ছবি: রৌদ্র মিত্র
গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের এই জনপদ খুব ভাল লেগে গিয়েছে মানুষটার। লাগবে না-ই বা কেন! মানুষজন ভাল। গঙ্গার মাটি-জলে ফসলও হয় সোনার মতো। একা গঙ্গা নয়, তিন-তিনটে নদীর ঢেউ ভিজিয়ে দিচ্ছে শহরটাকে। সে জন্যই তো নাম ত্রিবেণী। ইলাহাবাদের প্রয়াগের মতোই, গঙ্গা যমুনা আর সরস্বতী। এই হু-হু হাওয়া, নদীতীরের সন্ধে আর দূরের মায়াময় ঘণ্টাধ্বনি কেমন বিবশ করে দেয় এই ইমানদার মুসলমানকেও। তাই কি মুখ থেকে আলগোছে বেরিয়ে আসে ফারসির বয়ানের বদলে সংস্কৃত শ্লোক? সুরধুনী গঙ্গার সুললিত স্তব?
‘হে ভাগীরথী, মায়েরা যাকে ত্যাগ করেছেন, স্বজন-বন্ধুও যাকে স্পর্শ করেনি, যা পথে পড়ে থাকলে পথিকরাও শ্রীহরিকে স্মরণ করে, সেই মৃত শরীরকেও তুমি কোলে নিয়ে বইছ। তুমি করুণাময়ী, মায়েদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা।’ এক মুসলমান এই গঙ্গাস্তব লিখে গিয়েছেন বলে জনপ্রবাদ। জাফর খান গাজি। অনেকে বলেন তিনি এই স্তব অহরহ গাইতেন বটে, কিন্তু এর রচয়িতা বেদব্যাস। আজকের বাঙালি কাজী নজরুলের শ্যামাসংগীত গায়, গিরিশচন্দ্র সেনের কোরান অনুবাদের কথা জানে, কিন্তু জাফর খান গাজিকে চেনে না। সাতশো বছর পেরিয়ে আজও যিনি কবরে শুয়ে— ত্রিবেণীর গঙ্গাপাড়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে, দরগায়।
যিনি গঙ্গাস্তব লেখেন বা পাঠ করেন, তিনিই মসজিদও বানান। আজকের ভারতে এ জিনিস অসম্ভব না হোক, অবিশ্বাস্য বটেই। সেই জিনিসই সম্ভব হয়েছিল সাতশো বছর আগে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকের কথা, মুঘল সম্রাটরা তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। মুসলমান শাসকের সেনাপতি জাফর খান গাজি এসেছেন রাজ্যজয়ে। সেই নিয়েও কত কিংবদন্তি, বিচিত্র গল্পের বুনট! ত্রিবেণীর হিন্দু রাজার রাজত্বে এক মুসলমান প্রজার বাড়িতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, কুরবানি দেওয়া হয়েছে একটি গরু। রাজা শুনে অগ্নিশর্মা, দণ্ড দিলেন প্রজাকে। নাখোশ প্রজা নালিশ জানালেন খোদ দিল্লির বাদশাহ ফিরোজ শাহের কাছে। দিল্লি-বাংলা কোঁদল, বড় রাজা-ছোট রাজার রেষারেষি সে যুগেও ছিল। বাদশাহ বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালেন বদলা নিতে। সেই বাহিনীর সেনাপতিই নাকি ছিলেন জাফর খান গাজি।
শোনা যায়, আজকের হুগলি জেলার ত্রিবেণীর অদূরেই হয়েছিল সেই যুদ্ধ। হিন্দু রাজা পরাজিত হয়েছিলেন, শাসকের পদে বসেছিলেন জাফর খান গাজিই। আর সব দেশে সব কালেই শাসক সিংহাসনে বসা ইস্তক চেষ্টা করে এসেছে, জয়টাকে কী করে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া যায়। কেউ বানিয়েছে ভয়-জাগানো বিশালকায় মূর্তি, কেউ আকাশ-ছোঁয়া স্তম্ভ, মিনার, কেউ বা ধর্মস্থান। মন্দির-মসজিদ বানানোর চলই ছিল বেশি। আজকের জাফর খান গাজি মসজিদের সামনে বসানো আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার বোর্ড বলছে, সে দিনের যুদ্ধজয়ী মুসলমান সেনাপতির বানানো মসজিদ মাথা তুলেছিল ১২৯৮ সালে। আর সংলগ্ন দরগা, যেখানে আজও জাফর খান আর তাঁর ছেলে-নাতি এমনকী পুত্রবধূরও কবর দেখতে লোকে ভিড় করে, তা গড়ে উঠেছিল ১৩১৫ সালে।
ইতিহাস বলছে, এটাই বাংলার প্রাচীনতম মসজিদ। স্থাপত্যরীতিতে স্বতন্ত্র। আজও মসজিদের গায়ে টেরাকোটার কারুকাজ। মসজিদের কাছেই দরগা, যেখানে জাফর খান গাজির সমাধি, তার দরজার গায়ে মঙ্গলঘটের মোটিফ। কোথাও আঁকা কল্পলতা, তারা, ফুল, প্রদীপ। আরবিতে লেখা পাথরফলক যেমন আছে, তেমনই খোদিত সংস্কৃত লিপিও। আছে দশাবতারের ছবি, দেবদেবীর মুখ। গোটা মসজিদটাই ইট আর পাথরে মিলিয়ে অদ্ভুত কায়দায় বানানো। সে নিয়েও চর্চা বিস্তর।
এত কাণ্ডের কেন্দ্রে যিনি, সেই জাফর খান গাজির জীবনও খুব সুবিদিত নয়। এক হিন্দু রাজার সঙ্গে যুদ্ধে নাকি মারা যান তিনি। তবে ইতিহাস যেখানে তল পায় না, বিশ্বাস সেখানে আঁচল পেতে দেয়। ৭২০ বছরের পুরনো মসজিদ এখনও ‘চালু’। স্থানীয় মুসলমানরা প্রার্থনা করেন, হিন্দুরা পথচলতি মাথা ঠেকান। মানুষটা যুদ্ধ করতে এসেছিলেন, কাজ সেরে ফিরেই যেতে পারতেন। যাননি। থেকে গেছেন গঙ্গাপাড়ে। ত্রিবেণীর গঙ্গা নাকি ঢেউ উঁচিয়ে প্রণাম নিত এই ‘বুজুর্গ’-এর স্তোত্র উচ্চারণে। বিশ্বাসে সম্প্রীতির স্বস্তিটুকু তো মেলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy