Advertisement
E-Paper

মওকা! মওকা!

ক্রিকেটের উন্মাদনায় লঘু-গুরু গুলিয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটারের বান্ধবীকে বলির পাঁঠা করা, ফেসবুকে নোংরা গালাগাল— মওকা এখন চূড়ান্ত অসভ্যতার।তিস্তার জলবণ্টন, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং বিএসএফ-এর কামকাজ, ব্লগ-রাজপথে রক্তের দাগ আর মৌলবাদ— যে কোনও একটা নিয়েও যদি দুটো দেশের সম্পর্কটা ক্ষতবিক্ষত হত, এতটা অদ্ভুত লাগত না। কিন্তু স্রেফ একটা ক্রিকেট ম‌্যাচে হেরে, বাংলাদেশের আমজনতা এতটা রেগে গেল, বিষণ্ণ হয়ে পড়ল? প্রথমে অনেক সাধারণ মানুষ ভারতকে কুচক্রী ভিলেন বলে তীব্র শাপশাপান্ত করতে লাগল।

চিরশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৪২

তিস্তার জলবণ্টন, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং বিএসএফ-এর কামকাজ, ব্লগ-রাজপথে রক্তের দাগ আর মৌলবাদ— যে কোনও একটা নিয়েও যদি দুটো দেশের সম্পর্কটা ক্ষতবিক্ষত হত, এতটা অদ্ভুত লাগত না। কিন্তু স্রেফ একটা ক্রিকেট ম‌্যাচে হেরে, বাংলাদেশের আমজনতা এতটা রেগে গেল, বিষণ্ণ হয়ে পড়ল? প্রথমে অনেক সাধারণ মানুষ ভারতকে কুচক্রী ভিলেন বলে তীব্র শাপশাপান্ত করতে লাগল। তার পর সেই দেশের এক জন অসাধারণ মানুষও মুখের ওপর বলে দিলেন, ভুল আম্পায়ারিংয়ের জন‌্যই তাঁরা হেরেছেন, নইলে জেতার কথা তাঁদেরই। সে কথাটা সত্যি হতেই পারে, কিন্তু ভুল আম্পায়ারিংও তো খেলার অঙ্গ, ও-জিনিস আগেও বহু বার অনেক দলকেই অন্যায় ভাবে হারিয়েছে, তাতে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলেও, শেষ অবধি মেনে নিতেই হয়। সেটাই স্পোর্টিং স্পিরিট। কিন্তু সে সব জেনেও অত বড় এক জন মানুষ, রাষ্ট্রের প্রধান এক ব্যক্তি, যখন খেলাটাকে নিছক খেলা হিসেবে না দেখে এতটা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, তখন মনে হয় ক্রিকেট খেলাটা আমাদের অনেকেরই লঘুু-গুরু বোধটা বড্ড বেশি রকমের গুলিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ যখন এতটা হতাশ ও ক্রুদ্ধ, ইন্ডিয়া আবার তখন হালকা আমোদ বোধ করছিল। আহা পুঁচকে দেশ, বালখিল‌্যর দল। সামান‌্য খেলায় হেরে গেছে বলে কেমন হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপছে, তিলকে তাল করছে। গল্পের গরু গাছে তুলে দিচ্ছে। কোথায় আম্পায়ারের ভুল ডিসিশন, আর কোথায় আইসিসিকে টাকা খাওয়ানো! বাংলাদেশ, গ্রো আপ বাডি। ইটস ওনলি আ গেম। এন্টারটেনমেন্ট। ব্যস।

ঠিক এক সপ্তাহ পর। ননসেন্সের কাঁটাটা এ বার তড়াক করে ঘুরে গেল কাশ্মীর টু কন‌্যাকুমারিকার দিকে। অস্ট্রেলিয়ার পাড়ায় গিয়ে মেন ইন ব্লু ব‌্যাটে-বলে-মুখে-গালে নীল কালশিটে নিয়ে ফিরে এল। বাংলাদেশ যে রকম তালমাত্রাবিহীন আজব কাণ্ডকারখানা করছিল, একদম তারই সমান মাথামুন্ডুহীন ঘটনা ঘটাতে লাগল এ বার ভারত। তার ‘ম্যাচিয়োরিটি’ একটি হারের ধাক্কাতেই ভেসে গেল। আসলে বাংলাদেশ যে রাস্তায় ঢুকেছে, ভারত অনেক দিন আগে থাকতে সেই পথেই হাঁটছে। আগে টুর্নামেন্ট হারা মাত্র পোস্টারে জুতোর মালা ঝোলানো হত, ক্রিকেটারদের বাড়িতে ঢিল-পাথর পড়ত, খেলোয়াড়রা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। তাই নিয়ে কত্ত জোক্‌স-কিস্সা ঘুরত। ১৯৯৬ সালে হারার পর বিনোদ কাম্বলি নাকি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন পাগড়ি আর দা়ড়ি লাগিয়ে সর্দারজি সেজে। এক মহিলা তাঁকে চিনে ফেললেন। কাম্বলি তাতে প্রচণ্ড অবাক হতে মহিলা জানালেন, চেনাটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি তো স্বয়ং সচিন তেন্ডুলকর!

এ তো তাও গল্প-কাহিনি। কিন্তু খবরের কাগজে ছাপার অক্ষরে যে ঘটনাগুলোর কথা জানা যেত সেগুলো যেমন বেদনাদায়ক তেমনই বিরক্তিকর। ‘ভারতের হারে মৃত‌্যু’। কারও হা‌র্ট অ‌্যাটাক, অনেকের আত্মহত‌্যা। কেউ ফিনাইল খেয়েছে, কেউ ব্লেড চালিয়েছে, কেউ ফ‌্যান থেকে ঝুলে পড়েছে।

এই শেষ ২০১৫-র বিশ্বকাপের সময়ে যেহেতু সাইবার-দুনিয়া একটা অল্টার-পৃথিবীর আকার নিয়ে নিয়েছে, যেহেতু এই পৃথিবীর রাগ ও প্রতিবাদ প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন, তাই বাক্-স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই আঘাত হানার একটা প্রায়-নতুন টেকনিক সামনে আসছে। এর ভাল নাম স‌্যাটায়ার। কিন্তু আসলে, খুল্লমখুল্লা গালাগাল, কদর্য টিটকিরি। ফেসবুকে, মানে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই দেশের একটা অভদ্র, অসভ্য গালাগালি-যুদ্ধ চলেছে! নিজের দেশকেও ছেড়ে কথা বলা হচ্ছে না। কারণ যে-মুহূর্তে একটা ম্যাচ হেরে যাচ্ছে, সে-মুহূর্তে সাত-ম্যাচ জেতা ক্রিকেটাররা হয়ে যাচ্ছে ক্যালাস, অপদার্থ, হাঁদা। না না, শুধু ক্রিকেটাররা নয়। হারের জন্য তার চেয়েও বেশি দায়ী তাঁদের গার্লফ্রেন্ডরা। অন্তত সেলেব-গার্লফ্রেন্ডটি তো বটেই!

সেই ফর্মুলায় আচ্ছাসে তুলোধোনা করা হল অনুষ্কা শর্মাকে। ম্যাচ কা মুজরিম কিন্তু তাঁর বয়ফ্রেন্ড বিরাট কোহলি। তাঁর একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন শটই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু গালাগাল আর বিদ্রুপ হজম করতে হচ্ছে অনুষ্কাকে। কারণ? জলের মতো সহজ। সমাজটা যে ভাবে মেয়েদের জন‌্য উচ্ছন্নে যাচ্ছে, ঠিক সে ভাবেই কাপ না পাওয়ার কারণও ওই হিরোইনটা। শিখর ধাওয়ান যতই কনসেনট্রেশন ফসকান, বোলিং যতই হতশ্রী হোক, ও সব ছাড়ান দে। মোদ্দা কথা হল, ওই বিরাট বেচারা ওর দিকে তাকিয়েছিল বলে ক‌্যাচ দিয়েছে। এই সব বলে যারা হইহইটা ফেলে দিয়েছে, তারা কিন্তু ভারতের দু’উইকেট পড়া মাত্র অনুষ্কার মুখ ভর্তি যন্ত্রণা দেখতে পায়নি। আবার, অনুষ্কা খারাপ অভিনয় করলে কোহলির দোষ দেয়নি। আবার, কোহলির সোনার দিনে, যখন তিনি সেঞ্চুরি করছেন আর অনুষ্কা স্টেডিয়ামে বসে আছেন, তখন অনুষ্কার স্তুতি করেছে বলেও শোনা যায়নি। তবে সেঞ্চুরির পর ফ্লাইং কিস দেখে হিংসেয় ছটফট করেছে খুব। তা তো হবেই। ফেসবুকে প্রোফাইল বানালে কি আর ডাইনি পোড়ানোর অভ‌্যেস ছাড়া যায়?

আসলে, খোদ নিউটনের তৃতীয় সূত্রটাই যে বিগড়ে বসে আছে। ‘এভরি অ‌্যাকশন হ‌্যাজ অ্যান ইকুয়াল অ‌্যান্ড অপোজিট রিঅ্যাকশন’— এই বাক্যটা এখন বদলে হয়ে গিয়েছে: এভরি অ‌্যাকশন হ‌্যাজ অ‌্যান অপোজিট ‘ওভার-রিঅ্যাকশন’। এই যে মেট্রোয় বাসে ট্রেনে হররোজ কত বচসা লেগে যায়। কেউ দু’কথা বলে, তার পিঠে কেউ চার কথা শোনায়। কিন্তু এই কথা কাটাকাটির সময় কেউ তো পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বার করে সামনের লোকটাকে কুপিয়ে খুন করতে পারে না। একটা লঘু-গুরুর ব্যাপার থাকে। বাসে পাশের লোকটা পা মাড়িয়ে দিয়েছে বলে যে রাগ, আর সমাজে ধর্ষণ বেড়ে চলেছে বলে যে রাগ— তাদের মাত্রা এক হয় না। অন্তত, হওয়া উচিত নয়। কোন ঘটনায় কতটুকু প্রতিক্রিয়া জানাব, সেই ধারণাটা সারা ক্ষণ পরিষ্কার রাখতে হবে। এই বোধটা সভ‌্যতার একটা জরুরি ভিত্তি। যে জনগোষ্ঠী সেটা মেনে চলে, তার সমাজ তত মজবুত, তার ডিগনিটি তত বাড়ে।

কিন্তু বিশ্বকাপের মাসে কী হল? ভারত যখন সামান্য গ্রুপ লিগের ম্যাচ জিতল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, তখন সচিন তেন্ডুলকরের বাড়ির সামনে গিয়ে এক দল ভারতীয় ফ্যান পেল্লায় উল্লাসে দমাদ্দম বাজি ফাটিয়ে এল। তেন্ডুলকর যারপরনাই চমকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আবার কী করেছি ভাই? আর হারার পর তো সোনায় সোহাগা। সবাই নিজের টিভি সেট আছড়ে ভাঙল, জিভ কাটল, আন্ত‌র্জাতিক সম্পর্কের খুনখারাপি করল, আর তার পর এই অনুষ্কা-এপিসোড! যারা এই ইতরের মতো অভিযোগ করল, তারা এক জনও ক্রিকেট ফ‌্যান নয়। তারা ফ্যানাটিক। উন্মাদই তো লঘু-গুরুর বোধ গুলিয়ে ফেলে, সীমা ছাড়ায়, জীবনের একটা লাইট মোমেন্ট নিয়ে খামখা সিরিয়াস হয়ে গিয়ে নিজের আর অন্যের বিশাল ক্ষতি করে বসে। সমাজে বিপদ ডেকে আনে। অবশ্য আগেও ভারতীয়রা এমন ইতর কাণ্ড করে নিজেদের মুখ পুড়িয়েছে। ১৯৯৬-এর ইডেন কালি মাখিয়ে দিয়েছে ভারতের মুখে। খেলা যখন হেরে যাচ্ছি, মাঠের মধ্যে বোতল ছুড়ে তা ভন্ডুল করতে তো হবেই— এই তত্ত্বে স্টেডিয়াম ভর্তি লোকের বিশ্বাস করতে কোনও অসুবিধেই হয়নি।

এই ফ্যানেদের ফ‌্যানাটিক কে বানিয়েছে সক্কলে জানে। তারা যা বলে, আমরা তা-ই করি। যেমন নাচায়, তেমন নাচি। তারা যদি বলে কবাডি নিয়ে হইচই করা উচিত, আমরা সন্ধেবেলায় হাঁ করে কবাডি দেখতে বসে যাই। তারা যদি চায়, তা হলে কাল থেকে বাঙালি দুর্গাপুজোকে ত্যাগ দিয়ে শীতলাপুজোয় চার দিন উৎসব করবে, নতুন জামা কিনে পরবে। তারা টিভিতে প্রোমো দিয়ে, সতেরো হাজার বিশেষজ্ঞ আমদানি করে তাদের মতামত খেলিয়ে বুঝিয়ে দেবে, শীতলা আমাদের রোগ আরোগ্য করেন, তাই তিনিই মেগা-দেবী, তাঁর উপাসনা করলে মৃত্যুও আমাদের ছুঁতে ভয় পাবে, তাই সেরা পুজোর খেতাবটা তাঁরই প্রাপ্য। এই নিয়ন্তারা হল: স্পনসর। বাণিজ‌্যপ্রভু। ওদের সরু চোখ দারুণ ভাল সব সুযোগ চেনে।

তারা দেখেছে, এই ক্রিকেট খেলাটা খেলে খুব কম সংখ্যক দেশ। সুতরাং সাত-আট জনের ক্লাসে প্রথম তিনের মধ্যে থাকাটা খুব একটা শক্ত হবে না। তা ছাড়া, ক্রিকেেটর লেগ গ্লান্স-গালি-ডাকওয়ার্থ লুইস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকলেও এর প্রাথমিক নিয়মকানুন বোঝা সহজ। কত রান আর কত উইকেট— মাত্র সেটুকু বুঝলেই যে কেউ এর উত্তাপের ভাগীদার হতে পারবে। তাই, ভারতে ক্রিকেট-হুজুগটা চালিয়ে দিলে, প্রভূত লাভের সম্ভাবনা। ভারত খুব ভাল র‌্যাংকও করবে, আর ভারতীয় আমদর্শক একে জাতীয় ধর্ম বলে মাথায় তুলে নাচতেও পারবে। ফলও হাতনাতে। ফুটবলের মাঠে লোক কমে গেল। ট্রফি আনার পর কবাডি দল ট‌্যাক্সির অপেক্ষায় রাস্তার ধুলোয় বসে থাকল। বিশ্বনাথন আনন্দ-কে নিয়েও তেমন উন্মাদনা দেখাল না দেশ। পঙ্কজ আডবাণীর নাম শুনলে তো আমজনতা গেস করে লালকৃষ্ণ আডবাণীর উত্তরাধিকারী। এই ভদ্রলোেকর নামটা এক বার গুগ্‌ল করে দেখুন, রেকর্ডের চোটে ধাঁধা লেগে যাবে।

কিন্তু বিলিয়ার্ডসে যা-ই করো, স্নুকারে যতই অলৌকিক কীর্তি রচনা করো এই ধরাধামে, দাবায় বছরের পর বছর বিশ্বকে হাতের মুঠোয় রাখো, কিস্যু এসে যায় না।
ক্রিকেটের টুয়েলফ্থ ম্যানকে নিয়েও পাতার পর পাতা লেখা হয়। আর, চারপাশের এই ক্রিকেট-জ্বরের চোটে ‘ক্রিকেট ভালবাসি না’ বলে উঠতে না-পারা লোকটাকেও টিভির সামনে ভিড়ে যেতে হয় ফি সন্ধেয়। নইলে সে দলছুট হয়ে যাবে। গোটা দেশের কাছে ব্রাত্য হয়ে যাবে। তাই সে-ও ‘আম্মো আছি’ বলে বাউন্ডারির বাইরে বল গেলেই নাচতে থাকে দু’হাত তুলে। আর তার এই দু’হাত ধরেই স্পনসররা আমাদের ঘরে ঢুকে বলে, ক্রিকেট আর শীতকালের খেলা নহে। শুধু কমলালেবু আর সোয়েটারের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকবে কেন? ক্রিকেট এখন সম্বচ্ছরের খেলা। রোজকার খেলা। মেগাসিরিয়ালের মতোই, সে প্রত্যেক দিন পেখম মেলবে। ভাত কি লোকে সিজনে খায়?

ব্যস, পাভলভ-কুকুরের মতোই, সক্কলের এখন তাই ক্রিকেটে জেতার খিদে পায়, সর্ব ক্ষণ। সেই খিদে না মিটলেই সে এখন শুধু ভর হওয়ার মতো নিজেকে কামড়ায়, নয়তো অন‌্যকে চিবিয়ে খেতে যায়। এই মওকা-মওকা পেয়ে, হরেক টুর্নামেন্টের বন্দোবস্ত গজিয়ে ওঠে শনশনিয়ে। বিশ্বকাপে হেরেছ তো কী হয়েছে? সে দুঃখু ভুলে যাও। বালাই ষাট, তার জন্য চার-চারটে বছর অপেক্ষা করতে হবে না কি? এই নাও, আইপিএল! শুধু উগ্র জাতীয়তাবাদ-এর জায়গায় বসিয়ে দাও প্রাদেশিকতাবাদ। ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া বলে লাফাচ্ছিলে, এ বার কলকাতা কলকাতা বলে লাফাও। কিংবা চেন্নাই-চেন্নাই। কিন্তু দেখো বাবা, এক থেকে যায় যেন তোমার জোম্বি-পনা, জঙ্গিপনা। এখন এই যে স্টিভ স্মিথকে সাদা নেকড়ে বলে চ‌্যানেল ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন রাজস্থানের অলিতে-গলিতে তাঁরই প্রতিটা ছক্কায় ঠিকরে বেরোবে উল্লাস। সাকিব আল হাসান কেকেআর-এর জার্সি পরে রান আপ শুরু করলে আবার হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যাবে গঙ্গা-পদ্মার ভাই-ভাই সম্পর্ক। তখন হয়তো বিপক্ষ টিমে মহম্মদ শামির রিভার্স সুইং দেখে রাগে জ্বলে উঠবে কলকাতার ড্রয়িং রুম। সব রকমের সেন্স এবং সেন্সিবিলিটি তো দিব্যি নিরুদ্দেশে।

আরে ভাই, জিন্দেগিতে বাঁচছি কেন? ক্রিকেট দেখব, আর কাঁইকাঁই করে চেঁচাব বলে তো? ক্রিকেট আমার ধ্যানজ্ঞান, যুক্তিবুদ্ধি টোটাল ব্যান। আরে বাবা, ক্রিকেট কত বড় ঈশ্বর, সে এসে আমার পুরো বোর হওয়া সন্ধেগুলোকে রগরগে উত্তেজনায় ভরিয়ে দিল! আমার চব্বিশটা ঘণ্টা ছোট হতে হতে সন্ধে-রাতের চারটে ঘণ্টায় পর্যবসিত হল! বাজারে আলুর কী হল, গঙ্গায় কতটা ঝাঁপ খেল আর্সেনিক, রানাঘাটে প্রলয়ের আভাস পাওয়া গেল চকিতে— তার চেয়ে অনেক জরুরি হল, নাইট-বরণ উৎসবে আমায় ইডেনে ফ্রি-তে ঢুকতে দিচ্ছে কি না। কোন কোন ব্যান্ড আসছে, ঝিংকাচিকা মিউজিক শোনাতে? শাহরুখ ভাইয়ের সামনে কোমর দোলানোর মস্তি পেতে হবে তো!

সত্যিই তো। সারা দিন মুখ গোমড়া করে বসে থাকার মধ্যে কী গৌরব আছে? ও সব আঁতলামি ছাড়। প্লেন ভেঙে পড়েছে তো পাইলট বুঝবে। তোর-আমার কী? ওই দেখ না, মুখে কাটা দাগ নিয়ে জোকার বলছে, হোয়াই সো সিরিয়াস? আঃ, জাস্ট চার দিন বাকি আর। চল ভাই, স্ক্রিনের ক্রিকেটারদের সঙ্গে সঙ্গে গুনি। ফাইভ, ফোর, থ্রি, টু, ওয়ান...

গেম অন।

গন্ড‘গোল’

গত বিশ্বকাপ ফুটবলে জার্মানির কাছে ব্রাজিলের ৭-১ গোলে হারটা মনে আছে? তিন নম্বর জার্মান গোলটার পরই সাও পাওলোর রাস্তায় ভাঙচুর শুরু হয়ে যায়। টিভি সেট, গাড়ির কাচ— সব ভাঙচুর করতে থাকে সমর্থকরা। প্রায় দাঙ্গা লেগে যায়। খেলা শেষ হতে না হতেই সাও পাওলোতে ২০টা বাস পুড়িয়ে দেয় জনতা। স্টেডিয়ামের বাইরে ছবি পো়ড়ায় প্লেয়ারদের, বিভিন্ন অফিস বিল্ডিংয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। জাতীয় পতাকা টেনে নামিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যে সাংবাদিকরা খেলা কভার করতে গিয়েছিলেন, পুলিশ তাঁদের বার বার বলে, ‘হোটেলে থাকুন। বাইরে বেরোবেন না।’ সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা দেওয়া হয় জার্মান দলকে।

ইংল্যান্ড ফুটবল দলের সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘোরে এক দঙ্গল উগ্র সমর্থক। এদের সবাই ডাকে ফুটবল-গুন্ডা। যে দেশে যায়, সে দেশ তটস্থ হয়ে থাকে এদের নিয়ে। পুলিশও বিশেষ নজর রাখে। টিম হারলে এরা হোটেল-পাব-স্টেডিয়ামে মারদাঙ্গা করবেই করবে। এই ইংরেজ ফুটবল-ফ্যানাটিসিজম এমন পর্যায়ে গেছে, একে বলাই হয় ‘ইংলিশ ডিজিজ’।

নিজেদের দেশের ভেতর তো এরা সারা ক্ষণই মস্তানি দেখাচ্ছে। ক্লাব ফুটবলে একটা করে ম্যাচ শেষ হবে আর টিউব ট্রেনে শুরু হবে মারপিট। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে, ব্রিটিশ ট্রান্সপোর্ট পুলিশের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে— খেলা দেখতে আসার সময় বা ফিরে যাওয়ার সময়, ট্রেনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করে ম‌্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড-এর সমর্থকরা।

১৯৮৫-র ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ইতালির জুভেন্তাস আর ইংল‌্যান্ডের লিভারপুল। খেলা শুরু হওয়ার আগেই এক দল মদ‌্যপ ইংরেজ জুভেন্তাস সমর্থকদের ওপর চড়াও হল। ৩২ জনকে মেরেও ফেলল। স্টেডিয়ামের দেওয়াল ভেঙেও কিছু মানুষ মারা গেলেন। আর অনেকে মরলেন ছোটাছুটির সময় পায়ের তলায় পিষে। এর পর ইউরোপিয়ান ফুটবল অ‌্যাসোসিয়েশন ইংল‌্যান্ডের সব ক’টা ক্লাবকে ইউরোপের প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে পাঁচ বছরের জন‌্য ব‌্যান করে দিয়েছিল।

ইপিএল-এর সমর্থকরা অবশ্য নিজের উপরেও নিগ্রহের ব্যাপারে কম যান না। বছর দুই আগে, নিউক্যাস‌্ল ইউনাইটেড-এর কাছে হেরে যাওয়ায়, ম‌্যান ইউ-এর এক কেনিয়ান সমর্থক সাত তলা থেকে লাফ মেরে আত্মহত্যা করেন। তবে, ফুটবল-ভক্তরা বলতে পারেন, শুধু তাঁদের খেলাকে এত নিন্দে কেন? স্টেফি গ্রাফের অন্ধ সমর্থক এক টেনিস-উন্মাদ কি মোনিকা সেলেস-কে ছুরি মেরে তাঁর কেরিয়ার চিরতরে শেষ করে দেননি?

World Cup cricket 2015 WC2015 Cricket facebook Chirashree Majumdar Bangladesh India Indian Cricket team
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy