Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শত্রুর সঙ্গে লড়ে প্রেমে ধাক্কা খায়

এই সুপারহিরো অন্য গ্রহ থেকে আসেনি। তেজস্ক্রিয় মাকড়সার কামড়ে হয়ে উঠেছিল স্পাইডারম্যান। সম্প্রতি প্রয়াত হলেন তার স্রষ্টা স্ট্যান লি। ১৯৬২ সালের অগস্টে আত্মপ্রকাশ হল তার। পরের অংশটুকু ইতিহাস। মাত্র বারো সেন্টের সেই কমিকস বদলে দিল পুরো কমিকস দুনিয়াটাকেই। 

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

মাকড়সা-মানুষের ভাবনাটা যখন স্ট্যান লি তাঁর প্রকাশকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, পত্রপাঠ বাতিল হয়ে যায়। শুনতে হয়েছিল, কেউ কিনবে না ওই বই। বাজার দাপাচ্ছে তখন সুপারহিরোরা। যেন পাথর কুঁদে বানানো এক-একখানা অতিমানব, অসীম ক্ষমতাধর, আবেগের ছিটেফোঁটা নেই। মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ঘোরাফেরা তাদের। কমিকসের পাতায় তাদের কীর্তি পড়ে ভয়ভক্তিতে উদ্বেল হয় ভক্তকুল। আর স্ট্যান লি কিনা এমন চরিত্র বানাতে চাইছেন, যে নেহাতই এক ছোকরা, আমজনতার মতোই ভুলভ্রান্তিতে ভরা, ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে জেরবার! সেই বই নাড়া দেবে কী করে! নিজেদের রোজকার ঘষটে যাওয়া ঘ্যানঘেনে জীবনকে কি আর কেউ দুই মলাটের মধ্যে দেখতে চায়?

সেই হিরো আবার মাকড়সার মতো দেওয়াল বেয়ে ওঠে, চটচটে আঠালো জাল বোনে। আটপেয়ে ওই জীবকে কে না ঘেন্না করে? কিন্তু স্ট্যান লি প্রকাশকের বকাবকি মানলে তো! তাঁর জোরজবরদস্তিতেই শেষমেশ তৈরি হল স্পাইডারম্যান। ১৯৬২ সালের অগস্টে আত্মপ্রকাশ হল তার। পরের অংশটুকু ইতিহাস। মাত্র বারো সেন্টের সেই কমিকস বদলে দিল পুরো কমিকস দুনিয়াটাকেই।

স্ট্যানলি লাইবার, যাঁকে সারা দুনিয়া এক ডাকে স্ট্যান লি নামে চেনে, যখন ‘টাইমলি কমিকস’-এ চাকরি নিয়ে ঢোকেন, তখন তাঁর বয়স মোটে সতেরো। অফিস বয়-এর চাকরি, মাইনে সপ্তাহে আট ডলার। কাজ বলতে লেখক-শিল্পীদের ফাইফরমায়েশ খাটা, টুকটাক প্রুফরিডিং, লেখালিখি।

কমিকসের জগতে ‘টাইমলি কমিকস’-এর তত দিনে বেশ নামডাক করেছে। তিরিশের দশকের একেবারে শেষ দিকে মার্টিন গুডম্যান মালিকানায় এই সংস্থার পথ চলা শুরু। ১৯৪১ নাগাদ এই সংস্থা থেকেই শিল্পী জ্যাক কার্বি আর লেখক জো সিমোন-এর হাত ধরে বেরোল ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’। কিন্তু তুমুল জনপ্রিয়তার মাঝেই মালিকের সঙ্গে মন কষাকষির জেরে চাকরি ছাড়লেন কার্বি আর সিমোন। আর কোম্পানির অন্তবর্তীকালীন সম্পাদক হিসেবে গুডম্যান বেছে নিলেন উনিশ বছরের স্ট্যানলিকে। সামান্য পদ থেকে এক ঝটকায় উত্তরণ ঘটল তাঁর।

চল্লিশের দশককে বলা যায়, কমিকসের সোনার সময়। সুপারহিরোদের হাত ধরে বিক্রিতে তখন ভরা জোয়ার। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই অন্য রকম স্বর শোনা যেতে লাগল। অনেকেরই অভিযোগ, ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে গল্পের প্লট আর চরিত্র। বিক্রির তাগিদে ন্যায়নীতির বালাই থাকছে না গল্পের মধ্যে। উস্কানি দেওয়া হচ্ছে শিশু অপরাধকেও। কমিকসের ভক্ত শিশু থেকে বৃদ্ধ, তা হলে এমন নীতিহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া কেন?

কমিকস ইন্ডাস্ট্রি উদ্যোগী হয়ে তৈরি করল কমিকস কোড অথরিটি, যার কাজ বিষয়বস্তুর ওপর নজরদারি করা। এতে অভিযোগ ঠেকানো গেল ঠিকই, কিন্তু জনপ্রিয়তায় ভাটা এল। এই সময়েই টেলিভিশনের জনপ্রিয়তাও তুমুল বেড়ে ওঠায় জোরদার প্রতিযোগিতার মুখে পড়ল কমিকস দুনিয়া। কমিকসের বাৎসরিক বিক্রি প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ছুঁয়েছিল, সেখানে পরের ক’বছরে বিক্রি কমল প্রায় তিন-চতুর্থাংশ।

বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন লি নিজেও। টাইমলি কমিকস তখন নাম বদলে অ্যাটলাস কমিকস। এই কোম্পানির হয়ে তখন তিনি গল্প বানাচ্ছেন। প্রেম, কৌতুক, বিজ্ঞান, ভয়, সব ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর কলম। কিন্তু তৃপ্তি আসছে না। বাজারের খিদে মেটাতে মনের খোরাকটাই হারিয়ে যাচ্ছে যেন। হতাশ লি ঠিক করলেন, অন্য কোথাও হাত পাকাবেন। এই টানাপড়েনের সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর স্ত্রী। উৎসাহ দিলেন মনের কথাটাই শুনতে। লি-র স্বপ্ন একবারে অন্য রকম চরিত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার। সেটাই শুরু করার কথা বললেন। নতুন করে তো আর হারানোর কিছু নেই তাঁর।

ওই সময় কমিকস জগতের আর এক দাপুটে কোম্পানি ডিসি কমিকস তার সুপারহিরোদের উন্নততর সংস্করণ বাজারে আনে। আনামাত্রই হইচই। তাদের ‘জাস্টিস লিগ অব আমেরিকা’র অ্যাকোয়াম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, দ্য ফ্ল্যাশ, গ্রিন ল্যান্টার্নরা নিমেষে মন জিতে নেয় পাঠকদের। প্রতিদ্বন্দ্বীর সাফল্যে প্রমাদ গুনলেন স্ট্যান লি-র বস গুডম্যান। লি-কে বললেন, শিগগির সুপারহিরোদের এক নতুন টিম বাজারে নামাতে।

লি শুনলেন সেই নির্দেশ। কিন্তু তার সঙ্গে মেশালেন নিজের স্বপ্নকেও। জ্যাক কার্বির সঙ্গে ফের জোট বেঁধে লি ‘মার্ভেল কমিকস’ থেকে বের করলেন ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’। বাজারচলতি সুপারহিরোদের আদলে গড়লেন এক কাল্পনিক অসীম শক্তিশালী দলকে, কিন্তু তাদের মধ্যে পুরে দিলেন মানুষের দোষগুণ। লি-র সৃষ্ট সব চরিত্র এমনই। সমস্ত দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে থাকা অতিকায় অতিমানব নয় তারা। তাদের সুপারপাওয়ারের আড়াল থেকে উঁকি দেয় রক্তমাংসের মানুষও। তাঁর তৈরি চরিত্ররা টাকার চিন্তায় ব্যাকুল হয়, আয়রনম্যান অ্যালকোহলে ডুবে থাকে, স্পাইডারম্যান চাকরি নিয়ে, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে সমস্যায় ভোগে।

কমিকস দুনিয়া লি-কে চিনবে তাঁর স্পাইডারম্যানের জন্য, কয়েক দশক ধরে যে পাঠক আর দর্শকদের চোখের মণি হয়ে থেকেছে। লি নিজেও বলেছেন, স্পাইডারম্যান আর স্পাইডার ইউনিভার্স-ই তাঁর সবচেয়ে গর্বের জিনিস। হবে না-ই বা কেন? পিটার বেঞ্জামিন পার্কার নামের সেই হাইস্কুল ছাত্রের রেডিয়োঅ্যাকটিভ মাকড়সার কামড় খেয়ে স্পাইড্যারম্যান হয়ে ওঠার গল্পে তো তখন আচ্ছন্ন গোটা বিশ্ব! স্পাইডারম্যান তখন শুধু আমেরিকার সুপারহিরো নয়, আন্তর্জাতিক সম্পত্তি। অনাথ কিশোরটির সঙ্গে এক আত্মিক যোগ খুঁজে পায় পাঠকেরা।

এই সংযোগই ঘটাতে চেয়েছিলেন লি। সেই জন্যই স্পাইডারম্যান প্রেমে ধাক্কা খেয়ে ব্যর্থ প্রেমিকের মতো ভেঙে পড়ে, তার প্রেমিকা এক সময় মারাও যায় শত্রু হবগবলিনের হাতে। সুপারহিরো হয়েও স্পাইডারম্যান তাকে বাঁচাতে পারে না। কারণ, সে নিখুঁত নয়। ঈশ্বরও নয়। তার জীবনে হতাশা, প্রত্যাখ্যান, ব্যর্থতা সবই আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই।

স্ট্যান লি স্পাইডারম্যানকে বারবারই নিজের কৃতিত্ব বলে বর্ণনা করেছেন। তা নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। কিন্তু এ কথা সত্যি, কল্পনা তাঁর হাত ধরেই প্রথম পা রেখেছিল মাটিতে। সেই কৃতিত্ব ৯৫ বছর বয়সে সদ্যপ্রয়াত জাদুকরের একান্ত নিজস্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Marvel Comics Spider Man Stan Lee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE