Advertisement
E-Paper

এক ছিলিম ফিলিম

এক দেশের মধ্যে সে আর এক দেশ। পাথুরে দেওয়ালে ঘেরা, লোহার গরাদে পোরা। দিন-রাত, ঘণ্টা-মিনিট, জীবন, কাটে সেলবন্দি হয়ে।

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:২৬

ছবি: সিজার মাস্ট ডাই
দেশ: ইতালি
পরিচালক: পাওলো ও ভিত্তোরিয়ো তাভিয়ানি
সাল: ২০১২
শিশির রায়

এক দেশের মধ্যে সে আর এক দেশ। পাথুরে দেওয়ালে ঘেরা, লোহার গরাদে পোরা। দিন-রাত, ঘণ্টা-মিনিট, জীবন, কাটে সেলবন্দি হয়ে। ভারী, নিরেট লোহার দরজা, গায়ে ঢাউস তালা। রাখতেই হয়, বাসিন্দারা যে মার্কামারা ক্রিমিনাল সব! নৃশংস খুনি। জঘন্য ধর্ষক। ধুরন্ধর মাফিয়া-গুরু। ড্রাগ ডিলার। এক এক জনের পনেরো, সতেরো, উনিশ বছর কারাদণ্ড, বেশ ক’জনের যাবজ্জীবন। পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ-ষাটের পুরুষ সব, হাতের গুলি, কবজি, শক্ত চোয়াল, শীতল চাউনি দেখলে বোঝা যায়, রেবিবিয়া নামের এই জেলখানাটা কেন দেশের এক্সট্রিম হাই-সিকিয়োরিটি জেলগুলোর একটা!
এমনই পাথরচাপা চার দেওয়ালের মধ্যে যদি হঠাৎ ঢুকে পড়েন শেক্সপিয়র, জুলিয়াস সিজার-এর মতো আস্ত একখান রাজনৈতিক নাটক নিয়ে, আর অলক্ষে ঘুরতে থাকে মুভি ক্যামেরার রিল, কী হয়? ম্যাজিক? মিরাক্ল? প্লে উইদিন আ ফিল্ম? হয়তো এই সবই, প্লাস আরও কিছু। যিশুর জন্মেরও চুয়াল্লিশ বছর আগের এক হাড়-হিম রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আরও এক বার অভিনীত তথা আচরিত হয় ২০১২-র ইতালির এই জেলখানার ভেতরে, ওই ‘বাজে লোক’গুলোর জীবনে। যারা কোনও দিন অভিনয় কী বস্তু জানেনি-দেখেনি, তাদেরই ছুরিবোমাপিস্তল-ধরা হাতে পরিচালক-জুড়ি তুলে দেন চারশো বছরেরও বেশি পুরনো শেক্সপিয়র-এর স্ক্রিপ্ট। কাঁচা খিস্তি-মারা মুখে তিরতির কাঁপে ফ্রি ভার্স। কাস্টিং ডিরেক্টরের নেওয়া অডিশন থেকে একে একে উঠে আসে বিষণ্ণ সিজার, উদগ্র ক্যাসিয়াস, অস্থির ব্রুটাস, স্থিতধী মার্ক অ্যান্টনি। অন্যান্য চরিত্র মিলে শুরু হয় এক অপরাধ-আখ্যানের নাট্য-কাম-চলচ্চিত্রায়ন।
গোটা সিনেমাটা একটা জার্নি। পরিচালক দুজনের পক্ষে মস্ত চ্যালেঞ্জিং, জানা কথাই। এই লোকটার সঙ্গে ওর ঝামেলা, ওর ওপর তার দাউদাউ রাগ। ঠিক এমনটাই ছিল না সিজারের দরবার ‘ক্যাপিটল’-এ? বন্ধুতা আর বৈরিতা, বেইমানি আর বেরাদরির লুকোচুরি? এখানেও তাই। যার যার সেল-এ স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসে ডায়ালগ আওড়ায় এক একটা মানুষ, আর ক্যামেরা খুব কাছ থেকে ধরে ওদের মুখ, চোখ, গোটা শরীরের মানচিত্র। রিয়েল লাইফ দাগি অপরাধীদের রিল লাইফ-চরিত্রের গুচ্ছ শেড ধরতে, এই ছবির বেশির ভাগটাই সাদা-কালো। সেই ফ্রেমেই কত রং ফোটে! জিঘাংসার লাল, ঈর্ষার সবুজ, কাপুরুষতার কালো। গোড়ায় মহড়া চলে সেল-এ, জেলের অপরিসর করিডরে, জানলাহীন বিরাট উঁচু হলঘরে, পরে জেলের ছোট্ট অডিটোরিয়ামের মঞ্চে, চড়া এইচ এম আই আলোর তলায়। জেলের মধ্যে পরা কলারতোলা টি-শার্টের বদলে গায়ে ওঠে শেক্সপিয়রীয় ভাবনার রোমান কস্টিউম। পাশাপাশি ক্যামেরা-চোখে ধরা পড়ে অডিটোরিয়ামে দর্শকদের বসার চেয়ারগুলো সারাইয়ের কাজ, জেলবন্দিদের দিয়েই। দেখা যায়, এক সারি আসন মেরামত করে হা-ক্লান্ত এক কয়েদি কী নিরুচ্চার প্যাশনে হাত বোলাচ্ছেন একটা চেয়ারের কুশনে। হয়তো সেখানে এসে বসবেন সুন্দরী, তন্বী কোনও। কী নরম মমতায় জীবনের কত না-পাওয়াকে ছুঁয়ে যান ছবি-করিয়েরা!
তার পর এক দিন, সেই দিনটা আসে। বিশাল লোহার গেট দু’পাশে টেনে খুলে দেয় রক্ষী, বাইরের দুনিয়া হু-হু করে ঢুকে পড়ে আঁধার-জগতের বাসিন্দাদের করা নাটক দেখতে। পরদাও সাদা-কালো থেকে হঠাৎ রঙিন। যে মুখগুলো এত দিন, এত ক্ষণ ধরা ছিল ক্লোজ আপ আর মিড শট-এর চৌখুপিতে, তারাই এ বার লং শটে স্টেজ দাপায়। একের পর এক দৃশ্য সরে সরে যায় থিয়েটার আর সিনেমার হাত ধরাধরিতে। চটক ভাঙে, যখন নাটক-শেষে দর্শকদের স্ট্যান্ডিং ওভেশন আর সহর্ষ করতালির আবহে অভিনেতারা সবাই আনন্দে মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত ওপরে তুলে ঝাঁকায়, খুশিতে লাফায়, জড়িয়ে ধরে এ ওকে। আমরা পেরেছি, আমরাও পেরেছি রেবিবিয়া জেল-এর ‘ওরা’ যেন বার বার বলে, নিজেদেরই।
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার হাতে নিয়ে এ ছবির পরিচালক পাওলো তাভিয়ানি বলেছিলেন, ‘এই ডকু-ড্রামা যখন রিলিজ করবে, আশা করি দর্শকরা নিজেদেরকে আর চারপাশের সবাইকেও মনে করিয়ে দেবেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কুখ্যাত এক জন অপরাধীও আদতে এক জন মানুষ, বাকি জীবনটাও কিন্তু সে মানুষই থাকে।’ সেটাই শেষ কথা। যেমন দেখি ছবির শেষেও, যখন কড়া প্রহরায় সিজার-অ্যান্টনি-ব্রুটাসরা ফিরে যান যার যার সেল-এ, ক্লান্ত ক্যাসিয়াস ছোট্ট কফিমেকারটা নিয়ে কফি বানাতে বসেন। ঘৃণ্য অপরাধী? না নিঃসহায় ভঙ্গুর মানুষ? প্রশ্নটা জেগে থাকে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy