E-Paper

স্মৃতির সরণিতে গানের নুড়িপাথর

গানের মধ্যেই আছে এক আশ্চর্য জাদু। ফেলে আসা জীবনের ছোট ছোট স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে যায় নানা গানের সুর আর কথা। নুড়িপাথরের মতো পড়ে থাকে মনের পথে। যা ধরে ধরে আমরা ফিরে যেতে পারি অতীতের সেই সময়ে! ফিরে যেতে পারি আমাদের হারানো মানুষজনের কাছে।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৩৫
ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

এ বছর পুজো আসতে তখনও সপ্তাহ তিনেক বাকি। আমি গড়িয়াহাট থেকে অটো করে রাসবিহারী মোড় অবধি আসছি। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে নামছে শহরে। বয়স্ক অটোচালক সারা দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত। টইটম্বুর অটোর মধ্যে নরম স্বরে চালিয়ে রেখেছেন গান। না, এই সময়ের কোনও গান নয়। অনেক আগের একটি গান। বাংলা। গায়ক, মান্না দে। অটোর সহযাত্রীরা সবাই যুবক-যুবতী। কানে ইয়ারফোন। হাতে মোবাইল। তারাও দেখলাম গানটা শুরু হওয়ার কিছু পরে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে রাখল। গানটা যে সবাই শুনছে, বুঝলাম। ছোট্ট সবুজ অটোর মধ্যে নরম স্বরে ভেসে রইল— ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ/ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো/ তোমাতে আমরা লভিয়া জনম/ ধন্য হয়েছি ধন্য গো।’ আর মুহূর্তের মধ্যে যেন আমি দেখতে পেলাম বৃষ্টি পড়ছে এক ছোট্ট মফস্সলে। সকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বাজে। আমরা অনেকে মিলে জড়ো হয়েছি একতলা একটা বাড়িতে। কিসের যেন অনুষ্ঠান! ঘরের বাইরে টানাবারান্দা। তার উপর টালির ছাউনি। ঘরের ভিতর ভিড়। এরই মধ্যে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা এক জন মানুষ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছেন, ‘কিরীটধারিণী তুষারশৃঙ্গে/ সবুজে সাজানো তোমার দেশ/ তোমার উপমা তুমিই তো মা/ তোমার রূপের নাইকো শেষ।’ ভিড়ের মধ্যে বসে সেই পাঁচ-ছয় বছর বয়সের আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি সেই গান! আর বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সবুজ লম্বা ঘাস-মোড়া মাঠ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ওড়নার আড়ালে। আর গোধূলিবেলার রাসবিহারী যেন মিলিয়ে যাচ্ছে আমার সামনে থেকে। এই পুজোর ভিড়ের কলকাতা হারিয়ে যাচ্ছে... হারিয়ে গেল... নিমেষে। আর বহু বহু বছর আগের প্রায় ভুলে যাওয়া একটা সকাল ফিরে এল আমার সামনে! আমি বুঝলাম, এ এক আশ্চর্য জাদু!

হ্যাঁ, গান এমন জাদু পারে। ফেলে আসা জীবনের ছোট ছোট স্মৃতি, গান তার সুর আর কথার মধ্যে গেঁথে, নুড়িপাথরের মতো ফেলে রাখে মনের পথে। যা ধরে ধরে আমরা ফিরে যেতে পারি অতীতের সেই সময়ে! ফিরে যেতে পারি আমাদের হারানো মানুষজনের কাছে।

বাড়িতে ছিল একটা রেকর্ড প্লেয়ার। নীল রঙের সুটকেসের মতো দেখতে। খুললে, সাদা টার্নটেবল। রেকর্ডও ছিল অনেক। আমি তখন খুব ছোট। নানা রেকর্ডের মাঝে এখন আমার শুধু মনে আছে সাগর সেনের একটা রেকর্ডের কথা। বাবা মাঝে মাঝে সেটা চালাত। মন্দ্র স্বরে চলত, ‘সেই ভালো সেই ভালো…’। আজও সেই গান শুনলে মনে পড়ে, আমি বাবার পিঠে দোল খাচ্ছি এক রবিবারের সকালে!

ক্লাসিক্যাল গান শোনার রেওয়াজ আমাদের বাড়িতে ছিল না। বা বলা যায় আমাদের গোটা পাড়াতেই ছিল না। ওখানে পুরনো দিনের বাংলা আর হিন্দি গানই চলত মূলত। ন’কাকা গান শিখত। ন’কাকাকে আমি পঙ্কা বলতাম। এক জন লম্বা রোগা মাস্টারমশাই আসতেন পঙ্কাকে গান শেখাতে। কী যে ভাল গান গাইতেন তিনি! আমি ছোট ছিলাম, গোলমাল করতে পারি সেই আশঙ্কায় আমার ওই ঘরে গানের ক্লাস চলাকালীন ঢোকা বারণ ছিল। আমি তাই দরজার বাইরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম, পঙ্কাদের দেখতাম। আড়াল থেকে অমন করে যে দেখতে নেই, সে বোধ ছিল না তখন!

তখন একটা বাংলা সিনেমা বেরিয়েছিল। ‘জীবন মরণ’। তার একটা গান সেই স্যর গেয়েছিলেন—‘আমার এই কণ্ঠ ভরে/ বাজে গো যে সুরবাহার/ সবই যে তোমারই গান/ যত সুর সবই তোমার/ যত গান সবই তোমার।’

সেটা সম্ভবত তিরাশি সাল। ক্লাস ওয়ানে পড়ি আমি। সিনেমাটা আমি কোনও দিন দেখিনি। কিন্তু আজও এই গানটা কখনও শুনলে যেন দেখতে পাই, আমাদের সেই ছোট্ট ঘরে, বিছানায় বসে পঙ্কা হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে, আর রোগাটে এক জন মানুষ চোখ বন্ধ করে গান গাইছেন! আর কী আশ্চর্য, তাঁর চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল! কী ছিল সেই গানে! জানি না। শুনতাম স্যরের স্ত্রী নাকি কার সঙ্গে কোথায় চলে গিয়েছেন। সেই বয়সে এ সবের গুরুত্ব বুঝতাম না। শুধু তথ্য হিসেবে মাথায় থেকে গিয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু আজ, এই প্রায়-পঞ্চাশে এসে আমি যেন বুঝতে পারি, কেন সে দিন গাইতে গাইতে স্যরের চোখে জল এসে গিয়েছিল! বুঝতে পারি, সেই গান কী আশ্চর্য ভাবে স্যরকে তাঁর পুরনো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল! বুঝতে পারি, গান সত্যি এমনটা পারে।

আমি আর আমাদের অফিসের দাদা, সঞ্জয়দা গিয়েছি দিল্লিতে। সঞ্জয়দা কাজপাগল মানুষ। সোনারপুরে থাকে। সেটা ছিল শীতকাল। দিল্লিতে খুব ঠান্ডা। যে কাজে গিয়েছিলাম, সেটা শেষ হয়ে গিয়েছে আগেই। আমাদের ফেরার ট্রেন দু’দিন পরে। সঞ্জয়দা বলল, “চলো, দিল্লি ঘুরে দেখি।”

লাল কেল্লার সামনে বেশ ভিড়। সেখানে এক জন দরিদ্র অন্ধ মানুষকে দেখেছিলাম গান গেয়ে মাধুকরী করছেন। পাশে বসেছিল একটি বাচ্চা ছেলে। ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনও যন্ত্র বা অনুষঙ্গ ছিল না। শুধুমাত্র গলাই তাঁর সঙ্গী। সুরই তাঁর ভরসা। তিনি মাথা তুলে গাইছিলেন, ‘হর এক জিস্‌ম ঘায়েল হর এক রুহ্‌ পেয়াসি/ নিগাহোঁ মে উলঝন দিলোঁ মে উদাসি/ ইয়ে দুনিয়া হ্যায় ইয়া আলম-এ-বদহাওয়াসি/ ইয়ে দুনিয়া অগর মিল ভি জায়ে তো কেয়া হ্যায়।...’

শীতের সকালে ট্যুরিস্টদের ভিড়ে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ছিল বিরাট কেল্লার সামনে থেকে আমার ছোটবেলা অবধি। আর আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল হাই-পাওয়ারের চশমা পরা জিতেনকাকার কথা।

পাড়ায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে যেমন চলত, তেমন চলত কিশোর-রফি নিয়ে ঝগড়া। জিতেনকাকা ছিল রফির অন্ধ ভক্ত। আমার ছোটকাকার সঙ্গে প্রায়ই লাগত এই নিয়ে। ছোটকাকার কাছে এক থেকে দশ কিশোরকুমার।

জিতেনকাকা নিজেও খুব ভাল গান গাইত। রফি-কণ্ঠী হিসেবে কালীপুজোয় নানা গ্রামাঞ্চলে যেত গান গাইতে। একটা পেঁয়াজ-রঙের ভেলভেটের কোট ছিল জিতেনকাকার। তাতে চকচকে ধাতুর কী সব লাগানো থাকত। সে প্রায় বর্মের মতো লাগত আমাদের। ছোটকাকা তো ওকে অনুষ্ঠান করতে যেতে দেখলেই বলত, “কি রে, টিনের কোটটা নিয়েছিস তো?”

সেই জিতেনকাকা প্রেমে পড়েছিল মিতুদির। আর সেটাও ছিল গান গাইতে গিয়েই। তবে দূরে কোথাও নয়, আমাদের মফস্সলেরই আর এক দিকে, একটা কালীপুজোর ফাংশনে। মিতুদির বাবা ছিল বড় জুতোর ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। স্কুটার ছিল মিতুদির বাবার। তখন মোটরবাইক আর স্কুটার থাকলেই তাকে বড়লোক বলা হত। তার সঙ্গে মিতুদিদের ছিল রঙিন টিভি। টেপডেক। দোতলা বাড়ির বারান্দায় ঝুলত কঠিন, বিলিতি নামের কী সব গাছ! মিতুদি দুটো বিনুনি করে রাস্তায় বেরোলে সবাই চাপা গলায় বলত, “দেখ, রেখা রেখা!”

নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির জিতেনকাকার সঙ্গে অমন বাড়ির মেয়ের প্রেম নিয়ে ছোট্ট মফস্‌সলে ঢেউ উঠেছিল বেশ। আসলে মিতুদির জন্য বিশাল লম্বা লাইন ছিল। সেখানে কোথাকার কে, ইয়া মোটা কাচের চশমা পরা একটা অতি সাধারণ ছেলে এসে বেলাইনে ভালবাসা পেয়ে গেল! এ কি সহ্য হয়!

ছোটকাকা জিজ্ঞেস করেছিল, “কী করে প্রেম হল তোদের!”

জিতেনকাকা বলেছিল, “ওই রফির গান! সবাই তো ঈশ্বরের ভক্ত! আমার গাওয়া গান মিতুর ভাল লাগে। না হলে তুই ভাব, ওর মতো মেয়ে আমাকে চাইবে, এটা হয়!”

তখন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আলাদা। কোনও ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি হাঁটলেই লোকজন খুব কথা চালাচালি করত। উত্তম-সুচিত্রা ছাড়া আর সবার প্রেম করা বারণ ছিল।

তাও জিতেনকাকারা দেখা করত লুকিয়ে। আমার ছোটকাকা প্রায়ই জিতেনকাকাকে সাইকেলে ডাবল ক্যারি করে পৌঁছে দিত অভিসারস্থলে।

কিন্তু ব্যাপারটা শেষমেশ দীপকজেঠুর, মানে মিতুদির বাবার কানে উঠেছিল। দীপকজেঠু এসে জিতেনকাকার বাবাকে প্রথমে ভাল করে, তার পর খারাপ করে নানা কথা শুনিয়ে গিয়েছিল।

জিতেনকাকার দুই দিদি আর দুই বোন ছিল। তাদের কারও বিয়ে হয়নি। বাড়িতে টানাটানি বেশ। তার মধ্যে এ সব প্রেম তো গরিবের ঘোড়ারোগ!

ছোটকাকা এক বার বলেছিল, “তুই মিতুকে বল না। ও চাইলে কে কী করবে? মিতু তো তোর দলে!”

মিতু আসলে জিতেনকাকার দলে ছিল না। ছিল রফিসাহেবের দলে! এক দিন মিতুদিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল জিতেনকাকা। আসলে জিতেনকাকার মা দেখতে চেয়েছিল মিতুদিকে।

জিতেনকাকার মা কী দেখেছিল জানি না, কিন্তু মিতুদি দেখেছিল— জং-ধরা সাইকেল, একতলা টালির চালের বাড়ি, বেড়ার গেট। দেখেছিল লাল ফাটা-ফাটা মেঝে আর দুই কামরার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে থাকা কিছু হতোদ্যম, অসহায় মানুষ! সেই দোতলা গোলাপি বাড়ি আর বিলিতি গাছ ঝোলানো বারান্দা থেকে যার দূরত্ব কয়েক হাজার মাইল!

দীপকজেঠুকে আর কিছু করতে হয়নি। মিতুদিই যা করার করেছিল। সাড়ে ছ’মাসের প্রেম শেষ হয়েছিল মে মাসের গোড়ায়।

জিতেনকাকা অনেক চেষ্টা করেছিল মিতুদিকে বোঝাতে। কিন্তু প্রেম তো অঙ্ক নয়। মানুষ যেমন প্রেমে পড়ে, তেমন আবার প্রেম থেকে বেরিয়েও যায়! এই সহজ সত্যটা বলা সহজ হলেও মানা সহজ নয়, তাই সবাই কষ্ট পায়। জিতেনকাকাও পেয়েছিল।

রফিকণ্ঠী তার কণ্ঠ হারিয়েছিল। ফাংশন করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তখনও আমরা ‘ডিপ্রেশন’-এর নাম জানতাম না। শুধু জানতাম প্রেমে ‘দাগা’ খেয়েছে!

জিতেনকাকা কারও সঙ্গে দেখা করত না। কথা বলত না। মনে আছে, আমার তখন গরমের ছুটি চলছে। ছোটকাকা আমাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। না, আমাদের সঙ্গেও দেখা করতে বেরোয়নি জিতেনকাকা। জিতেনকাকার মা বলেছিল, “ও একটু একা থাকতে চাইছে। কিছু মনে কোরো না।”

ওদের বাড়ির লাগোয়া ছিল পায়ে হাঁটা পথ। পথের উপর ওদের বন্ধ কাঠের জানলার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমি আর ছোটকাকা। ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল গান, ‘যাঁহা পেয়ার কি কদর হি কুছ নেহি হ্যায়/ ইয়ে দুনিয়া অগর মিল ভি জায়ে তো কেয়া হ্যায়।’

সাহির, রফি, এস ডি মিলেমিশে ছড়িয়ে পড়ছিল মফস্সলের নির্জন দুপুর থেকে বাদশাহি কেল্লার সামনে অবধি। অন্ধ গায়ক মাথা তুলে যেন জীবনের মূল কথাই উচ্চারণ করছিলেন!

সঞ্জয়দা পকেট থেকে কুড়িটা টাকা বার করে গায়কের পাশে বসে থাকা ছেলেটির হাতে দিয়েছিল। সেই গান শুনে আমার যেমন কত কী মনে পড়ে গিয়েছিল, সঞ্জয়দারও কি মনে পড়ে গিয়েছিল কিছু! কী জানি! আসলে গানের নুড়িপাথর সবার জীবনেই তো ছড়িয়ে থাকে!

সত্যি বড় হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে কত গান যে আমরা শুনি! আর সঙ্গে সঙ্গে কত স্মৃতি যে অজানতেই ভেসে আসে! হয়তো সামান্য, তুচ্ছ। তাও মনে পড়লে এক আশ্চর্য ভাল-লাগা ছড়িয়ে পড়ে সেই মুহূর্তে!

যেমন ‘ওঠো ওঠো সূর্যাই রে’ গানটা শুনলে এখনও মনে পড়ে বহু আগের সেই ষষ্ঠীর দিনটার কথা। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল সে দিন। আমাদের ভয় লাগছিল এই ভেবে যে, পুজোটা কি তা হলে বৃষ্টিতেই ভেসে যাবে! কিন্তু সকাল দশটা বাজতেই বৃষ্টি থেমে কী যে সুন্দর রোদ উঠেছিল! আমাদের ভাড়াবাড়ির বারান্দার পাশে ছিল মস্ত একটা গ্রিল। তাতে গাল ঠেকিয়ে পাশের পুকুরের বৃষ্টি দেখতাম সবাই। মনে আছে সোমাদি, মানে আমাদের বাড়িওলার মেয়ে, সেও সে দিন আমাদের সঙ্গে বসে ছিল। আর ঝলমলে রোদ্দুর ওঠামাত্র গেয়ে উঠেছিল এই গান। সোমাদি যে খুব সুন্দর গান করে!

মনে আছে, আমাদের বাড়ির কাছে যুগলকাকার দোকানে আমরা সবাই চুল কাটাতে যেতাম। রোগা, বেঁটে যুগলকাকা খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। সারা ক্ষণ সেই দোকানে রেডিয়ো চলত। আসলে আশির দশকে রেডিয়ো-ট্রানজ়িস্টরই ছিল সেই সময়ের মোবাইল ফোন! এখনও যখন আর ডি বর্মণের ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গানটা শুনি, কেন কে জানে, আমার সেই ছোট্ট ছয় চেয়ারের সেলুনটার কথা মনে পড়ে খুব। যেন দেখতে পাই কাঠের চেয়ারের উপরে কাঠের পাটাতন পেতে বসানো হয়েছে আমাকে। আর একটু উঁচু আলমারির মাথায় রাখা রেডিয়ো থেকে ভেসে আসছে গান। এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই, চুল কাটার ফাঁকে যুগলকাকাও মাথা নাড়িয়ে গুনগুন করছে তার সঙ্গে! ভাবলে ভাল লাগে, আমাদের শহর মফস্সলের ছোট ছোট সেলুনগুলো আজও আশ্চর্য সব গানের স্মৃতি বহন করে চলেছে।

আর একটা গান আমাকে অন্য এক স্মৃতির কাছে নিয়ে যায়। গানটা যে এখন খুব একটা শোনা যায় তা নয়। তাও কিছু দিন আগে হিমাচলে ঘুরতে গিয়ে আমাদের ট্র্যাভেলারের চালক গৌরব ভাইয়া গানটা চালিয়েছিল—‘এক দিন বিক জায়েগা মাটি কে মোল/ জগ মে রহ জায়েঙ্গে প্যারে তেরি বোল’। সহজ সরল সুন্দর গান। আমাদের ট্র্যাভেলার চলছিল তাবো থেকে কাজ়া-র পাহাড়ি ও বিপজ্জনক পথে। রুক্ষ পৃথিবীর সৌন্দর্যের মধ্যেও কিন্তু সেই গান আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কৈশোরে, ট্রেনে করে স্কুলে যাওয়ার ‘ডেলি প্যাসেঞ্জারি’র জীবনে।

সবাই মফস্সল থেকে শহরে পড়তে যায়। আমার নদী উল্টো বইত। আমি শহর থেকে মফস্সলের স্কুলে পড়তে যেতাম। সে সময় বজবজ লোকালে উঠত এক অন্ধ বাঁশিওলা। সুলেইমান। রাজা সুলেইমানের যেমন অপার ঐশ্বর্য ছিল, তেমন এই সুলেইমানের ছিল সুরের ঐশ্বর্য! মানুষটির সারা মুখে বসন্তের দাগ। চোখ দুটো পাথরের মতো। একটি বাঁশি বাজিয়ে মানুষটা কামরায় কামরায় ঘুরত। না, মুখ দিয়ে নয়, সুলেইমান বাঁশি বাজাত নাক দিয়ে। ভিক্ষে করত বলতে খারাপ লাগছে আমার কারণ প্রকৃত শিল্পী ভিক্ষে করে না। আর যে গানটা সবচেয়ে বেশি বাজাত সুলেইমান, সেটা ছিল ওই ‘একদিন বিক জায়েগা মাটি কে মোল!’

আমার হাতে টাকাপয়সা সে ভাবে বাড়ি থেকে দেওয়া হত না। তাই ভাবতাম, কী দেব শিল্পীকে? আমি আমার টিফিনের ভাগ দিতাম মাত্র। সুলেইমানের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা হয়ে গিয়েছিল আমার। শিল্পী গরিব হলেও তার মর্যাদা তো কমে না। তাই সুলেইমান শুধু নিত না, আমাকেও কখনও লেবু-লজেন্স, কখনও এক টাকার সেই লম্বা প্যাকেটে বরফের ‘পেপসি’ কিনে দিত! ট্র্যাভেলারে যেতে যেতে আমার মনে পড়ছিল নঙ্গী স্টেশনের ওভারব্রিজে, শনিবারের নির্জন দুপুরে বসে আমাদের গল্প করার সেই সময়গুলোর কথা! জানি না আজ সুলেইমান কোথায়, কিন্তু তার ফেলে যাওয়া বাঁশির সুর, গানের নুড়িপাথরে জমা হয়ে আছে আজও।

সলিল চৌধুরীর ‘পাগল হাওয়া/ কি আমার মতন তুমিও হারিয়ে গেলে’ শুনলে আজও মনে হয় যেন বন্ধুর সাইকেলে বসে, ক্লাস ইলেভেনের আমি পুজোর সকালে, ভেসে চলেছি নদীর ধারের আড্ডার দিকে! খুবই সামান্য স্মৃতি, কিন্তু সেটাও মনকে এক আশ্চর্য ভাল-লাগায় ভরিয়ে দেয়! এমন কত-কত গান যে তার ভালবাসার স্মৃতি নিয়ে বসে রয়েছে আমার ছোটবেলার বারান্দায়!

কিন্তু যুবক হয়ে ওঠার সময়ের আর একটা গানের কথাও বলতে হবে। সে বড় প্রিয় গান আমার। কিছু দিন আগে আমার কন্যা অন্য ঘরে বসে গানটা শুনছিল। উদিত নারায়ণের গাওয়া গান, ‘মেরি সাসোঁ মে বসা হ্যায় তেরা হি এক নাম…’ আর আমার মনে পড়ে গিয়েছিল সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির কথা!

সেটা ছিল উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল। অনেক দুর্যোগ কাটিয়ে ছেলেটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল ইংরেজি অনার্স নিয়ে। প্রথম দিন কলেজ যাওয়ার পথে সে ঠিক করে নিয়েছিল, কোনও দিকে মন দেবে না আর। শুধু পড়াশোনাই করবে এ বার। কিন্তু ঈশ্বর আছেন। তিনি সব শোনেন। সে দিনও শুনেছিলেন। তার পর নিশ্চয়ই হেসেছিলেন খুব।

কলেজের প্রথম ক্লাসেই ছেলেটি দেখেছিল মেয়েটিকে। নীল চুড়িদার, সাদা শিফনের ওড়না। আরও কয়েক জনের সঙ্গে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল মেয়েটা। ছেলেটার সব প্রতিজ্ঞা কোথায় যে ভেসে গিয়েছিল মুহূর্তে! ওর মনে হয়েছিল এত ঝড়-ঝঞ্ঝা কাটিয়ে এই জন্যই কি ও এই কলেজে এসে ভর্তি হয়েছে!

মেয়েটি লাজুক। চুপচাপ। মুখ তুলে তাকায়ই না। শুধু যখন গান করে, তখন কী যে হয়! সব পাল্টে যায়। এই পুরনো কলেজবাড়ি, ছায়াঘেরা রাস্তা, দূষণের শহর, সব আলোয় ঝলমল করে ওঠে! আসলে নবীন বরণের অনুষ্ঠানে মেয়েটা তো গেয়েছিল একটা গান।

একই ডিপার্টমেন্ট ছিল ওদের। তার পর দেখা গেল, ভবানীপুরে একই স্যরের কাছে প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছে দু’জনে। কিন্তু তখনও মেয়েটা ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে না। মুখ তুলেই তাকায় না!

তার পর এল সেই অক্টোবর! এল হেমন্তের আশ্চর্য হাওয়া! সে দিন সাদার উপর গোলাপি ফুলছাপ চুড়িদার আর গোলাপি ওড়না পরে এসেছিল মেয়েটি। ক্লাস শুরুর একটু আগেই এসেছিল। তার পর এসেছিল ছেলেটা। আর কেউ তখনও আসেনি সে দিন। সেই প্রথম কথা হয়েছিল ওদের। শান্ত নরম গলায় মেয়েটা কথা বলেছিল কিছু! আর এলোমেলো পাগল হাওয়ায় ভরে উঠেছিল পুরনো শহর!

ক্রমে দু’জনের গাঢ়তর বন্ধুত্ব হয়েছিল। মেয়েটি আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়ত। সেখানকার ফোন নম্বর চেয়ে নিয়েছিল ছেলেটি। কিন্তু ভয় পেত ফোন করতে। তার পর মেয়েটিই আস্তে আস্তে ফোন করতে শুরু করেছিল। কথা হতে হতে ছেলেটি ক্রমে বুঝেছিল যে, সে এক এমন পথে এসে পড়েছে যেখান থেকে তার আর ফেরার উপায় নেই! এ পথ তার বাকি জীবনের সঙ্গী।

এরই মধ্যে এক দিন মেয়েটি বলেছিল, সে এই টিউশন ছেড়ে অন্য জায়গায় পড়তে চলে যাবে। ছেলেটির মাথায় যেন বাজ পড়ল। সেও মেয়েটির জন্যই ওই নতুন কোচিংয়ে এসে, স্যরের হাতে-পায়ে ধরে ভর্তি হল। মেয়েটি অবাক হয়েছিল কি? সে কি বোঝেনি, কেন ছেলেটি এমন করেছিল!

ছিয়ানব্বই পার হয়ে তত দিনে সাতানব্বই সাল এসে গিয়েছে। এসে গিয়েছে নতুন একটি হিন্দি সিনেমা। এক দিন টিউশনের আড্ডায় ছেলেটি বলেছিল, “একটা গান শুনলাম। খুব ভাল লাগল। এটাই আমার এখনকার প্রিয় গান।”

“কী গান?”

ছেলেটা বলেছিল, ‘মেরি সাসোঁ মে বসা হ্যায়, তেরা হি এক নাম!’

তার কিছু দিন পরে ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার একটু ঝগড়া হল। কিন্তু অভিমান হল অনেকটা। ছেলেটা তার স্বভাব অনুযায়ী বন্ধ করে দিল কথা। মেয়েটা ফোন করলেও ছেলেটা আর ধরে না। কলেজেও দূরে, লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকে একা। স্যরের কাছে টিউশনে গিয়েও অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে অনর্গল।

তার পর এক দিন স্যরের আসতে দেরি হচ্ছে। ক্লাসঘরের লাগোয়া যে ছাদ, সেখানে ওরা সবাই বসে আছে। অন্য একটি মেয়ে ছেলেটিকে বলেছিল, “একটা কবিতা বল না।”

ছেলেটা বলেছিল, ‘আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল/ এই জীবনের পদ্মপাতার জল;/ তবুও এ-জল কোথা থেকে এক নিমেষে এসে/ কোথায় চ’লে যায়;/ বুঝেছি আমি তোমাকে ভালোবেসে/ রাত ফুরোলে পদ্মের পাতায়।’

ক্রমে সবাইকে ঘুরে মেয়েটির কাছেও গিয়েছিল অনুরোধ। তবে কবিতার নয়, গানের!

সেই লাজুক, মুখচোরা, শান্ত মেয়েটি সময় নিয়েছিল একটু, তার পর গেয়ে উঠেছিল, ‘বাগোঁ মে হাম জো মিলে/ তো গায়ে সারি কোয়েলে/ মেহকে সারা ইয়ে সমা/ হাওয়ায়ে মহকি সি চলে/ তেরি খুশবু সে ভর জায়ে, কলিয়োঁকে ইয়ে জাম/ তেরি ইয়াদ হামসফর সুবহো শাম…’

ছেলেটি অবাক হয়ে দেখেছিল, মাথার উপর নীল পাথরে বাঁধানো আকাশ থেকে অন্য এক আলো ঝরে পড়ছে ওই ছোট্ট ছাদের মাথায়। আর কেউ বোঝেনি, এ গান কেন গেয়েছিল মেয়েটি। শুধু ছেলেটি জানত, যে কথা এত দিন হয়নি, এই গান বলে দিয়েছিল সেই সব কিছু। এই গান আসলে এমন এক ভাষা, যা ওরা দু’জনেই কেবল বোঝে।

সে দিন পড়ে বেরোনোর সময়, স্যরের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে মেয়েটা মৃদু গলায় বলেছিল, “আমারও এই গানটা খুব ভাল লাগে। এটা শুনলেই আমার তোর কথা মনে পড়ে!”

‘তোর কথা মনে পড়ে!’ ‘তোর কথা মনে পড়ে!’

কলকাতার হাওয়ায় সেই কথা যেন গতজন্ম থেকে ভেসে আসে আজও! আমার কন্যা অন্য ঘরে বসে উদিত নারায়ণের সঙ্গে গলা মেলায়। আর আমি যেন দেখতে পাই সেই ছেলেটিকে। স্যরের বাড়ির দরজা থেকে সে আজও সেই গানের তীর ধরে হেঁটে চলেছে একা! আর এই একাকিত্বের মধ্যে এখন সে অবাক হয়ে ভাবে, গান সত্যি এমনটা পারে! ঘুম থেকে ওঠা আর ঘুমিয়ে পড়ার দৈনন্দিনতার মধ্যেও গান কী ভাবে জীবনের সামান্য-অসামান্য সব স্মৃতির সঙ্গে বেঁধে রাখে মানুষকে!

এই জাগরণ আর ঘুমিয়ে পড়ার রোজকার নিয়মের মধ্যে কত-কত গান যে আমাদের মনের মধ্যে জেগে থাকে! সকাল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। বার বার অকারণে ভেসে ওঠে গলায়। কী ভাবে যেন তারা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই হারানো ছোটবেলার পাড়ায়! ইট-পাতা সামান্য গলি দিয়ে স্কুল থেকে ফেরার আনন্দে! ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাকী অপেক্ষার রেলস্টেশনে! নিয়ে যায় মায়ের কাছে! কাকার সঙ্গে সাইকেলে ঘুরতে যাওয়ার বিকেলে! বাবার সঙ্গে ছাদের উপর ঘুড়ি ওড়ানোর পাগল হাওয়ায়! এই সব গান আমাদের নিয়ে যায় পুজোর সকালে নদীর ধারের আড্ডায়! টিফিনবক্স বাজিয়ে সমবেত সঙ্গীতের উৎসবে! নিয়ে যায় যুবক হয়ে ওঠার একাকিত্বের নির্জনতায়! নিয়ে যায় সেই লেকের ধারে, জলের দিকে অপলক চেয়ে থাকার সময়ে! তার ছেড়ে চলে যাওয়ার শূন্যতায়!

এই বয়সে এসে আজ যেন আরও বেশি করে বুঝতে পারি, জীবন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অযুত গানের নুড়িপাথরের গুরুত্ব। আর এক-একটা নুড়ি ছুঁয়ে, পাথর স্পর্শ করে, যেন আমরা সহজেই ফিরে যাই হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোয়। সেই দিন, যেখানে এখনও আমাদের ভালবাসার মানুষজন রয়ে গিয়েছে। যেখানে এখনও রয়ে গিয়েছি সেই হারিয়ে যাওয়া ‘আমরা’, যারা সত্যি বিশ্বাস করতাম এই জীবন আনন্দের। বিশ্বাস করতাম আমরা একা একা, স্বার্থপরের মতো নয়, সবাই মিলে এক সঙ্গে ভাল করে বাঁচব। আবার এও বুঝি, আসলে আমরাই নিজের অজানতে গানের অজস্র নুড়িপাথর পথনির্দেশের মতো ছড়িয়ে রেখেছি এই জীবনে। যা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এখনও হারানো দিন এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে! সেই হারানো দিন, যেখানে স্মৃতি তার আশ্চর্য পসরা নিয়ে বসে রয়েছে আমাদের সকল গানের ওপারে!

ছবি: রৌদ্র মিত্র

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Manna Dey

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy