Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Brahmo Samaj

শ্রমিকদের জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাও করেছিলেন তিনি

তিনিই শ্রমিকদের বুঝিয়েছিলেন শিক্ষার প্রয়োজনের কথা। খুলেছিলেন শ্রমিকদের নৈশ স্কুল, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ব্যাঙ্ক। মহিলাদের স্বনির্ভরতার জন্য শেখান কুটিরশিল্প। তাঁদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া এবং সামাজিক উন্নতির রাস্তা দেখিয়েছিলেন। বিরোধিতা না করেও মালিকদের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য। তিনি শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের পথিকৃৎ।

শ্রমিকদরদি: শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ডান দিকে, বরাহনগরে অবস্থিত শশিপদ ইনস্টিটিউট লাইব্রেরির বর্তমান চিত্র

শ্রমিকদরদি: শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ডান দিকে, বরাহনগরে অবস্থিত শশিপদ ইনস্টিটিউট লাইব্রেরির বর্তমান চিত্র

অর্ণব নাগ
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২২ ০৭:০০
Share: Save:

মে মাসের প্রথম দিনটি শ্রমজীবী-আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বাংলায় গেঁয়ো যোগীর ভিখ মেলে না, তাই এই বাংলায় শ্রমিক আন্দোলনের পথিকৃৎ মানুষটিকে যে বাঙালি বিস্মৃত হয়েছে, সে ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। তাঁর নাম শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম ১৮৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, বরাহনগরে। উনিশ শতকের সেই সময়টি বাঙালির ইতিহাসে তাত্ত্বিক বিতর্ক সত্ত্বেও নবজাগরণের কাল হিসেবে চিহ্নিত। এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবেই সাম্যবাদী চিন্তাধারা তখন বাঙালিকে প্রভাবিত করছিল। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের অভিঘাতে প্রভাবিত হয়ে এ দেশে শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বলতে আমরা আজ যা বুঝি, বাঙালির জীবনে তা শুরু হতে তখনও ঢের দেরি। ইংরেজ বণিকরা যদিও তখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সিপাহি বিদ্রোহের পর বণিকের মানদণ্ড যখন সত্যিই রাজদণ্ডে পরিণত হল, বরাহনগরে গঙ্গা-তীরবর্তী অঞ্চলে প্রচুর সুযোগ-সুবিধে থাকায় পাটশিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। আর চটকল স্থাপিত হওয়ায় চটকল-শ্রমিকদের কলোনিও স্বাভাবিক নিয়মে গড়ে উঠেছিল। এ ছাড়াও মজুরিতে সস্তা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানীয় অন্ত্যজ অধিবাসীদেরও এখানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা হত। ১৮৬৯ সালে বরাহনগর পৌরসংস্থা স্থাপিত হলেও অন্ত্যজ নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা ছিল না। এই পরিস্থিতিতে বাঙালি মধ্যবিত্ত মননে সাম্যের চিন্তা কী গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল, শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনই তার প্রমাণ।

কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী, পরবর্তী কালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজী শশিপদর সঙ্গে সমাজ-সংস্কারের ঘনিষ্ঠ সংযোগ আযৌবন। হিন্দু-মুসলমান যৌথ ধর্মসাধনায় তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান ‘দেবালয়’ আজও বিধান সরণির ওপর অতীতের সাক্ষ্যবাহী। তিনি বরাহনগরে অন্ত্যজ মানুষের প্রতি স্থানীয় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্ণের মানুষের দুর্ব্যবহার লক্ষ করে খুব কষ্ট পেতেন। নিজে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের জন্য সামাজিক বয়কটের মধ্যে পড়েছিলেন, এমনকি নিজ গৃহে পরবাসী হয়েছিলেন, শ্বশুরবাড়িতেও তাঁর ঠাঁই হয়নি। সুতরাং শ্রমজীবীদের পাশে দাঁড়ালে যে অসীম সামাজিক দুঃখকষ্ট ও গঞ্জনা তাঁর কপালে জুটবে, তা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তবুও ট্রেজারি অফিসের কেরানি শ্রমিক-স্বার্থে কোনও রকম আপস করতে রাজি ছিলেন না।

ইতিমধ্যে ১৮৬৭ সালের ৬ জুন রামমোহন রায়ের জীবনীকার মিস মেরি কার্পেন্টার এ দেশের এক সভায় ইংল্যান্ডের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর বক্তৃতা প্রভাবিত করে শশিপদকে। শ্রমিকদের অসহনীয় পরিস্থিতির কথা অনেক দিনই তাঁর কানে এসেছিল। ১৮৬৬ সালের ১ নভেম্বর তিনি স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়ে এক সভা ডেকে তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা স্বকর্ণে শোনেন। তাঁর উপলব্ধি হয়, শিক্ষা না পেলে কখনও শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ে সমর্থ হবেন না। সেই সভায় নিজের বক্তব্যে তিনি শিক্ষার গুরুত্ব ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। সেখানেই তিনি শ্রমিকদের জন্য বরাহনগরে সূচনা করেন নৈশ বিদ্যালয়। কিছু দিনের মধ্যেই এই বিদ্যালয়ের জনপ্রিয়তা এত দ্রুতগতিতে বাড়ে যে, এর শাখা খুলতে হয় বরাহনগরের আশপাশে আড়িয়াদহ, কুঠিঘাট, কামারপাড়ায়। এই ভাবে শ্রমজীবীদের শিক্ষার অধিকারের যে আন্দোলনের সূচনা তিনি করলেন, তা ক্রমে আরও গতি পেল, যার বিস্তার আমরা দেখতে পাই শ্রীরামপুরের কাছে শ্রমিকদের পুত্র-কন্যাদের জন্য একটি চালু হওয়া একটি বাংলা বিদ্যালয়ের মাধ্যমে।

১৮৭৯ সালে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারত শ্রমজীবী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে ‘নিবেদন’ শিরোনামে শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে শিক্ষার সবিশেষ গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছিল— ‘প্রিয়তম শ্রমজীবীগণ! বহুকাল হইতে তোমাদের দুঃখ আরম্ভ হইয়াছে, আজিও তাহার শেষ হইল না। তোমাদের যে দুঃখ তাহা আর দূর হইল না। পূর্বেও যেমন বড়লোকে তোমাদিগকে ছোটলোক বলিয়া ঘৃণা করিত এখনও তোমাদিগকে সকলে তেমনি ঘৃণা করে, পূর্বেও যেমন সারাদিন খাটিয়া তোমরা পেট ভরিয়া খাইতে পারিতে না এখনও প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করিয়া পেট ভরিয়া খাইতে পার না; স্ত্রী পুত্র লইয়া দিন চালনা তোমাদের ভার হইয়াছে, তোমাদের বাঁচিয়া থাকা কেবল বিড়ম্বনা হইয়াছে। তোমরা গরিব। তোমরা লেখাপড়া জান না, তাই যে যত পারিল তোমাদের ওপর অত্যাচার করিয়া পার পাইল, তোমরা মনের দুঃখ মনেতেই থামাইয়া চিরদিন অত্যাচারীর অত্যাচার সহ্য করিতেছ। মনুষ্য সকলেই সমান। রাজাকে যে বিধাতা সৃষ্টি করিয়াছেন, তোমাদিগকেও সেই বিধাতা সৃষ্টি করিয়াছেন। ছোট বড় সকলেই এক ঈশ্বরের পুত্র। তবে তোমাদের দিন কান্দিয়া কাটাও কেন? তোমরা লেখাপড়া জান না, সেই জন্যই তোমাদের সকল দুঃখ। তোমাদের দুঃখে আমরা দুঃখী হইয়াছি, তোমাদের চক্ষের জল আর আমরা দেখিতে পারি না। তোমরা ভাল না হলে, তোমরা সুখী না হইলে আমরা ভাল, আমরা সুখী হইতে পারিব না। দেশের বড়লোক কয়জন? তোমরাই সকল, তোমাদেরই দেশ। তোমরা যদি লেখাপড়া শিখ সহজেই তোমাদের দুঃখ ঘুচিবে, দেশের মঙ্গল হইবে। তোমরা যাহাতে লেখাপড়া শিখিতে পার, তোমাদের চক্ষের জল যাহাতে দূর হয় সেই জন্যই আমরা এই কাগজখানা প্রকাশ করিতেছি। যাহাতে তোমাদের কষ্ট দূর হয় আমরা তাহা তোমাদিগকে বলিয়া দিব। তোমরা পাঠ করিয়া উপকার লাভ কর, ইহাই আমাদের নিবেদন।”

শিক্ষার সঙ্গে তিনি শ্রমিক শ্রেণির সামাজিক উন্নতিতেও সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৬৬ সালে তিনি বরাহনগরের বুকে শ্রমিকদের জন্য ‘সামাজিক উন্নতিসাধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সামাজিক বিধিনিষেধে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের একই বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার ছিল না, তা সে হিন্দুরা অন্ত্যজ শ্রেণির হলেও। এই বাস্তবতা অনুধাবন করে ১৮৭২ সালের ২০ অক্টোবর এক সভায় বরাহনগর অঞ্চলের মুসলমানদের আহ্বান করলেন। সেই বছরের ২০ ডিসেম্বর তাদের জন্য স্থাপিত হল স্কুল।

শ্রমজীবীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তিনি ছিলেন অক্লান্তকর্মা। সব সময় তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন। তাঁদের অসুখে-বিসুখে, আর্থিক প্রয়োজনে, সুখ-দুঃখের প্রয়োজনীয় খবর তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করতেন। ১৮৬৬ সালে বরাহনগর অঞ্চলে ঘোর দুর্ভিক্ষে বা তার বছর চারেক বাদে এক বার কলেরার সময় শশিপদর মহান সেবাব্রতীর ভূমিকা অবশ্যই স্মর্তব্য। এ ছাড়াও ১৮৬৭ সালের নভেম্বর মাসে ভয়ঙ্কর ঝড়ের সময়ে অসহায়, গৃহহীন শ্রমিকদের জন্য সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষাপ্রার্থনা করেন তিনি।

ক্রমশ তিনি উপলব্ধি করছিলেন, মালিকের থেকে ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায় করতে গেলে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকাটাও জরুরি। তবে বোর্নিও কোম্পানির চটকল মালিকদের সঙ্গে তাঁর কোনও বিরূপতা ছিল না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষের মধ্যস্থতার ভিত্তিতে শ্রমিক শ্রেণির দাবি আদায়। এই লক্ষ্যে তিনি যে পুরোদস্তুর সফল হয়েছিলেন, পরবর্তী ইতিহাস তার সাক্ষী। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৭০ সালের অগস্টে ‘শ্রমজীবী সমিতি’ বা ‘ওয়ার্কিং মেনস ক্লাব’ নামে শ্রমিক সংগঠনের সূত্রপাত হয়। কুলদাপ্রসাদ মল্লিকের নবযুগের সাধনায় এই সমিতির সম্বন্ধে অনুপম বর্ণনা আছে: “যে দিন এই সমিতির অধিবেশন হইত, সে দিন শ্রমজীবিগণের আর আনন্দের সীমা থাকিত না, তাহাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা প্রভৃতি সকলেই এই নির্মল আনন্দে যোগদান করিত। শশিপদ বাবুর চেষ্টায় স্বর্গীয় দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র, স্বর্গীয় কালীশঙ্কর সুকুল প্রভৃতি খ্যাতনামা বক্তাগণ এই সমিতিতে যাইতেন ও নিয়মিতভাবে বক্তৃতা করিতেন। নৈতিক বিষয়ে ও চরিত্রগঠন সম্বন্ধে বক্তৃতা হইত।...”

তিনি বুঝেছিলেন, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করতে হলে কেবল তাঁদের আর্থিক উন্নয়নই যথেষ্ট নয়, ভবিষ্যতের কথা ভেবে সঞ্চয়ও প্রয়োজন। তাই প্রথমত ইংল্যান্ডের পেনি ব্যাঙ্কের অনুকরণে বরাহনগরের বুকে একটি ক্ষুদ্র আমানত সঞ্চয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘আনা ব্যাঙ্ক’ তৈরি করেন। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের স্মল সেভিংস ব্যাঙ্ক তখনও সে ভাবে প্রসার লাভ করেনি। দ্বিতীয়ত, সুরাপান নিবারণ আন্দোলন শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে নেশায় অর্থব্যয় রোধ করে তাদের টাকা জমানোর প্রয়াস আরও এক ধাপ এগিয়ে দেন। তৃতীয়ত, শ্রমিকদের পরিবারের মহিলাদের আর্থিক ও পারমার্থিক উন্নতিতে সভা-সমিতিতে তাঁদের প্রকাশ্য যোগদানের জন্য অবারিত দ্বার ও অবসরে মহিলাদের কুটিরশিল্পের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পথও উন্মুক্ত করে দেন। চতুর্থত, শ্রমজীবীদের বিনোদনের জন্য নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। পঞ্চমত, ‘বরাহনগর ধর্মসভা’ স্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি স্থানীয় শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিতেও সচেষ্ট হয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা এ দেশে তো বটেই, এমনকি বিদেশে বিশেষ করে ইংল্যান্ডেও অনুচ্চারিত ছিল না।

বঙ্গের এক অখ্যাতনামা পল্লিতে তাঁর এই কর্ম তুমুল প্রশংসিত হয়েছিল দেশ-বিদেশে। ‘ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ়’ বলেছিল, অনেকেই মুখে বড় বড় কথা বলেন, দিস্তের পর দিস্তে লেখা লিখে সমাজ-সংস্কারের তাৎপর্য সকলকে বোঝান; কিন্তু কাজের বেলায় তাঁরা অষ্টরম্ভা, সে দিক দিয়ে এক জন শশিপদ এক লক্ষ লোকের সমান। ‘ডেলি একজামিনার’-এর বক্তব্য ছিল, “বড়ই আনন্দের বিষয় যে কলিকাতা হইতে উত্তরে চারি মাইল দূরবর্তী বরাহনগর গ্রামে শ্রমজীবিগণের উন্নতিসাধন কল্পে যথার্থ কার্য হইতেছে। তথায় শ্রমজীবিগণের জন্য নৈশ বিদ্যালয়, শ্রমজীবিসমিতি ও সেভিংস ব্যাঙ্ক আছে। এই সমস্ত সদনুষ্ঠানের জন্য গ্রামবাসিগণ অশেষরূপে প্রশংসাভাজন শশিপদ বাবুর নিকট কৃতজ্ঞ। শশিপদ বাবু একটি বালিকাবিদ্যালয়, একটি বঙ্গবিদ্যালয়, সংস্কার সমিতি ও একটি পুস্তকাগার প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।” (কুলদাপ্রসাদ মল্লিক কর্তৃক অনূদিত)।

শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রমিক-দরদি কর্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ স্বনামখ্যাত দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ও: “শ্রমজীবীদিগের শিক্ষার নিমিত্ত আরও দুইটা নৈশবিদ্যালয় সংস্থাপন করিয়াছেন। শ্রমজীবীদিগের উন্নতিসাধনের দিকেই ইহার অধিকতর চেষ্টা ও উদ্যম লক্ষিত হইয়া থাকে। স্ত্রীজাতির উন্নতিসাধন কল্পেও ইহার বিশেষ যত্ন আছে। সামান্য লোকদিগের শিক্ষা ও উন্নতির জন্য বরাহনগরে যত চেষ্টা হইতেছে, আমাদিগের দেশের আর কোন স্থানেই এতাদৃশ চেষ্টা লক্ষিত হয় না। এমন কি, শ্রমজীবীদিগের উন্নতিকল্পে ইনিই প্রথম প্রস্তুত ও যাত্নিক হইয়াছেন, এপর্যন্ত একমাত্র ইনিই সেই কার্যে ব্রতী রহিয়াছেন। আর কোথাও যদি এসম্বন্ধে কিছু হয়, তবে তাহা ইহারই সাধু দৃষ্টান্ত অবলম্বন করিয়া হইবে। ইহাঁর নাম একার্য দ্বারাই প্রধান রূপে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে।” (নববার্ষিকী, ১২৮৭ বঙ্গাব্দ)

তিনি ১৮৭১ সালের এপ্রিল মাসে সস্ত্রীক বিলেত যান, দশ মাস পর ১৮৭২ সালের মার্চ নাগাদ বরাহনগরে ফেরেন। বিলেত যাত্রায় তিনি শ্রমিক শ্রেণির জন্য নবপরিকল্পনার রসদ সংগ্রহ করে আনেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল শ্রমিক শ্রেণির জন্য পত্রিকা প্রকাশ। বহির্জগৎ সম্বন্ধে শ্রমিকদের জ্ঞানগম্যি যাতে বৃদ্ধি পায়, তাঁদের ওপর অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার হলে তাঁরা যাতে প্রতিবাদ করতে পারেন এবং তাঁদের চিন্তাচেতনা ও সর্বোপরি দেশাত্মবোধ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পত্রিকা পরিচালনার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি।

পত্রিকার মাধ্যমেই শ্রমজীবীদের মতপ্রকাশ ও জীবনধারণের পূর্ণ অধিকারের কথা তিনি প্রথম ঘোষণা করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর হাতিয়ার ছিল ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত ‘বরাহনগর সমাচার’ ও তার পরের বছর প্রকাশিত ‘ভারত শ্রমজীবী’ পত্রিকা। বিশেষত অপেক্ষাকৃত দীর্ঘায়ু ‘ভারত শ্রমজীবী’ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি শ্রমের মহত্ত্ব, কোনও কাজ বা পেশাই যে ছোট নয়, তা প্রচারের চেষ্টা করতেন। পত্রিকার শিরোভূষণ ছিল একটি চমৎকার বাক্য: ‘শ্রমই মানুষের মহত্ত্ব’। অনবদ্য আর একটি কাব্যও শোভা পেত পত্রিকাটিতে—

“শ্রম নামে কল্পতরু অতি চমৎকার,/ যাহা চাবে, তাহা পাবে নিকটে তাহার।”

শিবনাথ শাস্ত্রী এর প্রথম সংখ্যায় তাঁর ‘শ্রমজীবী’ শীর্ষক প্রসিদ্ধ কবিতাটি লেখেন— “উঠ জাগো শ্রমজীবী ভাই/ উপস্থিত যুগান্তর/ চলাচল নারীনর/ ঘুমাবার আর বেলা নাই/ উঠ জাগো ডাকিতেছি তাই।”

শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মকৃতিত্ব বিশ্লেষণ করলে তাঁর শ্রমিক-দরদি ভাবমূর্তি ছাড়াও বলতে হয় তাঁর সেবাব্রতী ভূমিকা, শিক্ষাবিস্তারে উদ্যম, নারীশিক্ষায় ও প্রগতিতে অবদান, বিধবাবিবাহে ও সামগ্রিক ভাবে বিধবাদের উন্নতিকল্পে প্রয়াসের কথা। বরাহনগর হিন্দু বিধবাশ্রমের কথা এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে স্মরণীয়, গ্রন্থাগার স্থাপনে তাঁর অপরিসীম উদ্যোগের কথাও। তবে উনিশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তাঁর জীবনের অন্যতম সুকর্ম ‘আত্মোন্নতি বিধায়িনী সভা’-র মাধ্যমে বরাহনগরে এক দল আদর্শবাদী যুবগোষ্ঠী নির্মাণে সাফল্য। এই যুবগোষ্ঠীতে তিনি পেয়েছিলেন কালীকৃষ্ণ দত্ত, ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতচন্দ্র দত্ত, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ দত্ত, গোপালচন্দ্র দে, হরিনারায়ণ দাঁ প্রমুখকে। এঁদের মাধ্যমে শ্রমিক কল্যাণে তাঁর আরব্ধ কাজকে তিনি অগ্রসর করতে পেরেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে তাঁর অসামান্য জীবনীকার কুলদাপ্রসাদ মল্লিকের মন্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য: “শশিপদবাবুর জীবনের ঘটনাবলী আলোচনা করিলে দৃষ্ট হইবে যে, তিনি আমাদের দেশের সমগ্র সমস্যাকে সমগ্রভাবেই গ্রহণ করিয়া তাহার মীমাংসায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। সমাজ যে একটি অখণ্ড জীবনের বিকাশমাত্র (an organic unity) তাহা শশিপদবাবু বহুপূর্ব হইতেই উপলব্ধি করিয়াছেন।” এ দেশের শ্রমিক-আন্দোলনে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরিসীম অবদানের স্বীকৃতি প্রয়াত কিংবদন্তি ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে-র কণ্ঠেও: “সীমাবদ্ধতার মধ্যেই শ্রমজীবী সমিতি ও তার কাগজ ভারত শ্রমজীবী ভারতীয় শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে চেষ্টা করে।... শশিপদর মতো যারা উচ্চবর্গের হিন্দু ও ব্রাহ্মনেতারা শ্রমিকদের উন্নতির জন্য নানা গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তার নন-প্রোলেটারিয়ান চরিত্র থাকলেও, তাঁদের ভূমিকার গুরুত্ব তো অস্বীকার করা যায় না।”

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে তাঁর শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এক জন ব্যক্তিত্বকে স্মরণ না করলে ইতিহাসকে উপেক্ষা করা হয়।

তথ্যসূত্র: নবযুগের সাধনা: কুলদাপ্রসাদ মল্লিক; ব্রহ্মর্ষি শশিপদ: সময়-সমাজ-সাধনা: ড. সুনীতা বন্দ্যোপাধ্যায়; নববার্ষিকী: দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়; কলিকাতা দর্পণ: রাধারমণ মিত্র। প্রথম পর্ব

ব্যক্তিঋণ: কানাইলাল চট্টোপাধ্যায়, সুনীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রয়াত গৌতম নিয়োগী,
অনুপ মতিলাল, সৌমেন নাথ

প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থাগার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Brahmo Samaj May Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE