Advertisement
E-Paper

ইনি on উনি

অ্যানোফিলিস মশার কামড়েই যে ম্যালেরিয়া হয়, তা আবিষ্কার করেন স্যর রোনাল্ড রস। এই পর্যন্ত অনেকেই জানেন। কিন্তু তাঁরাও হয়তো ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধে ওঁর ভূমিকা জানেন না। অথচ, আমরা যারা ডাক্তার, আজও তাঁরই দেখানো রাস্তায় মশাবাহিত রোগের মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রোনাল্ড রস-এর জন্ম ভারতের আলমোড়ায় ১৮৫৭ সালে। ছোটবেলাতেই পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। সেন্ট বার্থেলোমিউ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারিতে স্নাতক হন।

সুব্রত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

অ্যানোফিলিস মশার কামড়েই যে ম্যালেরিয়া হয়, তা আবিষ্কার করেন স্যর রোনাল্ড রস। এই পর্যন্ত অনেকেই জানেন। কিন্তু তাঁরাও হয়তো ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধে ওঁর ভূমিকা জানেন না। অথচ, আমরা যারা ডাক্তার, আজও তাঁরই দেখানো রাস্তায় মশাবাহিত রোগের মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

রোনাল্ড রস-এর জন্ম ভারতের আলমোড়ায় ১৮৫৭ সালে। ছোটবেলাতেই পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। সেন্ট বার্থেলোমিউ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারিতে স্নাতক হন। পাবলিক হেল্থ-এর ওপর পড়াশোনা করে ভারতে ফিরে এসে, ইন্ডিয়ান মেডিকাল সার্ভিসে যোগ দেন ১৮৮১ সালে। প্রথম দিকের পোস্টিংয়ের মধ্যে ছিল দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন শহর। তখন ভারতে খুব ম্যালেরিয়া হচ্ছে। কিন্তু এই রোগ ছড়ানোর কারণ ঠিক কী, সে বিষয়ে কেউই ভাল করে কিছু জানত না। এই ব্যাপারটা নিয়ে ইংল্যান্ডে ডা. ম্যানসন কাজ করছিলেন। ডা. রস তাঁর কাজে উদ্ধুদ্ধ হয়ে ম্যালেরিয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা ও কাজকর্ম শুরু করেন। তখন একটা ধারণা ছিল, ম্যালেরিয়া হয়তো জলবাহিত রোগ। স্যর রস পরীক্ষা করে দেখালেন, এটা তা নয়। তাঁর মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মাল, মশার কামড়েই ম্যালেরিয়া হয়। তিনি এ ব্যাপারে দক্ষিণ ভারতে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে লাগলেন।

প্রথমটায় সফল হলেন না। ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত রোগীকে যে মশা কামড়েছে, সুস্থ মানুষকে সেই মশার কামড় খাইয়ে দেখা গেল, ম্যালেরিয়া হচ্ছে না। আসলে, উনি না-জেনে প্রথম পরীক্ষার সময় কিউলেক্স মশা ব্যবহার করেন। কিন্তু উনি হাল ছাড়ার লোক ছিলেন না। সেকেন্দ্রাবাদের বেগমপেট অঞ্চলে থাকার সময়ই অ্যানোফিলিস মশার মধ্যে ম্যালেরিয়ার জীবাণুর জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে গবেষণার অনেকটা কাজই করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময় তাঁকে বদলি করে দেওয়া হল রাজস্থানের এমন একটা অঞ্চলে, যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব কম। এ যেন ‘পানিশমেন্ট পোস্টিং’।

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর সংঘাত লেগেই থাকত। কোনও দিনই তিনি এক জায়গায় বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। একে তিনি নিজেই ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বারবারিজ্ম’ আখ্যা দিয়েছেন। অবশেষে ডা. ম্যানসনের সুপারিশে তাঁর কর্মক্ষেত্র হয় কলকাতা। ভারতের চিকিৎসাক্ষেত্রে কলকাতাই তখন পীঠস্থান। এখানেই তিনি তাঁর রিসার্চের শেষ ধাপটুকু পার করলেন। জন্ম হল অবিস্মরণীয় কীর্তির।

কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। এক দিকে বার বার বদলি, অন্য দিকে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব। কলকাতায় এসে তিনি ব্যক্তিগত খরচায় দুজন সহকারী নিয়োগ করেন। এক জন তো প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই উধাও। অন্য জন, মহম্মদ বক্স, অবশ্য বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে নিরলস ভাবে তাঁকে সাহায্য করে যান। কিন্তু পরীক্ষা করার মতো রোগী কই? তখন কলকাতায় ম্যালেরিয়া ও প্লেগ মহামারীর আকার ধারণ করেছে, ভয়ে মানুষ সহযোগিতা করতে চাইছে না। মহম্মদ বক্স শেষমেশ রাস্তায় থাকা কিছু লোক ধরে আনলেন, টাকার লোভ দেখিয়ে। রক্ত-পরীক্ষার নাম শুনে তারাও পালাল। অবশেষে বাধ্য হয়ে পাখিদের ওপর শুরু হল তাঁর পরীক্ষা। ১৮৯৮ সালে তাঁর এই অসামান্য কাজের সঙ্গে কলকাতার নামটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, যদিও মাত্র আট মাস তিনি এই শহরে ছিলেন। মহম্মদ বক্সের ভূমিকাও তুলনাহীন। অতন্দ্র প্রহরীর মতো তিনি লেগে ছিলেন স্যর রসের গবেষণার কাজে। দিনের পর দিন বদ্ধ ঘরে পাহারা দিয়েছেন মশারির মধ্যে থাকা পাখি ও ভয়ংকর জীবাণুবাহী মশাদের।

সেই সময় কন্ট্রোল্ড ট্রায়াল-এর রেওয়াজ চালু হয়নি। তবুও তাঁর এই পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে আমি কন্ট্রোল্ড ট্রায়ালের স্পষ্ট ইঙ্গিত খুঁজে পাই। মশারির মধ্যে এক দল পাখির সঙ্গে তিনি রেখে দেন ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশাদের। আর অন্য একটা মশারিতে পাখিদের সঙ্গে কিছু সাধারণ মশা। এ ভাবেই তিনি অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ানোর গোপন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। এই কাজ অবশেষে তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়। ১৯০২ সালে পান ফিজিয়োলজি ও মেডিসিন বিভাগে নোবেল প্রাইজ।

কিন্তু আশ্চর্য, এই আবিষ্কারের কিছু দিনের মধ্যেই ফের তাঁকে বদলি করা হল অসমে, কালাজ্বর নিয়ে কাজকর্মের জন্য। বিরক্ত হয়ে উনি বলেছিলেন, ‘এ যেন আমেরিকা আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে কলম্বাসকে আদেশ করা, উত্তর মেরুতে অভিযান চালানোর জন্য।’ আক্ষেপ করতেন, ‘প্রশাসনে যোগ্য ব্যক্তিদের মাথার ওপর সব সময়ই অযোগ্য ব্যক্তিদের বসানো হয়, যারা ডেলিভার করতে অক্ষম।’ অবশেষে অবসাদগ্রস্ত হয়ে তিনি ইন্ডিয়ান মেডিকাল সার্ভিস-এর চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।

তাঁর আসল কাজ কিন্তু শুরু হয় এর পরেই। ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রাম-এর তিনি পুরোধা হয়ে উঠলেন। দেখলেন, জমা জলেই সাধারণত বর্ষাকালে মশা জন্মায়। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন রকম সুপারিশ করে, নানাবিধ স্যানিটেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে মশার প্রজনন বৃদ্ধি বন্ধের চেষ্টা করে গেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর ডাক পড়েছে এই ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রাম কার্যকর করার জন্য। পশ্চিম আফ্রিকা, গ্রিস, সুয়েজ ক্যানাল, সাইপ্রাস, মরিশাস প্রভৃতি অঞ্চলে তাঁরই দেখানো পথে ম্যালেরিয়া অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়। তাঁর এই একবগ্গা চিন্তাধারাকে সেই সময় ‘মসকিউটো বলশেভিজ্ম’ আখ্যা দেওয়া হত।

ব্যবহারিক জীবনে কিন্তু তিনি অতটা সফল ছিলেন না। শুনেছি সে জন্য তাঁর আক্ষেপও ছিল। জীবনের শেষ ভাগে নাকি গবেষণার স্বত্বও বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে গিয়েও বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি। লিভারপুলে কাজ করার সময় তিনি দু’বার পদত্যাগ করেন এবং পেনশন থেকে বঞ্চিত হন। দুর্ভাগ্য, তাঁর ক্ষেত্রে লক্ষ্মী-সরস্বতীর দ্বৈত যোগ সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

স্যর রোনাল্ড রসের ছিল বহুমুখী প্রতিভা। তিনি ছিলেন লেখক, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর লেখা কিছু বই খুব সমাদৃত হয়েছিল। গোড়ায় তিনি হতে চেয়েছিলেন কবি, লেখক বা মিলিটারি অফিসার। বাবার ইচ্ছেতেই ডাক্তার হন।

এখন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, এনসেফালাইটিস আবার বিষাক্ত ফণা মেলে ধরেছে। প্রায় দেড়শো বছর বাদে আবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আর এক স্যর রোনাল্ড রসের। আজ আমরা রাতদিন সেই আদর্শ চিকিৎসককেই খুঁজছি যিনি তাঁর যথার্থ উত্তরসূরি হয়ে আমাদের বৈতরণী পার করাবেন।

sir ronald ross subrata maitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy