Advertisement
E-Paper

আদিগঙ্গা থেকে মিলল ঘড়া ভর্তি মোহর, তারপর...

সোনার মোহরগুলি বিলেতে পাঠিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তার কিছু গেল সংগ্রহশালায়, আর সোনার লোভে গলিয়ে ফেলা হল বাকিগুলো। হেস্টিংস জানতেন না, আদিগঙ্গা থেকে পাওয়া মোহরগুলো আসলে গুপ্ত যুগের মুদ্রা!সোনার মোহরগুলি বিলেতে পাঠিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তার কিছু গেল সংগ্রহশালায়, আর সোনার লোভে গলিয়ে ফেলা হল বাকিগুলো। হেস্টিংস জানতেন না, আদিগঙ্গা থেকে পাওয়া মোহরগুলো আসলে গুপ্ত যুগের মুদ্রা!

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ০৭:১০
ধর্ম-অর্থ: কালীঘাট মন্দির। আদিগঙ্গার তলায় মিলেছিল প্রাচীন মুদ্রা।

ধর্ম-অর্থ: কালীঘাট মন্দির। আদিগঙ্গার তলায় মিলেছিল প্রাচীন মুদ্রা।

ফুরফুরে সকাল। সবেমাত্র ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠেছেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। এমন সময় দেখলেন, পালকি চেপে নবকৃষ্ণ আসছেন। সুতানুটির রাজা নবকৃষ্ণ দেব, হেস্টিংসের কাছের লোক। কিন্তু এত সকালে কী এমন দরকার পড়ল নবকৃষ্ণের? ভাবতে ভাবতেই সটান সাহেবের সামনে হাজির রাজা। হাতে একটা পিতলের ভাঁড়। ‘‘দিজ আর ফর ইউ স্যর,’’ ঘটির ভিতর থেকে বেরিয়ে প়ড়ল পুরনো আমলের একগাদা মোহর।

এই মোহর অবশ্য নবকৃষ্ণের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। আদিগঙ্গায় নৌকো নোঙর করতে গিয়ে এক জেলে পেয়েছিল এই ঘটি। লোভ হয়েছিল বটে, কিন্তু এমন যখের ধন তো রাজারই। তাই ঘটি নিয়ে সোজা রাজামশাইকেই দিয়ে গিয়েছিলেন সেই জেলে। বিচক্ষণ রাজা বুঝেছিলেন, এ জিনিসের সমঝদার সাহেবরা। তাই তা ইংরেজদের দিলে তাঁর কপাল আরও কিছুটা চওড়া হতে পারে। জেলেকে বকশিশ দিয়ে আর দেরি করেননি তিনি। সোজা সাহেবের সামনে।

হেস্টিংস বুঝেছিলেন, এ মোহর যে সে মোহর নয়। এ ইতিহাসের স্মারক। নেটিভদের শাসন করতে এসে এমন উপহার পাঠালে কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্স খুশিই হবে। সাহেবের সঙ্গে কিছু ক্ষণ গালগল্প করে উঠে পড়লেন নবকৃষ্ণ। এ দিকে হেস্টিংস লেগে প়ড়লেন নিজের কাজে। টেবিলে বসে দোয়াত-কলম নিয়ে একটা চিঠিই লিখে ফেললেন। বললেন, পারস্যের মোহর পাঠাচ্ছেন তিনি। এ সব বিভিন্ন জাদুঘরে পাঠানো উচিত, সেটাও লিখতে ভুললেন না। তার পরেই জাহাজে চেপে সোজা বিলেত পা়ড়ি দিল কালীঘাটের মোহর!

বিলেতে বসে থাকা কোম্পানির কর্তারা অবশ্য এ সব মোহর দেখে তেমন আহ্লাদিত হননি। কেমন যেন কালচে দাগ হয়ে গিয়েছে। তবুও বেছে বেছে কয়েকটা সাফসুতরো মোহরকে দিয়ে দেওয়া হয় গলানোর জন্য। যদি কিছু সোনা মেলে। বাকিগুলো অবশ্য পাঠিয়ে দেওয়া হল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। বাকিগুলো অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামে, খান কতক কেমব্রিজে। বাকি কিছু বিলিয়ে দেওয়া হল কয়েক জন ব্যক্তিগত সংগ্রহকারীকে।

১৭৮৩। সাহেবরা তখনও ভারতে গুপ্ত রাজাদের মুদ্রার নামই শোনেননি। হেস্টিংস সাহেবের পাঠানো মোহরগুলো তাই অজানাই ছিল। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, কালীঘাটের আদিগঙ্গার তলা থেকেই মিলেছিল গুপ্ত সম্রাটদের মুদ্রার প্রথম ভাঁড়ার। নবকৃষ্ণ, হেস্টিংসের হাত ঘুরে যা গিয়ে পড়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড়কর্তাদের হাতে। দীর্ঘ দিন চাপা পড়ে থাকা যখের ধন আলো দেখেছিল বটে। কিন্তু ভেঙে গিয়েছিল হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে টিঁকে থাকা ‘যৌথ পরিবার’।

প্রাচীন মুদ্রা।

বছর কয়েক পরে ওয়ারেন হেস্টিংস দেশে ফিরেছিলেন। কিন্তু যখের ধন তাঁর কপাল খোলেনি। বরং কোম্পানির কর্তারা তাঁকে সরানোর কথা জানিয়েছিলেন। মোহরের খোঁজ নিতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন, মাত্র চব্বিশটা মোহর রয়েছে। বাকিগুলো নাকি গলিয়ে ফেলা হয়েছে! বাড়ি ফিরে কপাল চাপ়়ড়েছিলেন গভর্নর-জেনারেল।

এর পরে এক শতাব্দী কেটে গিয়েছে। ২০০৯ সাল। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপিকা সুস্মিতা বসু মজুমদার। এমন সময় সহকর্মী সায়ন্তনী পালের ই-মেল। ‘‘এক বার গুপ্ত মুদ্রাগুলো দেখে এসো তো!’’ গুপ্ত মুদ্রা দেখার কথা ছিল না, তবু বন্ধুর কথায় কেমন একটা খেয়াল চাপল সুস্মিতার মাথায়। বন্ধু এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মুদ্রা বিভাগের কিউরেটর জো ক্রিব-এর কাছে কথাটা পা়ড়লেন তিনি। বন্ধুর কথা ফেলেননি জো। নিয়ে এসেছিলেন মিউজিয়ামে থাকা গুপ্ত আমলের কয়েকটা মুদ্রা। সেই সব দেখতে দেখতেই একটা জিনিস নজরে এসেছিল বাঙালি অধ্যাপিকার। দেখেছিলেন, কয়েকটা মুদ্রার গায়ে একটা কালচে দাগ রয়েছে। কীসের দাগ?

শুরু হল খোঁজ। আরও কিছু গুপ্ত মুদ্রা মিলল। তার মধ্যেও কয়েকটার গায়ে সেই কালচে মাটির দাগ! এটা কি কোনও পারিবারিক চিহ্ন? সুস্মিতা বলছেন, পেতলের ঘটিতে থাকা সোনার মোহর প্রায় ১১০০ বছর ধরে পলি-কাদার তলায় চাপা পড়ে ছিল। কাদা, জলের সংস্পর্শে পেতলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় গায়ে লেগে গিয়েছিল কালচে ছোপ। সেই ছোপ ধরেই খুঁজতে খুঁজতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে মিলল ১০৫টি মুদ্রার। কিন্তু চমক আরও বাকি ছিল।

মুদ্রার খোঁজ তখন চলছে। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে বিষয়টি তুললেন সুস্মিতা। তা দেখেই বোমা ফাটালেন নেদারল্যান্ডসের ইতিহাস গবেষক এলেন এম র‌্যাভেন। জানালেন, এমন কিছু মুদ্রা তিনি দেখেছেন। কোথায়? না, বিলেতে নয়। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতকলা মিউজিয়ামে! সেখানেও খোঁজ করে দেখা গেল, গুপ্ত যুগের মুদ্রাই বটে, এবং গায়ে রয়েছে কালীঘাটের ছাপ!

ভাঁড় গিয়েছিল বিলেতে। তা বেনারসে তাদের শরিকেরা এল কী ভাবে? সুস্মিতা বলছেন, পুরো ভাঁড়টাকেই বড়কর্তাদের কাছে পাঠাননি হেস্টিংস। খান তিরিশেক রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে। সেখান থেকেই এক ডজন মুদ্রা হাত ঘুরে ঠাঁই পেয়েছিল বেনারসে।

নথি ঘেঁটে, মুদ্রা ঘেঁটে ১১৭টি পেয়েছেন সুস্মিতা। তার মধ্যে সাহেবদের লোভে প্রাণ হারানো মুদ্রারাও রয়েছে। গা ঘেঁষাঘেষি করে, যখের বন্দি হয়ে থাকা হয়তো হয় না। সুস্মিতা বসু মজুমদার এ সব নিয়েই লিখেছেন তাঁর বই ‘কালীঘাট হোর্ড: দ্য ফার্স্ট গুপ্ত কয়েন হোর্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’। বহু যুগ আগের সেই মুদ্রারা এখন সেই বইয়ের পাতাতেই একে অন্যকে দেখতে পায়।

এ-ও এক পুনর্মিলনই বটে!

Kalighat Kalighat Temple কালীঘাট Warren Hastings ওয়ারেন হেস্টিংস
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy