Advertisement
E-Paper

ইচ্ছামৃত্যুর বন্ধু

ইচ্ছামৃত্যু নিয়ে তর্ক বিস্তর। কিন্তু পৃথিবীতেই এমন দেশ, আদালত, প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মানুষের মরে যাওয়ার অধিকারকে সম্মান করে।মানুষ ইচ্ছে করলেই নিজের জীবন নিজে নিতে পারে? না। সুইসাইড খুব ‘আপত্তিকর’ কাজ। সুইসাইড অ্যাটেম্প্ট তো তদধিক। প্রতি মুহূর্তে কোষ থেকে কোষে ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানসার, আস্ত অস্তিত্বটাকেই আউলে দিচ্ছে স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ঘণ্টা-দিন-মাস-বছর বেঁচে মরে থাকতে হচ্ছে বেডে হুইলচেয়ারে জড়-জড়তর আটার তালের মতো, তবু মরতে পারবে না। যত ক্ষণ না অফিশিয়ালি মরণ আসে। খুলে ফেলা যাবে না অক্সিজেনের নল, লাইফ সাপোর্ট, স্যালাইন। ‘ইচ্ছামৃত্যু’ শব্দটা এ দেশের সাইকিক ডিকশনারিতে নেই।

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০০:০৬
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

মানুষ ইচ্ছে করলেই নিজের জীবন নিজে নিতে পারে? না। সুইসাইড খুব ‘আপত্তিকর’ কাজ। সুইসাইড অ্যাটেম্প্ট তো তদধিক। প্রতি মুহূর্তে কোষ থেকে কোষে ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানসার, আস্ত অস্তিত্বটাকেই আউলে দিচ্ছে স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ঘণ্টা-দিন-মাস-বছর বেঁচে মরে থাকতে হচ্ছে বেডে হুইলচেয়ারে জড়-জড়তর আটার তালের মতো, তবু মরতে পারবে না। যত ক্ষণ না অফিশিয়ালি মরণ আসে। খুলে ফেলা যাবে না অক্সিজেনের নল, লাইফ সাপোর্ট, স্যালাইন। ‘ইচ্ছামৃত্যু’ শব্দটা এ দেশের সাইকিক ডিকশনারিতে নেই। অরুণা শানবাগ-এর পরেও না। ‘রাইট টু লিভ’ নিয়ে সফেদ সেমিনার, ‘রাইট টু ডাই’ আওড়ালে এমন তওবা করবে যেন কী মহা-স্যাক্রিলেজ মরমে পশিল। ঘরের পুষ্যিটার অনারোগ্য রোগ হলে আছাড়িপিছাড়ি কেঁদেও বিষ-ইঞ্জেকশন দেওয়া যায়, মারণ রোগে ককানো গরু-উট-হাতিকেও গুলি করে মুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ‘জীবন নেওয়া পাপ’। রোগকাতর মানুষটা সর্বস্ব দিয়ে মৃত্যু চাইলেও। অ্যাসিস্টেড সুইসাইড, অ্যাক্টিভ আর প্যাসিভ ইউথানাসিয়া (নিষ্কৃতি-মৃত্যু)— এই সব নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আর পার্লামেন্ট অনন্ত পিং পং খেলে যাবে যুগ যুগ ধরে।

অথচ, এই পৃথিবীতেই এমন দেশ, রাজ্য, আদালত, প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মানুষের মরে যাওয়ার অধিকারকে সম্মান করে। শুধু সম্মান করেই হাত ধুয়ে ফেলছে তা না, নিজেদের সংবিধানে অক্ষরে অক্ষরে বলে-লিখে রেখেছে, আইন করেছে কোনও সম্মাননীয় নাগরিকের সজ্ঞান সচেতন মরে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে বাস্তব রূপ দিতে। যেমন, সুইটজারল্যান্ড। যেমন, ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইট্স। যেমন, সুইস সংস্থা ‘ডিগনিটাস’। একটা মানুষের বাড়ি-ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-বিএমডব্লুর মতো তার জীবনটাও শুধু তারই, সেই জীবনটা বাঁচার বা না-বাঁচার অধিকারও তার। যেমন ইচ্ছে হলে (ও সম্ভব হলে) সে নিজের বাঁচার ধরনটা বেছে নেয়, তেমনই ইচ্ছে হলে সে এটাও বেছে নেবে, আমি অমুক সময়ে মরতে চাই, তমুক ভাবে মরতে চাই। আত্মহত্যা সুইটজারল্যান্ডে নিষিদ্ধ নয়। সুইস ফেডেরাল ক্রিমিনাল কোড-এর ১১৫ অনুচ্ছেদে যা লেখা, তার মানে: ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভের কোনও কিছু জড়িয়ে না থাকলে সে দেশের কোনও নাগরিক মৃত্যুকামী সহ-নাগরিককে আত্মহত্যায় সাহায্য করতেই পারেন। রাষ্ট্রের পূর্ণ নৈতিক ও আইনি সাপোর্ট আছে এতে।

এই সুইটজারল্যান্ডেই আছে আর এক সংস্থা ‘এগজিট’, যাঁরা শুধু স্বদেশিদেরই স্ব-হত্যায় সাহায্য করে। নিষ্কৃতি-মৃত্যু আইনসিদ্ধ বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ আর নেদারল্যান্ডসে, আর অ্যাসিস্টেড সুইসাইড চালু শেষ দুটি দেশ ছাড়াও জার্মানি, আলবানিয়া, কলম্বিয়া আর জাপানে, এমনকী আমেরিকারও পাঁচটি রাজ্য, অরিগন, ওয়াশিংটন, ভার্মন্ট, নিউ মেক্সিকো আর মন্টানায়। আরও অনেক দেশে বেশ কিছু সংস্থা আছে, যারা সরাসরি আত্মহত্যার ক্রিয়াটায় সাহায্য করে না, কিন্তু তথ্য ও পরামর্শ দেয়।

অ্যাসিস্টেড সুইসাইডের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিতর্কিত সংস্থা ডিগনিটাস-এর ওয়েবসাইট-এ বড় বড় করে লেখা— টু লিভ উইথ ডিগনিটি, টু ডাই উইথ ডিগনিটি। জুরিখ শহরে ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া এই অ-লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি গত বছর পর্যন্ত বিশ্বের মোট ১৭০১ জন মানুষকে স্বেচ্ছায় সানন্দে মরতে সাহায্য করেছেন। সবচেয়ে বেশি মরেছেন জার্মানরা, ৮৪০ জন। লিস্টিতে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়া, কানাডা, স্পেন, ইজরায়েল, কোথাকার মানুষ নেই! সুইসরা তো থাকবেনই, বলাই বাহুল্য। এক জন ভারতীয়ও আছেন বলে জানা গেছে। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের যে কেউ সদস্য হতে পারেন ডিগনিটাস-এর। সদস্য হওয়া মানেই এই নয় যে আপনি ওদের সাহায্য নিয়ে মরতে চান। তার তত্ত্বগত সমর্থনেরও তো লোক চাই। সহকর্মী ওদের অনেক আছে, অভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স, দুঁদে উকিল। ওরা চায় পৃথিবীজোড়া সহমর্মীও।

লুড্উইগ মিনেলি, পেশায় আইনজীবী ও মানবাধিকার-কর্মী। তিনিই ডিগনিটাস-এর প্রতিষ্ঠাতা। ৮১ বছর বয়সেও ‘রাইট টু ডাই’ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আপনি রোগে ভুগে তলতলে পড়ে আছেন, অন্যের দয়ামায়াপাত্র হয়ে আর বাঁচতে চান না? ডিগনিটাস-এর ফর্ম ভরুন। কয়েক প্রস্থ ফি আছে, সব মিলিয়ে খরচা ভারতীয় মুদ্রায় সাত লাখের ওপর। পাঠাতে হবে তাবৎ হিস্ট্রি-সহ পুরো মেডিকাল ফাইল, আর আপনার সি ভি। ডাক্তাররা সে সব খুঁটিয়ে দেখবেন কয়েক মাস ধরে, এই সময়টার মধ্যে বার বার কথা বলবেন রোগীর সঙ্গে যে তিনি সত্যিই মরতে চান কি না। ফর্ম-ভরলাম গেলাম মরলাম, ব্যাপার এত তুরন্ত নয়। তারও পরে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডাক্তার দেখেন, তিনিও যদি সিদ্ধান্ত নেন যে মানুষটার এই শারীরিক অবস্থার চেয়ে মৃত্যুই ভাল, তখন শুরু হয় মরণ-প্রস্তুতি। দু’ভাবে মৃত্যু ‘ঘটানো’ যেতে পারে। এক, প্রথমে একটা অ্যান্টি-ভমিটিং ওষুধ খাওয়ানো হয়। তার এক ঘণ্টার মধ্যে এক গেলাস জলে বা ফ্রুট জুসে মারণ ওষুধের পাউডার গুলে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। বা দুই, ২০০৮ সালে বেশ কিছু মৃত্যু ঘটানো হয়েছে হিলিয়াম গ্যাসে শ্বাস নেওয়া করিয়ে। যে কায়দাতেই হোক, শেষের সে সময়ের আগেও এক বার জিজ্ঞেস করা হয়, এর পরেই কিন্তু আপনার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। আপনি এখনও সে রকমটাই চান? উত্তর হ্যাঁ হলে, তাঁকে দিয়ে একটা সই করিয়ে নেওয়া হয় (সই করার মতো ক্ষমতা না থাকলে তিনি মুখে বলেন সজ্ঞানেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত, সেটা ভিডিয়ো রেকর্ড করে রাখা হয়)। তার পর? মৃত্যু, অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশ, দরকারে পোস্টমর্টেম। মৃত্যু-সফরের সুচারু ‘দি এন্ড’।

তাতেই কি সব শেষ হয়ে যায়? ডিগনিটাস-এর কাজকারবার নিয়ে তর্ক-অভিযোগ-মামলা বিস্তর। বলা হয়েছে, টুরিজম শুনেছি, সেক্স টুরিজমও, কিন্তু এ তো ডেথ টুরিজম! এ-ও শোনা গেছে, মিনেলি সহ ডিগনিটাস-এর কর্তাবিষ্টুরা মালামাল ব্যবসা চালাচ্ছেন, লুটছেন কোটি কোটি। নিজেদের অফিস থাকা সত্ত্বেও ফ্ল্যাট ভাড়া করে, এমনকী এক বার একটা গাড়ির মধ্যেও নাকি মানুষকে বিষ-ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ২০১০-এ এক বার হইহই, জুরিখ হ্রদের জলে চল্লিশটারও বেশি ছাই-ভরা পাত্র পাওয়া গেছে, যেগুলো ডিগনিটাস-এরই ব্যবহার করা।

এত বাউন্সার-বিমারের পরেও এই সংস্থা মর্তুকাম মানুষের অধিকার রক্ষায় বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে। আর একটা জরুরি তথ্য, ডিগনিটাসই একমাত্র আত্মহত্যা-সাহায্যকারী সংস্থা, যাঁরা মানসিক রোগগ্রস্তকেও মরতে সাহায্য করেন। মানসিক অসুখে কি ফেটাল ডিপ্রেশনে ভোগা কেউ, যাঁর জিয়ন-গ্রাফ দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে অতলে, হয়তোবা সে থেকেই তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন দুইতিনসাতআট বার, তাঁর চরম ও পরম চাওয়াকে পাইয়ে দিতে ডিগনিটাস বদ্ধপরিকর। মিনেলি পষ্টাপষ্টি বলেছেন, যে রোগ সারার নয় তার রোগীকে সাহায্য তো করবই, জীবন-অবসন্ন, হা-ক্লান্ত মানুষও মরতে চাইলে হাত বাড়িয়ে দেব। তথ্য বলছে, ডিগনিটাস-এর সাহায্য নেওয়া মানুষের ২১% কোনও অনারোগ্য-ভয়াবহ রোগের শিকারই ছিলেন না কোনও দিন। তাঁরা সবাই ক্রনিক ডিপ্রেস্ড, অনন্ত বিষাদবাসী!

মিনেলি-র কথায় এসেছে ভারতবর্ষ, ভারতীয় আইনের কথাও। বলেছেন, ইচ্ছামৃত্যুকে, আত্মহননকে অস্বীকার করা মানে ভারতীয় দর্শনকেও অস্বীকার করা। ভীষ্মের স্বেচ্ছামৃত্যু, পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থান, দধীচির প্রায়োপবেশন, ক’টা উদাহরণ চাই? কিন্তু সে সব বলতে গেলেই শোনা যাবে ‘আত্মহত্যা মহাপাতক’, বা, ‘জীবন দিয়েছেন যিনি, জীবন নিতে পারেন তিনিই’ জাতীয় অদৃষ্টবাদী কোটেশন। ‘আই কান্ট টেক দিস এনি মোর’ শুনলেই সাইকায়াট্রিস্টের কাছে ধরে নিয়ে যাবে, মোটিভেশনাল বই বেঁধে আনবে এক কাঁড়ি।

অথচ, হয়তো, ভয়ংকর অসুখে-ধরা অধিকাংশ মানুষ, আবার চারপাশের দশটা-পাঁচটা ঘষটানো অধিকাংশ মানুষও বেঁচে থাকেন স্রেফ পটাং করে মরে যাওয়ার খ্যামতাটা নেই বলে, ‘এর পরেও বাঁচতে ইচ্ছে করছে’ বলে আদৌ নয়। বুকে হাত রেখে সৎ কথা বললে, হয়তো অনেক মানুষই মেনে নেবেন, বেডরুম কলতলা অটোস্ট্যান্ড ক্যান্টিন ঘিরে রোজ ঠুকরোয় যে ঘ্যানঘেনে ঘিনঘিনে নীচতা-ব্যর্থতা-অপমান, সে সব ঘাড়ে-মনে-জীবনে নিয়ে বাঁচাটা আদৌ ‘বাঁচা’ নয়। আর, এই দীন জীবনেও তো মোড়ে মোড়ে অনেকগুলো চয়েস আসে, আমরা ভেবেচিন্তে বেছে নিই— ইলেভেনে সায়েন্স নেব না আর্টস, বিয়ে করব না একা থাকব, বিয়ে করলেও এই পৃথিবীতে ছেলেপুলে এনে দায়িত্ব নেব না

ঝাড়া-হাতপা থাকব, চার বছর পয়সা জমিয়ে একটা গাড়ির মালিক হব না কি রাশিয়ায় নেক্সট বিশ্বকাপটা ঘুরে আসব বিন্দাস। তা-ই যদি হয়, এই জীবনটা বাঁচবার প্যাটার্ন যদি বারে বারে নিজে গড়েপিটে নিতে পারি, তা হলে মৃত্যুর প্যাটার্নটা নিজে ঠিক করতে পারব না? কেন? আমি কবে মরব এবং কখন, সেটা ঠিক করাও কি আমার জীবনযাপনের সিদ্ধান্তের একটা গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অঙ্গ নয়? শরীরের কি মনের রোগে ভুগে-হেগে হেজেমজে গিয়ে নির্ধারিত শেষ শ্বাসটা নেব, না কি এই হরিব্ল বাঁচাটায় টেনে দেব একটা সচেতন ও কলার-তোলা দাঁড়ি, সেটাই যদি ঠিক না করতে পারলাম— তবে আমি সত্যি সত্যি স্বাধীন, না আসলে দণ্ডিত? এই তর্কে হয়তো অনেকেই বলবেন, দিনের পর দিন আটশো স্কোয়্যার ফিটের ঘেরে সঙ্গীহীন-বাক্যহীন বন্ধ্যা বাঁচাটাকে মারতে মরতেই তো চাই। উইথ ডিগনিটি। ডিগনিটাস যেমন দেয়।

iwritemyright@gmail.com

shishir roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy