Advertisement
E-Paper

আমারপ্রথমবই

বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে পড়তে আসি স্নাতক স্তরে। আবাসিক মহাবিদ্যালয়, তাই শনিবার সন্ধেয় মাঝেমধ্যেই ছাত্রাবাসে সাহিত্যসভার আয়োজন হত। তেমনই এক সান্ধ্য আসরে স্বরচিত কবিতা পাঠের কথা বলতে গিয়ে শুনি, কবিদের নাম নেওয়া শেষ। পড়তে হলে গল্প, কারণ কেউ নাম দেয়নি। অদম্য বাসনা লেখার, ফলে জীবনের প্রথম গল্প লিখে ফেলি ‘বেলুন’ নামে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকা ‘ক্যাম্পাস’-এ লেখা দিতে গিয়ে। পত্রিকার পাণ্ডুলিপি শেষ, কিন্তু তিন-চার পৃষ্ঠা তখনও ফাঁকা। ওই মাপে একটি গল্প দিলে, ছাপা হবে। সেই ফর্মা মেলানোর গল্পটি হল ‘মাদলে নতুন বোল’, যে নামে আমার প্রথম গল্প সংকলনও।

রামকুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০০:০৮

বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে পড়তে আসি স্নাতক স্তরে। আবাসিক মহাবিদ্যালয়, তাই শনিবার সন্ধেয় মাঝেমধ্যেই ছাত্রাবাসে সাহিত্যসভার আয়োজন হত। তেমনই এক সান্ধ্য আসরে স্বরচিত কবিতা পাঠের কথা বলতে গিয়ে শুনি, কবিদের নাম নেওয়া শেষ। পড়তে হলে গল্প, কারণ কেউ নাম দেয়নি। অদম্য বাসনা লেখার, ফলে জীবনের প্রথম গল্প লিখে ফেলি ‘বেলুন’ নামে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকা ‘ক্যাম্পাস’-এ লেখা দিতে গিয়ে। পত্রিকার পাণ্ডুলিপি শেষ, কিন্তু তিন-চার পৃষ্ঠা তখনও ফাঁকা। ওই মাপে একটি গল্প দিলে, ছাপা হবে। সেই ফর্মা মেলানোর গল্পটি হল ‘মাদলে নতুন বোল’, যে নামে আমার প্রথম গল্প সংকলনও।

চোদ্দোটি গল্প নিয়ে বইটি প্রকাশ পেল ১৯৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। শুরুর গল্প ‘বৌ, মেয়ে, অ্যালসেশিয়ান ও পাইপ’। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। বিষয়— জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া এক যুবকের বার্ধক্যে সপরিবারে গ্রামে ফেরা এবং অর্থকৌলীন্য ও নাগরিক উন্নাসিকতায় চার পাশের মানুষজনকে উপেক্ষা করা। কিন্তু কী ভাবে সেই স্বাতন্ত্র্যের অভিমান ভেঙে পড়ে ধীরে ধীরে, তারই বিবরণ এ গল্পে। আসলে আমার শৈশবে ইস্কুল-যাতায়াতের পথে এমন এক শহর-ফেরত মানুষের অ্যালসেশিয়ান কুকুরটি মাঝেমধ্যেই বিকট চিৎকারে ভয় দেখাত আমায়। তারই প্রত্যুত্তর বোধহয় উত্তর-জীবনে।

দ্বিতীয় গল্প ছিল ‘পিকনিক’। আমাদের অঞ্চলের গাছগাছালিতে বেশ একটা শোভা বলে পাশাপাশি শহর-সদরের মানুষজন নানা সুখাদ্য নিয়ে বনভোজন করতে আসত। কিন্তু ষাট-সত্তরের দশকে অনেক স্থানীয় মানুষের টান ছিল ভাত-মুড়ির। গাঁয়েরই এক জনের নামের সঙ্গে ‘মাইলো’ শব্দটি জুড়ে গেসল, কারণ ওই দানাসেদ্ধটি সে অনেক পরিমাণে খেতে পারত। এ সব দেখেশুনেই রাগ-দুঃখ থেকে ওই গল্পটি লিখি। গল্পটি অনেক পাঠকেরই পড়া নেই। কিন্তু কোনও কোনও পুরনো বন্ধু গল্পের প্রথম বাক্যটি আজও মনে রেখেছে— ‘খবরটা এঁড়ে বাছুরের মতো পাঁই পাঁই করে ছুটছে।’ ‘খবরটা’ হল বনভোজন দলের গাঁয়ে আসা।

‘গোষ্ঠ’ নামে একটি গল্পও ছিল সে সংকলনে, যার মূল চরিত্র একটি দলছুট গর্ভবতী ভেড়া এবং একটি রাখাল ছেলে। বারো-তেরো বছরের ওই ছেলেটি মালিকের বাড়িতে রাতে ভেড়া রাখতে এসে দেখে, একটি ভেড়া মাঠ থেকে ফেরেনি। তার পর হাড়-কাঁপানো শীতে জনহীন শূন্য মাঠে সে খুঁজে ফেরে ‘বুধু’কে। মধ্যরাতে সে ভেড়াও মেলে। কিন্তু প্রসব- বেদনায় সে চলচ্ছক্তিহীন। শেষ পর্যন্ত একটি মৃত-সহ তিনটি শাবক সে প্রসব করে, এবং রাখাল ছেলেটি নিজে ভেড়াটির স্তন্যপান করে, তার দুগ্ধচাপ-যন্ত্রণা লাঘব করে। সেই উষ্ণ দুধে সে একই সঙ্গে ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং শীতলতা থেকে মুক্তি পায়। তার পরেও গল্প আছে। সকালে মনিবের ঘরে ফেরা এবং একটি শাবকের মৃত্যুর কারণে তার কাজ হারানো। কিন্তু এ তো কাহিনির পরিচিত পরিণতি মাত্র। আসলে ওই পর্বে কয়েক মাসের পুরুলিয়া জীবনে এক রুদ্র প্রকৃতি আর এক কোমল মানবহৃদয়ের দেখা পাই সামনাসামনি।

‘পেয়ারা বুড়ো পান্তা বুড়ি’ নামেও একটা গল্প ছিল, যার শুরুর বাক্য হল, ‘এক গাঁয়ে এক পেয়ারা বুড়ো আর এক পান্তা বুড়ি থাকে।’ দুজনের সম্পর্ক বিশেষ সুবিধের ছিল না। কিন্তু এক দিন বুড়ির সাধ হল পেয়ারা খেতে আর বুড়োর পান্তা খাওয়ার। রাতে সেই পারস্পরিক চৌর্যকর্ম দুজনেরই চোখে পড়ে। তা থেকে চিৎকার ও সামাজিক বিচার দুজনেরই। তাতেই সত্তরের সমাজ-রাজনীতির কিন্তু টুকরো ছবি ফুটে ওঠে।

‘মাদলে নতুন বোল’ গল্পটিও ওই সংকলনে আছে, যেখানে আমাদের অঞ্চলের সাঁওতাল খেতমজুর আন্দোলনের কিছু উল্লেখ আছে। আমাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিল আমাদের গ্রামেরই সাঁওতাল পল্লির একটি ছেলে। সে সূত্রে ও-পাড়ায় যাতায়াত ছিল বেশ। সে সহপাঠী এক-দেড় বছর পরে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। কিন্তু ওর জন্যই বোধ হয় উত্তরকালে ওই গল্প লেখা হল। এখন বুঝি, গল্পটি দুর্বল। কিন্তু আমার তির-কাঁড় ছোড়ার ব্যর্থ প্রয়াস, মাদল বাজানোর নিরর্থক প্রচেষ্টা, ফুটবল খেলে তৃষ্ণা মেটাতে খাল পেরিয়ে সাঁওতাল পল্লিতে যাওয়ার স্মৃতি ওই গল্পে অলিখিত হলেও ধরা আছে।

গল্প-সংকলনটিতে ‘হা-ভাতে’ নামের একটি গল্পও ছিল, যেখানে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ তার পঞ্চম শিশু সন্তানটিকে কলকাতায় পৌঁছে দিতে যায় একটি দোকানে কাজের প্রতিশ্রুতিতে। চলার পথে শিশুটি মাইলস্টোন দেখে এবং দ্রুতই বাংলা সংখ্যা শেখে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো। কিন্তু হারিয়ে যায় বাবার গঙ্গাস্নান পর্বে। এমনই কিছু শৈশব-কৈশোরের, কিছু গাঁ-ঘরের মানুষজনের সুখ-দুঃখের কথা সংকলনটিতে।

সংকলনটির প্রকাশক ছিল ‘আবহমান’, যে নামে সে সময়ে লিট্ল ম্যাগাজিনের ওপর একটি লিট্ল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম বেশ ক’জন মিলে। বই প্রকাশে অগ্রজ কবি অনির্বাণ দত্ত স্নেহবশত ছাপাখানা নির্বাচন, প্রুফ সংশোধন ইত্যাদি সব দায়িত্বই নিয়েছিলেন। তারই ফল প্রায় নির্ভুল বানানে সুন্দর মুদ্রণে শক্তপোক্ত বাঁধাইয়ে প্রথম বই। বেশ দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ আঁকেন দীননাথ সেন। ১২৮ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রণসংখ্যা নির্ণয়ের দায়িত্ব ছিল গ্রন্থকারের ওপরেই। সে সময়ে আত্মাভিমান ছিল খানিকটা বেশিই, তাই ১১০০ বই মুদ্রিত হল স্বোপার্জিত ৩৭০০ টাকায়। বিক্রয়মূল্য দশ টাকা।

নবাগত কলেজ-ছাত্রদের মতো প্রথম প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের লেখকদেরও খানিক র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হতে হয়। তেমন ধমক-ধামক খেয়েছি দু-চার বার। কিন্তু এক বন্ধু-কথাকার বড় কঠোর এক রায় দিলেন, যে গদ্যে গল্প লিখছি, তাতে আধুনিক কথাসাহিত্য লেখা সম্ভব নয়। সে কথা প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলি। কিন্তু ভিন্ন এক মত মিলল দেবেশ রায়ের একটি লেখায়। দেশজ কথকতার কথনরীতিটিকে পুনরুদ্ধারের যে প্রচেষ্টা গল্পগুলিতে, তা তাঁর ভাল লেগেছিল। আর এক আলোচক, ‘বাঁকুড়া দর্পণ’ পত্রিকার সম্পাদক মিহির রায়, বাঁকুড়া জেলার ভাষায় সম্পূর্ণ একটি গল্পগ্রন্থ পেয়ে বেশ খুশি হয়েছিলেন। এ হল আঞ্চলিক ভাষার ভাই-ভায়াদি, যার বন্ধন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংঘের চেয়েও দৃঢ়।

প্রায় শ’আড়াই বই চেনাজানা লেখক ও বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করি। খানসত্তর নাকি সরকারি গ্রন্থাগারেও কেনা হয়েছিল। বাকি বই সঞ্চিত ছিল কলেজ স্ট্রিটের একটি প্রকাশনা দফতরে। আশা ছিল, পাঠক এক দিন সন্ধান করবেন ওই বইয়ের। কিন্তু ’৮৮ সালের প্রবল বর্ষণে আমার প্রথম বই জলতলে চলে গেল। মন খারাপ করে লেখালিখি করিনি বেশ কিছু দিন। লেখক-বন্ধুরা নতুন কারও সঙ্গে আলাপ করাবার সময় বলত, ও এক সময় গল্প লিখত।

তার বছর দেড়-দুই পরে দিদিমার শরীর খারাপ শুনে মামাবাড়ি যাই, বর্ধমান জেলার বাবলা গ্রামে। সে কথা আমার ‘পরিক্রমা’ গল্পে অনেকখানি বলা আছে। গ্রামখানি বর্ধিষ্ণু এবং মামার বাড়িটি দ্বারকেশ্বর নদী থেকে পাঁচ-ছ’মিনিটের হাঁটা পথ। দু-চার বছর পর পরই বর্ষার নদী বাড়ির পেছনের আম-চালতার বাগান পর্যন্ত এগিয়ে আসে। ’৭৮-এ বাড়ি ঢুকেছিল, আবার ’৮৮-তেও বাড়ির উঠোনে। খড়ের পালুই ভেসে গিয়েছিল নদীর স্রোতে, পচে গিয়েছিল জমির ধানটানও। সে সব কথা শুনতে শুনতে আমার প্রথম বইটির জলদশার কথাও মনে পড়ছিল। কিন্তু বেদনা থিতু হওয়ার আগেই মেজমামা বললেন, সাময়িক ক্ষতি হলেও মাঝেমধ্যে বন্যা হওয়া ভাল। ফলন দিতে দিতে মাটি এক সময় উর্বরতা হারায়। জলবাহিত নতুন মাটিতে জমির নবজন্ম হয়। তা ছাড়া বন্যাস্রোতে পরিষ্কারও হয়ে যায় চার পাশ, ডুবস্নানে দেহ-সংস্কারের মতো। আমার মামাতো ভাই, বড়মামার ছেলে মিঠু, পালুই ভেসে যাওয়ার দুঃখ ভুলে বাড়ির উঠোনে কিলো বারোর একটা কাতলা মাছ ধরার আজব অভিজ্ঞতার কথা বলছিল। সে মাছের এমন দাপট যে এক ঝটকায় পাঁচ হাত দূরে ছিটকে দিয়েছিল পাঁচ-সাত বার।

কলকাতায় ফিরে আবার লেখালিখিতে হাত দিই। নয়ের দশকে তিনটি উপন্যাস ও দুটি গল্প সংকলন প্রকাশ পায়। এখন আর দুর্যোগে তেমন ভয় হয় না, সে প্রাকৃতিক, সামাজিক, কিংবা রাজনৈতিক যা কিছুই হোক না কেন। অবগাহনে দেহ-মনের সংস্কার, বাহিত পলিতে নতুন প্রাণের উন্মাদনা। তবে ওই বারো কেজির মৎস্যটি আজও অধরা। সে আর ক’জনের কপালে থাকে!

mukhopadhyayrk@gmail.com

rajkumar mukhopadhyay prothom boi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy