Advertisement
E-Paper

চাকদহ এক্সপ্রেস আজও ছুটে চলেছে তুমুল গতিতে

এই ট্রেনের একমাত্র সওয়ার ঝুলন গোস্বামী। এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। তার আগে দ্রুততম বোলার, আইসিসি-র বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মানও এসে গিয়েছে এই বঙ্গকন্যার কাছে। সুমিত ঘোষএই ট্রেনের একমাত্র সওয়ার ঝুলন গোস্বামী। এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। তার আগে দ্রুততম বোলার, আইসিসি-র বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মানও এসে গিয়েছে এই বঙ্গকন্যার কাছে। লিখছেন সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৭ ১২:৩০
ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

স্বপন স্যর বলেছিলেন, ‘যাও, গিয়ে বল করো। মনে রাখবে, বোলারের জীবন মানে পরিশ্রমীর জীবন।’ সেই যে বল হাতে ছুটতে শুরু করলেন ঝুলন গোস্বামী, আজও থামেননি।

ক্রিকেটের যে বিভাগে তাঁর বিশ্বরেকর্ড, বিস্ময়কর ভাবে তাতে কোনও আগ্রহই ছিল না ঝুলন গোস্বামীর। বিবেকানন্দ পার্কে স্বপন সাধুর কোচিং ক্যাম্পে তিনি যে দিন প্রথম গিয়েছিলেন, ব্যগ্র ভাবে অপেক্ষা করছিলেন স্যর কখন তাঁকে ব্যাট করতে দেবেন।

কিন্তু স্বপন স্যর তাঁর উচ্চতা দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন, এ মেয়েকে দিয়ে বল করাতে হবে। তাই তাঁর হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন। বল হাতে চাকদহ মেল আর থামেনি। পনেরো বছরের আন্তর্জাতিক জীবনে পেরিয়ে গিয়েছে অনেক উজ্জ্বল স্টেশন! বিশ্বের দ্রুততম বোলার। আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। বিশ্বের সেরা পেসার। সব রকম পালক আগেই চলে এসে গিয়েছিল মুকুটে। এ বার দক্ষিণ আফ্রিকার পোচেসত্রুম-এ উঠে পড়লেন সেই এভারেস্টে, যা এর আগে ভারত থেকে একমাত্র কপিল দেব জয় করতে পেরেছেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। কপিল ছাপিয়ে গিয়েছিলেন রিচার্ড হ্যাডলিকে। বঙ্গতনয়া ভেঙে দিলেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি বোলার ক্যাথরিন ফিৎজপ্যাট্রিকের দশ বছরের রেকর্ড। সেই ক্যাথরিন, যিনি ঝুলনের আদর্শ বোলার।

কিন্তু বাইশ গজে ঝুলনের এই যাত্রা যদি অবিশ্বাস্য মনে হয়, জীবনের চলার পথ আরও বেশি রোমাঞ্চকর, আরও বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস। শুরুটাই তো চমকপ্রদ। চাকদহে বাড়ির উঠোনে চলত তাঁর দাদাদের ক্রিকেট। সেখানে ইচ্ছে থাকলেও প্রবেশাধিকার ছিল না ‘মেয়ে’ ঝুলনের। অনেক কান্নাকাটি করেও প্রথম টিমে জায়গা পাননি। বরাতজোরেই এক বার সুযোগ হয়ে গেল প্রথম দলের একটি ছেলে না আসায়। ঝুলনের কাছে সেটাই জীবনের প্রথম মরণ-বাঁচন ম্যাচ হয়ে দাঁড়াল। হয় ছেলেদের ক্রিকেটে তিনি ভিসা পেয়ে যাবেন, নয়তো ফিরে যেতে হবে ‘মেয়েলি’ পৃথিবীতে।

ঝুলন ফিরে যাননি। প্রথম দর্শনেই দাদাদের বুঝিয়ে দিতে পারলেন— তিনি রাঁধেন, ক্রিকেটও খেলেন। ‘আমার কাছে দাদাদের সঙ্গে সেই ম্যাচটার গুরুত্ব আজীবন একই রকম থেকে যাবে। ওই দিনটা না এলে জানি না পরের এই দীর্ঘ অধ্যায়টা আসত কি না,’ এক বার সল্ট লেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মাঠে বসে বলেছিলেন ঝুলন। এই ক্যাম্পাসের মাঠ তাঁর ক্রিকেট-আরাধনার আশ্রম গত কয়েক বছর ধরে। কলকাতায় থাকলে এখানেই তিনি ভোরবেলায় চলে আসেন। অনেক সময় তাঁকে একা একাও আসতে দেখা গিয়েছে। একা বল করে যাচ্ছেন নেটে। নিজে বল কুড়িয়ে আনছেন। আবার ফিরে যাচ্ছেন রান-আপে।

সেই বল কুড়িয়ে রান-আপে ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে মনে হতো কোথাও যেন স্বপন স্যরের অদৃশ্য কথাগুলো বেজে চলেছে— ‘মনে রেখো, বোলারের জীবন মানে পরিশ্রমীর জীবন। আজ ছোটা শুরু করলে। কখনও থামবে না।’

ঝুলন গোস্বামী সত্যিই থামেননি। কলকাতায় ক্রিকেট কোচিংয়ে আসার জন্য চাকদহ থেকে ভোরবেলায় ট্রেন ধরতে হতো। শিয়ালদহে নেমে আবার বাস ধরে কোচিংয়ের মাঠে। ভোর সাতটা থেকে ট্রেনিং। এক মিনিট দেরি হওয়া মানে কড়া হেডমাস্টার স্বপন সাধু বল-ব্যাট ধরতে দেবেন না। মানে চাকদহ থেকে যে ভাবে ভোরের ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতে এসেছেন, সে ভাবেই আবার ফিরে যেতে হবে ক্রিকেট-তৃষ্ণা না মিটিয়ে।

আর কী অমানুষিক সেই নিত্য যাত্রা! কাঁধে কিটব্যাগ নিয়ে ঠেলাঠেলি করে উঠতে হতো ট্রেনে। কত দিন অন্যান্য নিত্যযাত্রীদের অপ্রীতিকর টিপ্পনী শুনতে হয়েছে— ‘মেয়েদের আবার কী দরকার ক্রিকেট খেলার?’ সেই মুখগুলো আজ কোথায়! আসা-যাওয়ার পথে ট্রেনে বেশির ভাগ দিনই বসার জায়গা জুটত না। দেখা হয়ে যেত মাঠ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরা অনেকের সঙ্গে। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে তাঁরা ঝুলনকে শোনাতেন, ‘‘কী হবে এই খাটনি খেটে? আমাদের দেশে মেয়েদের খেলার কী ভবিষ্যৎ আছে!’’ ঝুলন এখন বলেন, ‘‘চাকদহ থেকে আমার সেই প্রত্যেক দিনের জার্নি, উঠোনে দাদাদের সঙ্গে ক্রিকেট— এ সব আমাকে মানসিক শক্তি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে আমি ভাল করতে পেরেছি, তার কারণ সংগ্রামের জীবন থেকে পাওয়া মনের জোর। রোজ ভিড় ট্রেনে করে যাতায়াত করাটা মোটেও সহজ ছিল না। ওটাই আমাকে লড়াই জিততে শিখিয়েছিল।’’

নতুন বিশ্বরেকর্ডধারীর প্রথম ইডেন দর্শনের কাহিনিটাও মনে রাখার মতো। অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড মেয়েদের বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচ ছিল। স্কুলের বাচ্চাদের ফ্রি টিকিটে খেলা দেখতে নিয়ে আসা হয়েছিল ইডেনে। সেই বাচ্চাদের দলে ছিল ১৫ বছরের কোনও এক ঝুলন গোস্বামীও। সেই ক্রিকেট ম্যাচ দেখে বাড়ি ফেরার পথেই নিজের কাছে অঙ্গীকার করেন ঝুলন, এক দিন এই খেলাটা আমাকে খেলতে হবে। ভারতের হয়ে খেলতে হবে।

কে জানত, নদিয়া থেকে স্বপ্নের উড়ান ধরে শুধু সেই লক্ষ্য পূরণই করবেন না, এক দিন বিশ্বের চুড়োয় উঠে পড়বেন! ইডেনে ম্যাচ দেখা, উঠোনে দাদাদের ক্রিকেটে হাতেখড়ি, কলকাতার কোচিংয়ে এসে স্যরের কথামত ব্যাটের মায়া ছেড়ে বোলারের মজদুরের পৃথিবীতে ঢুকে পড়া। এর পরের মোড় এল এয়ার ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের একটি ম্যাচে। ঝুলনের বোলিং দেখে পূর্ণিমা রাউ তাঁকে এয়ার ইন্ডিয়া দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। সেটাই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকল ঝুলনের জীবনে। পূর্ণিমাকে নিয়ে ঝুলন বলেন, ‘জীবন বাঁচতে শিখিয়েছিল পূরিদি।’ বাইরে খেলতে গিয়ে এক সময় মাটিতে ১৪-১৫ জন ক্রিকেটার শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। ও ভাবেই রাতে গল্প করতে করতে ম্যাচ জেতার শপথ নিয়েছেন। পরের দিন মাঠে নেমে আগুন ঝরিয়েছেন ঝুলন।

ঝুলনের জীবনে প্রভাব রয়েছে আরও এক জনের। প্রাক্তন ক্রিকেটার নীতু ডেভিড। যাঁকে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের বিষাণ সিংহ বেদী বলা হয়। ঝুলনের আগে ভারতের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীর রেকর্ড বাঁ হাতি স্পিনার নীতুর দখলেই ছিল। চ্যাম্পিয়নের আসল কবচ হচ্ছে দায়বদ্ধতা আর একাগ্রতা— নীতুকে দেখেই শিখেছিলেন ঝুলন। একা একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটে বল করে যেতেন নীতু। স্পিন বোলিংয়ে নিখুঁত হবেন বলে। ঝুলনের একা একা প্র্যাকটিসে ডুবে থাকাটা তাঁর থেকেই শেখা।

‘লড়াইটা চালিয়ে যা। তুই এক দিন সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাবি। আমার রেকর্ডও ভেঙে দিবি,’ ঝুলনকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন নীতু। সত্যিই সবাইকে ছাপিয়ে কপিল দেবের পর তিনি আবার তেরঙ্গা উড়িয়ে দিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের এভারেস্টে। আর এই অভিযানে বল ছাড়াও আরও একটা হাতিয়ার আছে তাঁর— বই। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে লান্স আর্মস্ট্রং, মারিয়ন জোন্স— সময় পেলেই এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলেন সকলের আত্মজীবনী।

কে বলতে পারে, এক দিন তাঁর আত্মজীবনীর খোঁজ করবে না নতুন কোনও অভিযাত্রী! চাকদহ থেকে শিখরে— এ তো অবিশ্বাস্য এক থ্রিলার!

Jhulan Goswami
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy