছে, গোটা তল্লাট ম-ম করছে সুঘ্রাণে। তার পর টমেটো-ধনেপাতা ছড়িয়ে পরিবেশন। মেজাজ আরও শরিফ করতে চাইলে হাজির হবে পাল্লা পুলাও। সে জিনিস অবশ্য বাঙালিও জানে। একটা সময় ছিল, যখন মোহনায় ছোট ইলিশ ধরার উৎপাতে গঙ্গা-পদ্মায় ইলিশের খুব টানাটানি হয়েছিল। অসময়ে, ক্ষতিকর জাল দিয়ে ইলিশ ধরা বন্ধ করে সেই দুর্দিন অনেকটাই কেটেছে।

কে জানে, হয়তো ও দেশেও কোনও রাস্তা বেরিয়ে যাবে ঠিক। সিন্ধু আবার জলে ভরবে, পাল্লার ঝাঁক ফিরবে রুপোলি ঝিলিক তুলে।

পথ দেখাবেন সেই তিনি, যিনি অক্লেশে দরিয়া পার করে দেন শরণাগতের ভেলা, ঝুলেলাল, বেড়া (ভেলা) পার!

Jhulelal ঝুলেলাল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy