স্মৃতিচিহ্ন: কর্মাটাঁড়ে ‘নন্দনকানন’ প্রাঙ্গণে বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি।
ঝাড়খণ্ডের মধুপুর ও জামতাড়ার মাঝের স্টেশন কর্মাটাঁড়। নির্জন পরিবেশ। লাল মোরামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। উঁচুনিচু টিলার মাঝে শাল, পলাশ ও কর্মা গাছের জঙ্গল। সালটা আনুমানিক ১৮৭৩। সাঁওতাল সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই জায়গাই পছন্দ হয়ে গেল বিদ্যাসাগরের। অবশ্য এর আগে তিনি দেওঘরের মনোরম পরিবেশে একটি বাগানবাড়িও পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু বাড়ির মালিক অনেক বেশি দাম চাওয়ায় কেনা হয়নি। তবে সেই খেদ মুছে গিয়েছে কর্মাটাঁড়ে এসে। স্থানীয় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে প্রায় তিন একর ১৯ ডেসিমেলের এই জায়গাটি কেনেন। স্বামী মারা যাওয়ার পরে তিনি দেশে ফেরার তাগিদে সেই জমি বিদ্যাসাগরকে বিক্রি করে চলে যান।
এখানেই তিন কামরার একটি ছোট বাড়ি বানান বিদ্যাসাগর। নাম দেন ‘নন্দনকানন’। রাতের স্কুল চালানোর জন্য মাঝখানে একটি হলঘর, এক পাশে শোবার ঘর, অন্য পাশে অধ্যয়নকক্ষ। পিছনের দিকে রান্নাঘর, শৌচাগার ও স্নানাগার। খুব বাগানপ্রিয় ছিলেন। বাড়িতে ঢোকার ডান দিকে নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন একটি কিষাণভোগ আমগাছ। ঝাঁকড়া সেই আমগাছ আজও দাঁড়িয়ে। শোওয়ার ঘরে অযত্নেই পড়ে আছে তাঁর খাট। এক পাশে আছে লেখার জলচৌকিটাও। বাগানের দেখভালের জন্য কালী মণ্ডল নামের এক মালিও ছিল তাঁর। ওই মালিকে দিয়েই বাগানের শেষ প্রান্তে লাগিয়েছিলেন একটি ভাগলপুরি ল্যাংড়া আমগাছ। কালী মণ্ডলের বংশোধর লিটু মণ্ডল এখনও সেখানেই থাকেন। তাঁর কাছেই শোনা গেল, আমগাছে ফলন হয় না। তবে স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনও তার নিয়মিত পরিচর্যা করে চলেছেন। বিদ্যাসাগরের জ্যেষ্ঠ সন্তান, একমাত্র ছেলে নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণে ক্ষুব্ধ বিদ্যাসাগর ১৮৭২ সালে তাঁকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। কিছু দিন পরেই মারা যান বিদ্যাসাগরের স্ত্রী দীনময়ী দেবী। নিঃসঙ্গ বিদ্যাসাগর একটু নির্জনতার সান্নিধ্য পেতে কর্মাটাঁড়ে এসে উপস্থিত হন। এই বাড়িতে বসেই তিনি বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের পরিমার্জিত সংস্করণ লিখেছিলেন বলে জানা যায়।
কর্মাটাঁড়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ছিল প্রায় ১৭ বছরের। এই সময়ের মধ্যে বহু প্রথিতযশা মানুষজন তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। কখনও খেতখামারে কাজ করা সাঁওতালদের কাছে থেকে চড়া দামে ভুট্টা কিনে আবার তাদেরই সেগুলি বিনা পয়সায় বিলিয়ে দিচ্ছেন। কখনও হোমিয়োপ্যাথির ব্যাগ নিয়ে আশেপাশের বস্তিতে দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসা করছেন। কখনও রাতের স্কুলে পড়ানোর জন্য ছাত্র জোগাড় করছেন। এক সময়ের মধুপুরের বাসিন্দা, বিদ্যাসাগর-গবেষক অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় জানালেন, সেই সময় কর্মাটাঁড় রেলস্টেশনের (এখন যার নাম ‘বিদ্যাসাগর’) স্টেশন মাস্টার ছিলেন এক জন বাঙালি। সরকারি উচ্চপদে থাকার সুবাদে এলাকার গরিবগুরবোদের সম্ভ্রম আদায় করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অতি সাধারণ মাটির মানুষ, সহজে দীন-দুঃখীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারা বিদ্যাসাগরের কর্মকাণ্ড খুব দ্রুত ওই স্টেশন মাস্টারের জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে গেল। তিনি সেটা ভাল ভাবে নিতে পারেননি। তাই বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে জনসমক্ষে কটাক্ষও করতেন। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তাকে একটুও খর্ব করতে পারেননি।
শোবার ঘরে বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত খাট
শরীর-স্বাস্থ্যের ভগ্নদশার কারণে ১৮৯০-এর গোড়া থেকে আর কর্মাটাঁড়ে বাস করেননি বিদ্যাসাগর। কলকাতার বাদুড়বাগানের বাড়িতেই ১৮৯১ সালে তিনি মারা যান। বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বাঙালিদের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি’ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গিয়েছে, তাঁর মৃত্যুর পরে অবহেলায় পড়ে ছিল তাঁর নির্মিত বাড়ি, স্কুলঘর, দাতব্য হোমিয়ো চিকিৎসাকেন্দ্র— সব কিছুই। এক সময় কলকাতার মল্লিক পরিবারকে এ সব বিক্রিও করে দিয়েছিলেন তাঁর ছেলে নারায়ণচন্দ্র। তবে মল্লিক পরিবারের সদস্যরা বিদ্যাসাগরের স্মৃতির কথা ভেবে সে সব অক্ষত রেখেছিলেন।
১৯৩৮ সালে বিহারের প্রবাসী ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা তৈরি করেন ‘বিহার বাঙালি সমিতি’। ১৯৭০-এর দশক থেকে এই সমিতি বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত কর্মাটাঁড়ের সম্পদ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। হদিশ মেলে কলকাতার সেই মল্লিক পরিবারের। সে সময় এই সম্পত্তির যিনি মালিক ছিলেন, তাঁর কাছ থেকেই ১৯৭৪ সালের ২৯ মার্চ ২৪ হাজার টাকায় বিদ্যাসাগরের বাড়ি সহ তিন একর ১৯ ডেসিমেল জায়গা কিনে নেয় বিহার বাঙালি সমিতি। শুরু হয় বিদ্যাসাগরের স্মৃতি সংরক্ষণের কাজ। ১৯৭৬ সালে ফের চালু করা হয় বিদ্যাসাগরের স্কুল ও দাতব্য হোমিয়ো চিকিৎসাকেন্দ্র।
২০০১ সালে বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড হল। আলাদা করে তৈরি হল ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি। দুই রাজ্যের বাঙালি সমিতির তত্ত্বাবধানে স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র চলতে থাকল। কিছু প্রশাসনিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় ঝাড়খণ্ড সরকারের সামাজিক নিবন্ধীকৃত আইনে ২০১৬-র অক্টোবর মাসে দুই বাঙালি সমিতির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ১১ সদস্যের ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি
রক্ষা সমিতি’।
এখন সমিতির সদস্যরাই দেখভাল করছেন। বছরে তিনটি দিন অনুষ্ঠান করেন ওঁরা। ২৯ মার্চ পালন করেন ‘গুরুদক্ষিণা দিবস’, ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিন আর ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। আর ক’দিন পরেই, এ বছর পুজোর ষষ্ঠীর দিনে কর্মাটাঁড়ে পালিত হবে বিদ্যাসাগরের জন্মদিন, স্মরণ-উৎসব। পুজোর রং-গন্ধমাখা শহর থেকে দূরে, এক সহজ সাধারণ, নির্জন উৎসব। যে নির্জনতা পছন্দ করতেন বিদ্যাসাগর নিজে, জীবনের শেষ দিনগুলোয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy