E-Paper

চিরবিষণ্ণ, চির-অনিবার্য

মা-কাকিমাদের মধ্যে কেউ এক জন বললেন, শিউলিই একমাত্র খসে পড়া ফুল, যা পুজোর কাজে লাগে। সরস্বতী পুজোর শাড়ি রং করতেও এই ফুল ছিল অপরিহার্য। ভেষজ, প্রসাধনী তৈরিতেও তুলনা নেই এই ফুলের। আবার শিউলি গাছই সাক্ষী ছিল প্রেমিকার করুণ পরিণতির। রাজকন্যা পারিজাতিকার স্মৃতি নিয়ে সূর্যের স্পর্শে শিউলি ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দুর মতো। তাই কি এর নামেও বিষণ্ণতার ছোঁয়া?

সেবন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৪০
ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

শেফালিকা ফোটা সন্ধ্যায়

খোয়াবে কি বলো মন যায়?

খোয়াবে তো মন যায়। চোখ বুজলে এত বছর পরেও স্পষ্ট দেখা যায়। ওই যে পাশেই অনেকখানি জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্যিকালের পারিজাত বৃক্ষ।‌ আজ্ঞে হ্যাঁ, খোঁজ করলেই দেখবেন পারিজাতের ডাকনাম শিউলি। তার আর একটি বেশ ইঙ্গিতমূলক নাম আছে, হরশৃঙ্গার। সেটির দিকে এখন আর যাচ্ছি না। সেই শৈশব থেকে শুনেছি, স্বর্গের ঐশ্বরিক ফুল হল পারিজাত। তবে তিনিই যে পাশের বোসবাড়ির শ্যাওলা-ধরা মাটিতে প্রাচীন শেকড়জাল ছড়ানো শিউলি গাছ, তা কে বা জানত!

তবে শিউলির গল্প মানে আমাদের বাঘা যতীন পার্কের দুর্গাপুজো। এই কান পাতলেই শুনতে পাই, অন্তরা চৌধুরীর আধো-আধো কণ্ঠে ‘পুজোর বাদ্যি’ বেজে উঠেছে। তবে সে বাদ্যি বেজে ওঠার পিছনে গল্প আছে। পাশের কলেজপাড়ায় দুর্গাপুজো হয়, সেখানে আমাদের বিশেষ পাত্তা দেওয়া হয় না। তাই বাবা-মা পাড়ার আরও অন্যদের নিয়ে দুর্গাপুজোর পরিকল্পনা করে ফেললেন। পুজোর বাসন গেল আমাদের বাড়ি থেকে। ডাক্তার রায়কাকু সপ্তমীর দিন খাওয়াবেন। অষ্টমীর দিনের দুটো আইটেমের দায়িত্ব উকিল সিংহজেঠুর। বাড়ি-বাড়ি থেকে যে যা পারে, চাঁদা তোলা হল। আমরা দুধভাতের দল পেলাম ফুলতোলার দায়িত্ব। মফস্সল শহরে তখন পুজোর ফুল বলতে যার যার বাড়ির ফুল। দুর্গাপুজোয় পদ্ম কেনা ছাড়া উপচে ওঠা ফুলের জোগান দেবে এই ছোটর দল। মোটামুটি সব বাড়ি থেকেই এক জন করে সদস্য এই দলে আছে। অনেক হিংসুটে আবার বাড়ির পিছন দিকের গোপন ফুলের খবর দিতে চায় না। কিন্তু বোসবাড়ির বড়মা উদারহস্ত। খুব ভোরে ঘুম-ভাঙা চার-পাঁচটি ছেলেপুলের দলকে শিউলি কুড়নোর পর মিষ্টি অবধি খাওয়াবেন বলেছেন। কিন্তু শিউলি তুলতে এসে শিহরিত তারা। প্রাচীন গাছটির কালচে কাণ্ডের ভাঁজে লেপ্টে আছে রোঁয়া-ওঠা খড়খড়ে কম্বলের মতো শুঁয়োপোকার দল। গা ঘিনঘিন করলেও ও-দিকেই চোখ চলে যাচ্ছে। নবীন গাছের ফুলগুলি বড়সড়। বড়মার বাড়ির গাছে অজস্র ফুল, কিন্তু তারা কোঁকড়ানো তারাকুচির মতো ছোট্ট। পরে বুঝেছি, গাছ বুড়ো হলে ফুল ছোট হয়ে আসে। তদুপরি শেকড়ের উপর ঘন সবুজ শ্যাওলায় শুঁয়োপোকা ঠাহর করা যায় না। ভয়ে ভয়ে সেদিনের ফুল সংগ্রহ হল। ঠিক হল, পরদিন সন্ধ্যায় ওই গাছের তলায় চার পাশে পাথর আর ইট চাপা দিয়ে খবরের কাগজ পেতে রাখা হবে। কোনও এক সমঝদার খোকা বুদ্ধি দিল, এই শিউলির পোকামাকড়ের চক্কর ছেড়ে অজস্র লঙ্কাজবা তুলে নিলেই তো হয়। সঙ্গে সঙ্গে মৈত্রবাড়ির পাকা মেয়ে বলে ওঠে, “বুদ্ধি না হাতি! ওই ক’দিন বাদে কালীপুজো হবে, তখন তুই লঙ্কাবাজির সঙ্গে মালা গেঁথে লঙ্কাজবা নিয়ে যাস।” ঝগড়া-টগড়া বাধিয়ে খোকার দল বিদায় নিল। ওরা দলের কারও ভাই হওয়ার সূত্রে এসেছিল, কিন্তু মাটি থেকে টুকিয়ে ফুল তোলার ইচ্ছে নেই মোটেই। অঞ্জলির লাইন ঠিক করা, ধুনুচি প্রতিযোগিতার আয়োজন, মাইকে হাঁকডাক আর বিসর্জনের ট্রাকের সামনে বাবা-কাকাদের সঙ্গে হেঁটে যাওয়া, ওতেই গর্বিত ছিল ওদের সদ্যজাগ্রত পৌরুষ। তবে এই যে এত ঘটাপটা করে শিউলি কুড়নো হল, পুজোর পাত্রে পৌঁছনোর আগেই সে মূর্ছা গেছে। পুরোহিত মশায়ের এক ধাপ নীচে আমরা সার দিয়ে বসে উঁকি মেরে দেখছি, কার আনা ফুল বেছে বেছে তুলে নিচ্ছেন তিনি। শিউলির স্তূপ একটু ঠেলে পিছনে সরিয়ে অপরাজিতা, টগর এগিয়ে গেল। আমরা পিছনের সারিতে। কিন্তু অবশেষে আমাদের শিউলিও কাজে লেগে গেল। ঠাকুরমশাই বোধ হয় তখনও জানতেন না পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য-ফুল শিউলি, তা হলে সর্বাগ্রে সেটিই টেনে নিতেন!

পিছন থেকে মা-কাকিমাদের মধ্যে কেউ এক জন বললেন, শিউলিই একমাত্র খসে পড়া ফুল যা পুজোর কাজে লাগে। এই জন্যেই বোধহয় শিউলির বৈজ্ঞানিক নাম, নিকট্যানথেস আরবার-ট্রিস্টিস, এর ভিতরেই বিষণ্ণ কথাটি আছে। ‘আরবার-ট্রিস্টিস’ এই লাতিন শব্দবন্ধের অর্থ বিষণ্ণ। সে সন্ধ্যায় ফোটে, সকালে শুকোয়। তার আর একটি নাম ‘ট্রি অব সরো’। তাই সে দুঃখী, নেতিয়ে পড়া রূপ নিয়ে দুর্গার ঝলমলে দিব্য বিভার নীচে স্তূপাকারে পড়ে রইল। তাতে অবশ্য ছেলেমেয়েদের দলটির কিছু এল-গেল না। আমরা পুজোর ক’টা দিন হইহই করে অন্য ফুলের পাশে সাজি ভরে শিউলি কুড়োলাম। উদ্বাস্তু হিসেবে পাওয়া পাঁচ কাঠা জমিতে সবার বাড়িতেই তখন অফুরন্ত ফুলের গাছ। তারা তখনও জানে না, তাদের পাড়াতেই চক্রবর্তী-বাড়িতে থেকে গেছেন খোদ ‘ফুলচোর’-লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ওই উপন্যাস যখন পড়লাম, তখন শিউলির গন্ধ-মেশা শৈশব আর বাঘা যতীন পার্ক থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।

সামান্য শিউলি/ পৃথিবীতে মাঝে

মাঝে শরৎ না এলেও তারা ফোটে

জঙ্গলের গেট পেরিয়ে চার পাশ খোলা গাড়িটি পা রাখল কালচে লাল পাথুরে মাটিতে। দু’পাশে শাল পলাশ বুনো জামগাছ। উঁচু-নিচু কাঁচা পথে লাফিয়ে উঠছে নামছে গাড়ি। দূরে সবুজ ভেদ করে পরিত্যক্ত দুর্গ, যেখানে শায়িত বিষ্ণুর পাশে অরণ্যের অধিকার নিয়ে বাঘেদের দ্বৈরথ চলে। জিপ এক খোলা প্রান্তর জোড়া ঘাসজমির মুখোমুখি হল। দেখবেন, হাতি ডুবে যাওয়া ঘাসজমির ভিতর তেমন বৃক্ষ নেই। ড্রাইভার ও অরণ্য-প্রদর্শক স্থানীয় ভাষায় কথা বলছে। বৃক্ষহীন জমির রহস্য উন্মোচনের আগেই বাঁদরের ‘কল’ আসতে শুরু করেছে। মন চলে যাবে আসল উদ্দেশ্য ব্যাঘ্র দর্শনে।

পেঁচানো পথ দিয়ে দুর্গের উপরে ওঠা যায়। তার পর বাঘেদের সাম্রাজ্য। ওই শেষ ধাপ থেকে নীচের দিকে বৃক্ষরাশি পেরিয়ে আবার সেই হলুদ-সবুজ শ্যাওলার মতো হিল্লোলিত ঘাসের দিকে খেয়াল করে দেখলাম, ওই জমির মাঝে কয়েকটি গাছ আছে। ফেরার পথে কৌতূহলের খানিক নিরসন করে চালক মহোদয় জমির ভিতর দিয়ে এমন একটি জায়গায় চলে আসবেন, যা ছিল আপনার কল্পনার অতীত। একটি ছেড়ে-যাওয়া কুয়ো, তার পাশে ধসে-পড়া মন্দির আর আম-বেলগাছের পাশে পুষ্পে ভরা দু’টি শিউলি গাছ। নবরাত্রির সময় বলে জঙ্গলে ঢোকার আগে সারা পথে ছেলেমেয়ে পরিবার-পরিজনহীন বেশ কিছু দুর্গামূর্তি দেখে এসেছি। তেমন কোনও দূরবর্তী মণ্ডপ থেকে মৃদু ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। চালক আর পথপ্রদর্শক নেমে এই ভগ্ন মন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে এল। যদিও অরক্ষিত এই বনভূমে বাঘের ভয় এবং সন্ধ্যা সত্যি হয়-হয়। চার পাশ ও মাথা-খোলা জিপে বেশি ক্ষণ থাকতে দিতে চায় না এরাও। আমি অবশ্য নাছোড়বান্দা। কেন এতটা জায়গা জুড়ে বড় গাছ নেই? শুনতে হল, এখানে বহু সংখ্যায় বৃক্ষ থাকতেই পারে না, কারণ এখানেই প্রায় শহরের গায়ে লেগে থাকা তাদের দীর্ঘদিনের গ্রাম বা বনবস্তি ছিল। বাঘের আবাস খাতায়-কলমে যত বেড়েছে, তাদের উচ্ছেদ বেড়েছে। রাতারাতি তাদের স্থায়ী-অস্থায়ী বাড়িঘর ভেঙেচুরে অরণ্য সম্প্রসারিত করা হয়েছে। স্থানীয় বিশ্বাসের কারণে মন্দিরটি ভাঙা হয়নি। জেদাজেদি করেই নেমে পড়লাম বাঘ-ডাকা অরণ্যে। মাত্র বছর পাঁচেক আগে বনবস্তি উচ্ছেদে মন্দির চত্বর তেমন কিছু ভগ্নপ্রায় নয়। অবশ্য চালক ছেলেটি বেশি দূর এগোতে দিল না। মূর্তিহীন গর্ভগৃহে এর মধ্যেই শিকড়বাকড় ডানা মেলেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, জগদ্ধাত্রীর মতো এ দিকে দুর্গারও বাহন বাঘ। চালক ছেলেটি বলল, ওর শৈশবে এই স্থায়ী ও একমাত্র মন্দিরে নবরাত্রির দুর্গা তৈরি করতে আসতেন এক বাঙালি কুমোর। যদিও তেমন বাংলা জানতেন না। মাঝে মাঝে বাঘের মাথায় মাটির কেশর দিয়ে দিতেন। উনিই বলেছিলেন, এই পারিজাত তাঁদের শরৎকালের দুর্গাপুজোর সময় ফোটে। চার পাশে ঢেউ খেলে যাওয়া ঘন ঘাস বন, তার পিছনে গা-ছমছমে শালের জঙ্গল। বহু দূর থেকে নবরাত্রির পূজার্চনার শব্দ নিচু সুরে ভেসে আসছে। চার পাশের ফুলে ওঠা ঘাসফুলকে কাশ মনে হতে পারে আপনার, আর ম-ম করা শিউলির গন্ধ এক গলা শৈশবের মধ্যে এনে ফেলবে। কল্পনা করবেন ওই স্তরের উপর শিউলির স্তর পড়া জাজিমে শরীর টেনে টেনে সরীসৃপ উঠে যাবে মন্দিরগৃহে, বিকেলের নিবে আসা রোদের নিরিবিলিতে ক্ষণিকের ব্যাঘ্রদম্পতি খুনসুটিতে গড়াগড়ি যাবে। পথপ্রদর্শক ছেলেটি কেন গোঁজ হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছে, পরের দিন শুনতে পাবেন। যে দেবী তাদের পূর্বপুরুষ-নারীর জমি থেকে উৎখাত হওয়া রুখতে পারে না, তাঁর মন্দিরে আর পারিজাত বৃক্ষে তার কোনও অভিরুচি নেই।

দুটি পাতা একটি কুঁড়ি

এলাসি মুন্ডাকে চেনেন না নিশ্চিত। বন্ধ হওয়া আর খোলা, ডুয়ার্সের চা-বাগানের বিরক্তিকর আশা-নিরাশার দোলা দেওয়া এলাকার বাসিন্দা সে। বছরের কিছু সময় কাঁচা পাতা বেচে, সরকারের ভর্তুকি পেয়ে আর বাদবাকি আকালের সময়ে চায়ের ফুল সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটে তার পরিবারের। জঙ্গল-মানুষের টানাটানি-লড়াইয়ের যে অচ্ছেদ্য চক্র তৈরি হয়েছে, তার বলি তাঁর মতো অনেকেই। এলাসির তিন বছরের কন্যা প্রেমিকা মুন্ডা সন্ধ্যার সময় বাবার পাশে বসে খেলছিল। সারা দিনের খাটুনিতে চোখ ধরে এসেছে এলাসির। পাথরের টুকরো চাপানো দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিল সে। ব্যস, বয়স্ক বা দাঁতভাঙা চিতাবাঘ তক্কে তক্কে ছিল। দুর্বল শিকার পেয়ে টেনে নিয়ে গেল প্রেমিকাকে। কুকুর-ছাগলের পর সহজ শিকার এই মানবশিশু। তার পর যথারীতি হইহই রইরই কাণ্ড।

স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষিপ্ত শ্রমিক মহল্লা। জঙ্গলের ভিতরে এক শিউলিতলায় প্রেমিকার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার হল। এর পর থেকে এলাসি পরশুরামের মতো শিউলি বৃক্ষ দেখলেই তেড়ে যায়। শিউলি হিমালয়ের পাদদেশের অতি স্বাভাবিক বৃক্ষ। দোষ কোথায় তার? দোষ আমাদের, যারা লাভের জন্যে ক্রমাগত দেশীয় শালের বদলে স্বার্থপর সেগুন লাগাই। সেগুনের তলায় সেভাবে নানা ধরনের লতাগুল্ম-ঝোপঝাড় জন্মায় না। কন্দ ধরে না। ফলে সেগুন-অরণ্যে খরগোশ, বন্য বরাহ, হরিণের খাদ্যাভাব ঘটে। আর তারা না থাকলে চা-বাগানের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা চিতাবাঘের খাদ্যে টান পড়ে। অন্য দিকে প্রায় বন্ধ চা-বাগানে অর্থাভাবে শ্রমিকদের ঘরগুলি জীর্ণ দশায় আর নিরাপত্তাহীন খোলামেলায় বিপন্ন হয়। সূক্ষ্ম তারে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এরা। একটা গিঁট খুললেই অন্যটি ঢিলে হয়ে যায়। এলাসি, যার নাম তার বাবা এলআইসি থেকে রেখেছিল, তার কন্যার নামে কোনও জীবনবিমা নেই যে, ক্ষতিপূরণ পেয়ে অন্য সন্তানদের সুরক্ষিত রাখতে পারে।

বনবস্তির আশপাশে দুর্গাপূজার ঢাক বেজে ওঠে। শিউলি কুড়িয়ে আনে মেয়েরা। এলাসি বলছিল, গাছগুলি দেখলেই তার কাটতে ইচ্ছে করে, কারণ ওই ফুলের মধ্যে তার ফুলের মতো মেয়েটাকে কেমন বীভৎস দেখাচ্ছিল! আপনি তাকে বোঝাতে যাবেন না যে, যার নিজের অপর নাম ‘ট্রি অব সরো’, সন্ধ্যায় ফুটে সকালে ঝরার বিষণ্ণতায় যে কাতর, সে কি আর চেয়েছিল, তার সুগন্ধি বিছানায় এসে শিশুটির অমন পরিণতি হোক? দোষ শিউলির নয়, মানুষ নামে সর্বগ্রাসী প্রাণীর।

শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ

এমন রাত একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই

গল্পের টানে টানে একেবারে শ্যাম-চম্পায় পৌঁছে যেতে পারেন। কোথায় বঙ্গদেশ আর কোথায় শ্যাম বা তাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুড়ি প্রদেশ! পশ্চিমবঙ্গের মতো শিউলি সেখানেও রাজ্য-ফুল। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় কাঞ্চনাবুড়ি আমাদের কাছে ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’ সিনেমার খাতিরে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা মিত্রশক্তির যুদ্ধবন্দি এবং তাদের অধিকৃত অঞ্চল থেকে নিয়োগ করা এশীয় শ্রমিক, উভয়কে জোরপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করে। এই যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে জাপানি সাম্রাজ্যবাদী সেনাবাহিনী তাইল্যান্ড ও মায়ানমারকে সামরিক সরবরাহ দেবে বলে অমানুষিক তৎপরতায় রেলপথ নির্মাণ করছিল। এদের দিয়ে সেখানকার স্বচ্ছতোয়া নদী কোয়াইয়ের উপর ‘ডেথ ব্রিজ’ বানিয়েছিল। যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, ওলন্দাজ সবাই ছিল। এক শান্ত, গড়ানো দুপুরে কোয়াই নদীর উপরের রেলপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি যখন, চার পাশ শৈশবের পিকচার পোস্টকার্ডের মতো ঝকঝকে। ব্রিজের ও-পারে নদীর পাড় ঘেঁষে ফুলে ভরা শিউলি গাছ। স্যুভনির শপে শিউলি আকৃতির দুল। মনে হচ্ছিল, সমস্ত নৃশংস অন্যায়ের সময়েও প্রকৃতি নিজের সৌন্দর্যকে কখনও অমলিন করে না। সে-ই যেন শাশ্বত, চিরসত্য।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

শিউলির আর এক নাম পারিজাত! হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে শিউলি ফুল বা পারিজাতের কথা অনেক বার এসেছে। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী— সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে, তাঁদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা, তাঁরা পানই বা কী উপায়ে? ওদিকে কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন, যার ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়। এ দিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র ঘটনাটা জেনে ফেলে স্বাভাবিক ভাবেই রেগে আগুন। তিনি কৃষ্ণের উপর গোপনে নাকি ক্রুদ্ধও ছিলেন। এই কারণে তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন— কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই, কিন্তু তাতে কোনও দিন ফল ধরবে না। তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।

এই ভেষজ বৃক্ষের আরও একটি গল্প আছে। পারিজাতিকা নামে এক রাজকন্যা সূর্যের প্রেমে পড়ে তাকে কামনা করেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও পান না বলে আত্মাহুতি দেন। তাঁর দেহভস্ম পারিজাতবৃক্ষ রূপে ফুটে ওঠে; যে কিনা নীরব ব্যর্থ প্রেমের প্রতীক। সূর্যের স্পর্শমাত্র সে ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দুর মতো। প্রকৃতি ও মানবজীবন অঙ্গাঙ্গি জড়িত ছিল এক সময়। অতি প্রয়োজনীয় ভেষজ বৃক্ষগুলিকে বাঁচানোর জন্য পূজনীয় ঠাকুর-দেবতাকে তার ভিতরে প্রোথিত করে দেওয়া হত। এই গল্পগুলো সে বিষয়কেই প্রমাণ করে।

ওগো শেফালিবনের মনের কামনা

এক বার সরস্বতী পুজোর হলুদ শাড়ি নিয়ে কথা উঠেছে। মা বলল, তাদের একান্নবর্তী পরিবারের নানা বোনের জন্য ছোপানো হলুদ শাড়ি তৈরি হত। উদ্বাস্তু পরিবারে টানাটানির সংসারে নতুন শাড়ির প্রশ্ন নেই। উঠোনে পড়ে থাকা শিউলি ফুল জমিয়ে রাখত মা ও মায়ের তুতো দিদি-বোনেরা। বৃন্ত ছিঁড়ে রোদে শুকিয়ে নিয়ে, তা জলে গুলে হলুদ রং তৈরি হত। মায়ের সেই বিবাহ-পূর্ব শহর পূর্ণিয়ায় থাকতেন এক ফুলমুগ্ধ লেখক। সেই লেখক সতীনাথ ভাদুড়ির বাড়ির চার পাশ জুড়ে অজস্র গাছ। টর্চ জ্বেলে ফুল ফোটা দেখছেন যিনি, নিজের বাগানের শিউলি কি আর তাঁর মন ভোলায়নি?

লেখা আর লেখক জুড়ে শিউলির ছড়াছড়ি। ভক্ত পাঠকের মনে পড়বে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘শিউলির গন্ধ’। আবার এই ক’দিন আগেই উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায় দিদির সঙ্গে সমরেশ মজুমদারের একদা বাসস্থান চা-বাগানের কোয়ার্টার্স দেখতে গিয়ে দেখি, ঢোকার মুখে উঠোনে এক মস্ত শিউলি গাছ। ওই ফুলের বিছানো চাদরে পা না দিয়ে প্রবেশ বা প্রস্থানের কোনও পথ নেই।

জয় গোস্বামীর বহুপঠিত কবিতা ‘নন্দর মা’। দেশভাগ আর তার শরণার্থী জীবনের অন্তিম করুণ পরিণতিতে যখন উঁচু-নিচু ঢালু পথ, শিশির ভেজানো কাঁটাতার পেরিয়ে দুলালী ওরফে প্রিয়বালা ছুটছে, তার মনে পড়ছে ফেলে আসা গ্রাম-ঘর-দোরের কথা, মনে পড়ছে তাদের ‘দাওয়ায় শিউলি গাছ’। বুদ্ধদেব গুহর ‘শিউলি ফুল’ গল্পে যে ‘শিউলি’, তার বাড়ি ছিল কাণহারি হিলের পায়ের কাছে ঘন সবুজ শাল জঙ্গলের মধ্যে, হাজারীবাগে। শিউলি আর গল্পের নায়ক, দু’জনেই দশ-বারো বছরের।‌ স্মিথ সাহেবের বাড়ির কাছে সদ্য কিশোরটি শিউলিকে দেখে রবিঠাকুরের গান গাইছে, ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল... কেন রে তুই উন্মনা, নয়নে তোর হিমকণা’ এই বাল্য-কৈশোরের সন্ধিক্ষণের ভাল লাগার শিউলি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় হঠাৎ করেই চলে যায়। শিউলি এখানে যেন তার মুহূর্তের জীবন ও ঝরে পড়া নিয়ে প্রতীক রূপে থেকে যায়।

এক বা একাধিক শিউলি গাছ নেই, এক সময় এমন বাঙালি বাড়িই ছিল না। উঠোনের এক পাশে, বাগানের মধ্যিখানে, শিউলি থাকবেই। সে সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগল্পে হোক বা রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাঁকুড়ার গ্রামের বাড়ির শিউলি বিছানো উঠোনেই। রামকুমার মুখোপাধ্যায়দের মস্ত বড় গাছটির তলায় কাপড় বিছিয়ে রাখা হত, যাতে ভোরের শিউলিতে কাদা-নোংরা না লাগে। ওই ফুল চলে যেত মুখুজ্জেদের ঠাকুরদালানে।

আমাদের বাঘা যতীন পার্কের টিনের চালের একতলা বাড়ির সামনে কাঠের ক্যাঁচ করে খোলা গেটের দু’পাশে ছিল বাগান। আমাদের এই বাগান দিয়ে ঘেরা একতলা বাড়িটিতে বহু গাছের একটি-একটি করে গল্প আছে। একেবারে সেই ছোট্টবেলায় মানুষ সঙ্গীসাথীর বদলে গাছের সঙ্গে গল্প করতাম আমি। বলা বাহুল্য, উভয়পাক্ষিক সংলাপ ছিল ভেন্ট্রিলোকুইজ়মের মতো! একটি কাঁঠাল এবং কাল্পনিক শিউলি ছিল আমার গল্পের প্রধান চরিত্র। তত দিনে পাশের বাড়ির বড়মাদের বাড়ির পিছনে গ্যারাজ বাড়াতে হবে বলে সেই শিউলি গাছ কাটা পড়েছে। যেমন সে অনায়াসে জন্মায়, তেমনই অবহেলায় বিদায় নেয়। জবা, টগর, পেয়ারা, ব্রহ্মযষ্টি বা বামুনহাটি, পাহাড়ের তিতোপাতি থাকলেও আমাদের ছিল না শিউলি। আমার সমান মাপের শিউলি চারা এল। বাড়িতে ঢোকার গেটের ডান দিকে পোঁতা হল তাকে। টগবগিয়ে বাড়ে না সে, তবু আমাকে ছাড়িয়ে কবে যেন আস্ত বৃক্ষ হয়ে উঠল। আমি আজীবন রয়ে গেলাম তেমনই ছোট্টটি!

ওষধি বৃক্ষরূপেও শিউলির কত কদর। সে সময়ের কোবরেজমশাইরা অধুনা সরকারি সিলমোহরে শল্যচিকিৎসকদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। তাঁদের ছেঁচা-বাটা-শুকনোয় শিউলির ছাল অতি প্রয়োজনীয়। আয়ুর্বেদ বলুন বা হালের ভেষজ ওষুধ ও প্রসাধনী, শিউলির গুণ রাখার জায়গা পাবেন না। এ সুগন্ধ নাকি মানসিক চাপ কমাতে ও মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। চুল পড়া কমানো, চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা, পাতার রসে কৃমি দূর করা থেকে সে সর্বরোগহর। অরুচি হলে ঠাকুমা শিউলি পাতার বড়া খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। বিষ-তেতো সেই পাতার বড়া সোনামুখ করে খাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। উদরসর্বস্ব সর্বভুক বাঙালি এ ভাবেই শিউলির ধড়ামুড়োর ব্যবহার করেছে। তখন আর মনে হবে না, এই গাছটির আসল সৌন্দর্য তার কোমল নরম পুষ্পে!

আপনার এই কেজো দৌড়বাজের জীবনে শরৎ মানে সেই টানা এক মাসের বদলে মোটে চার দিনের ছুটি। একদা আকাশের গাঢ় নীল এখন খর আগুন ঝরায় বা বৃষ্টিতে প্যান্ডেল ডুবিয়ে দেয়। নগরের বাইরে সারা বছর নর্দমা আর বৃষ্টির সময় খানিক নদী-নদী দেখতে জলধারার পাশের ঝড়তিপড়তি জায়গায় কাশের গুচ্ছ কোনও মতে টিকে থাকে। আটশো-ন’শো-হাজার-বারোশো বর্গফুটে থাকার আকাঙ্ক্ষায় মানব পুত্র-কন্যারা সবটুকু কংক্রিটে মুড়ে ঊর্ধ্বমুখী সুখী গৃহাঙ্গন তৈরি করেন, যেখানে একটি রোগা টিকটিকে পেঁপে গাছেরও জায়গা হয় না। তারাই আবার শৈশবের বকুল, শিউলির জন্য বেজায় হা-হুতাশ করেন। কেউ কেউ টবে লাগিয়ে ফেলেন আর বছরের প্রথম শিউলিটি খসে পড়লে তা নিয়ে চটজলদি রিল তৈরি হয়ে যায়। শহরের অক্টোপাসের হাত-পা এখন মফস্সল ছাড়িয়ে গ্রাম ছুঁয়ে ফেলেছে। ‘আরবান ভিলেজ’-এ বাঁধানো ঘেরাটোপে চিড়িয়াখানার বাঘের মতো শিউলি বৃক্ষ দেখতেও পারেন। তবে সেখানে ভুলেও হামলে পড়ে, পড়ে-থাকা ফুল কুড়োতে যাবেন না। বরং সেখানে ‘ফিলিং শিউলি ফুল’ লেখা সেলফি জ়োনে একটি ‘পারফেক্ট পিকচার’ নিয়ে নেবেন।

এই গোপন সুযোগ নেয় শিউলির গেরিলা গন্ধ

ওই যে আমাদের রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমি সমস্ত দিন কেবল টুপটাপ্ করিয়া ফুল ফেলিতেছি; আমার তো আর কোনো কাজ নাই। আমার প্রাণ যখন পরিপূর্ণ হইয়া উঠে, আমার সাদা সাদা হাসিগুলি মধুর অশ্রুজলের মতো আমি বর্ষণ করিতে থাকি।” এই শিউলি চিরকাল হাসি ও অশ্রুজলের ভিতর থেকে গেছে। কিন্তু এখন তো আর তার দেখা মেলে না। তবে আপনার শিউলি ফুলটি থাকল কোথায়? থাকল কল্পনার উপবনে, স্মৃতির ভাঁড়ারে। যেখানে উঁকি দিলে কিছু অবোধ, সরল বালিকামুখ দেখা যায়, যারা ভোরের শিউলির স্তূপের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকে। মনে করুন, ওই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ‘শিউলির গন্ধ’ উপন্যাসটি। দারিদ্ররেখা রেল লাইনের এ পার-ও পারের মতো যে বিভাজন তৈরি করে, শিউলি কুড়নোর বালিকাবেলায় তা মোটেও থাকে না। ওই যে, যে মেয়েটি আপনার সঙ্গে বাঘা যতীন পার্কের পুজোয় পাশাপাশি সাজিতে ফুল ভরে নিয়ে গেল, বহু দিন পর তার খোঁজ করে চমকে উঠবেন। বাধ্যতার শরীর-বিক্রির পল্লিতে তার দারিদ্ররেখা তাকে লাইনের ও-পারে নিয়ে চলে গেছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘হাংরাস’ উপন্যাসের শুরুতে রাজনৈতিক কারণে জেলবন্দি লেখকের সহবন্দিরা জেলের ভিতর গুলিতে নিহত। তাঁদের এক জনের বিষয়ে লিখছেন, “গলা অব্দি চাদরে ঢাকা। কনকের মুখটা শিউলি ফুলের বোঁটার মতো হলুদ”— আদতে কবি এ ভাবেও শিউলিকে দেখতে পারেন! শিউলির বৃন্ত তখন আর ঈশ্বররূপী আশ্রয়-সান্ত্বনায় নয়, সমাজ বদলের কাহিনিতে মিশে গেছে। আসলে যে যে ভাবে দেখতে চায়, সে ভাবেই দেখতে পায়। সে মৃদু গন্ধভরা স্পর্শকাতর পুষ্পই হোক আর বিপ্লবের গনগনে আগুন। আগুনে কমলা জ্বলছে।

ওই যে নরম একটু পুরনো রুমালের মতো মোলায়েম আর মুছে যাওয়া আতরের মতো সুগন্ধি ফুল, তার মালাও বড় স্পর্শকাতর। মুহূর্তের সুখ নিয়ে এসে সে জীবনের ক্ষণস্থায়ী মাধুর্যকে বুঝিয়ে দিয়ে যায়। কান পাতলে আজও নগর বাহিরে কোনও নৈঃশব্দ্যে মোড়া পাহাড়তলি গ্রাম বা অরণ্যপ্রান্তে তার খসে পড়ার শব্দ শোনা যায়। তার ফোটা ও ঝরে পড়ার বিরাম নেই। পূতিগন্ধময় কোলাহল ছেড়ে ওই বৃক্ষতলে আমরা দাঁড়াব কি না, সে তো আমাদেরই নির্বাচন। মানুষের জগতের অন্যায়-হত্যা-প্রবঞ্চনায় তার কোনও দেনাপাওনা নেই। তবু নিষ্ঠুরতম সত্যি এই, তার বেঁচে থাকা বা অন্তিম বিনাশ নির্ভর করে থাকে শুধুমাত্র মানুষের শুভাকাঙ্ক্ষায়।

শিউলি এক ফেলে আসা শৈশবের, হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প। যেমন দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়াতেই তার চরিতার্থতা, মানুষ তার নিজের জীবনের সঙ্গে তাকে ঠিক সে ভাবেই মিলিয়ে নিতে পারে। তাকে আপনি কোনও ভাবেই দীর্ঘ সময়ের জন্য আগলে রাখতে পারবেন না। ফুলদানিতে তাকে সাজানো যায় না। ভাসমান অবস্থায় জলেও সে খানিক পরেই গলে পচে যায়। মানুষের পাতানো সম্পর্কগুলি অতি স্পর্শকাতর, অতি ক্ষণস্থায়ী, ঠিক তেমনই। সন্ধ্যায় সারা দিনমানের উত্তাপ যখন নম্র, তখন সে ফুটে উঠে সুগন্ধ বিলিয়ে দেয়। সমস্ত রাত যেন তার নির্জন একাকী অভিসার। কে এল, কে এল না, তাতে তার কিছু যায়-আসে না। সূর্যের আলো পড়তে পড়তে যখন মানুষের দিন শুরু হয়, ধীরে ধীরে সে সরে যায়। শিউলির এই জীবনচক্রে আমাদের অতি প্রিয়জনেরা, যাঁরা এই ছিলেন, আবার এই ‘নেই’ হয়ে গেছেন— তাঁদের গন্ধ ছড়ানো থাকে। আশ্বিনের ছুটিতে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা আমি দেখতে পাই, যখন বারান্দায় এসে বসেছি, মায়ের শিউলি কুড়িয়ে সাজিতে ভরা হয়ে গেছে। ঠাকুমা সেই ফুল নিয়ে ঠাকুরের আসন সাজাচ্ছে। ওই যে মা, ওই যে আমার বাবা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা, এঁরা তো এই ছিলেন! প্রখর সূর্যতাপের পর দিবস তাঁদের কোথায় গিলে নিল? ধু ধু পৃথিবীতে আমাকে একা ফেলে কোন শিউলিবনে তারা এখন শিউলি কুড়োচ্ছেন কে জানে! এই যে আজ পরম নিশ্চিন্তে বন্ধুর হাত ধরাকে মনে হচ্ছে চিরন্তন, পলক ফেলতেই মুছে যাচ্ছে সেই উন্মাদনা। ফুর্তির ডগমগ উল্লাস নয়, শিউলি আমাদের চিরবিষণ্ণ, চির-অনিবার্য মৃত্যু।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Night Jasmine Sheuli Flower

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy