E-Paper

বৌ-দিদির হোটেল

বৌদির হোটেল। শহর, মফস্সল, গ্রাম— রাস্তার ধারে চোখে পড়বেই এই নামের এক টুকরো ভাতের হোটেল। ভেঙে পড়া জীবনকে এই ভাতের থালাতেই দাঁড় করিয়েছেন ‘বৌদি’রা। তাঁদের জীবনের চড়াই উৎরাই, অন্দরমহল আর হেঁশেলের খোঁজ নিলেন দীপক দাস

দীপক দাস

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫২
ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

আট বছর বয়সে কলকাতা এসেছিলাম… দুটো ভাত খেতে,” খদ্দেরদের জন্য কাগজের থালায় ভাতের পাশে তরকারি সাজাতে সাজাতে বলছিলেন অণিমা জানা।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মোড়। কাছেই একটা পেট্রল পাম্প। সেটির গা ঘেঁষে কিছুটা এগোলেই অণিমার ভাতের হোটেল। ফুটপাতের উপরেই। চার দিক খোলা, উপরে টিনের ছাউনির দোকানকে কি হোটেল বলা যায়? না বোধহয়। ছাউনি দিয়েছেন বেশি দিন হয়নি। আগে তাঁবু খাটানোর মতো ঘেরা ছিল। তাতে রোদ আটকালেও জল ঠেকানো যেত না। ভেজা কাপড়ে খদ্দেরদের ভাত বাড়তে হত। নিজের ভাতের জোগানও। গায়েই শুকিয়ে যেত ভেজা কাপড়। এখনও বৃষ্টির ঝাপটায় খুব একটা যে সুবিধে হবে, তা নয়।

অণিমা আদতে অবিভক্ত মেদিনীপুরের মোহনপুরের বাসিন্দা। এখনকার প্রশাসনিক ভাগ অনুযায়ী পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় পড়ে মোহনপুর। ওড়িশা-ঘেঁষা এলাকা। বাড়িতে পাঁচ-ছ’টা পেট। বাবার এ দিক-ও দিক খাটার গোনাগুনতি পয়সা। তাতে অতগুলো পেট চলত না। বাধ্য হয়েই ভাতের খোঁজে প্রান্তবাসিনী বালিকার রাজধানীতে এসে পড়া। আট বছর বয়সে শিশুরা বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে, বায়না জোড়ে। তাদের ছায়ার নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চায়। সেই বয়সে ভাতের লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল অণিমাকে। ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল কোনও এক সম্পন্ন পরিবারে।

কেন এত জিজ্ঞাসা? জানতে চেয়েছিলেন অণিমা। ভাতের হোটেলে মেয়েদের লড়াই খুঁজতে বেরিয়েছি। শুনে চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অণিমা। বলেন, “লড়াই! লোকের বাড়ির এঁটোকাঁটা খেয়ে মানুষ। বাড়ির লোক পাতের ভাত তুলে রাখত। সেগুলোই খেতে দিত।” বলতে বলতে কি চোখ দুটো সজল হল বছর পঞ্চাশের অণিমার?

এখন একডালিয়ায় থাকেন একটা ঘরে। বিবাহিতা। তবে স্বামীর কথা বলতে উৎসাহী নন। খদ্দের আসে। সুবেশ মাঝবয়সি। সুবেশা তরুণী। ডালার গায়ে লাগানো কাঠের পাটায় থালা রেখে খান তাঁরা। কেউ প্লাস্টিকের টুলে বসে। কেউ দাঁড়িয়ে। চাহিদামতো খাবার এগিয়ে দিতে থাকেন অণিমা। ভাত, ডিম-মাছ-মাংস। কারও রুটি। খদ্দেরদের ঝাঁক চলে গেলে আবার কথা শুরু হয়। কলকাতায় আশ্রয় পেয়েই ভাতের লড়াই শেষ হয়ে যায়নি অণিমার। টেলিভিশনের ধারাবাহিকের মতো পর্ব থেকে পর্বান্তরে চমক দিতে দিতে চলেছে তাঁর জীবন। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অনেক কিছু করেছেন। প্রথমে একডালিয়ার কাছে চপের দোকান করেছিলেন। বেশি দিন চলেনি। তার পর আবার লোকের বাড়িতে কাজ। একটা সময়ে হোটেলেও কাজ করেছিলেন। বছর দশেক আগে ফাঁড়ির কাছের ফুটপাতে দোকান দেওয়া। প্রথমে চা, রুটি, পরোটা, আলুর দম, ঘুগনি। কিন্তু করোনা-অতিমারির লকডাউনের পরে সে দোকান চলছিল না একেবারে। আস্তে আস্তে ভাত দিতে শুরু করেন।

এখন নিয়মিত খদ্দের পেয়ে গিয়েছেন। তাঁদের কাছে তিনি দিদি, বৌদি, কাকিমা। একটি কমবয়সি ছেলে বড়মা বলেও ডাকলেন। রাত আড়াইটেয় উঠে আনাজপাতি কাটাকাটি শুরু করেন। চারটের সময়ে চলে আসেন দোকানে। চা বসিয়ে রান্না শুরু হয়। সকাল ন’টা থেকে ভাত পাওয়া যায় অণিমার হোটেলে। সন্ধেয় দোকান বন্ধ। জীবনের চক্র এখন এই পথ ধরেই গড়ায়। বাবা মারা যাওয়ার পরে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে। তা-ও বছর পনেরো-ষোলো হবে।

ঘরে থাকতে চেয়েছিলেন সেই মেয়েটিও। প্রেমের বিয়ে। সুখের ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিল তাঁর। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তাঁকে ভাতের হোটেলে নিয়ে আসেন স্বামী। ধরা যাক তাঁর নাম মালতী। বীজগণিতের নিয়মে যেমন নির্দিষ্ট সংখ্যাকে এক্স-এর আড়ালে রাখা হয়, তেমনই ‘ধরা যাক’-এর আড়ালে রাখতে হল মালতীর পরিচয়কে। জীবনের লড়াইয়ের কাহিনি বলতে রাজি মালতী। কিন্তু স্বনামে নয়। শর্ত ছিল এটাই।

কল্যাণী ঘোষপাড়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে পর পর কয়েকটা ভাতের হোটেল রয়েছে। সেগুলোরই কোনও একটি চালান মালতী। ঘর করার স্বপ্ন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে হোটেলে এসে। মালতীর কথায়, ভাতের হোটেল একলা চালানো যায় না। তাই স্বামী তাঁকে এনেছিলেন হোটেলে। কিন্তু কয়েক বছর পরে স্বামীর নেশা করা শুরু হল। হোটেল উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা। হাল ধরতে হল মালতীকে। এক সময় স্বামীর হোটেলে আসা বন্ধ করে দিলেন। না হলে হোটেল টিকিয়ে রাখা যেত না। বছর দুয়েক নিজেই চালাচ্ছেন। বাজারের ভারটা স্বামীর হাতে ছেড়েছিলেন। কিন্তু সে টাকাও নেশায় চলে যাচ্ছিল। ধার-দেনা বাড়ছিল বাজারে। বাজারের ভারও নিজেই নিয়েছেন। ছোট ছোট দুই সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে স্বামীর সঙ্গে ভাতের হোটেলে এসেছিলেন। এখন হোটেলের সঙ্গে গোটা সংসারটাই তাঁর কাঁধে। সে কাঁধ ঝোঁকেনি হাজারো সমস্যাতেও। এক দিন শাশুড়িমা জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “ছেলেটা মানুষ হল না। তুই না থাকলে…” বলার সময়ে মালতীর চোখ-মুখে লড়াই জেতার আলো।

বাংলার পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে এমন বহু অণিমা-মালতী। রাজধানীর বুকে কোনও কলেজের দেওয়ালে, প্রান্তিক জেলার গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে, আধা শহরের বাজারে তাঁরা গরম ভাতে জীবনের সন্ধান করে চলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কুমুদিনীকে কম সঙ্কটে ফেলেছিলেন! ‘ইন্দিরা’র কুমুদিনী। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে কালাদিঘির কাছে ডাকাতেরা পালকি লুট করল ইন্দিরা বা কুমুদিনীর। কুমুদিনী সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছিল রান্নার জোরে। ভালমানুষ গৃহিণী সুভাষিণীর বাড়িতে তার জায়গা পাকা হয় পাকা হাতের রান্নায়।

‘ইন্দিরা’ সাহিত্যের সঙ্কট। পরিস্থিতির শিকার হয়েও মেয়েটি কিছুটা সুবিধাপ্রাপ্ত। লেখক বিপদতারিণী করে পাঠিয়েছিলেন সুভাষিণীকে। বাস্তবের ইন্দিরাদের পাশে সুভাষিণী মেলে কদাচিৎ। নিজের লড়াই নিজেকেই লড়ে যেতে হয়। সে যেন অনন্ত লড়াই! সাল-তারিখ গুলিয়ে ফেলেন ইন্দিরারা। যেমন ভানুমতী। শলপ বাজার, হাওড়া জেলা। উড়ালপুলটা যেখানে শুরু হচ্ছে, বা শেষ হচ্ছে, তার কাছেই খাবারের দোকান ভানুমতী কোলের। অপরিসর লম্বাটে একটা দোকান। সকালে জলখাবার বিক্রি করেন। দুপুরে ভাতের হোটেল। সন্ধেবেলা তেলেভাজা, রাতে রুটি, তরকারি। সন্ধে-রাতে তার হোটেলে যাওয়া হয়েছিল। সামান্য আয়োজনই চোখে পড়েছিল। একটা টেবিলে খানতিনেক তরকারি। ডিম-মাংস, আনাজপাতির। পাত্রগুলো কোনওটাই খুব বড় নয়। একটা গামলায় ভাতও ছিল। ভানুমতীর লড়াইয়ের অস্ত্র।

সত্তর পার হয়েছে ভানুমতীর। ক্ষয়াটে চেহারা বহু ঝড়ঝাপটার সাক্ষী। বছরের হিসাব ভাল করে মনে রাখতে পারেন না। মনে রাখেন ‘আগেকার যুগের’ মানুষদের মতো, বড় ঘটনার হিসেব ধরে। কবে বিয়ে হয়েছিল? উত্তরে বলেন, “মার্টিন রেল বন্ধ হওয়ার দু’বছর আগে।”

মার্টিন রেল হাওড়া জেলার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ হাওড়ার ‘লাইফলাইন’ ছিল। সেই ট্রেন বন্ধ হওয়া একটা ঘটনা তো বটেই। ভানুমতীর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, তাঁর বিয়ে সম্ভবত ১৯৬৯ সাল নাগাদ হয়েছিল। ১৯৭১-এ ‘হাওড়া-আমতা লাইট রেলওয়ে’ বন্ধ হয়। জেলারই ধুরখালির মেয়ে। মানিক কোলের সঙ্গে ষোলো-সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই শলপের বাসিন্দা।

ভানুমতীর গল্প কিছুটা মালতীর মতোই। রান্নার ওস্তাদ ছিলেন মানিক। শহরের কোনও রেস্তরাঁয় কাজ করতেন। কিন্তু নেশাভাঙের প্রাবল্যও ছিল। দোকান করেও রাখতে পারলেন না। দেনার দায়ে বিক্রি করতে হয়েছিল। শেষে শলপ বাজারের ফুটপাতে খাবারের দোকান দেন। তখন শলপ বাজার এখনকার মতো এত জমজমাট হয়নি। ভানুমতী সন্ধেবেলা দোকানে এসে চপ, ফুলুরি ভাজতে সাহায্য করতেন। ধীরে ধীরে দুপুরের ভাতের হোটেলেও এসে বসা। না হলে হোটেল টিকিয়ে রাখতে পারতেন না। স্বামী মারা গিয়েছেন কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে। তার পর থেকে ভাতের হোটেল একা হাতেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আয়োজন সামান্যই। বাধা এসেছে বার বার। রাস্তা তৈরির সময়ে দোকান ভেঙে দিয়েছিল প্রশাসন। কাগজ, পলিথিনের ছাউনিতে ভাতের হোটেল চালাতেন। বৃষ্টিতে সমস্যা হত খুব। পরে দোকানটা একটু পিছিয়ে নিয়েছেন। অল্প অল্প ইট কিনেছেন। ধীরে ধীরে পাকা করেছেন তাঁর হোটেল। বছর পনেরো-কুড়ি হল। ছাউনি আর পাকা করতে পারেননি। সেটা টালির।

মানিক আর ভানুমতীর চার মেয়ে, দুই ছেলে। সকলেই বিবাহিত। ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তবে তাঁরাও নিজেদের লড়াইয়ে ব্যতিব্যস্ত। ভানুমতীর ভাতের হোটেল বার বার সরেছে, হাতছাড়া হয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁইও তেমনই। থাকতেন শলপ হাই রোডে। সরকারি জায়গায়। রাস্তা সম্প্রসারণের সময়ে সরতে হয়েছিল সেখান থেকেও। বাড়ি ভাঙা পড়ে। ভাড়াবাড়িতে গিয়ে উঠতে হয়। ভানুমতীর কথায়, “কুঁড়েঘরের মতো ভাড়াবাড়ি। তাতে আট জন থাকা। ভাড়াও দিতে পারতুম না সময় সময়।”

ছেলেদের বাড়ি আছে। ভানুমতী ছোট্ট হোটেলের ঘরেই থাকেন। পাড়ায় পুজো হওয়া রাধাকৃষ্ণ আর কালীপ্রতিমা চেয়ে এনে রেখেছেন দোকানে। পুজো করেন। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির অণিমাও বলছিলেন, সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে গোপালঠাকুরের সেবায় সময় কেটে যায়। খদ্দেরদের জন্য মাছ, মাংস রান্না করেন। কিন্তু নিজে নিরামিষ খান অণিমা।

“দিনে এক কেজি চালের ভাত হত। লোক কোথায় তখন? এত বড় বড় বাড়ি ছিল নাকি! তিনটে বড় বাড়ি ছিল এখানে। একটা সুচিত্রা সেনের বাড়ি, আর একটা বাড়িতে খুব গান হত। আর একটা ওই পাশে। আর ছিল কলেজের বাড়িটা। এলাকা ছিল নির্জন। সন্ধের পরে লোকজন আসতে চাইত না...” বলছিলেন অনিতা পট্টনায়েক। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের পাঁচিলের গায়ে বিশ্রামাগারের পাশে মেয়ে পম্পা আর বৌমা সোমাকে নিয়ে ভাতের হোটেল চালান। হোটেল বলতে ওই আর কী। তিন দিক খোলা। চতুর্থ দিকটা খোলা হওয়া ঠেকিয়েছে কলেজের পাঁচিল। মাথার উপরে অস্থায়ী ছাউনি।

অনিতার জীবন-সফর দীর্ঘ। শুধু সময়ের হিসাবে নয়, দূরত্বেও। পদ্মা-গঙ্গা এসে মিশেছিল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এই ফুটপাতে। ঢাকার মেয়ে অনিতা। আর তাঁর স্বামী সুভাষ পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘার। আট বছর বয়সে সুভাষ কলকাতায় চলে এসেছিলেন। নানা জায়গায় ঠেক খেতে খেতে এক সময়ে ভাতের হোটেল খোলেন। অনিতার কোনও এক দিদি চলে এসেছিলেন বালিগঞ্জের এই এলাকায়। দিদির বাড়িতে এসে বিয়ের কথাবার্তা। তখন পনেরো বছর বয়স অনিতার। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে হোটেলে। নির্জন সার্কুলার রোডকে ধীরে ধীরে সাজতে দেখেছেন নাবালিকা থেকে বৃদ্ধা হওয়া অনিতা। তাঁদের হোটেলের বয়সই বছর ষাটেক। যখন হোটেল শুরু করেন, তখন কলেজের শুধু মেন বিল্ডিং ছিল। তাঁদের হোটেলের কাছে ছিল একটা ঝিল। সেই ঝিল বুজিয়ে কলেজের নতুন বিল্ডিং হয় পরে। দু’চারটে বাড়ির, আর কলেজের রক্ষীদের ভরসায় চলত তাঁদের হোটেল। অবশ্য প্রথম দিকে হোটেলটা এই জায়গায় ছিল না। ছিল উল্টো দিকের ফুটপাতে। সেখানেএখন সকালের রান্না করেন অনিতারা। সকালে টিফিনের খাবার। দুপুরে ভাতের হোটেল। রাতে রুটি ও অন্য কিছু।

বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছেন সুভাষ। তার পর থেকে হোটেল নিজেই চালান অনিতা। ডাল পড়ে এক বার পুড়ে গিয়েছিল শরীর। ভর্তি থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে। মেয়ে আর ছোটছেলের বিয়ে দিলে তাঁর দায়িত্ব অনেকটাই শেষ, বলছিলেন অনিতা।

এই যে জেলায় রাজধানীতে পথের পাশে মেয়েদের পরিচালিত পাইস হোটেল, এগুলো কি শুধুই মালকিনদের জীবনের লড়াইয়ে সাহায্য করে? উত্তর খোঁজার আগে আর এক বার সাহিত্যের দ্বারস্থ হওয়া যাক। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘পল্লীচিত্র’। বইয়ের ‘দুর্গোৎসব’ অংশে এক দেওয়ানজির বাড়ির মহাধুমধামের পুজোর বর্ণনা রয়েছে। ভোজের রান্নার বিপুল আয়োজনের বর্ণনায় রসনা সিক্ত হবে। এ সবের মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে এমন একটি অংশ— “বারান্দায় বসিয়া পাড়ার অনাথা বর্ষীয়সী বিধবারা তরকারী কুটিতেছে; আলু, পটল, সূর্য্যিকুমড়ো ছোট ছোট করিয়া কুটিয়া বড় বড় ঝুড়ি বোঝাই করিতেছে।” সমারোহের জৌলুস যেন এক ঝটকায় কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে যায় এমন ছবিতে। ‘পল্লীচিত্র’টি যেন সেই ‘ইন্দিরা’রই পরিস্থিতির অন্য রূপ। রান্না জীবনধারণের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে অসহায়াদের। মেয়েদের ভাতের হোটেলগুলোতেও ১৯০৪ সালের ‘পল্লীচিত্র’ পুনরাবৃত্ত হয় প্রতিদিন। মালকিনের সঙ্গে সেই মেয়েদেরও জীবনের লড়াইয়ের সহায় হয় ভাতের হোটেলগুলো।

ফিরে যাওয়া যাক কল্যাণী ঘোষপাড়ায়। মালতীর হোটেলে কাজ করেন দুই মহিলা। এক জন কমবয়সি। আর এক জন বৃদ্ধা বিধবা। কমবয়সির বছর তিরিশেক বয়স। বিবাহিতা। কিন্তু ‘স্বামী ভাত দেয় না’। স্বামীর অনেক ‘গুণ’! সে মদ্যপ, জুয়া খেলে। স্বামী খেতে না দিলেও খেটে নিজের ভাত জোগাড় করে নিতে পারেন মেয়েটি। কিন্তু মদ্যপ স্বামী পেটায়। রোজকারের মারধর আর সহ্য করতে পারেননি তিনি। দুই সন্তানকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে গিয়েছেন। সেখানেও তো অভাব। এতগুলো পেট চলবে কী করে? তাই মালতীর হোটেলে কাজ নিতে হয়েছে দুই সন্তানের মাকে। সন্তানদের মায়ের কাছে রেখে হোটেলে কাজে আসেন। সন্ধের পরে ফিরে যান। জীবনের লড়াইটা একাই লড়তে হচ্ছে। বয়স্ক মহিলাটির ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু তাঁরাও নিজেদের জীবনের যুদ্ধে বেসামাল। হোটেলে কাজ করে মাকে নিজের ভাত জোগাড় করে নিতে হয়।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ির অণিমার হোটেলে কাজ করেন দিদি জয়ন্তী দাস। তিনি বিবাহিত। স্বামী ছোটখাটো কাজ করেন। ঘরে অভাব। বোনের দোকানে তাই কাজ করতে হয়। বোনের সঙ্গে প্রথম থেকেই আছেন তিনি। সার্কুলার রোডের অনিতার কাছে কাজ করেন তাঁর এক বোন অন্নপূর্ণা হালদার। বৃদ্ধার নামটি যেন তাঁর জীবনের প্রতি মূর্তিমান কটাক্ষ। শলপের ভানুমতী বড় মেয়েকে কাছে রেখেছেন। তাঁকে রান্নায় সাহায্য করেন। মেয়েরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে। অনেক ছোট থেকে কাজ করতে হচ্ছে তাঁকেও। এক সময়ে পুরীর হোটেলে কাজ করেছেন। তাঁর এক বোনকেও হাওড়ার কদমতলা শহরে কাজ করতে পাঠাতে হয়েছিল। চেষ্টা ছিল ভানুমতীর বড় মেয়ের জীবনের গল্প জানার। দু’-একটা প্রশ্নের পরে ভানুমতী বলে উঠলেন, “ওর কথা থাক। ওরও অনেক কষ্ট।”

বদল সময়ের ধর্ম। সেই ধর্ম মেনেই ‘পল্লীচিত্র’গুলো গঞ্জচিত্র হচ্ছে। তার পর আধা-শহরচিত্র। রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমান, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৬৮ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করবে। নগরায়ণের একটি অনিবার্য দিক হল, জীবনধারণে বদল। বিশেষ করে খাবারের জোগানে। গ্রাম-গঞ্জ থেকে কাজের খোঁজে মানুষের স্রোত রাজধানীমুখী হওয়ার পরেই বোধহয় পাইস হোটেলের সৃষ্টি। সস্তায় খাবার মেলে সেখানে। স্বল্পবেতনের কর্মীদের সুবিধে হয়। অন্যদেরও হয়। সেই কথাই বলছিলেন তো অনিতা। সার্কুলার রোডে শুরুর দিকে তাঁদের হোটেলের মূল খদ্দের ছিলেন এলাকার রক্ষীরা। যেমনটা দেখলাম কল্যাণী ঘোষপাড়ায়। সেলসম্যান, রিপ্রেজ়েন্টেটিভ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা খাচ্ছেন মালতীর ভাতের হোটেলে।

দ্রুত নগরায়ণে ভিড় বাড়ছে ছোট শহরগুলোতে। ফ্ল্যাটের সংখ্যাও বাড়ছে। খাবারের ‘হোম ডেলিভারি’র সুবিধেও মিলছে সেখানে। অ্যাপ-বাইকের বাইরেও ‘হোম ডেলিভারি’ করে সংসারের হাল ধরছেন দু’-এক জন। তাঁরা ওই ছোট শহরগুলোর ভানুমতী, অণিমা। ভাতের হোটেল করার সুবিধে বা উপায় নেই তাঁদের। বাড়ির হেঁশেলই তাঁদের হোটেল। সকালে ফোন করে বলে দাও। দুপুরে টিফিনে নিয়ে চলে এস খাবার।

বদল এসেছে আর একটা জায়গাতেও। সেটা রূপের বদল। এখন স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না হয়। সে কাজ করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা। এখন তাঁরা হোটেলও চালান। সে রকমই একটি হোটেলের সন্ধান মিলল আমতা-২ ব্লক অফিসে। এখানে ছয় দিদি মিলে চালান তৃপ্তি ক্যান্টিন। যাঁরা খেতে আসেন তাঁরা ‘দিদি’ বলেই ডাকেন এঁদের। ক্যান্টিনটি আমতা-২ উদয়ন মহাসংঘ পরিচালিত। নামে ক্যান্টিন হলেও আদতে ভাতের হোটেল। ব্লক অফিসের অফিসার ও কর্মী, অফিসে কাজে আসা লোকজন, পাশের কলেজের লোকজন, আশপাশের দোকানের কর্মীরাও দুপুরে খান এখানে। স্থানীয় আনাজ-নির্ভর রান্না। ঘরোয়া রান্না বলে যাকে। মরসুমে শেষ পাতে মেলে আমড়ার চাটনিও।

তৃপ্তি ক্যান্টিনের ছয় দিদি নানা বয়সের। সংঘের অফিস সামলান অনিতা পাত্র। তাঁর সহায়ক আরতি ঘোড়া। হেঁশেলের দায়িত্বে মিলি কুল, পূর্ণিমা পোড়েল, কাকলি চোংদার ও শিখা ধাড়া। প্রত্যেকের জীবনে লড়াই রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র আলাদা। কিন্তু মিল এক জায়গাতেই, সকলেরই বাঁচার লড়াই। অনিতা পাত্র হাওড়ার উত্তরপাড়ার মেয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। বিয়ের পর শহর এলাকা থেকে এসে পড়েন বন্যাপ্রবণ আমতায়। প্রথম সন্তান তখন গর্ভে। স্বামী তরুণ পাত্র যে কারখানায় কাজ করতেন, সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কারখানা থেকে কিছু পাননি। সংসারের হাল ধরতে অনিতা টিউশন পড়িয়েছেন। করেছেন টিপের কাজ। শাড়িতে জরি বসিয়েছেন। মায়ের মতো শাশুড়িকে লড়াইয়ে পাশে পেয়েছিলেন। সংঘে কাজ শুরু ২০০৩ সাল থেকে। প্রথমে গ্রুপের খাতা সারানো, ন্যাপকিন তৈরির কাজ করেছেন। করেছেন ক্যান্টিনের বাসন মাজার কাজও। বাংলা ও হিন্দি ভাল জানতেন বলে শহরের নানা দায়িত্ব পেতেন। তার পর এক সময়ে সংঘের দায়িত্বে। বছর সাতেক আগে স্বামীর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়। তিন মেয়ে নিয়ে আবার আতান্তরে পড়েন। গ্রুপের কাজ তাঁকে রক্ষা করে। এক সময়ে ৪০০ টাকা দিয়ে সাইকেল কেনার ক্ষমতা ছিল না। এখনস্কুটি কিনেছেন কিস্তিতে। জেলা পরিষদের সদস্য অনিতা পাত্র।

আরতিদিদির স্বামীর রোজগার কম ছিল। ‘লোহার লাইন’-এ কাজ করতেন তিনি। সংসারে সাহায্য করতে আরতিকেও নানা ছোটখাটো কাজ করতে হয়েছে। শাশুড়ির পরামর্শে স্বনির্ভর দলে যোগ দেওয়া। অনিতাদিদির বছরখানেক পরে।এক সময়ে স্বনির্ভর দলের প্রশিক্ষণে তাঁরা নিজেরাই রান্না করতেন।

ক্যান্টিনের হেঁশেলের মিলি কুলের স্বামী আনাজ-বিক্রেতা। পরিবারকে ভাল রাখতে মিলি ক্যান্টিনের রান্নার কাজ করেন। তাঁর দুই ছেলে কারিগর হয়ে উঠেছেন। পূর্ণিমাদিদির ছেলে স্নাতক হয়ে ভিন রাজ্যে কাজে গিয়েছেন। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কাকলিদিদির ছেলেও লেখাপড়া শিখে কাজ করেন। শিখাদিদি আগে মাঠেঘাটে কাজ করতেন। তাতে সংসার চালানো যেত না। সংঘের দিদিদের ধরেছিলেন, যদি একটা কাজ দেওয়া যায়। তাঁকে রান্নার কাজে নেওয়া হয়।

স্বনির্ভর দলগুলোর হেঁশেলে যাঁরা রান্না করেন, তাঁদের সামান্য হলেও বেতন থাকে। আর একটা সুবিধে হয়। গোষ্ঠী থেকে কর্মীদের বাচ্চাদের পুষ্টির দিকটা খেয়াল রাখা। কারও সন্তান দুর্বল হলে তার জন্য বিশেষ পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গল্পসল্প’ বইয়ে ‘বড়ো খবর’ দিয়েছিলেন। কাজের গুরুত্ব কার বেশি, তা নিয়ে মহাজনি নৌকার পাল আর দাঁড়ের তাল ঠোকাঠুকি। এক ধরনের ভাতের হোটেল রয়েছে, যেখানে স্বামী-স্ত্রী জীবনতরীর এই পাল ও দাঁড়। কিন্তু কোনও তাল ঠোকাঠুকি নেই। বরং তাল মিলিয়ে সংসার চালানোর অনিবার্য গরজটি প্রবল ভাবে রয়েছে। এ রকমই একটি হোটেল রয়েছে ঝিখিরার রাউতাড়ায়। আসলে এটি অর্ধেক বৌদির হোটেল। শুরু করেছিলেন স্বামী। প্রথম দিন থেকে সেই লড়াইয়ের স্ত্রীও শামিল। কানু হাজরা ছিলেন বাস-কন্ডাক্টর। কিন্তু সে কাজে সব সময় যাত্রীদের কথা শুনতে হয়। সেটা ভাল লাগত না কানুর। কন্ডাক্টরি ছেড়ে ঝিখিরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা খাবারের ঠেলা লাগান। বছর দশেক আগে। মুখরোচক বা সাড়ে বত্রিশ ভাজার ঠেলা নয়, ভাতের ঠেলা। কানু আগে ট্রাকে কাজ করতেন। রান্না করতে হত নিজেকেই। সেই অভিজ্ঞতার ভরসাতেই হোটেল খোলা। কন্ডাক্টরি ছেড়ে যে দিন রাস্তায় এসে নেমেছিলেন, সে দিন পাশে পেয়েছিলেন স্ত্রী পুতুলকেও। দুই ছেলে, মেয়েকে ঘরে রেখে পুতুলকেও হাতে হাতে কাজ করতে হত। পুতুল বলছিলেন, একটা ভাতের হোটেল চালাতে তিন-চার জন লোক লাগে। লোক রাখার মতো অবস্থা তাঁদের ছিল না। তাই দু’জনে মিলে চালান।

এক সময় ঠেলা সরিয়ে রাস্তার পাশে একটা ঘর ভাড়া নেন। ঘর না বলে কুঠুরি বলাই ভাল। টালির চাল, প্লাস্টারহীন ইটের দেওয়াল। আড়ে-লম্বায় খান দুয়েক বেঞ্চি আর কাঠের পাটা পাতা। সেগুলোই খাবার টেবিল-চেয়ার। সকাল ন’টা থেকেই ভাত মেলে পুতুলদের হোটেলে। মূলত বাসের চালক-কন্ডাক্টরেরা তাঁদের খদ্দের। সে দিন দোকানে তিনটি থাক দেওয়া টিফিন ক্যারিয়ার ছিল। ও দিকে নজর করতে পুতুল জানালেন, যাঁদের তাড়া থাকে তাঁরা টিফিন ক্যারিয়ার রেখে যান। এক বার বাস থামিয়ে তুলে নেওয়া দুপুরের খাবার। আসলে এখন দোকান থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছে বাসস্ট্যান্ড। তাই টিফিন রাখা।

বাস রুটের উপরে নির্ভরশীল হোটেলগুলোর আশঙ্কা, বিশেষ করে এই প্রবল টোটো-অটোর যুগে। বাস রুট ধুঁকতে শুরু করলে হোটেলের খদ্দেরও কমে। হাওড়া জেলার গ্রামের দিকে এমন বন্ধ বাস রুটের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু ব্যতিক্রম হাওড়া-ঝিখিরা রুট। এই রুটে আগে বাস ছিল ৩২টি। এখন ৪২টি। ফলে পুতুলদের খদ্দেরও বেড়েছে।

ভাতের হোটেলের মেয়েদের জীবনে কি শুধুই লড়াই? নেই কোনও উত্তরণ বা খুশির ছোঁয়া? আছে। তার অনেক পরত। শলপের ভানুমতী ঘুরতে যেতে ভালবাসেন। বছরে এক বার বেরিয়ে পড়েন কোনও দলের সঙ্গে। তাঁর হোটেলে বসে এক পরিচিতা বলছিলেন, বহু তীর্থে ডুব দিয়েছেন ভানুমতী। ঘুরে এসেছেন কুম্ভমেলায়।

সার্কুলার রোডের অনিতা পথকুকুরদের খাওয়ান। প্রয়োজনে চিকিৎসাও করান নিজের খরচে। অতিমারির লকডাউনের সময়ে এলাকার ৬০টি কুকুরের জন্য ভাত রাঁধতেন। ভাতের বিরাট ডেকচি দেখে পুলিশ জিজ্ঞাসা করত, হোটেলে কেউ খাচ্ছে না তো!

বালিগঞ্জ ফাঁড়ির অণিমা হয়েছিলেন এক শিল্পীর মডেল। এক বার নাকি কোনও এক শিল্পী সারা দিন বসে ছবি আঁকছিলেন, তাঁর হোটেলের কাছে ফুটপাতে বসে। অনেক ক্ষণ পরে কী আঁকছেন দেখতে উঁকি দিয়েছিলেন অণিমা। দেখেন, ক্যানভাসে তাঁদের দুই বোনের জীবনের ছবি। তাঁরা রান্না করছেন, দিদি বাসন মাজছেন, এ রকম টুকরো টুকরো জীবন।

মালতীর খুশি? হোটেল চালিয়ে এক সন্তানকে আইন পড়িয়েছেন। আর তৃপ্তি ক্যান্টিনের আরতিদিদি বলছিলেন, “এক সময়ে মেয়েকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। এখন মেয়ে নার্স হয়েছে।”

গরম ভাতে জীবনের সন্ধান।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rice hotel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy