Advertisement
E-Paper

দিল্লি-গাজা প্রেমকথা

ছেলে ভারতের, মেয়ে প্যালেস্তাইনের। বিয়েতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। দুজনেই চান, সন্তান বড় হোক গাঁধী আর ইয়াসের আরাফতের আদর্শে।ছেলে ভারতের, মেয়ে প্যালেস্তাইনের। বিয়েতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। দুজনেই চান, সন্তান বড় হোক গাঁধী আর ইয়াসের আরাফতের আদর্শে।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০১
মাফেজ আহমেদ ইউসুফ ও বাদর খান সুরি।

মাফেজ আহমেদ ইউসুফ ও বাদর খান সুরি।

ওর হাসিটা ছিল বসন্তের মতো ছোঁয়াচে! চোখ জর্ডন নদীর মতো স্বচ্ছ। ভারত নিয়ে অপার কৌতূহল আর প্রশ্ন যে চোখে স্থায়ী ছায়া ফেলে রেখেছে।

এ হেন প্যালেস্তাইন-কন্যার সঙ্গে কথা বলার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল সে দিন! সাত বছর আগে গাজায় যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিনিধি দলটি গিয়েছিল, তাদের অনেকেরই নাকি জাহাজডুবি ঘটেছিল সে দিন ওই চোখে! কিন্তু বাজিমাত করার ধনুকভাঙা পণ করেছিলেন এক জনই। বাদর খান সুরি। শান্তি ও সংঘর্ষবিদ্যা (পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ) নিয়ে জামিয়া মিলিয়ায় গবেষণারত এই দিল্লিওয়ালা বিলক্ষণ জানতেন, রাস্তাটা সহজ নয়। বলিউডের চিত্রনাট্যকেও পিছনে ফেলতে হবে এই প্যালেস্তানীয় সুন্দরীকে পেতে হলে। ‘‘অথচ জানেন, বিগ বি-শাহরুখ খানকে দিয়েই আমাদের নৈকট্যের সূত্রপাত,’’ হাসতে হাসতে জানালেন মাফেজ আহমেদ ইউসুফ। যিনি এখন বাদরের স্ত্রী এবং একটি ফুটফুটে সন্তানের মা।

যমুনা আর জর্ডনের জল মিলেমিশে গিয়েছে, তা-ও হতে চলল চার বছর। মাফেজের বাবা আহমেদ ইউসুফ ছিলেন গাজার হামাস সরকারের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী। পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন নির্বাচন না হওয়ায় তিনি ওই পদ ছেড়ে শীর্ষ কর্তা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন হাউস অব উইজডম ইনস্টিটিউট-এ। এই সরকারি সংস্থাটি মানবাধিকার সংক্রান্ত ও বিভিন্ন প্রশাসনিক পরামর্শ দেয় সরকারকে।

‘‘ওঁর মতো কড়া ধাতের মানুষের অনুমতি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। গাজা থেকে নয়াদিল্লি ফিরে এসে আবার ছুটতে হয়েছে গাজায়,’’ বাদর জানাচ্ছেন। ‘‘বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে দুরুদুরু বুকে আইএসডি কলটি করেছিলাম মাফেজের চাচাকে। তাঁর মাধ্যমেই ওর বাবা জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই সব ভুলে যেতে। এই বিয়ে হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই!’’

তবু এই আপাত-অসাধ্য কাণ্ডটি কী ভাবে ঘটালেন বাদর খান? জানার আগে এক বার গোড়া থেকে ঝালিয়ে নেওয়া যাক এই দূরপাল্লার প্রেমকাহিনিটি।

‘‘২০১১ সালের সেই গাজা সফরে মাফেজ ছিল আমাদের অনুবাদক। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর জন্য সে আমাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রথম দর্শনেই প্রেম যাকে বলে, অনেকটা সে রকমই কিছু হয়ে থাকবে! ওর হাসিটা এত ছোঁয়াচে ছিল! ভারতের সব কিছু নিয়ে জানার ওর কী ইচ্ছা! আমাকে প্রশ্নে প্রশ্নে পাগল করে ছেড়েছিল,’’ হাসছেন বাদর। সেই মুগ্ধতা এখনও ঘিরে আছে এই সুখী দম্পতিকে।

প্রথম যাত্রায় পাঁচ দিন গাজায় কাটিয়ে একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিল্লি ফিরেছিলেন বাদর। বিপুল দূরত্ব কমাতে পারেনি দু’জনের মধ্যে তৈরি হওয়া উষ্ণতাকে। প্রথমে ই-মেল, তার পর ফেসবুক এবং শেষ পর্যন্ত দূরপাল্লার কলে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। বাদর বলছেন, ‘‘এক দিকে বলিউড নিয়ে ওর ছেলেমানুষের মতো আগ্রহ, অন্য দিকে প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ। মাফেজ-এর মনের যেন দু’টি আলাদা দিক। প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল যুদ্ধ নিয়ে কথা শুরু হলে কিছুতেই যেন শেষ হতে চাইত না।’’

শুধু বাদরই নন, যুদ্ধের এই দিনগুলির মধ্যেই প্রেম এসে বসেছিল মাফেজের হৃদয়েও। কারণ বাদর তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর মাফেজ ভাবতে বিশেষ সময় নেননি। তবে একটি শর্ত রেখেছিলেন। সেটি হল, ‘যদি বাড়ির অনুমতি পাওয়া যায়, তবেই।’

অনুমতি অবশ্যই সহজে আসেনি। প্রথমে জানানো হয় মাফেজের চাচাকে। তিনি জানান বাবাকে। যিনি শুনেই বলেছিলেন, ‘‘আমার মেয়ে প্যালেস্তানি ছাড়া ভিনদেশী কাউকে বিয়ে করবে না।’’ মাফেজের মতে, ‘‘আমার বাবা কিন্তু যথেষ্ট উদারপন্থী মানুষ। সে সময় নিষেধ করেছিলেন বোধহয় এটা ভেবেই যে মেয়েকে এত দূরে পাঠানোর ইচ্ছে ছিল না তাঁর।’’ তবে হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না মাফেজ। কারণ তত ক্ষণে তিনি মন থেকে সায় পেয়ে গিয়েছেন— মহাত্মা গাঁধীর দেশই হতে চলেছে তার ভবিষ্যৎভূমি। ‘‘অনেক সাহস করে মা’কে সব কিছু খুলে বললাম। মা বুদ্ধি দিলেন বাবার সঙ্গে বাদরকে সরাসরি কথা বলতে। কথা হল। বাবা ডেকে পাঠালেন ওকে। ২০১৩ সালে বাদর এলো গাজায়, শুধুমাত্র বাবাকে বোঝানোর জন্য!’’

কয়েক দফা কথাবার্তার পর মাফেজের বাবা রাজি হলেন এক ভারতীয় যুবকের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে। তখনই আংটি বদল হয়। স্মৃতিচারণ করছেন বাদর, ‘‘ওর পরিবার আমাকে রীতিমত বাধ্য করে বলিউডের গানের সঙ্গে নাচতে! বলতে পারেন সেটাও একটা পরীক্ষা ছিল আমার! স্থির হয়, গাজাতে ওই বছরেই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে, ডিসেম্বর মাসে।’’ সে আর এক কাণ্ড— জানাচ্ছেন দম্পতি। ‘‘হল ভাড়া হয়ে গিয়েছে, নিমন্ত্রণ শেষ, বরযাত্রীদের জন্য প্যালেস্তিনীয় রেওয়াজে আপ্যায়নের ব্যবস্থাও শেষ। কিন্তু সীমান্ত রাষ্ট্র মিশরে শুরু হল হিংসা। রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পাত্রপক্ষের আসা সম্ভব হল না। তাতে অবশ্য থেমে থাকেনি কিছু!’’ আবার হাসিতে ভেঙে পড়ছেন মাফেজ। ‘‘ওর ছবি সামনে রেখে বলিউডের গানের সঙ্গে সারারাত নাচগান, খাওয়াদাওয়া চলেছিল। বর ছিল না ঠিকই, কিন্তু আমরা ওকে ছাড়াই অনুষ্ঠান শেষ করেছিলাম!’’

শেষ পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয় দিল্লিতেই। উত্তেজিত মাফেজের পরিবারের অনেকেই তাঁকে ভারতে রওনা হওয়ার আগে বলে দিয়েছিলেন, অমিতাভ বচ্চন অথবা শাহরুখ খানের সঙ্গে দেখা হলে তাঁদের হয়ে সালাম জানাতে! উত্তেজনা কি মাফেজেরই কিছু কম ছিল? মা, ভাই, চাচাকে সঙ্গে নিয়ে দুরুদুরু বুকে মাফেজ আসেন দিল্লি। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ওঁদের বিয়ে হয়।

প্রথম দর্শনে কেমন লেগেছিল ভারত তথা দিল্লি? ‘‘একেবারেই কিন্তু বলিউডের ছবির মতো নয়!’’ সরাসরি জানাচ্ছেন মাফেজ। ‘‘গাজার মতো বিশুদ্ধ মিষ্টি আবহাওয়া নেই। ভিড়, দূষণে জর্জরিত, মলিন। বেশ কিছু দিন লেগেছিল আমার, মানিয়ে নিতে।’’

তবে শুধু বাদরেরই নয়, ধীরে ধীরে মাফেজ প্রেমে পড়়তে থাকেন তাঁর শহরেরও। ‘‘শ্বশুরবাড়ির সবাই খুবই উত্তেজিত ছিলেন বিদেশি বউকে নিয়ে। কিন্তু আত্মীয়দের কাছে বোঝাতে একটা সমস্যা হত যে ঠিক কোন দেশ থেকে আমি এসেছি! প্যালেস্তাইন সম্পর্কে এখানে খুব বেশি ধারণাও কারও নেই, এটাও বুঝেছিলাম। অথচ ভারত কিন্তু আমাদের দেশের ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। অনেকে তো ভাবতেন আমি বুঝি ফিলিপিন্স থেকে এসেছি। প্যালেস্তাইনের সঙ্গে পাকিস্তানকেও গুলিয়ে ফেলতে দেখেছি বাদরের বাড়ির অনেককে!’’

বেশি দিন অবশ্য বাড়িতে বসে রাঁধাবাড়া আর শ্বশুরবাড়ির দেখাশোনার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি পড়াশোনা-ভালবাসা মেয়েটি। ২০১৫ সালেই জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে ভর্তি হন ‘কনফ্লিক্ট অ্যান্ড পিস স্টাডিজ’-এর স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে। ‘‘প্রথমেই দেখে খুব ভাল লেগেছিল যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনটিতে একটি হল রয়েছে আমাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইয়াসের আরাফত-এর নামে। তবে খারাপও লেগেছিল এটা জেনে যে আগে যেখানে গোটা ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার তিনেক প্যালেস্তাইনি ছাত্র পড়তে আসতেন, এখন সেই সংখ্যাটা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০০-তে। হয়তো গাজা এবং ভারতের দূরত্ব এতটাই বেশি যে সমস্যা হচ্ছে।’’

আরাফত।

এই শহরে মানিয়ে নেওয়াই শুধু নয়, মাফেজ এখন এ দেশে কাজ করছেন তাঁর নিজের দেশের এক জন দূত হিসাবেও। গোটা দেশে প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল সংঘাত নিয়ে বলার জন্য বিভিন্ন সেমিনার থেকে ডাক আসে তাঁর। ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশনের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। প্যালেস্তাইনের অধিকার নিয়ে এ দেশে জনমত তৈরি করার জন্য একটি ফেসবুক পেজ খুলেছেন। ভারতীয় মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান, সাংসদ এবং সাধারণ মানুষের সংযোগ গড়ে তোলাটাই তাঁর লক্ষ্য। বিভিন্ন ভারতীয় উদ্যোগেও যুক্ত হয়েছেন। তাঁর ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ারের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এঁরা সবাই প্যালেস্তাইন নিয়ে জিজ্ঞাসু, আগ্রহী।

এই সবের মধ্যেই ওদের জীবনে এসেছে আরাফত! ‘‘ভেবেছিলাম ওর নাম দেব হয় গাঁধী অথবা আরাফত। শেষ পর্যন্ত আরাফত নামটাকেই বেছে নিলাম!’’ দু’বছরের সন্তানের মাথার নরম চুলে আদর করতে করতে জানাচ্ছেন মা। ‘‘যদিও আমি চাই, ওর মধ্যে গাঁধীর আদর্শও থাকুক। ভারত আর প্যালেস্তাইনের সব ভালগুলি নিয়ে তৈরি হোক আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। যেখানে কোনও হিংসা থাকবে না।’’

Palestine love story untold story
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy