Advertisement
E-Paper

ইঙ্গমার বার্গম্যান

সুমন মুখোপাধ্যায়বিশ্বে খুব কম ছবি-করিয়েই আছেন যাঁরা চলচ্চিত্র ও মঞ্চে পাশাপাশি কাজ করে গেছেন। ইঙ্গমার বার্গম্যান এমনই এক মহা-পরিচালক, আর তাই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক জন মানুষ। বহু দিন দুটো মাধ্যমেই কাজ করেছেন, আর চূড়ান্ত সফল ভাবে।

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০

বিশ্বে খুব কম ছবি-করিয়েই আছেন যাঁরা চলচ্চিত্র ও মঞ্চে পাশাপাশি কাজ করে গেছেন। ইঙ্গমার বার্গম্যান এমনই এক মহা-পরিচালক, আর তাই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক জন মানুষ। বহু দিন দুটো মাধ্যমেই কাজ করেছেন, আর চূড়ান্ত সফল ভাবে। বার্গম্যানকেই এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন মাধ্যমটা আপনার বেশি পছন্দের? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সিনেমা আমার স্ত্রী, আর থিয়েটার উপপত্নী।

বার্গম্যানের যত ছবি দেখেছি, মনে হয়েছে, বার্গম্যান এমন এক জন পরিচালক, যিনি খুব গভীর ভাবে ‘মানুষ’ নামের অস্তিত্বটাকে দেখেছেন, সেই অস্তিত্বের এক একটা পরত ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে একেবারে আদত মানুষটাকে বার করে এনেছেন। নিজেই বার বার বলেছেন, আমার ছবিতে মানুষই প্রধান। একটা দৃশ্যকে আমি কী করে নির্মাণ করব, সেটা তো ভেবেচিন্তে করে ফেলাই যায়। কিন্তু আসল শুরু মানুষেই, আর মানুষই শেষ কথা। একটা জ্যান্ত (বা মৃত) মানুষের সব উপাদান, তার আনন্দ-দুঃখ-বেদনা-শয়তানি-রসিকতা-অমানুষিকতা, এই সব কিছু তিনি ওঁর ছবিতে ধরতে পেরেছেন। বলতেন, নারী-পুরুষের সমস্যা নিয়ে আমরা লাখ কথা বলি, আসলে সমস্যাটা নারী বা পুরুষের নয়, মানুষের। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের। সম্পর্কের খুব গহন, গোপন, যে জায়গাগুলোতে মানুষ খুব একলা, বা খুব অমানবিক, সেগুলো নিয়েই ওঁর ছবি। ‘সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ’ (যে ছবিটা উনি থিয়েটারেও করেছেন) দেখে মনে হয়েছে, মানুষকে এই ভাবে হাড়-মজ্জা-কঙ্কাল সহ দেখার এই লেন্সটা সবার হাতে নেই।

বার্গম্যান যখন তারকোভস্কির ছবি প্রথম দেখলেন, বললেন, যে ঘরটার চাবি আমি কোনও দিন খুঁজে পাইনি, হাতড়ে বেড়িয়েছি, দেখলাম তারকোভস্কি সেই ঘরের মধ্যে অবাধে পায়চারি করছেন। কত বড় শিল্পী হলে এমন বিনয় আয়ত্ত করা যায়, অন্য এক শিল্পীর এমন দরাজ প্রশস্তি করা যায়! পরে বার্গম্যানকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিয়ে ভেঙেছে, নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন, বিদেশে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থেকেছেন। কিন্তু এই বিপন্ন যাপনের মধ্যেও তাঁর চলচ্চিত্র রয়ে গেছে অর্থপূর্ণ, বাঙ্ময়।

কে বড়, চিত্রপরিচালক বার্গম্যান না নাট্য-পরিচালক বার্গম্যান, সে নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু আমি যেটুকু বুঝেছি, মঞ্চে নাটক সৃষ্টিতেও তিনি অসামান্য। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল নিউ ইয়র্কে ওঁর বিখ্যাত প্রযোজনা ‘মিস জুলি’ দেখার। খুব বড় মাপের প্রযোজনা। উনি তিনটে নাটকের একটা প্রজেক্ট করেছিলেন, ইবসেন-এর ‘ডল্স হাউস’ থেকে ‘নোরা’, স্ট্রিন্ডবার্গ-এর ‘মিস জুলি’ থেকে ‘জুলি’, আর ওঁর নিজের ‘সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ’। ওঁর নোরা চরিত্রের ইন্টারপ্রিটেশনও আলাদা। বলতেন, নোরাকে পড়তে হবে নাটকের শেষ দৃশ্য থেকে। মহড়ায় নিজেও নাটকের শেষটা থেকেই পড়া শুরু করতেন। মানে, ওঁর দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল একদম আলাদা। আবার মঞ্চেই হোক কি ছবিতে, অভিনেতাদের খুব গুরুত্ব দিতেন। সিনেমাকে সবাই বলে ডিরেক্টর’স মিডিয়াম, অথচ উনি সকলকে একসঙ্গে নিয়ে, সামগ্রিক ভাবে গড়তেন একটা শিল্পকৃতি। এটা রীতিমত শেখার বিষয়।

একটা গল্প চালু আছে, এফটিআইআইয়ে পড়ানোর সময় ঋত্বিক ঘটক বার্গম্যানকে নিয়ে বড় বড় আর ভাল ভাল কথা তেমন বলতেন না। কোথাও একটা দার্শনিক সংঘাত ছিল। এক বার বার্গম্যানের রেট্রোস্পেকটিভ হচ্ছে, একটি ছাত্র ছবি না দেখে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঋত্বিক জিজ্ঞেস করায় সে বলল, কেন, আপনিই তো বলেন ওঁর ছবি আপনার ভাল লাগে না.. তখন নাকি ঋত্বিক বলেছিলেন, দ্যাট’স বিটুইন টু মাস্টার্সযাও, ছবি দেখো, শেখো ওঁর কাছ থেকে!

বার্গম্যান বার বার বলতেন, সিনেমা হচ্ছে একটা স্বপ্নের মতো। বাহ্য কোনও প্রকাশ নেই, ছুঁয়ে চলে যায় আর বদলে দিয়ে যায়। স্বপ্নে যেমন কোনও যুক্তিক্রম থাকে না, বরং অতিবাস্তবতা থাকে, সিনেমাও তাই। মুহূর্ত দিয়ে দিয়ে তৈরি হয়। ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ ছবির একটা মুহূর্ত মনে আছে, একটা লোককে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে নাচানো হয়। আমার বাবার (অরুণ মুখোপাধ্যায়) ‘জগন্নাথ’ নাটকের একটা দৃশ্যে যখন খোদ জগন্নাথকে জোর করে নাচানো হয়, কোথাও যেন একটা যোগ অনুভব করেছিলাম বার্গম্যানের সঙ্গে। খুব দাগ কেটেছিল ওই ছবির ‘ড্যান্স অব ডেথ’ও। ‘সামার উইথ মনিকা’, ‘সিনস ফ্রম এ ম্যারেজ’-এর যুগল চরিত্রগুলোও নিয়ত মনে থাকে। আমার সে অর্থে যে বার্গম্যানের একটা দৃশ্য, একটা চরিত্র ভাল লাগে তা নয়। বার্গম্যান যেন ওঁর সব ছবি নিয়ে তালগোল পাকিয়ে মাথার মধ্যে ঢুকে থাকেন। নিজেকে একটা অন্য মানুষ হিসেবে চিনতে শেখান। তিনটে ছবির কথা বলতে পারি, নিরন্তর আনন্দে আর মনখারাপে যাদের কাছে বার বার ফিরে যেতে পারি। বার্গম্যানের ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেকজান্ডার’, গোদার-এর ‘ব্রেথলেস’, আর সত্যজিতের ‘অপরাজিত’।

প্রতিটা ছবি বানানোর আগে কাস্ট-মেম্বারদের একটা চিঠি দিতেন। কেন আমি এই ছবিটা বানাচ্ছি, তোমার কাছে কী চাইছি। খুব বিশ্বাসী ছিলেন রিহার্সালে, অভিনেতা ও কলাকুশলীদের সঙ্গে কথা বলে কাজ করতেন। এই যে ছবি বানানোর একটা প্রক্রিয়া, ছবি মানে সবাই মিলে শুরু-করা একটা ‘মিশন’, এই ভাবনাটা ওঁর অপূর্ব এক অবদান। আমার তো মনে হয় এর থেকে আমরা এখন শত মাইল দূরে চলে গেছি। প্রফেশনালিজম যত বেড়েছে, আমরা তত যেন বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপের মতো ভেসে ভেসে কাজ করছি। সমবেত ভাবে কিছু করতে পারছি না। গ্রুপ নিয়ে, দলবদ্ধ ভাবে কাজ করার এই ব্যাপারটা খুব সম্ভবত ওঁর থিয়েটারের শিক্ষা থেকে এসেছিল।

কত অল্প আয়োজনে কত বড় কথা বলা যায়, সেটাও বার্গম্যানের থেকে শেখার। অনায়াসে, স্বচ্ছন্দে একটা গভীর জটিল সত্যকে বলে দিতে পারতেন। কুরোসাওয়া বলতেন, ছবিতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল ‘সিমপ্লিসিটি’কে ‘অ্যাচিভ’ করা। বার্গম্যানকে তা ‘অ্যাচিভ’ করতে হত না, সিমপ্লিসিটি ওঁর ছবিতেই নিহিত ছিল। এটায় পৌঁছতে পারাটাই তো এক জন ছবি-করিয়ের জীবনের সেরা শিক্ষা হতে পারে। সে দিন আমার আর এক প্রিয় পরিচালক মাইকেল হ্যানেকে-র লেখা পড়ছিলাম। ওঁর ‘হোয়াইট রিবন’ বলে ছবিটা যখন ঠিক করলেন যে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে বানাবেন, তখন রেফারেন্স হিসেবে বার্গম্যানের সব ক’টা ছবি দেখে নিলেন। সাদা-কালোয় ওঁর ফ্রেমিং, লেন্সিং, সব কিছু। এটাই আশ্চর্য লাগে, যে কোথায় বার্গম্যানের সুইডেন, আর কোথায় হ্যানেকের জার্মানি, বা আমাদের ভারতবর্ষ। ওঁর দেশের অর্থনীতি, প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষের জীবন-যাপন, সবই তো একেবারে আলাদা। কোন গভীর সত্যে পৌঁছতে পারলে যে ছবি এমন বিশ্বজনীন হয়!

sumanmukhopadhyay@gmail.com

ingmar bergman suman mukhopadhay ini on uni rabibasariyo probondho
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy