কিন্তু সেই সব দিন এখন পুরোপুরি আমার পিছনে চলে গিয়েছে। কংগ্রেসের আদর্শে বেড়ে উঠলেও দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এখন আদ্যন্ত অরাজনৈতিক ব্যক্তি আমি। এটাও আমার মাথায় এল যে, হয়তো একটু আগেভাগেই রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে ফেললাম ইউপিএ-র রাষ্ট্রপতি পদের মনোনয়নে সম্মতি জানিয়ে। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে হয়তো আরও কয়েকটি বছর আমি দিতেই পারতাম। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই এই সব চিন্তার জাল কাটিয়ে ফেলতে হল। আমি এখন এই সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি। এখন থেকে সে ভাবেই নিজেকে তৈরি করতে হবে। আমার সামনে এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে, যাঁরা রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন, কালক্রমে দেশের প্রধান হয়েছেন এবং অরাজনৈতিক ভাবে নিজের কর্তব্য পালন করেছেন। অবশ্য এমন কেউ কেউও রয়েছেন যাঁরা রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে থেকে এসে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। অধ্যাপক কালাম এ রকমই একটি উদাহরণ।
তবে যিনি যে রকম প্রেক্ষাপট থেকেই আসুন না কেন, রাষ্ট্রপতি পদের গরিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন প্রত্যেকেই। আমার ক্ষেত্রেও যাতে তার অন্যথা না হয়, সে জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম আমি। আর তাই গোড়া থেকেই মন থেকে একটা কথা নিজের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিলাম যে, রাজনৈতিক ভূমিকা আমার শেষ হয়ে গিয়েছে। শপথবাক্য পড়ার সময় প্রত্যেকটি শব্দ নিজের মধ্যে প্রোথিত করে নিয়েছিলাম, যাতে প্রত্যেকটি শপথ পালন করতে পারি। আজ যখন পিছন ফিরে তাকাই, কিছু তৃপ্তির সঙ্গে এটাই বলতে পারি, নিজের কাছে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি পালনে সমর্থ হয়েছি।
• • • • • •
সংসদ অধিবেশন এবং রাজ্যের বিধানসভা অর্থহীন ভাবে বানচাল করে দেওয়ার মতো ঘটনা আমায় যতখানি হতাশ এবং বিরক্ত করেছে, তেমনটা বোধহয় আর কিছুই করেনি। সংসদীয় গণতন্ত্রে, সংসদ এবং বিধায়কদের প্রধান দায়িত্ব হল, দেশের এবং সমাজের হিতের জন্য আইন প্রণয়ন করা। প্রত্যেক সাংসদ এবং বিধায়কের এটা মাথায় রাখা উচিত যে, তাঁরা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ, যে মানুষ নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের এখানে পাঠিয়েছেন। এমনকি দেশের রাষ্ট্রপতিকেও পদটিতে জেতার জন্য নির্বাচিত হতে হয়।
যখন থেকে আমার সংসদীয় জীবন শুরু হয়েছে, সেই তখন থেকেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সংসদের কিংবদন্তি বক্তাদের বক্তৃতা শুনতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তা সে আমি ট্রেজারি বেঞ্চেই থাকি বা বিরোধী। এই অভ্যেসের ফলে আমার এই জীবন্ত প্রতিষ্ঠানটিকে আত্মীকরণ করতে সুবিধে হয়েছে, বিতর্ক, বিরোধিতা এবং আলোচনার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে সাহায্য হয়েছে।
নেহরুর সময় এই বিতর্ক বিরোধিতা এবং আলোচনার দিকটি বিশেষ করে সমৃদ্ধ হয়। নেহরু শুধুমাত্র বিতর্কে উৎসাহই দিতেন না, মতবিরোধকেও সম্মান করতেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী-সহ বহু বিরোধী নেতা সংসদে দাগ কাটতে পেরেছিলেন তার কারণ সেই সময়ের সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের বক্তব্য, অবস্থান এবং সমালোচনাকে প্রকাশ করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হত। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গণতান্ত্রিক চর্যার অনেকটাই বদলে গিয়েছে বিরোধিতার নামে তুমুল হই-হল্লায়।
সাম্প্রতিক অতীতে, বিশেষ করে গত এক দশকে সংসদ ভন্ডুল করার যে নজির তৈরি হয়েছে, তা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা এর ফলে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। একে কোনও ভাবেই সংসদীয় বিরোধিতা বলা যায় না, বরং এটি দেশের মানুষকে ঠকানোরই শামিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে যদি ক্রমশ এই ভাবে অকেজো করে দেওয়া হয়, তা হলে শুধু যে প্রতিষ্ঠানই পঙ্গু হবে এমনটা নয়, গোটা ব্যবস্থাতে তার প্রভাব পড়বে। বাজেট-বক্তৃতার সময়েও বার বার বাধা দেওয়া হয়ে থাকে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে ছাড় পান না। ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফায় এটা বার বার ঘটেছে।
• • • • • •
এটা দুঃখজনক বিষয় যে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার তার প্রথম দফায় (২০১৪-১৯) সুষ্ঠু ভাবে সংসদ অধিবেশন চালানোর প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ট্রেজারি এবং বিরোধী বেঞ্চের মধ্যে যে বিতণ্ডা চলেছে, তার জন্য আমি সরকারের ঔদ্ধত্য এবং অধিবেশন চালানোর প্রশ্নে অক্ষমতাকে দায়ী করব। তবে বিরোধীরাও দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদে উপস্থিতির সঙ্গেও এই প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের সংযোগ রয়েছে। জওহরলাল নেহরুই হোন বা ইন্দিরা গাঁধী, মনমোহন সিংহ, অটলবিহারী বাজপেয়ী — প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী সংসদে তাঁদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিতেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর দ্বিতীয় দফায় তাঁর পূর্বসূরিদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া উচিত, যাতে তাঁর নেতৃত্ব দৃশ্যমান হয়। ওঁর অবশ্যই বিরোধীদের বক্তব্য শোনা উচিত ও সংসদে আরও বেশি করে বক্তব্য পেশ করা উচিত। বিরোধীদের শান্ত করতে, নিজের মতামত সামনে এনে তাঁদের বোঝাতে এবং দেশকে সব কিছু জানাতে তাঁর অবশ্যই উচিত সংসদীয় মঞ্চকে আরও বেশি করে ব্যবহার করা।
আমি বিশ্বাস করি, সংসদ এবং সরকার চালানোর নৈতিক দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর উপর বর্তায়। যখন মনমোহন সিংহ জোট বাঁচানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর প্রশাসনকে তার দাম দিতে হয়েছে। তাঁর প্রথম দফায় মোদী অনেকটা একনায়কতান্ত্রিক ভাবেই প্রশাসন চালিয়েছেন। দেখা গিয়েছে, সরকার, আইনসভা এবং বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থার মধ্যে তিক্ততা। সময়ই বলবে তাঁর দ্বিতীয় দফায় এই সব ক্ষেত্রে আগের তুলনায় ভাল সমঝোতা গড়ে ওঠে কি না। সরকারের খেয়াল রাখা খুবই জরুরি, সেই অংশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং দাবির কথাও, যাঁরা তাদের ভোট দেননি। কারণ সরকার সবার। কে কাকে ভোট দিয়েছে, তা অপ্রাসঙ্গিক এ ক্ষেত্রে। নীতি নির্ধারণ এমন ভাবেই করা প্রয়োজন যাতে সবাই উপকৃত হন।