Advertisement
E-Paper

আমাদেরই মতো দেখতে

কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণী। কেউ অচেনা লোককে আগুন থেকে বাঁচাতে প্রাণ দিচ্ছেন। কেউ গণধোলাই থেকে ড্রাইভারকে বাঁচাতে ঝাঁপাচ্ছেন।গোটা মুখটা আগুনে এতটাই ঝলসে গিয়েছিল যে চেনা দায়। একটা চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। চাদর ঢাকা বাকি শরীরটা কেঁপে উঠছিল মাঝেমধ্যেই। এসএসকেএম-এর বার্ন ইউনিটে টানা ৩৬ ঘণ্টা লড়াই করবার পর মারা গেলেন জগদীশ দাস। ডাক্তাররা অবাক, লোকটা এত ক্ষণ লড়াইটা চালাল কী ভাবে! তার চেয়েও বেশি অবাক হওয়ার ব্যাপার, নিজের ভালমন্দ নিয়ে এক মুহূর্তও না ভেবে কেউ পাড়ার এক ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ অনাত্মীয় কিছু মানুষকে বাঁচানোর জন্য ও ভাবে আগুনে ঝাঁপ দেয়!

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

গোটা মুখটা আগুনে এতটাই ঝলসে গিয়েছিল যে চেনা দায়। একটা চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। চাদর ঢাকা বাকি শরীরটা কেঁপে উঠছিল মাঝেমধ্যেই। এসএসকেএম-এর বার্ন ইউনিটে টানা ৩৬ ঘণ্টা লড়াই করবার পর মারা গেলেন জগদীশ দাস। ডাক্তাররা অবাক, লোকটা এত ক্ষণ লড়াইটা চালাল কী ভাবে!

তার চেয়েও বেশি অবাক হওয়ার ব্যাপার, নিজের ভালমন্দ নিয়ে এক মুহূর্তও না ভেবে কেউ পাড়ার এক ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ অনাত্মীয় কিছু মানুষকে বাঁচানোর জন্য ও ভাবে আগুনে ঝাঁপ দেয়! দমকল আসার আগে ওই পরিবারের সমস্ত সদস্য, এমনকী পোষা ডালমেশিয়ান কুকুরটিকে পর্যন্ত বার করে এনেছিলেন তিনি। কিন্তু মুশকিল হল, কুকুরটি ভয়টয় পেয়ে ফের ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাকে বাঁচাতেই আবার ভিতরে ঢুকেছিলেন জগদীশ। তখনই মারাত্মক ভাবে পুড়ে যান।

বাড়ির সবাইকে তো বাইরেই এনেছিলেন। তা হলে আবার ভেতরে ঢুকলেন কেন? কাতরাতে থাকা জগদীশকে প্রশ্নটা না করে পারেননি এক ডাক্তার। জড়ানো গলায় জবাব এসেছিল, ‘না হলে কুকুরটা মরে যেত যে!’

কে এই জগদীশ? কে-ই বা রণজিৎ দাস? আগুপিছু বিচার না করে ১২ ডিসেম্বর জগদীশের পাশাপাশিই ওই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন যিনি? রণজিৎ তো জীবনে কখনও ওই পরিবারের কোনও লোককে চোখেই দেখেননি। টিভি সিরিয়ালের শুটিং চলছিল হিন্দুস্থান পার্কের ওই ফ্ল্যাটের উলটো দিকের বাড়িতে। প্রোডাকশন টিমের ড্রাইভার, ৪৭ বছরের রণজিতের কানে এসেছিল ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ আর্তনাদ। শুনেই দৌড়েছিলেন তিনি। আপাতত মৃত্যুর সঙ্গে যুঝছেন রণজিৎও।

সারদা কেলেঙ্কারি, বিরাট কোহলির বিরাটত্ব, বছরশেষের পার্টির তোড়জোড়ে আমরা অনেকেই যখন বেজায় ব্যস্ত, তখন খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় এক কোণে কয়েকটা লাইন বরাদ্দ হয় জগদীশদের জন্য। আমরা খবরটা পড়ি। আবার ক’মিনিটের মধ্যে ভুলেও যাই। শুধু মাঝেমাঝে নিরাপত্তায় ঘেরা নিশ্চিন্ত জীবনে কোত্থেকে কাঁটার মতো ফোটে নামগুলো। তখন আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় হয়।

কিছু কিছু লোক মানসিক রোগীদের খুঁচিয়ে আনন্দ পায়। বাড়িতে শিশু পরিচারিকাকে খেতে না দিয়ে তালাবন্ধ করে বেড়াতে চলে যায়। কিছু লোক রাস্তায় কুকুর-বেড়াল তাড়াতে তাদের গায়ে গরম জল ঢালে। এদের প্রসঙ্গ উঠলে আমরা বলে উঠি, ‘এরা কি মানুষ!’ ওই নিষ্ঠুরতা খুব অচেনা লাগে আমাদের। কিন্তু জগদীশ, রণজিৎদের মতো মানুষদের দেখেও কি আমাদের একই রকম অচেনা লাগে না? এঁদের কারও গায়েই মহৎ সমাজসেবী কিংবা অসমসাহসীর লেবেল সাঁটা নেই। ওঁদের পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেউই স্বভাবে তেমন ডাকাবুকোও নন। বরাবরই যে অন্যের জন্য জীবন বাজি রেখেছেন, এমনটাও মোটেই নয়। তা হলে? তা হলে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে, অচেনা অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দেওয়া কেন?

হয়তো বিশেষ কোনও মুহূর্তে কোনও কোনও মানুষ হঠাৎই নিজেদের ছাপিয়ে যান। সম্ভবত তার জন্য আগাম কোনও প্রস্তুতি লাগে না। সাধারণ মাঝেমাঝে অসাধারণ হয়ে ওঠে, বা, সাধারণ লোকও অসাধারণত্বের সম্ভাবনাকে সারা ক্ষণ ভেতরে লালন করে— এইটা শেখানোর জন্যই বোধহয় ঘটনাগুলো পৃথিবীতে ঘটে। তখন মানুষ নিজের সব ক্ষুদ্রতাকে কোন ভোজবাজিতে কে জানে উড়িয়ে দিয়ে, অন্যের ভাল-র জন্য ঝাঁপ দেয়।

যেমন দিয়েছিলেন ঢাকুরিয়ার পঞ্চাননতলা বস্তির বাসিন্দারা। ২০১১-র ৯ ডিসেম্বর আগুন লেগেছিল আমরি হাসপাতালে। যে হাসপাতালে নিজের বা আত্মীয়ের চিকিৎসা করাতে না পারার অক্ষমতা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ করে রাখত মানুষগুলোকে, অসহায় কিছু রোগীকে বাঁচাতে সেখানেই ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। এক মুহূর্তের জন্যও পুরনো ক্ষোভ তাঁদের পথ আটকায়নি। দমকল আসার আগে একটা গোটা বস্তি হাজির হয়েছিল উদ্ধারের কাজে। নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে অনেককে বাঁচিয়েওছিলেন তাঁরা। গুরুতর জখমও হয়েছিলেন অনেকেই।

দিন কয়েক আগে কাগজে মধ্য-চল্লিশের জুলিয়া দত্তের কথা পড়ছিলাম। এক মিনিবাস চালককে জনরোষ থেকে বাঁচাতে ছুটে গিয়েছিলেন পথচলতি জুলিয়া। একটা অ্যাক্সিডেন্টের পর উন্মত্ত জনতা চালককে টেনে নামিয়ে বাঁশ, লাঠি নিয়ে গণধোলাই দিচ্ছিল। জুলিয়া ছুটে গিয়ে, চালককে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নিজেও আহত হন। আরও বড় কোনও বিপদও ঘটে যেতে পারত। কিন্তু ওই মুহূর্তে সে সব কথা ওঁর মাথাতেই আসেনি। কে এই জুলিয়া? অন্য গ্রহের কোনও জীব তো নন। তবু কেন তিনি পারেন, আমরা পারি না?

জুলিয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দিল ১৪ বছর আগের একটা রাতকে। শিয়ালদহ স্টেশন। একটা ধর্মীয় মিছিল বেরিয়েছে। রাস্তা থেকে সেই মিছিল ঢুকে পড়েছে স্টেশনের ভিতরেও। কোনও একটা কারণে ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ। স্টেশন চত্বরে থিকথিক করছে ভিড়। হতাশা আর বিরক্তিতে ফুটছেন সাধারণ মানুষ। ওই মিছিল তাঁদের অসুবিধে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলছে। হঠাৎই ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে জনতার। মিছিলের শেষ প্রান্তে থাকা এক কিশোরকে জাপটে ধরেন এক জন। বেগতিক দেখে মিছিলের অন্যরা তড়িঘড়ি সরে পড়েন। যাবতীয় রাগ ওই কিশোরের ওপরে উগরে ফেলে তাকে নির্মম ভাবে মারতে শুরু করেন সকলে। কিল, চড়, লাথি। কিশোরের মুখ ফেটে রক্ত ঝরছে। কয়েকশো মানুষের ওই ভিড়কে স্তম্ভিত করে দিয়ে হঠাৎই তিরবেগে ছুটে যান এক তরুণী। শাড়ি, বড় টিপ, চশমায় নেহাতই সাধারণ চেহারার এক তরুণী। ছেলেটির ওপর উপুড় হয়ে পড়েন তিনি। কয়েকটা মার তাঁর উপরেও পড়ে। তার পরে ধীরে ধীরে নিজেদের সংযত করে জনতা। শুরু হল তরুণীর উদ্দেশ্যে বিদ্রুপ, টিপ্পনী। সেই অবসরে কিশোর পালিয়ে বাঁচে। স্টেশনে তো কয়েকশো মানুষ ছিলেন। সকলেই যে ওই কিশোরকে মারছিলেন তা তো নয়। অনেকে ভেতরে ভেতরে চাইছিলেন, ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু তাঁরা সাহস করে এগোতে পারেননি। ওই তরুণী পেরেছিলেন।

দক্ষিণ কলকাতার এক অশান্ত এলাকা। গুন্ডাদের এলাকা দখলের লড়াই লেগেই থাকে। সেই রাতে আচমকা আলো নিভে গেছে। হঠাৎই বাঁচাও-বাঁচাও চিৎকার। গোটা পাড়া জেগে ঘুমিয়ে রয়েছে রাত ন’টায়। এক তলার ঘুপচি ঘর থেকে বেরিয়ে সেই সময় চেঁচিয়ে উঠেছিল এক কিশোরী, ছুরি ঝিকিয়ে ওঠা কয়েকটা হাত তাকে দমাতে পারেনি। ওই মেয়ের সাহসেই একটু একটু করে জেগেছিল বাকি পাড়া। সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে শিকারকে ফেলে চম্পট দিয়েছিল গুন্ডারা। দু’বিনুনি ঝুলিয়ে স্কুল যাওয়া গরিব ঘরের নিরীহ, বৈশিষ্ট্যহীন মেয়েটা সেই রাতে ওই সাহস কোথা থেকে পেয়েছিল?

শুধু তো জীবনের ঝুঁকি নয়। আরও নানা ঝুঁকিই নেন অনেকে। মাস কয়েক আগের কথা। এক রবিবার সকালে বাসের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন এক বৃদ্ধা। একাই যাচ্ছিলেন তিনি। বাস থেকে নামানো হল ধরাধরি করে। মুখেচোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরল। তার পর সহযাত্রীরা যে যার মতো সরে পড়লেন। সরলেন না শুধু এক তরুণ। নিজে দায়িত্ব নিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে বৃদ্ধাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। সে দিন ওই যুবকের চাকরির পরীক্ষা ছিল। সময় পেরিয়ে যাওয়ায় সেটা আর দেওয়া হয়নি তাঁর। পরে ঘটনাটা শুনে প্রায় সকলেই বিস্মিত।

আসলে আমরা শুধু বিস্মিতই হই। বাহবা যেটুকু দেওয়ার, দিই দূর থেকেই। নিজে তো নয়ই, নিজের পরিবারের কেউ এতটুকু ঝুঁকি নিলে তার হাত ধরে টানতে আমাদের তিলমাত্র দ্বিধা থাকে না। আজকের এই শৌখিন অনুতাপ, এর আয়ুও তো খুব বেশি ক্ষণ নয়।

আমরা যারা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখি, এগিয়ে যাই না, তাদের একটা পোশাকি নাম আছে। ‘বাইস্ট্যান্ডার’। বাইস্ট্যান্ডার হয়ে থাকার মধ্যে যে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার বোধ রয়েছে, তার মোহ এড়ানো খুব কঠিন। কিন্তু সাতপাঁচ না ভেবে যাঁরা এগিয়ে যান, তাঁদের কী বলে? কোনও একটা বিশেষ নামে কি তাঁদের পরিচয় দেওয়া সম্ভব?

কী লিখছি, জেনে আমার পরিচিত এক জন জগদীশের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বোকামি করে লোকটা বেঘোরে প্রাণ দিল। ওর কথা কেউ মনে রাখবে নাকি?’ সত্যিই তো, জগদীশের জন্য কি কেউ শহিদ বেদি বানাবে? ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে সাহসিকতার জন্য কোনও শৌর্য-পদকও বরাদ্দ হবে না। তা হলে এটা বোকামি ছাড়া আর কী!

পাড়ায় সে দিন আরও অনেকেই ছিলেন। বাঁচাও-বাঁচাও আর্তনাদ শুনে বাকিরা যখন দূর থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন তাঁর কী দরকার ছিল ভেতরে ঢোকার? দমকল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতে পারতেন। যে পৃথিবীতে জুনিয়র ডাক্তারদের হোস্টেলে গণধোলাই দিয়ে লোককে খুন করা হচ্ছে, এবং কেউ বাঁচাতে তো এগিয়ে আসছেই না, বরং তার পরেও মুখ না খুলে ‘বন্ধু’দের বাঁচাচ্ছে, সেখানে জগদীশবাবুর কাণ্ড যাচ্ছেতাই বোকামি।

ইদানীং প্রচুর মিছিল হচ্ছে। রাজনৈতিক মিছিলের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের মিছিল, ছাত্রদের মিছিল, খেলোয়াড়দের মিছিল। এত মিছিলের ভিড়ে একটা বোকাদের মিছিল করতে পারলে মন্দ হত না। বেঁচে থাকলে অবধারিত ভাবে স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেই মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার দায় বর্তাত জগদীশের উপরেই।

জগদীশ দাস। সাফাইকর্মী। বয়স: ৫৭। বাড়ি: বিহার।

somatitas@gmail.com

soma mukhopadhyay rabibasariya anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy