Advertisement
০২ মে ২০২৪
New Year Resolution

শূন্য থেকে শুরু হোক নতুন বছর

মহাশূন্যে চাঁদের বাড়ি ঘুরে আসা আর পাতাল থেকে মানুষ উদ্ধার, দুয়ের মাঝে মর্তধামে হৃৎকম্প জাগানো এআই— সব কিছুর রেশ রেখেই শেষ হচ্ছে ২০২৩, দোরগোড়ায় ২০২৪।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

উল্লাস মল্লিক
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৬
Share: Save:

একটা বছরের যবনিকা পড়ল। সে রেখে গেল কত কিছু। রেখে গেল কিছু আনন্দ কিছু নিরানন্দ, কিছু আশা কিছু নিরাশা। বছর শেষ হলেও সময় কিন্তু এগিয়ে গেল নিজের গতিতে, সম্মুখ পানে। তার থামা নেই, শেষ হওয়া নেই। দুঃখ আবিলতা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয় সে, আনন্দ উদ্‌যাপনেও স্পৃহা নেই তার। পিছন ফিরে তাকানোর সময়ও নেই। ক্লান্তি আর স্থবিরতার শেওলা জমে না তার গায়ে। সে শুধু এগিয়ে যায় এক মহাজাগতিক রাজপথ ধরে।

কিন্তু তুচ্ছ মানুষ তার লিলিপুট-ছাপ ভাবনাচিন্তা নিয়ে সময়ের ভাগ করে। বছর মাস দিন। তার পর সে হিসাবের ফর্দ লেখে। সময়ের ভাগ ধরে ধরে সুখ-দুঃখ চাওয়া-পাওয়ার ব্যালান্স শিট মেলায়। এখানে চেষ্টা করা হল তেমনই কয়েকটা সুখ-দুঃখ চাওয়া-পাওয়া তুলে ধরার।

ভারত চন্দ্রযান পাঠাল। সেই চন্দ্রযান নিখুঁত রাস্তা চিনে পৌঁছে গেল চাঁদামামার বাড়ি। আমাদের সবার মুখে তখন চাঁদের হাসি। বিশেষত আগের বারই নিশিভূতের পাল্লায় পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল সে।

কিছু দিন আগেই তো অন্য এক ভয়ঙ্কর টানাপড়েন পেরিয়ে শেষ হাসি হাসল মানুষ। সুড়ঙ্গে আটকে পড়ল এক দল শ্রমিক। বেরোনোর দ্বার রুদ্ধ। প্রকৃতির সঙ্গে এক অসম লড়াই। শেষ পর্যন্ত ভিকট্রি ল্যাপে মানুষই।

আবার অনেকের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে এআই। শ্রমজীবী বুদ্ধিজীবী সবাই আতঙ্কে। এই ভয়ঙ্কর রাক্ষস বিশাল হাঁ করে এগিয়ে আসছে। বকরাক্ষসের চেয়েও বেশি খিদে তার। লক্ষ কোটি মানুষের রুজিরুটি খেয়ে ফেলার পরও তৃপ্তির ঢেকুর উঠবে না, এমনই রাক্ষস সে!

এমন আরও কত কী! কত মানুষের কত হাসি-কান্নাকে সাক্ষী রেখে চলে যাচ্ছে সে! আমরা বলি, যা গেছে তা যাক। নতুন বছর সামনে। আমরা নতুন কিছু শপথ নিই। রাখতে না পারলে কী আর হবে! সামনের বছর আবার নতুন করে নেব। শপথ কাচের গ্লাসের মতোই ভঙ্গুর। ব্যবহার করতে গেলে দু’-চারটে ভাঙবেই। লজ্জার কিছু নেই।

তা হলে এ বছর শূন্য থেকেই শুরু করা যাক!

শূন্য

ভূতের ভয় পাব না। অনেক হয়েছে। আর নয়। যতই অন্ধকার হোক, যতই ঝিঁঝিপোকা ডাকুক, যতই শেয়ালের হুক্কাহুয়া, চামচিকি, বাদুড়— সব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব— ফোট!

তা হলে কি ভূত নেই? না না, তা হবে কেন, দিব্যি আছে! খোশমেজাজে আছে। আসলে আমরা ভূতকে ঠিক চিনে উঠতে পারিনি। কঠিন অসুখের মতো। ডাক্তারবাবু যেই ধরে ফেললেন, অমনি নিদান দিয়ে দিলেন। অসুখ ভ্যানিশ। আসল ভূত হল আমাদের অপরাধ, আমাদের মিথ্যাচার, আমাদের লোভ, স্বার্থপরতা ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্ধকারে থাকলে, একা থাকলে এগুলোই আমাদের ঘাড় মটকাতে আসে। শুরুতেই বাতলে দিলাম ভূতের মেডিসিন। তাই নতুন বছরে নো ভূত!

এক

বচ্ছরকার দিনে হোয়াটসঅ্যাপে ফেসবুকে অকাতরে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বিলোব না। মাগনা পাই বলেও নয়। কোথাও কারও সঙ্গে ক্ষণিক পরিচয়, দুটো বাক্য আর নম্বর বিনিময়, তার পর সারা বছর আর কোনও লেনদেন নেই; লোকটা খেতে পায় না উপোস করে, জেলে আছে না বাইরে, স্ত্রী আছে না চলে গেছে— কিচ্ছুটি না জেনে একটা ফিঙ্গার টাচে ‘শুভ নববর্ষ’ ঠুকে দিলাম— ব্যাপারটা খুব সুখকর নয়। কারণ অনেক খোঁজখবর নিয়ে, কাগজ পড়ে, টিভিতে টক-শো দেখে জেনেছি, এতে আলুর দাম কমে না, সস্তা হয় না বেগুনও। তা ছাড়া বৎসরান্তে কেউ যদি এসে চেপে ধরে— ‘ভাই! কী উইশ করেছিলি! গত এক বছরে কারখানা বন্ধ হল, বৌয়ের অপারেশন হল, মেয়ে পাড়ার মস্তানের সঙ্গে ভেগে গেল, ছেলে রাজনীতি করতে গিয়ে জেলে গেল, এখন ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে দরজায় দরজায় ঘোরার অপেক্ষা!’ আপনাকে কিন্তু তখন তোতলাতে হবে!

দুই

‘শুভ’ শব্দটাকে ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর আওতায় আনব। রোধ করব এর তেলাপিয়াসম বংশবৃদ্ধি। শুভ নববর্ষ, শুভ অক্ষয় তৃতীয়া, শুভ গণেশ চতুর্থী থেকে শুরু করে শুভ ঘেঁটুপুজো হয়ে শুভ জামাইষষ্ঠী, শুভ মহাপঞ্চমী ইত্যাদিতে পৌঁছে গেছি আমরা। এখনই লাগাম না টানলে আগামী দিনে শুভ সুনামি, শুভ নিম্নচাপ, শুভ ভূমিকম্প, শুভ ল্যান্ডস্লাইডে ভর্তি হয়ে যাবে ফোনের মেমরি। ফোন হ্যাং করতে পারে কিন্তু।

তিন

ঘুষ নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করব। পোস্টমডার্ন ঘুষ। অহেতুক লেজে না খেলিয়ে, ভ্যানতারা না করে প্রথম দিনই সোজাসুজি বলে দেব, ‘ভাই, উপরি চাই, তবেই ফাইল গা ঝাড়া দেবে।’ দাতাও সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবেন, ‘দেখুন, এই পর্যন্ত আমার দৌড়, এটা দিয়েই ঝাড়পোঁছ যা করার, করে নিন!’ ফলত সময় বাঁচবে, গাড়িভাড়া বাঁচবে। সেই গাড়িভাড়া দু’জনে সমান ভাগে ভাগ করে নেবেন পরে।

চার

নেতাদের বলছি, খাটের নীচে টাকা রাখবেন না। নানা বিপত্তি হতে পারে। খাটের তলা সাধারণত মশা-মাছি-মাকড়সা আর পোকামাকড়দের মুক্তাঞ্চল। বিছেরাও মাঝে মাঝে অতিথি হয়ে আসে। টাকা বার করার সময় গোয়েন্দাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলে মনে করতে পারে তারা। হুল আর কামড় দিয়ে পাল্টা আঘাত হানতে পারে তখন। মনে রাখবেন, গোয়েন্দারাও মানুষ। তোতাপাখি নয়।

আর দ্বিতীয়ত, বাড়িতে অবশ্যই টাকা গোনার মেশিন রাখুন। তা হলে গোয়েন্দাদের দৌড়ঝাঁপ করে মেশিন জোগাড় করতে হবে না। এটা গোয়েন্দাদের ডিউটির মধ্যে পড়ে না। তা ছাড়া মেশিন থাকলে আপনারও সুবিধে। উপঢৌকন অনেক সময় গুনে নেওয়া সম্ভব হয় না। মেশিন থাকলে সহজে গুনে ফেলতে পারবেন। টাকার অঙ্ক কম হলে সতর্ক করে দিতে পারবেন। বলবেন, এটা ভদ্রলোকের চুক্তি, এখানে চুক্তি খেলাপ মেনে নেব না। হ্যাঁ? কী বললেন? খাটের তলায় না রাখলে, টাকা রাখবেন কোথায়? সেটা আপনি ভাবুন! সবই কি বলে দেব নাকি!

পাঁচ

গোয়েন্দাদের প্রতি বিনম্র নিবেদন এই যে, আপনারা একচক্ষুবিশিষ্ট হরিণ হইবেন না। খাটের তলায় উঁকি দিতে হলে সবার খাটের তলায় উঁকি দিন, বেছে বেছে নয়। কারণ সব নোটেই গান্ধীছাপ আছে। তোয়ালে মুড়ে যিনি নিয়েছেন তিনি নিজের উন্নতিকল্পে নিয়েছেন, আর বাঁদিপোতার গামছা মুড়ে যিনি নিয়েছেন তিনি পাবলিকের উন্নতিকল্পে নিয়েছেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। যাঁর পরনে তোয়ালে ছিল তিনি তা-ই পেতেছেন। যাঁর পরনে গামছা ছিল, তিনি তা-ই বিছিয়েছেন। দু’জনের কেউই জানতেন না অলক্ষ্যে ক্যামেরা চলছে। জানতেন না, তাঁদের উলঙ্গসম ছবি জনগণের সামনে চলে আসবে কিছু দিনের মধ্যে। অতএব গোয়েন্দাগণ, আপনারা গামছা-তোয়ালের মধ্যে ভেদাভেদ করবেন না। যদি করেন, তা হলে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। কারণ আপনারা যেমন সন্দেহভাজনদের উপরে নজরদারি চালান, জনগণও তেমনই আপনাদের উপরে নজরদারি চালাচ্ছে। তারা একেবারেই বোকা-হাবা নয়। ইতিমধ্যেই জনগণ আপনাদের ‘রোবট’, ‘দম দেওয়া পুতুল’ ইত্যাদি বলে ডাকছে। কিছু দিন পর যদি ‘সেলাই মেশিন’, ‘কাদাখোঁচা’, ‘বুড়ো ভাম’, ‘জলবিছুটি’ এই সব বলে, তাদের দোষ দেওয়া যাবে না।

ছয়

জনপ্রতিনিধিদের বলছি, কেনারাম-বেচারাম হবেন না। ধরা যাক, আপনি ‘বি’-দলের হয়ে নির্বাচনে লড়েছিলেন। আপনি নিজে জিতেছেন, কিন্তু আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী ‘এ’-দল ক্ষমতায় চলে এসেছে। ওয়ান ফাইন মর্নিং, দেখা গেল, আপনি মাচায় উঠে কঞ্চিতে একটা ‘এ’-দলের পতাকা গুঁজে নাড়তে নাড়তে বলছেন, “অনেক ভেবে, অনেক লসাগু-গসাগু করে দেখলাম, ‘এ’-দলই পারে মানুষের প্রকৃত মঙ্গল করতে। তাই জনগণের স্বার্থে আমি আজ থেকে ‘এ’-দলে যোগ দিলাম।” স্বার্থ যে জনগণের নয়, আপনার নিজের, সে কথা ওই ঝান্ডাটিও জানে, এবং আড়ালে ফিকফিক করে হাসে। সে ‘এ’-দলের ঝান্ডা, তাই বিলক্ষণ জানে তার দল কতগুলো নোটের বান্ডিল দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়েছিল আপনাকে ওজন করতে। যদি মনে করেন যে, বড় বড় সরকারি চাকরি যদি বিক্কিরি হয়ে যেতে পারে, তা হলে আপনি, এক জন জনপ্রতিনিধি, তো নেহাতই তুশ্চু— তা হলে বলব, আর একটু ভেবে দেখুন। কথাটা ঠিক ভাবছেন কি?

সাত

ড্রাইভারদের প্রতি। ট্রাফিক সিগন্যাল লাল হয়ে থাকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খামোখা হর্ন বাজাবেন না। কারণ আপনি যতই হর্ন বাজান, নির্দিষ্ট সময়ের আগে সিগন্যাল তার রক্তচক্ষু মুদিবে না। শুকনো খটখটে কুয়োয় বালতি নামানো আর রক্তচক্ষু দেখানো সিগন্যালে দাঁড়িয়ে হর্ন দেওয়া একই ব্যাপার। কেউ তেএঁটে-র মতো বলতেই পারেন, ‘আমার হর্ন আমি দিয়েছি, তাতে কার কী! বিশেষ করে এটা তো আর নো-হর্ন জ়োন নয়।’ ঠিকই। যুক্তি আপনার সিমেন্টের গাঁথনির মতো নিরেট। কিন্তু আমি একটু অনুরোধ করব তাঁদের কথা ভাবতে, যাঁরা একটু রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চান। বাড়িতে সময় পান না, সিগন্যাল সেই সুযোগ করে দিচ্ছে।

আট

সেলেব্রিটিদের প্রেম বা বিয়ে নিয়ে ‘খিল্লি’ করব না। হতে পারে এটা তার সপ্তম বিয়ে বা নবম প্রেম। কিন্তু তাতেই বা কী! সে এক জন স্বাধীন দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। সুতরাং আপনি, জনৈক হুলিদাস, তাঁর প্রেম বা বিয়ের সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারেন না। আমাদের মহান রাষ্ট্র আপনাকে সেই অধিকার দিয়েছে কি না, বা পরচর্চা আপনার ব্যক্তিস্বাধীনতা কি না, সে তর্কে যাচ্ছি না। কথা হল, অপ্রয়োজনে মাথা না গলানোই ভাল। কে কার গলায় মালা দিলেন, তাতে আপনার কী! চরকা আপনার আছে, তেলও। শুধুমুধু অন্যেরটায় দিয়ে নষ্ট করবেন কেন? সেলেব্রিটিরা আপনার তৈলঋণ শোধ করতে আসবেন না। তাঁদেরকে তাঁদের মতো থাকতে দিন, নিজেও ভাল থাকুন।

নয়

কমরেড, সব দোষ আমেরিকার ঘাড়ে চাপাব না। যুদ্ধ, কোভিড, উষ্ণায়ন, উল্কাপাত, সীমান্ত সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, ক্রিকেটে হার সব কিছুর মূলে ওই বেঁড়ে ব্যাটা। খালি নিজের স্বার্থ বোঝে, খালি আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ে, খালি যুদ্ধবিমান আর বোমা বেচে পয়সা কামায়। আর দেশে দেশে গিয়ে ফুসমন্তর দেয় রাষ্ট্রপ্রধানদের কানে, তারাও অমনি হা-রে-রে-রে করে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। প্রথমত, নিজের স্বার্থ বোঝে না কোন মামা! কোন মামা নিজের স্বার্থ না দেখে পাড়াতুতো মহিমবাবুর মুরগির স্বার্থ দেখে? দ্বিতীয়ত, কলকাঠি তো আর চাঁদার কৌটো নয় যে, প্রকাশ্য দিবালোকে নাড়ানো হবে! কলকাঠি আড়াল থেকেই নাড়তে হয়, তা না হলে তার এমন নামকরণই বৃথা। তৃতীয়ত, মওকা পেলে যুদ্ধাস্ত্র সবাই বেচে। দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি। এখন তোমার স্টকের বোমা যদি পটকার মতো ফাটে, বা বিমান মাঝ-আকাশে গোঁত্তা খায়, খদ্দের তোমার কাছে আসবে না, অন্য দোকানে চলে যাবে। ভেবে দেখো কমরেড, যখন কেউ বাজারে আসে আখের গুড় কিনতে, পাঁচটা দোকানের মধ্যে, ধরা যাক, শ্রীগুরু ভান্ডারের গুড় সবচেয়ে ফ্রেশ আর সস্তা দেখে, তখন সে সেখান থেকেই গুড় নেবে। এর জন্য অন্য গুড়ের দোকানদাররা যদি ঘ্যানঘ্যানায়, শাপশাপান্ত করে, ‘বিচার চাই’ বলে, তা হলে তাদের বলা উচিত, ‘তোমরা আগে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক শেখো। সিঁড়িভাঙা অঙ্ক শিখলেই বুঝতে পারবে, জীবন এবং গুড়ের ব্যবসায় কী ভাবে ধাপে ধাপে উপরে উঠতে হয়।’ কিন্তু তা না বলে, আপনি কমরেড, তাদের নিয়ে মিছিল করেন। রাস্তার মোড়ে স্লোগান দিয়ে বলেন, ‘শ্রীগুরু ভান্ডারের গুড় কিনছি না, কিনব না। শ্রীগুরু ভান্ডার নিপাত যাক, নিপাত যাক!’ তার পর শ্রীগুরু ভান্ডারের মালিক জনৈক গুরুদাস সামন্তের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। এতে শব্দদূষণ বা বায়ুদূষণের বেশি কিছু হয় না। তার চেয়েও বড় কথা, তুমি বিপ্লব করে রাতে বাড়ি ফেরার পথে সেই শ্রীগুরু ভান্ডার থেকেই চুপিচুপি গুড় কিনে চাদরের তলায় ঢোকাও আর রাতে বৌয়ের হাতে তৈরি পিঠে খাও সেই গুড় দিয়ে। তার পর হাত মুঠো করে ‘কমরেড লাল সেলাম’ বলে কী যেন একটা বোঝাতে চাও। তার পর ‘তোমার নাম, আমার নাম, মুচিরাম (গুড়)’ বলে গদিওয়ালা পালঙ্কে শুয়ে পড়ো। কারণ পরদিন সকালে উঠে বিপ্লব করতে হবে, সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে গর্জন করতে হবে, প্রচুর কালো হাত হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করতে হবে।

দশ

প্রচুর মানুষ কথায় কথায় বলেন, ‘আমি বাম’। খুব ভাল কথা। কিছু বলার নেই। আবার হাততালি দেওয়ারও কিছু নেই। পৃথিবীর অনেক পন্থার মতো এটাও একটা পন্থা। এই পন্থাও মানুষের মঙ্গল কামনা করে। কিন্তু বহু কাল ধরেই বাঙালির কাছে এটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। আমি বাম, মানে আমি অন্য প্রজাতির এলিয়েন। মানে আমার এক্সট্রা তিনটে হার্ট আছে। কিন্তু মুশকিল হল, চার দিকে চিকেন-হার্টেড বামপন্থী থিকথিক করছে (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু তা নেহাত ব্যতিক্রমই)। তাঁদের জীবনযাপন, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মপন্থা বামপন্থা থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করে। মনে করুন, কখনও আপনাদের সরকার কৃষকদের উপরে গুলি চালাল। খানদানি শুঁড়িখানা বা রাশভারী ক্লাবে হুইস্কি খেতে খেতে ঘটনাসমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে থাকেন তাঁরা। প্রথম পেগের পর বলেন, ‘আনফরচুনেট’। তার পর কালের নিয়মে কারণসুধা গলা পর্যন্ত এমন উঠে আসে যে, হাঁ করে কড়াইভাজা ফেললে টুপ করে শব্দ হয়। তখন বলশেভিক জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, মার্ক্সবাদ, মহানায়ক চেচেস্কু, মানবদরদি স্ট্যালিন, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন নিয়ে আলোচনার পর জড়ানো গলায় রায় দেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের মহামন্ত্রী যা করেন, মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন।

এ সব করুন। কোনও অসুবিধে নেই। আপনার মদ, আপনি খাবেন; আপনার মগজ, আপনি বিশ্লেষণ করবেন; কারও কিছু বলার নেই। শুধু নিজেদের বামপন্থী ইত্যাদি বলার আগে একটু ভাববেন। কারণ আমার মতো হাঘরে মানুষজন ‘বাম’ মানে মলম ভাবতে পারে। ঢোল কোম্পানির মলম— দাদ হাজা চুলকানির অব্যর্থ দাওয়াই। মনে রাখবেন কমরেড, ঢোল কোম্পানির মালিক কানাইলাল ঢোল এক বার ভোটে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিলেন কমরেড জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে। তাই নতুন বছরে, আপনারা ঠিক কী ধরনের বাম, লেফটিস্ট বাম নাকি চুলকানির, সেটা একটু খোলসা করে দেবেন, ব্যস!

এগারো

মিত্রো-ওঁ-ওঁ! ভাইয়োঁ অওর বেহনোঁ! অচ্ছে দিন আ গয়া! শুধু অচ্ছে নয়, বহুত অচ্ছে দিন আ গয়া!

অ্যাঁ! কী বলছিস রে তোরা আবোড় পাবলিক? হাড়-হাভাতে, ঘড়ি-হারানে, দাঁতকেলানের দল! দেখতে পাচ্ছিস না চোখে চশমা লাগা! ছানি পড়লে কাটিয়ে নে! তখন ঠিক দেখতে পাবি! হ্যাঁ, কী বলছিস? ‘অচ্ছে দিন’ কেমন দেখতে? কী মুশকিল! কেমন আবার দেখতে! অচ্ছে দিন দেখতে অচ্ছে দিনের মতো! হ্যাঁ, ডিটো অচ্ছে দিনের মতো! আচ্ছা দাঁড়া, বুঝিয়ে বলছি! ‘অচ্ছে দিন’ অনেকটা ভগবানের মতো দেখতে! ভগবান যাকে যেমন রূপে দেখা দেন, সেটাই তাঁর রূপ। কাউকে মন্দিরের দেবতা রূপে দেখা দিলেন, তো কাউকে ঝালমুড়িওয়ালা। এক জনের সঙ্গে অন্য জনের মেলে না। ‘অচ্ছে দিন’ও ঠিক তাই। কারও কাছে ‘অচ্ছে দিন’ মানে ডাস্টবিন খুঁটে খাওয়া, কারও কাছে সদ্যোজাত সন্তান বিক্রি করে দেওয়া, কারও কাছে আবার ‘অচ্ছে দিন’ মানে দশলাখি কোট, কোটের পকেটে আবার একলাখি পেন। মিত্র, কানে কানে একটা কথা বলি আপনাকে। দশলাখি উষ্ণতার স্বাদ পেয়েছেন আপনি। কিন্তু আরও মিঠে উষ্ণতা আছে। আরও জম্পেশ। কী বলছেন? কুড়িলাখি কোট? তিরিশলাখি? না না, এটা ঠিক লাখ কোটির ব্যাপার নয় মিত্র, এটা অন্য টোটকা! আপনার ওই কোটটা খুলে ফেলুন গা থেকে। তার পর আপনার ওই সব মূর্খ দেশবাসী, অজ্ঞ দেশবাসী, খালপাড় দেশবাসী, ফুটপাত দেশবাসী, ফ্লাইওভারের তলদেশ ভারতবাসী— সবাইকে তেরো সেকেন্ড, সাত সেকেন্ড বা আট সেকেন্ড করে পরতে দিন। তারা সবাই অনুভব করুক সেই আশ্চর্য কোমল কবোষ্ণতা। সবাই ধন্য ধন্য করবে, জয়ধ্বনি দেবে আপনার নামে। হ্যাঁ, কী বলছেন? আপনি তা হলে কী পরবেন? আর একটা কোটের অর্ডার দেবেন? না না, কোনও দরকার নেই। দেখবেন, কোনও কোট-ফোট লাগছে না, কোট ছাড়াই দিব্যি শরীর গরম লাগছে। কী বলছেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? তা হলে বলি, এক বার করে দেখুন। ঠিক মিলে যাবে আমার কথা। এক রাজার গল্প বলি আপনাকে। আমাদের দেশেরই রাজা, নাম হর্ষবর্ধন। মেলায় গিয়ে তিনি প্রচুর দানধ্যান করতেন প্রজাদের। কপর্দকশূন্য হয়ে যেতেন। শেষে সামান্য বস্ত্র সম্বল করে, প্রজার হাতে তুলে দিতেন রাজপোশাকও।

বারো

সাহস করে আর একটা কথা বলব মিত্র। জানি, আপনি রাগ করছেন না। আপনার দরাজ হৃদয়। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। জানি আপনি আমাদের মতো ইতরজনকে একটু-আধটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। এটাও তেমনই করবেন। বলি কী, মিত্র, একটা প্রবাদ আছে আপরুচি খানা, অর্থাৎ যে যার রুচিমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। যেমন ধরুন কেউ ফলমূল খাবে, কেউ ভাত-রুটি খাবে, কেউ মাছ, কেউ মাছরাঙা। যিনি আপেল খেতে ভালবাসেন, কী দরকার তাঁকে জবরদস্তি ডালিম খাওয়ানোর! যিনি ডাল-ভাত খেতে পছন্দ করেন, তাঁকে জোর করে বিরিয়ানি খাওয়ানোর কোনও অর্থ হয় না। আবার ধরুন, কেউ মাছ— কেউ পমফ্রেট ভালবাসে তো কেউ ইলিশ, কেউ আবার কই। কেউ মুড়ো ভালবাসে তো কেউ ল্যাজা, কেউ পেটি তো কেউ গাদা। তেমনই কেউ উটপাখির মাংস ভালবাসে তো কেউ উটের। এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ একেবারেই অবাঞ্ছিত। কিন্তু সেটাই হচ্ছে যে এখানে! আর একটা কথা মিত্র, আপনার রাজ্যে নিজেদের কপাল দোষে অনেক প্রজাই এখনও ডাস্টবিন খুঁটে খায়, খিদের ‘বন্দে ভারত’ যখন তাদের নাড়িভুঁড়ি পিষে দেয়, তখন খেয়াল থাকে না দাঁতে কোন মাংস পেষাই হচ্ছে— বক না বকচ্ছপ, হাঁস না হাঁসজারু। তাই মহারাজ, আপনি তো সবার রাজা, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে প্রজাদের একটু স্বায়ত্তশাসন মেনে নিন।

তেরো

আমরা সবাই জানি সেই কিশোর ছেলেটিকে। কলকাতা শহরে একটা তারাওয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পড়তে এসেছিল অনেক দূর থেকে। শেষে নিজেই চলে গেল তারাদের দেশে। পাঠিয়ে দেওয়া হল তাকে। কেন পাঠিয়ে দেওয়া হল? অপরাধ কী? যত দূর জানি, সে তো দাদাদের হুকুম মোতাবেক কাজই করেছিল। নারীশরীরের মাপজোখ বলেছিল, নিজের বাবা-মাকে উলঙ্গ করেছিল, উলঙ্গ হয়েছিল সে নিজেও। এমনকি সেই অবস্থাতেই দক্ষ অলিম্পিয়ানের মতোই চার তলা বারান্দার সঙ্কীর্ণ রেলিং-এর উপর দিয়ে ‘কদম কদম বঢ়ায়ে’ দিয়েছিল। তার পরও তাকে চলে যেতে হল! বোকা ছেলে! এত দূর হেঁটেও হেরে গেলি! কী বলছিস? ঠেলে ফেলে দিয়েছিল তোকে? সেই সুযোগ তুই কেন করে দিলি বাবা আমার! অন্তত একটাকেও কষিয়ে লাথি মারলি না কেন একটা? আসলে ভেবেছিলি, একটু মজা করছে দাদারা। শোন, এরা সব আলালের ঘরের দুলাল-দুলালী। এরা শিয়ালের চেয়েও ধূর্ত, হায়নার চেয়েও হৃদয়হীন, শকুনের চেয়েও সুযোগসন্ধানী। দরকারে এরা নিজের মা-বাপকেও নিলামে চড়ায়। এখন আমরা জানি, সিসি ক্যামেরা থাকলে হয়তো আটকানো যেত তোর অকালমৃত্যু। হস্টেলে কী না হয়! মাদক যৌনতা র‌্যাগিং— সব জানতেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিন্তু কেউ কোনও পদক্ষেপ করেননি। তাই এ সব পাত্তা দিস না তুই। তোর ছবিতে মালা দিয়ে নয়, তোর হাতে হাত রেখে বলি, আর যেন পরের বছর এই সময় এমন লেখা আমায় আর লিখতে না হয়।

চোদ্দো

অতিবাম। আমরা জানি, ‘অতি’ জিনিসটা খুব হিতকর নয় সমাজের কাছে। আমাদের শাস্ত্রই তো কত সতর্ক করেছে! অতি বাড় বেড়ো না, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, অতি চালাকের গলায় দড়ি, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ— সুতরাং দেখা যাচ্ছে ‘অতি’ জিনিসটা মোটেই শাস্ত্রসম্মত নয়। তাতে অবশ্য তাঁদের কিছু যায় আসে না, কারণ তাঁরা শাস্ত্র মানেন না। আরও অনেক কিছুই মানেন না তাঁরা। দেশ মানেন না, সংবিধান মানেন না, জাতীয় সঙ্গীত মানেন না, জাতীয় পতাকা মানেন না, জাতীয় পশু পাখি ফুল মানেন কি না সে ব্যাপারে এখনও পরিষ্কার কোনও প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়নি। তবে তাঁরা মানেনটা কী?

পনেরো

যুদ্ধ সম্বন্ধে দু’-চারটে কথা। সিগারেট যদি বিড়িকে আক্রমণ করে, বোমা ফেলে মানুষ মারে, হাসপাতাল দখল করে, সেটা ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ, চরম মানবতাবিরোধী। একই সঙ্গে বিড়িও যদি সিগারেটে হামলা চালায়, মানুষ মারে, মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে গ্যাংরেপ করে, তা হলে সেটাও সমান ভাবে অন্যায়, নিন্দনীয়। সিগারেট আক্রমণ করলে নিন্দে ও মিছিল করব, আর বিড়ি আক্রমণ করলে বলব— ‘দাঁড়া ভাই, এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলাম, এখন একটু হাই তোলার সময় দে, তবে জানিসই তো সিগারেট কেমন ছ্যাঁচড়া...’ (অর্থাৎ, ওদের মানুষের বোমার ঘায়ে মরে যাওয়াটা খুবই উচিত, ওদের মেয়েদের গণধর্ষিতা হওয়াটাও...) তখন কেউ আপনাকে গাঁজাখোর বললে, তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।

ষোলো

ইন্ডিয়া ক্রিকেট টিমকে বলব, ফাইনালে হারার ধারাবাহিকতায় এ বার একটু ক্ষ্যামা দাও। খেলায় হার-জিত থাকেই। কিন্তু সব ম্যাচ জিতে, বেছে বেছে ঠিক ফাইনালে ধ্যাড়ানো! যেন জীবনে প্রচুর প্রেম করে বিয়ের দিন নার্ভাস হয়ে যাওয়া। আমার প্রস্তাব— আগেভাগে দু’-একটা এলেবেলে ম্যাচ হেরে তার পর ফাইনালে নেমো বাবারা।

সতেরো

যাঁরা যে কোনও উপায়ে মন্দির করতে চান, করুন। আমি চাঁদা দেব। যাঁরা মসজিদ করতে চান, করুন। আমি চাঁদা দেব। গির্জা কিংবা গুরুদোয়ারার বেলাতেও আমি উপুড়হস্ত। কারণ আমি মনে করি এই মুহূর্তে আমাদের দেশে মন্দির-মসজিদের খুব দরকার। শত সহস্র মন্দির-মসজিদ সমস্যা জর্জরিত ভারতবর্ষের সব সমস্যার সমাধান হয়ে উঠবে। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে আমি এক দিন যাব এই সব ধর্মস্থানে। ঈশ্বর আল্লা গডকে দেখতে। জীবন ধন্য করতে। পুণ্য অর্জন করতে। কিন্তু ঢুকে আপনি অবাক! এ সব কী হচ্ছে এখানে! সারি সারি বেড! অসুস্থ রোগী! স্যালাইন চলছে! স্টেথো গলায় ডাক্তারবাবুরা এক বেড থেকে আর এক বেডে যাচ্ছেন। কোনও উপাসনালয়ের বেঞ্চিতে সারি সারি ছাত্র-ছাত্রী। তারা পড়ছে সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন। শিক্ষক পড়াচ্ছেন। বিস্ফারিত চোখে দেখব আমরা।

এ বার কাজের কথায় আসি। আপনারাও কিছু কিছু চাঁদা দেবেন তো? যাঁরা দেবেন এবং যাঁরা দেবেন না— সবাইকে হ্যাপি নিউ ইয়ার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariyo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE