রবীন্দ্রনাথকেও রাতের আহারের পর ঘুমোতে হয়েছে শংকরী কিংবা প্যারী কিংবা তিনকড়ির বলা রাজপুত্র-রাজকন্যার সব গল্প শুনতে শুনতে।
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কুড়ি বছর আগে জন্মেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনিও লিখে গেছেন, ‘মার কাছে আমরা বেশিক্ষণ থাকতাম না।’
রবীন্দ্রনাথের দিদি সৌদামিনী দেবীও লিখে গেছেন, ‘আমার মা বহু সন্তানবতী ছিলেন এইজন্য তিনি আমাদের সকলকে তেমন করিয়া দেখিতে পারিতেন না।’
তবে এর অর্থ এই নয় যে, তিনি সন্তানদের স্নেহ করতেন না বা ভালবাসতেন না।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন, ‘আমরা বউরা প্রায় সকলেই শ্যামবর্ণ ছিলুম।... প্রথম বিয়ের পর শাশুড়ী আমাদের রূপটান ইত্যাদি মাখিয়ে রং সাফ করবার চেষ্টা করতেন।’... ‘আমি বড্ড রোগা ছিলুম।... আমাকে কিছুদিন নিজে খাইয়ে দিতে লাগলেন। আমার একমাথা ঘোমটার ভিতর দিয়ে তাঁর সেই সুন্দর চাঁপার কলির মতো হাত দিয়ে ভাত খাওয়াতেন।’
সারদাদেবী যে কত সুন্দরী ছিলেন এই আঙুলই তার প্রমাণ। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কর্তাদিদিমা রূপসী ছিলেন’।
ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বৌমা নাতনিদের মধ্যে বোধ করি সবচেয়ে বেশি সুন্দরী ছিলেন জ্ঞানন্দানন্দিনী। তাঁর কন্যা ইন্দিরাও আশ্চর্য সুন্দর ছিলেন। তথাপি উভয়ের মধ্যে কে বেশি সুন্দর, তা বিতর্কের বিষয়। বিশেষ করে যিনি বিংশতি বর্ষীয়া জ্ঞানদানন্দিনীর ফটোগ্রাফ দেখেছেন, তাঁর পক্ষে মা-মেয়ের মধ্যে
কে বেশি সুন্দর— সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
আসলে, দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদে ঠাকুরবাড়ির প্রায় সব মহিলা এবং পুরুষই ছিলেন গৌরবর্ণের অধিকারী। এই রূপ, এমন সৌন্দর্য বলা যায় পরম্পরাসূত্রে পাওয়া।
সারদাদেবী কেন, তাঁরও পূর্বে দ্বারকানাথের স্ত্রীর দিগম্বরীদেবীর কথাও মনে রাখতে হবে, তাঁর এমনই অসামান্য সুন্দর মুখশ্রী ছিল যে, বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পূজায় দেবীর মুখ দিগম্বরীর মুখের আদলে নির্মাণ করা হত।
এই দিগম্বরী এবং দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ এবং দেবেন্দ্রনাথ ও সারাদাসুন্দরীর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এঁদের পরিবারের কেউই সেই অর্থে কালো ছিলেন না। প্রায় সকলেই ফর্সা ছিলেন— তাঁদের অনেকেরই গায়ের রং ছিল স্বর্ণচাঁপার মতো।
বৌঠান-কাদম্বরী তাঁর প্রিয় দেবরটিকে ভিতরে ভিতরে রাগিয়ে দিয়ে উত্তেজিত করে বলতেন ‘রবি সবচেয়ে কালো, দেখতে একেবারেই ভাল নয়, গলা যেন কী রকম। ও কোনোদিন গাইতে পারবে না, ওর চেয়ে সত্য ভাল গায়।’ কাদম্বরীর এ সব কথা কোনও ইতিহাসবিদ বা গবেষক যদি সত্য মনে করেন, তা হলে তো বিপদ!
শরৎকুমারী ছিলেন দেবেন্দ্র-সারদার নবম সন্তান। ঠাকুরবাড়ির নারীপুরুষদের সৌন্দর্য সেকালে একটা আলোচনার বিষয় ছিল। শরতের স্বামী যদুনাথ মুখোপাধ্যায় সুরসিক মানুষ ছিলেন। তাঁকে এক জন কৌতূহলী প্রশ্ন করেছিল— ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরা সকলেই এত সুন্দর হয় কেমন করে? উত্তরে তিনি খুব সংক্ষেপে বলেছিলেন ‘দুধে আর মদে।’ কিংবদন্তি, ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্মাবার পরেই নাকি তাঁদের দুধে আর মদে স্নান করানো হত।
রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘একটা গুজব চলে আসছে যে জন্মমাত্র আমাদের বাড়িতে শিশুদের ডুবিয়ে দেওয়া হয় মদের মধ্যে, তাতেই রঙটাতে সাহেবি জেল্লা লাগে।’
সেই জেল্লা দেখেই ট্রেনের মেমসাহেব যাত্রীরা বারো বছরের বালকটিকে নিয়ে যে যথেষ্ট ‘নাড়াচাড়া’ করেছিল, তা বোঝা যায়।
পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের দেবতুল্য রূপ দেখে অনেকেই তাঁকে জিশুখ্রিস্টের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। ইন্দিরা দেবীও তাঁর ‘যিশুখ্রিস্টতুল্য মুখাবয়বের’ উল্লেখ করেছেন।
দেবেন্দ্র রবীন্দ্রের পর পরম্পরায় ভূমিষ্ঠ হলেন রবীন্দ্র-মৃণালিণীর প্রথম সন্তান বেলা বা মাধবীলতা। ‘বেলা যেন মোমের পুতুলটির মতো হয়েছিল।’— ইন্দিরা বলেছিলেন। আর আর্চার বেলাকে কোলে-নেওয়া রবীন্দ্রনাথের ছবি এঁকে বলেছিলেন, ‘Christ-এর মতন ইঁহার মুখশ্রী। ইনি সময়ে খ্রিস্টান না হউন, Christ-কে প্রেম করিবেন।’
রবীন্দ্রনাথের রূপের প্রতি আকর্ষণ মেমসাহেবদেরই বুঝি বেশি ছিল। তরুণ বয়সে, মধ্য বয়সে, বিদেশিনিদের সঙ্গে তাঁর যতটা মেলামেশা, আকর্ষণ ও প্রীতিভাব ছিল, পরিবারের বাইরে বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে তেমন সম্পর্কের সুযোগ ছিল না। অনিন্দ্যসুন্দর
রূপবান পুরুষটির আকর্ষণে কোনও রূপমুগ্ধ স্বেচ্ছায় এগিয়ে না এলে কবি কোনও দিনই অন্যের কাজে নিজেকে নিয়ে যেতে বা ধরা দিতে পারতেন না। কিন্তু সেই রূপমুগ্ধ রূপবতীর প্রতি তাঁর অন্তরে যে কোনও বিকর্ষণ থাকত, তা কিন্তু আদৌ নয়। রূপবতীর রূপকে স্পর্শ করতে তাঁর অন্তরে সাড়া জাগত; কিন্তু তিনি নিজে থেকে কোনও দিন সীমানা ভাঙতে প্রস্তুত ছিলেন না।
তাই তাঁর জীবনে মুগ্ধ মেয়েদের কাছ থেকে আদর ভালবাসা চুম্বনপ্রাপ্তির অজস্র উদাহরণ থাকলেও উল্টো উদাহরণ দুর্লভ। তবে পুরুষ বা নারী যিনিই সক্রিয় হোন, দুই আগ্রহী মানুষের চুম্বনে সুখ তো উভয়েরই!
কবি পরিণত বয়সে বলে গেছেন, ‘কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি— তা সে-ভালোবাসা যে-রকমই হোক না কেন।’
ছেলেবেলায় চাকরদের শাসনে বাইরের ঘরে মানুষ হতে হয়েছে কবিকে। জীবনে যে-সময়টা মায়ের বা মেয়েদের আদর ছিল একান্ত আবশ্যক, তখন তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল কবিকে। ‘যখনকার যেটি সহজপ্রাপ্য তখন সেটি না জুটিলে মানুষ কাঙাল হইয়া দাঁড়ায়।’ ফলে সারা জীবন মেয়েদের আদরের তৃষ্ণা ছিল তাঁর বক্ষ জুড়ে; কিন্তু সেই তৃষ্ণা তাঁর চক্ষে প্রকাশ পেত না কখনও।
তখন তাঁর সতেরো বছর বয়স। বিলাতযাত্রী রবীন্দ্রনাথ। জাহাজে ওঠার আগে কিছু দিন কাটল আমদাবাদ ও বম্বেতে। বম্বেতে একটি মরাঠি পরিবারে কবিকে কাটাতে হল কয়েকটি দিন। সেই পরিবারেরই একটি কন্যা আনা তরখড়। বয়স বছর বাইশ-তেইশ। সুন্দরী। লেখাপড়াওয়ালা মেয়ে, বিলেত থেকে ঝকঝকে করে মেজে এনেছে তার ইংরেজি শিক্ষা। মেয়েটি রূপবান রবীন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল তীব্র ভাবে। দীর্ঘদেহী সুঠাম শুভ্রশরীর সপ্তদশবর্ষীয় বিলাতযাত্রাভিমুখী উজ্জ্বল তরুণ। কবি বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই সে ঘুরত আমার আনাচে-কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিত সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে।’ কবিও তো তার প্রতি আকৃষ্ট। তিনিও তাকে আকর্ষণ করতে চান। অন্যকে আকৃষ্ট করার যে সম্ভার বিধাতা নারীকে উপহার দিয়েছেন, পুরুষ সেখানে অনেকটাই বঞ্চিত। তা হলে? ‘তাই সুবিধা পেতেই জানিয়ে দিতুম যে কবিতা লেখবার হাত আমার আছে। আদর আদায় করবার ঐ ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো মূলধন।’ এই তরুণ কবিকে মেয়েটি ভালবেসে ফেলেছিল। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ কোনও এক অবঙ্গীয় নারীর মুখে শুনলেন তিনি রূপবান। তার চুম্বনতৃষ্ণাও কবি কোনও দিন ভুলতে পারেননি। রূপমুগ্ধ আনা কবিকে আবদার করে বলেছিল, ‘আমার একটা কথা রাখতে হবে রবি তোমাকে, তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না; তোমার মুখের ঐ শুভ্র-সুন্দর সীমানা যেন কিছুতে ঢাকা না পড়ে।’
মেয়েদের এই রূপমুগ্ধতা, এই ভালবাসা কবির কাছে বরাবরই ছিল যেন তৃষ্ণার শান্তি। কবি নিজে আনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সে মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে কখনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনোদিন।’
তার পরে কবির জীবন জুড়ে ‘নানান্ অভিজ্ঞতার আলো-ছায়া খেলে গেছে।’
শুধু কবির কবিত্বে নয়, তাঁর রূপ, তাঁর সৌন্দর্য, তাঁর দেহকান্তি, তাঁর রেশমি কেশগুচ্ছ, তাঁর চম্পকসদৃশ দীর্ঘ অঙ্গুলি, তাঁর রক্তিম করতল, তাঁর দৃষ্টি, তাঁর অভিব্যক্তি, তাঁর ভিন্নমাত্রার উপস্থিতি পৃথিবীর মানুষকে অভিভূত, বিস্মিত করেছিল। গভীর মুগ্ধতায় তাঁর প্রত্যক্ষদর্শীরা ভাবতেন, তিনি কি প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে আসা কোনও মহর্ষি, না কি নবজন্ম লাভ করে এসেছেন আর এক জিশুখ্রিস্ট আরও এক বার।
‘ভারতী’ পত্রিকায় মুদ্রিত সমগ্র ‘কবিকাহিনী’র অফপ্রিন্ট তরখড়ের হাতে উপহার দিয়ে কবি চললেন বিলেতের পথে।
ইংল্যান্ডে কবি ডাক্তার স্কটের পরিবারের অতিথি হয়ে উঠলেন। তাঁদের দু’টি মেয়েই যে এই আশ্চর্য অনিন্দ্যসুন্দর তারুণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হবে, তা অননুমেয় নয়। তাঁকে ঘিরে মেয়ে দু’টির কত আনন্দ কত খেলা কত কৌতুক। তারা দু’জনেই তরুণ কবিকে ভালবেসে ফেলেছিল। ভালবাসা তো একপক্ষে হয় না। কবিরও তাদের ভীষণ
ভাল লেগেছিল। কিন্তু তারা যে সত্যিই কবিতে মুগ্ধ, ভালবাসায় আত্মহারা, ‘তখন যদি ছাই সে কথা বিশ্বাস করবার এতটুকু মরাল কারেজ থাকত।’
আর তাই কি জাহাজে ‘ভগ্নহৃদয়’ লিখতে লিখতে দেশে ফিরলেন কবি?
কখনও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাঁর ‘মরাল কারেজ’ নেই, কখনও আবার বলেছেন ‘আমার stupidity-বশত আমি ধরা দিইনি।’
আর এক জাহাজের কাহিনি। ১৮৯০ সাল। অক্টোবর মাস। রবীন্দ্রনাথ বিলাতভ্রমণ পর্ব শেষ করে দেশে ফিরছেন। জাহাজ ‘টেমস’। সাগরে সময় নেবে পঁচিশ দিন। জাহাজে অনেক পুরুষ, অনেক রমণী। কবি জাহাজের কোণে বসে নিরিবিলিতে কাব্য-কবিতা লিখলেও সুন্দরী মেমসাহেব তাঁর নজরের বাইরে যায় না। কিন্তু নিজে থেকে কিছুতেই তিনি আলাপ করতে পারেন না, যত ক্ষণ না সেই সুন্দরী নিজে এসে কবির সঙ্গে আলাপ করে যায়।
জাহাজে এক নীলচক্ষু মেয়েকে কবির বড় পছন্দ হয়েছে। তার চমৎকার ঠোঁট— হাসলে তাকে আরও সুন্দর দেখায়।
এক সুন্দর আর এক সুন্দরের প্রতি তো আকৃষ্ট হবেই।
জাহাজে কবি উঠেছেন ৯ অক্টোবর। আর ১৫ অক্টোবরের দিনলিপিতে কবি লিখেছেন, ‘সেই সুন্দরী মেয়েটি যাকে আমার খুব ভালো লাগে আমি দেখলুম ক’দিন ধরে সেও আমার সঙ্গে আলাপ করবার অনেক চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমার stupidity-বশত আমি ধরা দিইনি। সে কাল রাত্তিরে আপনি এসে বললে: Aren’t you going to sing?’ সুতরাং কবির দিক থেকে আড়ষ্টতার দরজা গেল খুলে। মেয়েটির নাম মিস লং। জাহাজে কয়েকটা দিন দিনে এবং রাতে মিস লং ও কবি একত্রে অনেকটা সময় অনেক গল্প করে অনেক গান গেয়ে কাটিয়ে ছিলেন। জাহাজ জুড়ে এত সাদা চামড়ার মানুষ থাকতেও সুন্দরীর পছন্দ হল ভারতবর্ষের মানুষটিকেই।
শুধু গায়ের রং দেখেই কি আর সৌন্দর্যের বিচার হয়?
মেয়েরা তাঁকে পছন্দ করে, তিনি বোঝেন। নিজে স্বগতোক্তির মতো করে বলেন, ‘আমি মনে মনে মেয়েদের এত ভালোবাসি, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভাব করতে পারি নে—আশ্চয্যি!’ অবশ্য এতে কবির কোনও সমস্যা হয় না, কারণ তারাই শেষ পর্যন্ত কবির কাছে এসে তাঁর সঙ্গে ভাব করে যায়।