Advertisement
E-Paper

আকাশের চোখ আর নীল সানগ্লাস

তামাটে কালো বোল্ডারের ওপর আমার ছায়া পড়েছে। পা থেকে কোমর পর্যন্ত। এবড়োখেবড়ো শরীর রোদ জল খাওয়া শক্ত পাথরে। তাই ছায়াটাও ভেঙেচুরে একাকার। ছায়ার মধ্যেই শয়ে শয়ে মণিহীন কোটর, ছায়ার বাইরে রোদ পড়া জায়গায় জল জমে আছে, জোয়ার রেখে গেছে। সেখানে ছোট ছোট আকাশের চোখ।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০১:২২
ছবি: শুভময় মিত্র।

ছবি: শুভময় মিত্র।

তামাটে কালো বোল্ডারের ওপর আমার ছায়া পড়েছে। পা থেকে কোমর পর্যন্ত। এবড়োখেবড়ো শরীর রোদ জল খাওয়া শক্ত পাথরে। তাই ছায়াটাও ভেঙেচুরে একাকার। ছায়ার মধ্যেই শয়ে শয়ে মণিহীন কোটর, ছায়ার বাইরে রোদ পড়া জায়গায় জল জমে আছে, জোয়ার রেখে গেছে। সেখানে ছোট ছোট আকাশের চোখ। বোল্ডারের সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে প্রায় সোজা একটা লাইন বহু দূরের বাঁ দিগন্ত থেকে শুরু হয়ে আমার পা স্পর্শ করে চলে গেছে ডান আকাশ পর্যন্ত। কলম্বো শহরটা আবছা দেখা যাচ্ছে সেখানে, সমুদ্রের ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাসের আড়ালে। বৃষ্টির পরে রোদ উঠলেও আবার বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে, হাওয়ায় ভিজে ভাব। তাই আকাশের রং নীলচে স্লেটের মতো। মাঝসমুদ্রে কার যেন কিছু উষ্মা জমে ছিল, ভেসে ছিল আকাশে, তাও নেই আর, মিশে গেছে বাতাসে। এমন সহজ আকাশের নীচে প্রায় সরল আর একটা রেখা যার নীচে একটু গাঢ় নীল ছাই জল। বড় ঢেউ নেই। ভেতরে ভেতরে কারা যেন ফুঁসছে ইতস্তত। তাই কোথাও কোথাও সাদা ফেনা। চটচটে, নোনা গন্ধ ভেসে আসছে। প্রায় সবটাই শুষে নিচ্ছে ভেজা বালির পাড়, কিছুটা হারিয়ে যাচ্ছে ফ্যাকাশে, হলুদ, শুকনো বালিতে। এই বালিকে বেঁধে রেখেছে আমার পায়ের নীচের বোল্ডারের লাইন। বোল্ডারের গা বেয়ে নিশ্চয়ই ছোট্ট একটা লাফ মেরে নেমে গেছে আমার ছায়া। তাই কোমরটুকু নেই। পেট, বুক, কাঁধ আর মাথাকে দেখতে পাচ্ছি বালিতে। দু’হাত ছড়িয়ে দিলাম। পাখা মেলল ছায়া। মাথাটা সামনে ঝোঁকালাম অনেকখানি, ছায়া থেকে মাথা অদৃশ্য হয়ে গেল। এ বারে আর একটা ছায়া পড়ল আমার পাশে। নিঃশব্দে এসেছে কেউ, টের পাইনি, খসখসে, ফিসফিসে হাওয়ার শব্দে।

একটা লোক। এই রকম লোকই আসে আমার কাছে। মাছ ছাড়ানো জালের মতো মাথার চুল। বাকি শরীরের বর্ণনা দিতে অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টিতে নিভে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া জ্বলন্ত কাঠের মতো চেহারা, তার ওপরে অত্যাচারের নানা আঁকিবুকি। দাঁড়িয়ে আছে মাথা নামিয়ে, চোখ দেখা যাচ্ছে না, কিছু বলছেও না। আস্তে আস্তে ঘুরল সে, ছায়াকে সঙ্গে নিয়ে। কাঁপছে হাতের আঙুলগুলো, ডাকছে বোধহয় আমাকে। সচরাচর কেউই আমাকে ডাকে না। যারা ডাকে, তাদের শরীরের ভাষা বুঝতে পারি আমি। এগোচ্ছে লোকটা, আমিও পিছন পিছন, মাঝে মাঝে মাড়িয়ে ফেলছি ওর মাথার ছায়াটাকে। নুড়ি পাথর, ফিশপ্লেট, রেললাইন, প্ল্যাটফর্মের র্যাম্প উঠে গেছে, পা টেনে টেনে উঠছে সে। টিকিট কাউন্টারে কেউ নেই। চারপাশ খাঁ খা। কিন্তু আওয়াজ করে ট্রেন এল, পুরনো চেহারা, লোক আছে কিছু। আমরাও উঠলাম। দাঁড়ালাম দরজায়। নারকেল গাছের সারি, চালাঘর, বাড়ি, ছোট চার্চের ক্রস, সমুদ্রের ঝলক। আমরা কোনও কথা বলছি না। আমি জানি ও কোথাও একটা নামবে, আমিও নামব। গমগমে স্টেশন গেল ক’টা, এর মধ্যে চেকার এসেছিল, আমার দিকে এক বার তাকাল, তার পর অন্য দিকে চলে গেল।

একই রকম ফাঁকা আর এক জায়গায় নামলাম, তার পর চললাম। হাওয়ায় চেনা গন্ধটা ভেসে এল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। তার পরেই আবার বালি, সমুদ্র। ভাঙাচোরা কিছু বাড়ি, কেউ থাকে না বোধহয়। পাতা গজিয়ে যাওয়া একটা দেওয়াল পেরিয়ে মনে হল বসতি এসে গেছে। বাচ্চার কান্না শুনতে পেলাম। দাঁড়ালাম ছায়ায়। আরও ক’জন এল, আমাকে হাত নেড়ে ডাকল দূর থেকে। আমার সঙ্গে আসা লোকটাকে আর দেখা গেল না। এরা নিশ্চয়ই মাছ ধরে সমুদ্রে। শ্রীলঙ্কার চার পাশেই তো সমুদ্র। মেছোদের গ্রাম আমি আগেও দেখেছি অনেক, এখানটা সে রকম নয়। শুনেছি বিশাল বিশাল ট্রলারে করে মাছ ধরা হয় এখন, জাল ফেলে কে আর ধরবে, কটাই বা উঠবে। তা হলে এরা করে কী? চলে কী করে? এই অবস্থায় আমার কিছুটা ভয় পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করল না। কারণ আমার কিস্যু নেই। তা ছাড়া ইচ্ছে হলে আমি নিজের ছায়ার মাথাও কেটে ফেলতে পারি।

বিচ্ছিরি প্লাস্টিকের মগে করে জল দিল আমাকে, ইশারা করে বুঝিয়ে দিল, বোসো, খাবার দেব। বেশ কয়েক জন মদ খাচ্ছে, রোদ্দুরে বসেই, কোনও কথাবার্তা নেই কারও। পরিষ্কার অনুভব করছিলাম মেয়েটেয়ে আছে নিশ্চয়ই, আশেপাশে। আর আমি, এখানে একেবারেই অড ম্যান আউট। আমাকে রাস্তা থেকে কেন তুলে এনে খেতে দিচ্ছে সেটাও ভাবলাম এক বার। স্রেফ চেহারাটা স্থানীয়দের মতো নয় বলে? কিন্তু ফরেনার নই সেটাও বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই। একটা ঘুমঘুম ছায়া, মিঠে হলুদ বিকেলের রোদ, নানা শরীরের নোনা মেছো গন্ধে বিভোর হয়ে ভাবছিলাম তা হলে আমি আসলে কে?

সন্ধের আগে জলের ধারে ঘুরে এলাম, টুরিস্ট নেই, তাই বিচ বলা চলে না। ভিজে বালিতে কারা যেন নকশা রেখে যাচ্ছে, আবার জল এসে মুছে দিচ্ছে। ফিরে যেতে রাজি নয়, ঝিনুক একটা, শরীর উপুড় করে জল ভরা বালি আঁকড়ে পড়ে আছে। বার বার তার খোলা শরীরের ওপর দিয়ে আরব সাগরের জল আদুরে অত্যাচার করে যাচ্ছে যাবি না মানে? একটা ঝিনুক তুলে মুখের খুব কাছে এনে চুমু খেতে গেলাম, নোনতা লাগল, একটা নতুন গন্ধ পেলাম। মনে হল দে-জা-ভু হচ্ছে।

আলো নেমে যাওয়ার পর সমুদ্রে, দিগন্তে আলো উপচে পড়ল, জাহাজের পর জাহাজ চলেছে ঝলমলিয়ে। তীরের শহরেও দূরের নীলচে আভা। চাঁদ আছে, মনমরা। কেরোসিনের কুপি দিয়েছে দুপুরের খাওয়ার পর যে ঘরে আমি আছি সেখানে। পাশে কোথাও রান্না হচ্ছে। গলা পাচ্ছি, টুংটাং। ভাষা না জানা, না বোঝাটা এত সুবিধের ভাবতেও পারিনি। ঘরের তাকে বুদ্ধমূর্তি আছে, সেই নিমীলিত দৃষ্টি, বরাবরই মৌনী, অল্প ফুল পায়ের কাছে। আর কয়েকটা ছোট প্যাকেট, প্লাস্টিকের তৈরি, ভেতরে সাদা গুঁড়ো। ইশারা করে দেখালাম এক জনকে, সে আপত্তি করল, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। হাত নেড়ে, বার বার ইঞ্জেকশন দেওয়ার ভঙ্গি করে, মাথা চাপড়ে, নিজের চোখ বন্ধ করে ভয়ংকর কিছুর ইঙ্গিত করতে লাগল। বুঝলাম হেরোইন। ইশারা করলাম, রাজি আছি। দাও।

প্রথম দুটো শটের পর আহামরি কিছু হল না। এক বার মনে হল আকাশ থমকে গিয়েছে, তারা ঝরা থেমে গিয়েছে, আকণ্ঠ জল খেলেও গলার ভেতরে শিরীষ কাগজ। রাতটা থাকব, যেখানে বসে ছিলাম সেখানেই শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়তেই মাথার ওপর টালি খসে যাওয়া চালের মধ্যে একটা ধূমকেতু, বড় হচ্ছে, একটু একটু করে বাড়ছে। জানি, আমার দিকেই আসছে। কে যেন একটা হালকা, ময়লা নিশ্চয়ই, চাদর চাপা দিয়ে দিল আমার ওপরে। তার ভেতর দিয়েও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম অকারণে খসে পড়া উল্কার আলো। ভুল পাওয়ার দেওয়া নীল সানগ্লাসটা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে অন্ধকারে। কানটা খুব সজাগ হয়ে উঠেছে, সুর করে পড়া দুর্বোধ্য স্তোত্র শুনতে পাচ্ছি। যেন অনেকে মিলে পরিক্রমা করছে আমার চাদর মোড়া শায়িত দেহের চারপাশে। এ বারে কেউ ছুঁয়েছে আমাকে, আঙুলগুলো খেলা করছে চিবুকের ওপরে, নীচে। খসখসে আঙুল, আমি জানি এগুলো এক সময় খুব নরম ছিল। পাচ্ছি সেই গন্ধটা, নাকের কাছে, ঝিনুকের গন্ধ।

ভোরের আলো ফুটতেই নীল গোলাপি আলোয় স্নান করে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। চলে যাব, তাই সবাই দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি, কেউ কিচ্ছু বলল না। কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনলাম, ‘একা আছো এখন, সাবধানে যেও।’

suvolama@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy