Advertisement
০৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Charles Darwin

বাংলার পাখির লড়াই থেকেই সঙ্গী নির্বাচনের নতুন দিশা

বুলবুলি বা মোরগের লড়াইয়ের কথা চিঠিতে জানতে পেরেছিলেন চার্লস ডারউইন। তথ্যটিতে ছিল ইচ্ছাকৃত আলো-আঁধারি। কিন্তু তাতেই প্রভাবিত হল যৌন নির্বাচনের তত্ত্ব। এক পুরুষ প্রাণীর সঙ্গে অন্য পুরুষ প্রাণীর যুদ্ধ হয় সঙ্গিনী দখলের জন্যই।

দিশারি: বিবর্তন-বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, পশুপ্রেমী নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ (মাঝে) এবং তৎকালীন এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক এডওয়ার্ড ব্লাইথ (ডান দিকে)

দিশারি: বিবর্তন-বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, পশুপ্রেমী নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ (মাঝে) এবং তৎকালীন এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক এডওয়ার্ড ব্লাইথ (ডান দিকে)

প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৬
Share: Save:

উনিশ শতকের গোড়ার দিকটায় বাঙালির হুজুগের মধ্যে অন্যতম ছিল পাখির লড়াই। এই সব লড়াইয়ের আয়োজন করতেন শহরের বিখ্যাত বনেদি বাবুরা। পোস্তার রাজা বা ছাতুবাবুর মতো ধনী পৃষ্ঠপোষকদের প্রচেষ্টায় শহরের বিভিন্ন ছোট-বড় ময়দানে এই সব লড়াইয়ের আয়োজন হত। সেই লড়াই দেখতে ভেঙে পড়তেন শহরের বিত্তবান থেকে নিঃস্ব, সকলেই।

কোম্পানির সরকার তখন সমগ্র উপমহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে ব্যস্ত এবং তাদের নব্য রাজধানী রূপে কলকাতা তখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান শহর। যদিও কথায় আমরা বলি ‘ইংরেজ রাজত্ব’, তবু সেই সাম্রাজ্যে কিন্তু বাঙালি অংশীদারি কম ছিল না। ইংরেজরা এ দেশের ভাষাও বুঝত না, এখানকার রীতিনীতিও বুঝত না। তাই তারা কাজ চালাত বাঙালি দেওয়ান, মুনশি আর কেরানিদের দিয়ে। সেই সুবাদে অনেক বাঙালি পরিবারের লক্ষ্মীলাভ হয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, ছাতুবাবু-লাটুবাবু কিংবা ‘হুতোম’খ্যাত কালীপ্রসন্ন সিংহ, সকলেরই সমৃদ্ধির শিকড় সেই সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসেরই অঙ্গ। ইংরেজদের জয়যাত্রার শুরু থেকে তাদের সমৃদ্ধির মধ্যাহ্ন পর্যন্ত যেখানেই ইংরেজ রাজত্ব বিস্তৃত হয়েছে, সেখানেই বাঙালি বাবুদেরও প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে। যদিও পরবর্তী কালে এই বাঙালিরাই আবার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন, তবুও আধুনিক বাঙালির ধনসম্পত্তি ঠাটবাট যে অনেকটাই ইংরেজ উপনিবেশেরই ফলশ্রুতি, তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। তাই ইংরেজ সাম্রাজ্যকে ইঙ্গ-বঙ্গ সাম্রাজ্য বললেও খুব একটা ভুল হবে না।

আমার বর্তমান উদ্দেশ্য অবশ্য শুধু বাঙালিদের ইংরেজ রাজত্বের ছোট তরফ রূপে প্রতিপন্ন করা নয়। বরং বাঙালি বাবুবৃত্তান্ত এবং ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির সম্পৃক্ত ইতিহাসের একটি উপেক্ষিত দিককে তুলে ধরতে চাই। চমকপ্রদ সেই দিকটা হল পাখির লড়াই আর বিজ্ঞানের অধুনাবিস্মৃত এক ইতিহাস।

বিবর্তনবাদের জনক

আমাদের এই বিস্মৃত ইতিহাসের নায়ক চার্লস ডারউইন। তাঁর অন্যতম কীর্তি প্রাণিজগতের বিবর্তনের তত্ত্ব আবিষ্কার। তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজের চিরাচরিত বাইবেল-বিবৃত নৈসর্গিক উৎপত্তির আখ্যান, এবং বিশেষ করে ঈশ্বর দ্বারা মানুষ সৃষ্টির উপাখ্যান— এর মূলে আঘাত হানে ডারউইনের নতুন আবিষ্কার। বিবর্তনের এই নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কেবল ইউরোপ বা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শিক্ষিত সমাজেই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ধার্মিক সৃষ্টিতত্ত্বের ভিত নাড়িয়ে দেয়।

ডারউইন তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা সবিস্তারে প্রথম লেখেন ‘দি ওরিজিন অব স্পিশিস’ (১৮৫৯) গ্রন্থে। তবে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রগাঢ় ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সেই বইয়ে ডারউইন মানব-সৃষ্টি সম্বন্ধে সরাসরি কিছু লেখেননি। এমনকি বইটির সর্বশেষ বাক্যে তিনি যে স্রষ্টাহীন সৃষ্টির একটি ইঙ্গিতমাত্র করেছিলেন, সেটুকুও পরবর্তী সংস্করণে তিনি বদলে সরাসরি স্রষ্টার ভূমিকার উল্লেখ করেন। ফলে ‘দি ওরিজিন অব স্পিশিস’-এর বিবর্তনবাদের মধ্যে মানব-সৃষ্টির কোনও প্রচ্ছন্ন বিবরণ ডারউইন আমাদের দেননি।

যা দিয়েছিলেন, তা হল প্রাণিজগতের বিবর্তনের একটি সর্বজনীন নিয়মাবলি। সেই নিয়মগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ বা ন্যাচারাল সিলেকশন। এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূল কথা হল, যে কোনও জাতির প্রাণী নিজের অভ্যন্তরীণ কারণেই নিত্যনতুন রূপের উত্তরসূরিদের জন্ম দেয়, তার মধ্য থেকে প্রকৃতি কিছু রূপকে নির্বাচিত করে। সেগুলি টিকে যায় এবং বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। বাকিরা কালের অতলে ডুবে যায়। এই ভাবেই নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হতে থাকে।

মানুষের জন্য নতুন বই

মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বটি প্রযোজ্য কি না, তাই নিয়ে নানা দ্বিমত দেখা দেয়। উপরন্তু যেহেতু বিবর্তন সংক্রান্ত বাগ্‌বিতণ্ডার একটি অন্যতম মাত্রা ছিল বর্ণবৈষম্য। তাই মানুষের উৎস সন্ধানে সংস্কৃতিকে বাদ দেওয়ার বিশেষ অবকাশ ছিল না। অনেকের মতে, কুকুর-বাঁদরের ক্ষেত্রে বিবর্তনের ভূমিকা থাকলেও মানুষের মতো সভ্য জীবের রূপ কখনওই জৈব বিবর্তনের মূক শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। সেখানে সংস্কৃতির একটি ভূমিকা অপরিহার্য।

ডারউইন ১৮৭১ সালে ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান’ নামে নতুন একটি বই প্রকাশ করেন। এতেই তিনি মানুষের উৎসের জটিল সমস্যার আলোচনা করেন। তত দিন বিবর্তনবাদ শিক্ষিত ইংরেজ সমাজে বেশ প্রভাবশালী। সকলে স্বীকার না করলেও, তৎকালীন ইংরেজ পণ্ডিত মহলে অনেকেই ডারউইনের পক্ষ নিয়েছেন। এমত সময় ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান’-এ ডারউইন মানুষের উৎস এবং বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে নতুন একটি তত্ত্বের অবতারণা করেন। তিনি বলেন, যদিও বিবর্তনের মৌলিক শর্ত হল প্রাকৃতিক নির্বাচন, প্রাণিজগতের উপরের তলাগুলিতে আর জোরালো একটি প্রকরণ বিবর্তনের গতি নির্ধারণ করে। সেটি যৌন নির্বাচন বা সেক্সুয়াল সিলেকশন। এই যৌন নির্বাচনের সার কথা হল, এখানে প্রকৃতি নামক অলীক সমষ্টির বদলে নির্বাচকের ভূমিকায় প্রাণীরা নিজেরাই। প্রজননের পূর্বে এই সকল প্রাণী অপর লিঙ্গের সমগোত্রীয় প্রাণীর মধ্য থেকে কিছু নির্দিষ্ট গুণ অনুসারে একটিকে চয়ন করে এবং তার মধ্য দিয়েই বংশবৃদ্ধি করে। যথা, একটি পুরুষ হয়তো একটি মহিলার সৌন্দর্য, ঘরোয়া স্বভাব বা মধুর কণ্ঠস্বর দেখে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। অন্য দিকে মহিলাটি হয়তো বীর, বলিষ্ঠ বা বুদ্ধিমান
পুরুষকে বেছে নেবেন।

ঘরে বসেই তথ্যসন্ধান

তবে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তো কল্পিত আখ্যায়িকা নয়। তার আকর হল তথ্য। এবং সেই তথ্যই ডারউইনের যৌন নির্বাচনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে কলকাতার পাখির লড়াইয়ের যোগসূত্র। আজকাল বিজ্ঞানীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ অনেকটাই নিয়মবদ্ধ। সে তথ্য প্রয়োগশালা-প্রসূতই হোক, আর ক্ষেত্রসমীক্ষা-নির্ভরই হোক। কিন্তু ডারউইনের সময়, অর্থাৎ উনিশ শতকের মাঝামাঝি এমন ছিল না। বিজ্ঞানীরা তখন সদ্য নব্য বিজ্ঞানের নিয়মকানুন নির্ধারণ করছেন। তথ্য সংগ্রহের কোনও সুপরিকল্পিত প্রথানুগ প্রণালী তখনও কায়েম হয়নি। যে বিজ্ঞানী যেমন করে পারেন তাঁর তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা করেছেন।

ডারউইন নিজে যুবাবস্থায় বিগল নামের জাহাজে চেপে প্রশান্ত মহাসাগর পরিক্রমা করেছিলেন বটে, কিন্তু তার পর থেকে ঘরকুনো ভদ্রলোক আর বিশেষ কোথাও যাননি। বরং তিনি চিঠিচাপাটির মাধ্যমে এবং নানা গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা পাঠের মাধ্যমেই তাঁর তত্ত্বগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করার খোরাক খুঁজে নিয়েছেন। এবং সেই ভাবেই তিনি জানতে পারেন পাখির লড়াইয়ের কথা।

‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান’-এ মানুষের বিবর্তনের বিবরণ দিতে গিয়ে ডারউইন শুরু করেছেন অন্য নানা জীবজন্তু দিয়ে। এদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন তিনি পক্ষী প্রজাতির আলোচনায়। সাকুল্যে তাঁর বইটির দুটি খণ্ডে চারটি অধ্যায় পুরোপুরি পক্ষী বিষয়ক। এতটা জায়গা ডারউইন আর কোনও জীবকেই দেননি। এই পক্ষপাতিত্ব অপ্রত্যাশিত নয়। ডারউইন চিরকালই পাখিদের মধ্য দিয়েই সব চেয়ে সাবলীল ভাবে নিজের ধারণাগুলো গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বটিও ছিল গালাপাগোস দ্বীপের নানা প্রজাতির ফিঞ্চ পাখির ঠোঁটের আকারের তারতম্যের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল।

তা ছাড়াও তিনি বাড়িতে পায়রা পুষতেন এবং অন্যান্য পায়রাপ্রেমীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন ধরনের কবুতরের জন্ম দিতেন। এই অভিজ্ঞতাও সরাসরি তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজে লাগে।

বিজ্ঞানের শখ, শখের বিজ্ঞান

আজকাল বিজ্ঞানীরা যদি বা তাঁদের ব্যক্তিগত শখের উল্লেখ করেন, তবে তা মূলত আত্মজীবনীর সার্বিকতা রক্ষা করতে, কিংবা বড়জোর তাঁদের কাজের অনুপ্রেরণা রূপে। কিন্তু ডারউইনের সময় ব্যক্তিগত শখ এবং পেশাদার গবেষণার মধ্যে এমন অস্পৃশ্যতা ছিল না। বরং তখনকার বিজ্ঞানটাই ছিল কিছুটা শখের মতো। ডারউইনের মতো বিজ্ঞানীরা গবেষণার দ্বারা কিছু আয় করতেন না। তাঁরা ছিলেন বিত্তবান পরিবারের, এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাও ছিল কিছুটা কবুতর ওড়ানোর সমগোত্রীয়। কেউ তাঁদের বলতে যায়নি যে, ঠিক নিয়মকানুন মেনে কী করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয় বা করতে নেই।

তাই ডারউইনের পাখি নিয়ে আগ্রহ, তাঁর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সামাজিকতা এবং অভিজ্ঞতা সবই ধীরে ধীরে এসে মিলেছে তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে। ডারউইনের বইগুলো পড়তে গেলে তাই আমরা বার বার খুঁজে পাই নানা টুকরো ঘটনা বা গল্প। এই সব অণুকাহিনির মালা গেঁথেই ডারউইন সৃষ্টি করেন তাঁর যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলি।

যৌন নির্বাচনের কথা ভাবতে গিয়ে যে সব অণুকাহিনি ডারউইনের চিন্তাকে প্রভাবিত করে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পাখির লড়াইয়ের প্রসঙ্গ। সে যুগে পাখি দেখা কেবল বৈজ্ঞানিক অভ্যাসই ছিল না, এটি ভদ্রসমাজের একটি বিশিষ্ট শখ রূপেও গণ্য হত। পাখি দেখার পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল আরও কয়েকটি আনুষঙ্গিক শখ, যেমন পাখির ডিম সংগ্রহ বা পাখি শিকার করে সেই মৃত পাখিগুলিকে ‘স্টাফ’ করে বাড়িতে সাজিয়ে রাখা। এই সব শখের জোগান দিতে আবার গড়ে উঠেছিল পাখির বইয়ের এক বৃহৎ এবং বহুমাত্রিক বাজার। উনিশ শতকের যে কোনও বনেদি গ্রন্থাগারেই তাই মেলে পাখি-সম্বন্ধীয় নানা বই। আর এই সব বইয়ের অক্লান্ত পাঠক ছিলেন ডারউইন। বইগুলি ছিল তাঁর বৈজ্ঞানিক তথ্যের প্রাথমিক ঠিকানা।

শুধু বই পড়াই নয়, বিশ্ব জুড়ে প্রায় যেখানেই ইংরেজ সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল, সেখানেই কারও না কারও সঙ্গে তিনি পত্রালাপ করতেন। পত্রলেখকদের একটি বিশ্বব্যাপী অন্তর্জাল ধীরে ধীরে সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন, এবং সেই অন্তর্জালের মাধ্যমেই তিনি পেয়ে যেতেন এমন অনেক খবর এবং অণুকাহিনি, যা ছাপা বইয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি।

বাংলার পাখির লড়াই

পাখি বিষয়ক বই এবং পত্রবিনিময়— এই দুইয়ের দ্বারাই ডারউইন বঙ্গদেশের পাখির লড়াইয়ের বিষয় অবগত হন। এই সমস্ত পাখির লড়াইয়ের অণুকাহিনির মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন ভারত তথা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের নানা পাখির লড়াইয়ের কথা। বাংলার বুলবুলি, লাল মুনিয়া, কোড়া এবং মোরগ লড়াইয়ের খবরগুলি ছিল অন্যতম। এই খবরগুলির দ্বিবিধ সূত্র ছিল টমাস ক্ল্যাভারহিল জের্ডনের লেখা, তিন খণ্ডে প্রকাশিত বিখ্যাত বই ‘দ্য বার্ডস অব ইন্ডিয়া’ এবং তৎকালীন এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক, এডওয়ার্ড ব্লাইথ। এঁদের দু’জনের মধ্যে ব্লাইথের সঙ্গে পত্রালাপই ছিল বিশেষ প্রভাবশালী।

এই সব চিঠির মাধ্যমেই ডারউইন ধীরে ধীরে তাঁর প্রাথমিক ধারণাগুলোকে পরিশীলিত করে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের স্তরে উন্নীত করতে সক্ষম হন। যেমন ব্লাইথের কাছেই তিনি জানতে পারেন যে কোড়া, জলাভূমির এক ধরনের বুনো মোরগ, পাখির মাথার থলথলে লাল ঝুঁটির মতো অবয়বটি শীতকালে সঙ্কুচিত হয়ে থাকে, কিন্তু বসন্তকাল এলেই সেটি আবার বর্ধিত এবং টুকটুকে লাল হয়ে ওঠে। এর উপর ভিত্তি করেই ডারউইন ‘আনুষঙ্গিক যৌন বৈশিষ্ট্য’ বা সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল ক্যারেক্টারিস্টিক্স-এর কথা চিন্তা করেন। তাঁর মতে এই সব আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্যই যৌন নির্বাচনের আদিকল্প। মানুষের ক্ষেত্রে যেমন তিনি পুরুষের গোঁফ-দাড়ি বা ভারী কণ্ঠস্বরের কথা ভাবেন।

পূর্বসূরির সূত্র ও ফারসি কবিতা

তবে ইতিহাসবিদ এভেলিন রিচার্ডস দেখিয়েছেন, ডারউইনের মাথায় যৌন নির্বাচনের মৌলিক একটি ধারণার উৎস অনেক পুরনো এবং ব্যক্তিগত। ডারউইনের উপর প্রভাব পড়েছিল তাঁর ঠাকুরদাদা ইরাসমাস ডারউইন সাহেবের। ইরাসমাস পেশায় ছিলেন ডাক্তার, কিন্তু তাঁর ঝোঁক ছিল মৌলিক বিজ্ঞানের দিকে। সেই সুবাদেই আঠারো শতকের শেষার্ধে তিনি আকৃষ্ট হন কার্ল লিনিয়াসের নতুন চিন্তার দিকে এবং গাছপালার যৌন জীবন নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটি পুরোপুরি কবিতার ছলে লেখা, কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি গাছেদের যৌন প্রজননের নতুন তত্ত্ব ইংরেজ সমাজে পৌঁছে দেন। সেই বই থেকেই তাঁর পৌত্র চার্লস, প্রথম যৌন প্রতিযোগিতা এবং যৌন নির্বাচনের কথা ভাবতে শুরু করেন।

আঠারো শতকের শেষের দিকে পিতামহ ডারউইন যখন তাঁর বৈজ্ঞানিক কবিতা রচনা করছেন, তখন ইংরেজ সমাজে কবিতার নতুন জোয়ার এসেছে। এই নতুন কবিতার উৎস সন্ধান মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলা তথা ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে করতে লেগে পড়ল, তখন তারা দেখল যে, মোগল প্রথা অনুযায়ী এ দেশের আইন-আদালতের কাজকর্ম সবই হয় ফারসিতে। ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, মেধাবী এবং চাকরিসন্ধানী ইংরেজ যুবকরা তাড়াতাড়ি লেগে পড়লেন ফারসি শিখতে। সকলেই কম-বেশি ফারসি শিখে যেতে তৈরি হল ফারসি কবিতার প্রতি নতুন আকর্ষণ।

যাঁরা চাকরি পেয়ে বাংলা শাসন করতে এলেন, তাঁদের মধ্যে আঠারো শতকের অন্যতম বিখ্যাত নাম নিঃসন্দেহে স্যর উইলিয়াম জোন্স। জজ হয়ে এলেন তিনি কলকাতায়। তাঁর বৃহৎ কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা। ফেরদৌসি, হাফিজ এবং সাদির মতো নানা ফারসি কবির অনুবাদ করে তাঁদের কবিতা ইংরেজ সমাজে পৌঁছে দেওয়াও তাঁর আর একটি বড় কীর্তি। আর পাঁচ জনের সঙ্গে পিতামহ ডারউইনও পড়লেন এই সব ফারসি কবিতা। সেই ফারসি কবিতার একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপমা স্থান পেল তাঁর বইয়ের একটি পাদটীকায়। এই উপমাটির মধ্যে দিয়েই পৌত্র ডারউইনের কাছে প্রথম পাখির প্রেমের খবর পৌঁছল।

বুলবুলি আর গোলাপের প্রেম

ফারসি প্রেমের কবিতার এই বহুব্যবহৃত উপমাটি হল গোলাপ ও বুলবুলের প্রেমের উপমা। কবিদের ভাষায় বুলবুলি ও গোলাপফুল যুগযুগান্ত ধরে একে অপরের প্রেমে দিওয়ানা, কিন্তু যে হেতু তাদের মিলন অসম্ভব, তাই তারা দু’জনেই দুঃখের গান গেয়ে নিজেদের নিঃশেষ করে দেয়। পরিণতিহীন প্রেমের ব্যথা এবং আত্মবিসর্জনের এই চিত্রটি বার বার ঘুরে ঘুরে এসেছে ফারসি কবিতায়। পিতামহ ডারউইন এই কাব্যিক উপমার উল্লেখ করে তাঁর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তবে সমসাময়িক ইংরেজ কবিরা এই চিত্রটিকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুললেন। লর্ড বায়রনের মতো রোমান্টিক কিন্তু পৌরুষসম্পন্ন কবিরা, বুলবুলির মজনুর মতো হাল ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুবরণ করাটা মানতে পারলেন না। বায়রনের লেখা ‘জিয়াউর’-এর মতো কবিতায় তাই প্রতিহত প্রেমিক নিছক আত্মবলিদানের দিকে না ঝুঁকে গর্জে উঠলেন বিধ্বংসী আক্রোশে। একা নিজেকে শেষ করার জায়গায় বিফল প্রেমিক এ বার চাইলেন তাঁর ব্যাহত প্রেমের আগুনে দুনিয়া পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে। গোলাপ ও বুলবুলের প্রেম ব্যর্থতার প্রতিমূর্তি না হয়ে তাই হয়ে উঠল প্রেমজনিত হতাশার ভয়াবহ পরিণতির ছবি।

এই সব কবিতাই ছিল চার্লস ডারউইনের বিশেষ প্রিয়। বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ-এর মতো রোমান্টিক কবিরা ছিলেন তাঁর প্রিয়তম। বায়রনের ‘জিয়াউর’ নামক বৃহৎ কবিতাটি তিনি জীবনে একাধিক বার আদ্যোপান্ত পাঠ করেছিলেন। দ্বিতীয় বার যখন তিনি এটি পড়ছেন, মোটামুটি সেই সময় থেকেই তিনি প্রথম প্রাণিজগতের যৌন প্রতিযোগিতার কথা চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু সেই অস্পষ্ট চিন্তাগুলিকে রূপায়িত করতে সাহায্য করে সেই সময় কলকাতা থেকে লেখা ব্লাইথের কয়েকটি চিঠি। এই চিঠির মাধ্যমেই ব্লাইথ ডারউইনকে আশ্বস্ত করেন যে বাংলায় পুরুষ-পাখিরা নারী-পাখিদের জন্য নিজেদের মধ্যে নশ্বর জীবনের মায়া না করে মহাসমরে আবদ্ধ হয়।

অসম্পূর্ণ তথ্য ও আংশিক সত্য

বুলবুলি, মোরগ বা লাল মুনিয়াকে একে অপরের সঙ্গে লড়াই করাতে যে ধনী রাজারাজড়া বা জমিদাররা কত কাঠখড় পোড়ান, তা কিন্তু ব্লাইথ বলেননি। এও তিনি বলেননি যে, এই সব পাখি অনেক সময়ই, হাজারো প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও লড়তে নারাজ হয় এবং উড়ে পালিয়ে যায়। ব্লাইথের বিবরণে মনে হয়, যেন পাখিগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই হিংস্র এবং নারীসঙ্গ পেতে একে অপরকে শেষ করে দিতে রাজি আছে। এই লড়াইয়ের পিছনে মানুষের চেষ্টা, প্রশিক্ষণ এবং সার্বিক ভূমিকার প্রায় কিছুই তিনি জানাননি।

কেন ব্লাইথ এ সব খবর দিলেন না, তা বলা কঠিন। হয়তো তিনি নিজেই বুঝতে ভুল করেছিলেন। ভেবেছিলেন যে পাখিগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই হিংস্র। এও হতে পারে যে, তিনি মনে করেছিলেন হয়তো সবটা বললে ডারউইন এ সব তত্ত্বে আগ্রহী হবেন না। পাখির লড়াইয়ে মানুষের ভূমিকা নিয়ে ডারউইনের আগ্রহ থাকবে না। তবে এ সব সম্ভাবনার পাশাপাশি এ-ও সম্ভব যে, ব্লাইথ জেনেশুনে কিছু খবর চেপে গিয়েছিলেন।

প্রাণী ব্যবসায় লক্ষ্মীলাভ

আসলে ব্লাইথ লোকটি পণ্ডিত হলেও বিশেষ চরিত্রবান ছিলেন না। তাঁর ব্যয় চিরকালই আয়ের থেকে বেশি। আর তার জোগান দিতে তিনি ভারতের নানা রাজারাজড়া, নবাব, জমিদারের কাছে নানা বন্য পশুপাখি বিক্রি করতেন। ১৮৫৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, স্বয়ং ডারউইনকেই ব্লাইথ একটি ব্যবসায়িক প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। একটি চিঠিতে তিনি পায়রা-প্রেমী ডারউইনকে লিখলেন যে ডারউইনের পছন্দ মতো ভাল ভাল পায়রা ব্লাইথ তাঁকে খুব সস্তায় কলকাতা থেকে রফতানি করতে পারেন। তবে সরাসরি দামের বদলে ডারউইন যদি তাঁকে বিলেত থেকে কিছু জন্তু-জানোয়ার কিনে পাঠান, তিনি সেগুলো চড়া দামে ভারতে বিক্রি করবেন। বিশেষ করে ব্লাইথ চাইছিলেন যে, ডারউইন তাঁকে হয় ম্যাকাও পাখি কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার মার্মোসেট বাঁদর কিনে পাঠান। যে হেতু ইংরেজ সাম্রাজ্য তখন পৃথিবীব্যাপী, লন্ডনের বাজারে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকেই জিনিস আসত, যার মধ্যে ছিল এই সব জন্তু। তাই লন্ডনে এ সব জীবের দামও তেমন ছিল না। মাত্র তিন-চার পাউন্ডে তখন এক জোড়া ম্যাকাও লন্ডনে কেনা যায়, কলকাতায় যা বিরল। শৌখিন রাজা-রাজড়ারা তাই এক জোড়া ম্যাকাওয়ের জন্য ৫০ পাউন্ড পর্যন্ত দিতে রাজি। খুদে মার্মোসেট বাঁদর আবার অন্দরমহলের পোষ্য রূপে বিশেষ আকর্ষক, তাই তার দাম আরও চড়া। কলকাতার বড়লোকরা তাঁদের প্রিয়তমাকে খুশি করতে তখন এই বাঁদরের জন্য ১০০ পাউন্ড অবধি দিতে রাজি। ব্লাইথ এ সব জানিয়ে ডারউইনকে লোভ দেখালেন যে, যৌথ এই প্রচেষ্টায় নামলে ব্লাইথ যে কেবল ডারউইনকে ভাল ভাল পায়রা জোগাড় করে দেবেন তা-ই নয়, তাঁকে সে লাভের একটা অংশও দেবেন।

ঠকলেন মেটিয়াবুরুজের নবাব

জানা যায়, ডারউইন এই প্রস্তাবে রাজি হননি। তবে ব্লাইথের জন্তুর ব্যবসা তাতে থেমে থাকেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জীবজন্তু বেচে ব্লাইথ মুনাফার মুখ দেখেছেন। তবে সব চেয়ে বড় মুনাফা তিনি করেন অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলিকে ঠকিয়ে। ওয়াজিদ আলি চিরকালই পশুপ্রেমী। লখনউতে তাঁর বিশাল ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা ছিল। ইংরেজরা নির্বাসিত নবাবকে তাঁর প্রিয় পোষ্যগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসতে দেয়নি। তাই জলের দরে বাঘ-সিংহ, হাতি, নানা পাখি, বাঁদর ইত্যাদি লখনউতেই ইংরেজ তত্ত্বাবধানে নিলাম করে দেওয়া হয়েছিল। বেশির ভাগই কিনলেন ব্লাইথ। এ সব জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে তিনি কিছু পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনের বাজারে বিক্রির জন্য। আর বাকিগুলো কলকাতা এনে আবার ওয়াজিদ আলিকেই বিক্রি করলেন অস্বাভাবিক চড়া দামে। যে বাঘ লখনউতে মাথাপিছু ২০ টাকা দরে ব্লাইথ কিনেছিলেন, কলকাতায় নবাব ওয়াজিদ আলিকে তাঁরই প্রিয় পোষ্যগুলো ব্লাইথ মাথাপিছু ৩০০ পাউন্ডে বিক্রি করেন।

ব্লাইথের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল তুখোড়। তাই জন্তুগুলো বেচার আগে তিনি নিজেই বকলমে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেই সব জন্তুর বিষয়ে লেখালিখি করে বাজার গরম করতেন। তখনও ওয়াজিদ আলির কাছ থেকে কেনা জন্তুগুলো লন্ডন পৌঁছয়নি, ব্লাইথ নিজের নাম গোপন করে লন্ডনের একটি বহুলপ্রচারিত জীব-জন্তু সংক্রান্ত পত্রিকায় এই সব জন্তুর ভূয়সী প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। তখনকার বিজ্ঞাপনী ভাষায় এমন লেখাকে বলা হতো ‘পাফ’, অর্থাৎ ফুঁ দিয়ে একটি বস্তুর মূল্যকে ফাঁপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ব্যবসার উদ্দেশ্যে রং চড়ানো

১৮৫৪ সালে ৪৩ বছর বয়সে ব্লাইথ কলকাতায় বিয়ে করেন। তার পর তাঁর টাকার চাহিদা বেড়ে যায়। এর উপর পানদোষ। দু’-এক বার তাঁকে রাস্তায় মাতলামি করার জন্য পুলিশের হাতেও পড়তে হয়েছিল। ফলে যতই মুনাফা হোক, ব্লাইথের আর্থিক অবস্থা চিরকালই শোচনীয়। অনুমান করা যেতে পারে, ডারউইনকে লেখা চিঠিতে ভারতীয় পাখির তেজিয়ান হিংস্র চরিত্রের খণ্ডসত্য হয়তো ব্লাইথ কিছুটা ‘পাফ’ করার উদ্দেশ্যেও করেছিলেন। ডারউইনের মতো নামী, সম্ভ্রান্তবংশীয় ভদ্রলোকের লেখায় এই সব পাখির লড়াকু প্রকৃতির কথা পড়লে হয়তো, ব্লাইথ ভেবেছিলেন, লন্ডনের পশু-বাজারে বুলবুলি, লাল মুনিয়া বা কোড়ার মতো সাধারণ পাখির চড়া দাম হাঁকানো যাবে।

ব্লাইথের উপর নির্ভর করে যদিও ডারউইন ভাবলেন যে, এ সব পাখি প্রকৃতিগত ভাবেই যৌন হিংসা দ্বারা তাড়িত, পাখির লড়াইয়ের বাংলা বা উর্দু বিবরণগুলি থেকে কিন্তু দু’টি বিপরীত তত্ত্ব প্রমাণিত হয়। প্রথমত, পাখিগুলো অনেক সময়ই লড়তে নারাজ হত। তাদের নানা ভাবে তাতিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু তা-ও সব পাখি লড়ত না। লড়তে আনা অনেক বুলবুলি বা লাল মুনিয়া উড়ে পালিয়ে যেত। দ্বিতীয়ত, এই সব পাখিকে অনেক দিন ধরে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বিত্তবান পৃষ্ঠপোষকরা তাই দেশ-বিদেশ থেকে নাম করা প্রশিক্ষক আনতেন। পাখিরা ভাল লড়লে, পৃষ্ঠপোষক খুশি হয়ে প্রশিক্ষকদের মোটা ইনাম দিতেন। ওয়াজিদ আলির সঙ্গে লখনউ থেকে কলকাতা আসেন তাঁর নিজস্ব পক্ষী-প্রশিক্ষক, দারোগা গুলাম আব্বাস।

পাখি-প্রশিক্ষণের কদর সেই মোগল আমল থেকেই চলে আসছে। এক বার বাদশার দরবারে দেশ-বিদেশ থেকে আসা পক্ষী-প্রশিক্ষকরা স্থান পেয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে চিরস্মরণীয় বোখারা থেকে আসা আব্দুল লতিফ, হেরাত থেকে আসা মুমিন, সমরখন্দ থেকে আসা মকসুদ ও তার শিষ্য চেলা হিরানন্দ প্রমুখ।

জোর করে পাখির লড়াই

তবে মোগল যুগে পাখির লড়াই ছিল রাজা-রাজড়ার ব্যাপার। এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে আঠারো শতক থেকে। মোগল বংশের প্রতাপ তখন তলানিতে। লখনউ, মুর্শিদাবাদের মতো স্থানে নতুন সব ভুঁইফোড় রাজবংশ মসনদে বসেছে। প্রজাদের বশ করতে তাঁরা নানা সার্বজনীন অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এরই অন্যতম পাখির লড়াই। উনিশ শতকে কলকাতায় যখন অজ্ঞাতকুলশীল নতুন সব রাজা গজিয়ে উঠল, তখন তারাও এই একই প্রথা অবলম্বন করল প্রতিপত্তি বিস্তার করতে। তৎকালীন কলকাতার পাখির লড়াইয়ের দু’জন সব থেকে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পোস্তার রাজা সুখময়ের পুত্র নরসিংহ রায় এবং হাটখোলার আশুতোষ দেব, যিনি আজও ‘ছাতুবাবু’ নামে কলকাতাবাসীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

ঔপনিবেশিক ভারতের প্রথম যুগে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্থন হয়েছিল, তার মধ্যে দিয়েই নতুন কিছু রাজবংশ উঠে আসে। তাঁরা তাঁদের সামাজিক প্রতিপত্তি স্থাপন করতে পাখি-লড়াইয়ের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। সেই সুবাদে পাখিদের ধরে বা উঁচু দামে কিনে ভাল প্রশিক্ষকদের দিয়ে তাদের প্রশিক্ষিত করতে, অবশেষে নানা ভাবে তাদের তাতিয়ে দিয়ে শহরের কোনও এক খোলা মাঠে পাখিগুলোকে লড়ানো হত। এই লড়াইয়ের মধ্যে পাখির নিজের স্বকীয় বা সহজাত প্রবৃত্তির রেশ খুবই কম। বরং প্রাকৃতিক জীবের উপর মানুষের সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার ছাপটাই প্রকট। ব্লাইথের মধ্যস্থতায় ডারউইনের কানে সে খবর পৌঁছয়নি।

ডারউইন কেবল পাখির লড়াইয়ের কথাই জানলেন, তার সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর কথা জানলেন না। আর জানা না-জানার এই আলো-আঁধারি থেকেই উঠে এল ডারউইনের বিবর্তনবাদের একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত: যৌন নির্বাচন।

অন্য বিষয়গুলি:

Wajid Ali Shah Animal Kingdom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy