Advertisement
E-Paper

আমি তখন এসপি

গল্পে সিনেমায় দেখানো হয়, পুলিশ নকশালদের নির্বিচারে খুন করছে। নকশালরা যে নিরীহ মানুষগুলোকে নির্বিচার নিষ্ঠুর খুন করেছিল, তা নিয়ে কেন কারও হেলদোল নেই?আমি হাওড়ায় এসপি হয়ে এসেছিলাম ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি, আর ১৯৭০ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ প্রথম নকশাল আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগল। প্রথম দিকে পোস্টারে লেখা হত: ‘বিপ্লব কোনও জনসভা নয়’, ‘পৃথিবী আমাদের ও তোমাদের, কিন্তু অবশেষে তোমাদের’। কিন্তু খুব শিগগিরই আরম্ভ হল ‘খতম মানে খুন নয়, এটা হল শ্রেণিঘৃণার চরম প্রকাশ’। আমরা বুঝতে পারছিলাম মাও-এর এই উক্তিগুলোর পোস্টার লাগাচ্ছে চারু মজুমদারের পার্টির লোকেরা, কিন্তু তাদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

নিরুপম সোম

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

আমি হাওড়ায় এসপি হয়ে এসেছিলাম ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি, আর ১৯৭০ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ প্রথম নকশাল আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগল। প্রথম দিকে পোস্টারে লেখা হত: ‘বিপ্লব কোনও জনসভা নয়’, ‘পৃথিবী আমাদের ও তোমাদের, কিন্তু অবশেষে তোমাদের’। কিন্তু খুব শিগগিরই আরম্ভ হল ‘খতম মানে খুন নয়, এটা হল শ্রেণিঘৃণার চরম প্রকাশ’। আমরা বুঝতে পারছিলাম মাও-এর এই উক্তিগুলোর পোস্টার লাগাচ্ছে চারু মজুমদারের পার্টির লোকেরা, কিন্তু তাদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এও বোঝা যাচ্ছিল, এ বার খতম অভিযান শুরু হবে। প্রথম দিকে যারা ছুরিকাহত হয়ে মারা গেলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন বেলুড় পলিটেকনিকের টিচার, কলকাতার হেয়ার স্ট্রিটে একটি বড় সাইকেল দোকানের মালিক। এঁরা কী করে শ্রেণিশত্রু হলেন, বুঝে উঠতে পারলাম না। দেশব্রতী-তে পড়ে আমরা জানতে পেরেছিলাম, চারু মজুমদারের নির্দেশ ছিল, শ্রেণিশত্রু নিধনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হবে না, কারণ তা নাকি ‘এলিটিজ্ম’-এর জন্ম দেয়। তাই সব শ্রেণিশত্রুকেই ছোরা-ছুরি দিয়েই জখম বা হত্যা করা হচ্ছিল। প্রথম দু-একটি ঘটনাস্থল থেকে নকশাল ছেলে ধরা পড়ার পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, এ পার্টির কোনও লোকাল কমিটি, ডিস্ট্রিক্ট কমিটি ইত্যাদি নেই। এক একটি পার্টির ছেলেকে মধ্যমণি করে গড়ে উঠেছে এক একটি অ্যাকশন স্কোয়াড, এবং তাদের নিজ নিজ এলাকায় শ্রেণিশত্রু চিহ্নিত করে তাকে খতম করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

এ আন্দোলন নিয়ে সমর সেনের মতো পণ্ডিত লোকেরা অনেক কিছু লিখেছেন। আমি খালি পুলিশ সংক্রান্ত ঘটনার কথা বলছি। ছুরি খেয়ে পুলিশের মধ্যে যাঁরা মারা গেলেন, তাঁরা সবাই কনস্টেবল ও দু-এক জন এ এস আই। প্রথম যে কনস্টেবলটি নকশালের ছুরিতে মারা গেলেন, তাঁর দেহ পোস্টমর্টেমের পর চ্যাটার্জিহাট ফাঁড়ির কাছে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলাম আমি এবং প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের ডিআইজি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্ত্রী একটি শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো আমাদের দিকে ছুটে এলেন ও ছেলেটিকে ডিআইজি-র সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার স্বামী তো চলে গেল। এখন আপনারাই বলুন, এই বাচ্চাটাকে আমি কী ভাবে মানুষ করব।’ ডি আই জি কল্যাণ চক্রবর্তী পুলিশে যোগ দেওয়ার আগে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে আবেগের সঙ্গে বললেন, ‘মা, কিছু ভাববেন না, আপনার স্বামী বেঁচে থাকলে এ-ছেলে যে-ভাবে মানুষ হত, এখনও সেই ভাবেই মানুষ হবে। আপনি পেনশন, গ্র্যাচুইটি ছাড়াও এক সপ্তাহের মধ্যে কুড়ি হাজার টাকা হাতে পাবেন এবং আপনি রাজি থাকলে আপনার এই ছেলে আঠারো বছর বয়স হলে আপনার স্বামী যে চাকরি করত, সেই চাকরিই পাবে। আর যাদের হাতে আপনার স্বামী মারা গেল, তাদের ধরার জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে।’ শুনে মহিলা অনেকটা শান্ত হলেন। এ রকম দুজন কনস্টেবলের মৃতদেহ আমি তাঁদের বিধবা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছি ও একই রকম অবস্থার মধ্যে পড়েছি। তবে, আমি কল্যাণবাবুর মতো অমন নাটকীয় ভাবে কথা বলে আশ্বস্ত করতে পারিনি।

যে সব একটু অবস্থাপন্ন চাষি নকশালদের হাতে মারা যেতেন, প্রায়ই দেশব্রতী-তে দেখতাম, তাঁদের জোতদার, সুদখোর, নারীমাংসলোলুপ ইত্যাদি বলা হত। আর নিহত পুলিশকর্মীদের ঘুষখোর, ট্রাকের মালিক ইত্যাদি বলা হত। অথচ, তদন্তে দেখেছি সে রকম কিছু নয়। এক জন চাষি মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত ভাইদের বলেছেন, ‘একসঙ্গে থেকো, কিছুতেই পৃথক হয়ো না, তোমাদের বড় বউদিকে (অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীকে) ও আমার ছেলেটাকে দেখো।’ আর পুলিশ কনস্টেবলদের ‘ট্রাকের মালিক’ বলা একেবারেই মিথ্যে ছিল।

অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ড নকশালরা করেছিল। অথচ, তখনকার দিনে যে-কোনও পত্রিকার সংখ্যা তুললেই একটি গল্প অবশ্যই থাকত, যেখানে নিরীহ, সুকুমার, অত্যন্ত প্রতিভাবান নকশাল ছেলেদের পুলিশ নির্বিচারে হত্যা করছে। এই সে দিনও ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমাটিতে দেখলাম একই পন্থা নেওয়া হয়েছে। তবে, এক দিক দিয়ে হাওড়ার পুলিশ খুব দেখিয়ে দিয়েছিল। আন্দোলনের প্রথম দিকে দুটি নকশাল ছেলে আমতলা ফাঁড়িতে ঢুকতেই সেন্ট্রি কনস্টেবল ২০/৩০ রাউন্ড গুলি চালায়। ছেলে দুটি ভয়ে পালিয়ে যায়। তার পর আর কোনও নকশাল ছেলে থানা বা ফাঁড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেনি।

নকশাল আন্দোলনের জন্য পুলিশের সব কাজকর্ম তছনছ হয়ে যায়। থানা-ফাঁড়ির কনস্টেবলরা সব বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে থানা-ফাঁড়িতেই মেস করে থাকতে আরম্ভ করেন। মাসের প্রথম দিকে মাইনের টাকাটা স্ত্রী বা মা-বাবা’কে দিয়ে আসতেন। পিকেট, পেট্রল ডিউটি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ একলা ডিউটি করলে নকশালদের হাতে মারা পড়বার সম্ভাবনা ছিল খুব।

আমার ছেলে লিলুয়ার ডন বস্কো-তে পড়ত। হঠাৎ স্কুলে পোস্টার পড়ল— ‘এসপি-র ছেলেকে খতম করতে হবে।’ সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ছেলেকে আমার কোয়ার্টারের কাছে সেন্ট টমাস স্কুলে ভর্তি করলাম।

দুটো দিনের কথা বলতেই হবে। এক দিন সকালবেলা বেলুড়ের দিকে খুব গোলমালের খবর পেয়ে ওখানে গেছি, তত দিনে হাওড়ার নকশাল আন্দোলন প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে লুম্পেন এলিমেন্টের হাতে। বিভু নামে একটি নকশাল ছেলের বোমা ফেটে মৃত্যু হলে পোস্টার পড়ল— ‘লাল হাওড়ার লাল কমরেড লাল বিভু লাল সেলাম।’ অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি দেখে এক ভদ্রলোক আমাকে তাঁর বাড়িতে খানিক ক্ষণ বসতে অনুরোধ করলেন আর বললেন, তাঁর ছেলে হুগলি পুলিশে আছে ও এখনই চুঁচুড়া যাবে। তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গেলাম। দেখি, বেরনোর দরজার উপরে রামকৃষ্ণদেবের বিরাট ছবি। তাঁর ছেলে বাড়ি থেকে বেরনোর আগে সেই ছবিতে বার বার প্রণাম করছে। এর পর সেই ভদ্রলোকও ছবিটির সামনে বার বার প্রণাম করলেন। একটু পরে ছেলেটি বাড়ির ভেতর থেকেই বড় একটা ব্যাগ নিয়ে এল, সঙ্গে তার স্ত্রীও কাঁদতে কাঁদতে এল ও ছবির সামনে গিয়ে প্রণাম করতে আরম্ভ করল। ছেলেটি আমাকে বলল, তার পোস্টিং রিজার্ভ অফিসে। ও বালি থেকে ট্রেন ধরবে। আমি বালির ওসি’কে বললাম একটা জিপে করে বালি স্টেশনে পৌঁছে দিতে। ওরা চলে গেলে মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতেই ভেতরের দিকে চলে গেল এবং ভদ্রলোক আমায় বললেন, বউমা এখন ওর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কেঁদে যাবে। কেননা, তিন-চার ঘণ্টা তো কোনও খবর পাবে না, ওর স্বামী বেঁচে আছে কি মরে গেছে। সে দিন বাড়ি ফেরার সময় আমার মনে হচ্ছিল, নকশাল আন্দোলন এক দিন আমরা নিশ্চয়ই দমন করব। কিন্তু যারা প্রাণ দিচ্ছে কিংবা যারা চোখের জল ফেলছে, তাদের কেউ কি কোনও মূল্য দেবে? নকশাল নেতাদের যদি সাজাও হয়, তাদের আদর্শবাদের জন্য সরকার নিশ্চয়ই তাদের ছেড়ে দেবে এবং তারা বেরিয়ে এসে পুলিশের বিরুদ্ধেই বড় বড় কথা বলবে।

আর এক দিনের কথা ভেবে সবচেয়ে কষ্ট হয়, সে দিন আমার ভুলের জন্য একটি প্রাণ চলে গেল। এক দিন সকালের দিকে কাসুন্দিয়াতে কয়েক জন নকশাল ছেলে পোস্টার লাগাচ্ছিল। ওসি শিবপুর খবর পেয়ে ওখানে উপস্থিত হন। কিন্তু ছেলেরা গুলির মধ্যে দিয়ে এ দিক ও দিক পালিয়ে যায়। পাড়ার কিছু লোক বেরিয়ে আসেন। তাঁদের সঙ্গে ওসির তর্ক-বিতর্ক হয়। ওখানে গিয়ে কয়েক জন বৃদ্ধ লোককে দেখতে পেলাম। তাঁরা আমাকে দেখে রাগত ভাবে বললেন, ‘এটা কী হচ্ছে? এই সব ছেলেকে পাড়ার সবাই চেনে। আমরাও চিনি। অথচ আপনার ওসি-ই তাদের চেনে না ও ধরতে পারছে না!’ আমি বললাম, ‘আপনারা বিশ্বাস করুন, আমরা সত্যিই জানি না। আপনারা যখন জানেন, আমাদের একটু সাহায্য করুন না, অন্তত টেলিফোনে।’ এক ভদ্রলোক দল ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, একটু ক্ষণ দাঁড়ালেন। তার পর খুব নিচু গলায় বললেন, ‘আচ্ছা আমিই বলব।’ তার পর ফিরে গেলেন। আমরা যথারীতি কিছু বাড়ি সার্চ করে দু-তিনটি সন্দেহভাজন ছেলেকে তুলে নিয়ে এলাম। ভদ্রলোক কিন্তু আমার সঙ্গে পরে আর যোগাযোগ করলেন না।

পরদিন ভোরবেলায় ওসি শিবপুর আমাকে খুব উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘স্যর, একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে। কাসুন্দিয়ায় কাল যেখানে গিয়েছিলেন, সেখানে এক্ষুনি চলে আসুন। খুন হয়ে গেছে।’ ওখানে গিয়ে শুনলাম, সেই ভদ্রলোক সকালে মর্নিং ওয়াক করেন। সকালে তিনি বাড়ি থেকে বেরনো মাত্রই দু-তিনটি ছেলে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রমাগত ছুরি মারতে থাকে। লোকজন এলে তারা পালিয়ে যায়। ভদ্রলোককে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বাঁচার আশা খুব কম। বোধহয় এত ক্ষণ শেষ হয়ে গেছেন। সবাই আমার সামনে একটা পোস্টার তুলে ধরল, যেটা ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে। দেখলাম, তাতে লেখা: ‘এসপি-র দোস্ত শ্রেণিশত্রুকে খতম করা হল’। ভদ্রলোক এজি বেঙ্গলের অবসরপ্রাপ্ত কেরানি ছিলেন।

nirupam som
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy