Advertisement
E-Paper

লক্ষ্মীবাইয়ের আগে

তিনি উমাবাই দাভাড়ে। গুজরাতে স্বামী, শ্বশুরের সম্মানরক্ষার্থে যুদ্ধ করেছিলেন পেশোয়া প্রথম বাজিরাওয়ের বিরুদ্ধে। পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়তিনি উমাবাই দাভাড়ে। গুজরাতে স্বামী, শ্বশুরের সম্মানরক্ষার্থে যুদ্ধ করেছিলেন পেশোয়া প্রথম বাজিরাওয়ের বিরুদ্ধে। পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ০০:০০

ছত্রপতি শিবাজির বংশধর রাজারাম ভোঁসলের অন্দরমহলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট মেয়েটি। মাত্র কিছু দিন হল তার বিয়ে হয়েছে খান্ডেরাও দাভাড়ের সঙ্গে। বাবা নাসিকের আভোনে অঞ্চলের জায়গিরদার দেভরাও ঠোকে দেশমুখ। শ্বশুরমশাই যেশাজি রাও দাভাড়ে ছিলেন ছত্রপতি শিবাজীর প্রধান সেনাপতি। সেই সুবাদে রাজপ্রাসাদে তাঁর পরিবারের লোকের অবাধ যাতায়াত। বিশেষ করে রাজারামের স্ত্রী তারাবাইয়ের ভারী পছন্দ ফুটফুটে উমাবাইকে। ছোট্ট উমা স্পষ্টবাদী, অদ্ভুত দাপট তাঁর ব্যক্তিত্বে।

তারার ঘরেই গয়নার বাক্সটা চোখে পড়েছিল উমার। চোখ টেনেছিল এক জোড়া অপূর্ব সুন্দর সোনার নূপুর। খেলাচ্ছলে সেটা পায়ে পরে দেখাতে গেল শ্বশুরমশাইকে। দেখে মুখ কালো হয়ে গেল যেশাজির। রানিসাহেবার জিনিস উমা পরেছেন বলে রাগ, তা নয়। আদরের বৌমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বোঝালেন, এ নূপুর সাধারণের জন্য নয়। এ জিনিস পরতে পারেন শুধু রানিসাহেবা। উমাকে খুলে ফেলতে বললেন নূপুর। নির্দেশ মানলেন উমা, কিন্তু নাড়িয়ে দিল। প্রতিজ্ঞা করল সে, জীবনে এমন ভাবে নিজেকে গড়বে যাতে ওই ‘রাজকীয় অলঙ্কার’ পরার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই উমাবাইয়ের হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন রাজজ্যোতিষী, এক দিন সোনার নূপুরের অধিকারী হবে এই মেয়ে, কিন্তু তার সঙ্গী হবে লোহার বেড়িও!

মিলে গিয়েছিল সেই কথা। উমাবাই দাভাড়ে পরে হয়েছিলেন মরাঠা সেনাবাহিনীর একমাত্র মহিলা সেনাপতি। উমাবাই তরোয়াল হাতে যখন যুদ্ধে শত্রুদের নিকেশ করছেন, তার প্রায় পঁচাশি বছর পরে লক্ষ্মীবাইয়ের জন্ম। ইতিহাস ঝাঁসির রানিকে যতটা মনে রেখেছে, ভুলে গিয়েছে এই মরাঠা রানিকে। দাভাড়ে পরিবারের সদস্যেরা এখন থাকেন পুণেতে। তাঁর ত্রয়োদশ উত্তরসূরি সর্দার সত্যশীলরাজে দাভাড়ে আইনজীবী। দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে বংশের এই সাহসিনীর জীবন নিয়ে গবেষণা করছেন। আগলে রেখেছেন উমাবাইয়ের তলোয়ার-সহ অজস্র স্মারক। উমাবাইকে ভুলে যাওয়ার জন্য কাউকে দোষ দিতে চান না তিনি। হয়তো বিদেশি বা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েননি বলে উমাবাইয়ের কথা প্রচারিত হয়নি; তাতে তাঁর বীরত্ব খাটো হয়ে যায় না— তাঁর বক্তব্য। উমাবাইয়ের লড়াই ছিল পেশোয়া প্রথম বাজিরাওয়ের বিরুদ্ধে।

বংশ পরম্পরায় দাভাড়েরা ছিলেন ছত্রপতির সেনাপতি। শিবাজির উত্তরসূরি শাহুজির সেনাপতি ছিলেন উমার স্বামী খান্ডেরাও। তাঁকে গুজরাতের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাহুজি। কিন্তু সেখানকার ‘চৌথ’ বা কর হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন পেশোয়া প্রথম বাজিরাও। এই ক্ষমতা নিয়ে শুরু হয় দাভাড়েদের সঙ্গে পেশোয়ার সংঘাত। খান্ডেরাও ছিলেন নির্বিবাদী। কিন্তু স্বামীর পন্থা নিতে নারাজ ছিলেন উমাবাই। পেশোয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রানি। ছত্রপতি শাহুজির কাছে পেশোয়া সম্পর্কে বার বার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নির্বিকার! ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন রানি। ক’বছরের ব্যবধানে স্বামী ও পুত্রকে হারিয়ে, চরম অর্থকষ্টেও মাথা নত করেননি। পেশোয়ার তরফ থেকে একাধিকবার সন্ধিপ্রস্তাবের সুযোগ সত্ত্বেও কোনও আপস করেননি।

১৭৫৩ সালে উমাবাইয়ের মৃত্যু হয়। আমৃত্যু তিনি পেশোয়ার বিরোধিতাই করেছেন মনেপ্রাণে। লড়াইয়ে শেষ দিকে পাশে পেয়েছিলেন রাজারামের স্ত্রী তারাবাইকে। কূটনীতি আর যুদ্ধনীতি দিয়ে দুই নারী প্রায় পরাজিত করে ফেলেছিলেন পেশোয়াকে। তবে শেষরক্ষা হয়নি।

১৭২৯ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান খান্ডেরাও। কিছু দিনের মধ্যে পেশোয়ার ভাই, চিমনজি আপ্পা গুজরাত থেকে সংগৃহীত করের অর্ধেক পেশোয়াকে দেওয়ার নির্দেশ দেন। দাভাড়েরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে গুজরাতের একাধিক জায়গা আক্রমণ করে লুটতরাজ চালান চিমনজি। তিক্ততা তীব্র হয়। ১৭৩১-এ থাওয়াইয়ের যুদ্ধে লড়াই হয় সমানে-সমানে। কিন্তু উমার বড়

ছেলে ত্রিম্বকরাও দাভাড়েকে আলোচনার ছলে ডেকে হত্যা করেন পেশোয়ার লোকেরা। শাহুজি সব জেনেও পেশোয়ার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেন না, সামান্য মৌখিক হুঁশিয়ারি ছাড়া। উমা রাগে, প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলতে থাকেন। কিন্তু মদ্যপ মেজ ছেলের যশোবন্তরাওয়ের উপর ভরসা করতে পারেন না। ছোট ছেলে বাবুরাও তখন নাবালক। নিরুপায় হয়ে দাভাড়ে গোষ্ঠীর হাল ধরেন উমা। হয়ে ওঠেন শাহুজির অধীন মরাঠা সেনাবাহিনীর সেনাপতি।

তখন তিনি নির্মম। একের পর এক এলাকা লুট করতে থাকেন, টাকাপয়সা, হাতি-ঘোড়া, অস্ত্র...যদিও করের অংশ নিয়মিত ছত্রপতি শাহুজির কাছে পাঠাতে ভুলতেন না। তাঁর লাগাতার হানায় অন্য মরাঠা সর্দারেরা দিশেহারা হয়ে পড়েন।

১৭৩২ সালে আমদাবাদের কাছে ভদ্রা কেল্লায় মুঘল সর্দার জোরাওয়ার খানের সঙ্গে যুদ্ধ হয় দাভাড়ে বাহিনীর। তলোয়ার হাতে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন উমা। তাঁর বীরত্ব আর রণকৌশলে পর্যুদস্ত হয় মুঘল সর্দারের বাহিনী। শাহুজি উমাবাইকে উপহার দেন তাঁর আকাঙ্খিত সেই ‘রাজকীয় নূপুর’। সেই নূপুর, যা শুধু পরতে পারতেন মরাঠা রানিরা! আজও তা সংরক্ষিত রয়েছে দাভাড়ে পরিবারে।

ছবি সৌজন্য:

সর্দার সত্যশীলরাজে দাভাড়ে

Baji Rao I Umabai Dabhade
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy