Advertisement
E-Paper

২৫ জুলাইয়ের সেই ট্রেনযাত্রা

শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা। তার পর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসা, তাঁকে সুস্থ করে তুলতে ডাক্তারদের নিরন্তর প্রয়াস, শেষে অস্ত্রোপচার। লেখা হল শেষ কবিতা: তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে...। স্বপনকুমার ঘোষ ২৫ জুলাই রবীন্দ্রনাথ খুব ভোরে উঠেছেন। তৈরি হয়ে, ‘উদয়ন’-এর দোতলায় পুব দিকের জানালায় আশ্রমের দিকে চেয়ে বসে আছেন। হয়তো ভাবছিলেন তাঁর প্রিয় আশ্রম ছেড়ে যাওয়ার কথা।

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৮ ০৫:০০
বিদায়বেলা: বোলপুরে কলকাতাগামী ট্রেনের কোচে রবীন্দ্রনাথ। ২৫ জুলাই ১৯৪১

বিদায়বেলা: বোলপুরে কলকাতাগামী ট্রেনের কোচে রবীন্দ্রনাথ। ২৫ জুলাই ১৯৪১

জুলাই, ১৯৪১। রবীন্দ্রনাথ খুবই অসুস্থ। প্রায় প্রতিদিনই জ্বর, খাওয়াদাওয়াও কমে গিয়েছিল খুব। তার মধ্যেই, আষাঢ় মাস পড়তে না পড়তেই বর্ষার রূপ প্রত্যক্ষ করার জন্য কবি দারুণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। তখন উত্তরায়ণের ‘উদয়ন’ বাড়ির দোতলায় ‘কবিকক্ষে’ তাঁকে নিয়ে আসা হল। সেখানে বসেই কবি তাঁর প্রিয় ঋতু বর্ষার প্রাকৃতিক শোভা দেখছিলেন।

১৬ জুলাই ডা. বিধানচন্দ্র রায় ও আরও ক’জন চিকিৎসক— ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দুভূষণ বসু— শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য। ডা. রায় ও তাঁর সহযোগীদের নিয়ে যাওয়া হল কবির কক্ষে। বিধানচন্দ্র রায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘‘আপনি আগের থেকে একটু ভালো আছেন। সে কারণে অপারেশনটা করিয়ে নিতে পারলে ভালো হবে, আর আপনিও সুস্থ বোধ করবেন।’’

কবির অসুস্থতা তখন বেড়ে গিয়েছিল। তাই তাঁর সেবা-শুশ্রূষার জন্য কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও আশ্রম সচিব সুরেন্দ্রনাথ কর কয়েক জনকে নির্বাচিত করলেন। ‘উদয়ন’ বাড়িতে রোগশয্যায় কবিকে সেবা করার দুর্লভ সৌভাগ্য যাঁরা লাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কর নিজে, বীরেন্দ্রমোহন সেন, অনিল চন্দ, বিশ্বরূপ বসু, সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, সরোজরঞ্জন রায়চৌধুরী। মহিলাদের মধ্যে ছিলেন নন্দিতা কৃপালনী, রানি মহলানবিশ, রানী চন্দ প্রমুখ। এঁদের মধ্যে বিশ্বরূপ বসু ও নন্দিতা কৃপালনী বয়সে সবার চেয়ে ছোট ছিলেন। সকলে এ-বেলা ও-বেলা পালা করে কবির সেবা করতেন। পিতৃদেবের সেবার কাজে রথীন্দ্রনাথ এক বিদেশি মহিলাকেও নিযুক্ত করেছিলেন।

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কবির যে নিবিড় সম্পর্ক, তা এক করুণ ঢেউ হয়ে জেগে উঠেছিল কবির শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে। সেই বিষাদময় আবহের মাঝখানেই চিকিৎসার কারণে কবিকে নিয়ে যেতে হল কলকাতায়।

তিন বছর আগে, ১৯৩৮ সালেই তিনি লিখেছিলেন, ‘এবার তবে ঘরের প্রদীপ/ বাইরে নিয়ে চলো।’ এ যেন ছিল আগাম সংকেত। শুরু হল শান্তিনিকেতনের আশ্রম জীবনে এক বিষাদ ভরা পর্ব। কবি অবশ্য বেদনার্ত বোধ করতেন ‘ক্ষণস্থায়ী’ অস্তিত্বের জালে বন্ধ থাকতে। বরং নিশান্তে যাত্রী তিনি ‘চৈতন্যসাগর তীর্থপথে’। কিন্তু প্রত্যাশাময় মানুষ আমরা, এ কথায় তো সান্ত্বনা পাই না।
যতই কষ্ট পাই, মনে রাখতে হয়— ‘অবসন্ন দিবসের দৃষ্টিবিনিময়—/ সমুজ্জ্বল গৌরবের প্রণত সুন্দর অবসান।’

২৪ জুলাই ১৯৪১। শান্তিনিকেতন, বোলপুর, শ্রীনিকেতন, ভুবনডাঙা, সুরুল, মহিদাপুর, গোয়ালপাড়া, পারুলডাঙা, আদিত্যপুর-সহ সমস্ত এলাকার মানুষজন, ছাত্রছাত্রী, কর্মী, শিক্ষক, আশ্রমিক, সবার কাছেই খবরটা খুব দ্রুত পৌঁছে গিয়েছিল, পর দিন সকালে রবীন্দ্রনাথকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। স্বভাবতই সকলের মন ছিল বেদনায় ভারাক্রান্ত।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভান্ডারি শৈলজারঞ্জন মজুমদার ক’মাসের জন্য সঙ্গীতভবনে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পূর্বপল্লীর বাড়িতে বসে তাঁর কাছে ২৫ জুলাই দিনটির বিষয়ে শোনার সুযোগ হয়েছিল। বলেছিলেন, ‘‘বিকেলের দিকে সঙ্গীতভবনে বসে আছি। হঠাৎই খবর পেলাম যে, কাল সকালেই গুরুদেবকে অপারেশনের জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। মনে আছে— বিকেলের পড়ন্ত বেলা, দিনের শেষে পশ্চিমের আকাশে রবি ঢলে পড়েছে। আর ঠিক সেই সময় আমাদের সবার পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রাণের রবি ঠাকুরের আশ্রম ছেড়ে কলকাতা যাত্রার খবরে মনটা কেমন উদাস ও বিষণ্ণ হয়ে গেল। তাই মনে মনে ঠিক করলাম যে, আমরা বৈতালিকের গানে গানে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দেব। আমি তক্ষুনি রান্নাঘরের (জেনারেল কিচেন) সামনে চলে যাই। সব ছাত্রছাত্রীকে একসঙ্গে জড়ো করি। নতুন কোনও গান শেখানোর সময় ছিল না। তাই সবার জানা ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ গানটি দু’একবার রিহার্সাল দিয়ে তৈরি করিয়ে নিলাম।’’ সে দিনের কথা বলতে বলতে শৈলজাদা আনমনা হয়ে পড়ছিলেন বারবার।

২৫ জুলাই রবীন্দ্রনাথ খুব ভোরে উঠেছেন। তৈরি হয়ে, ‘উদয়ন’-এর দোতলায় পুব দিকের জানালায় আশ্রমের দিকে চেয়ে বসে আছেন। হয়তো ভাবছিলেন তাঁর প্রিয় আশ্রম ছেড়ে যাওয়ার কথা।

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মী ও আশ্রমিকের দল সমবেত কণ্ঠে ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ গানটি গাইতে গাইতে উত্তরায়ণ বাড়ির ফটক পেরিয়ে, লাল মাটির কাঁকুরে পথ ধরে উদয়ন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে একান্ত চিত্তে বৈতালিকের সঙ্গীত-অর্ঘ্য গ্রহণ করেন।

ক্রমে কবির কলকাতা যাত্রার সময় এগিয়ে আসছে। একে একে আশ্রমিকেরা বেদনার্ত হৃদয়ে জড়ো হচ্ছেন উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে। অন্তরঙ্গ সেবকরা খুবই সাবধানে বিশেষ ভাবে তৈরি একটি স্ট্রেচারে করে কবিকে দোতলা থেকে নীচে নামিয়ে আনলেন। উদয়ন বাড়ির নীচের বারান্দায় একটি আরামকেদারায় প্রায় অর্ধশায়িত ভাবে বসানো হয়েছে। তাঁর চোখে নীল চশমা, সমস্ত শরীরে ক্লান্তির সুস্পষ্ট ছাপ।

উদয়ন-এর সামনে এসে দাঁড়াল আশ্রমের মোটরগাড়ি। কবিকে যাতে সরাসরি স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তুলে দেওয়া যায়, তাই গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল।

উদয়ন থেকে উত্তরায়ণের গেট অবধি রাস্তার দু’ধারে শ্রদ্ধানত আশ্রমবাসীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন অশ্রুসজল চোখে। আকাশে মেঘ, প্রতিটি মানুষের মনেও অস্ফুট ব্যাকুল গুঞ্জরণ। তারই মধ্য দিয়ে কবির গাড়ি ধীরে ধীরে বোলপুরের দিকে এগিয়ে চলল। আশ্রমিকরা তখন সমস্বরে গাইছেন, ‘আমাদের শান্তিনিকেতন...’ আশ্রম থেকে বোলপুর আসার রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ, খানাখন্দে ভর্তি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাবেন, খবর পেয়ে বীরভূমের তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড কর্তৃপক্ষ রাতারাতি রাস্তা সংস্কারও করেছিলেন যতটা সম্ভব।

Rabindranath Tagore Bolpur to Kolkata 25th July রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy