Advertisement
E-Paper

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়সন্ধে তখন গড়িয়ে রাতের দিকে ঢলছে, ঝিমঝিম চোখের পাতা, কু ঝিক ঝিক লোকাল ট্রেন। অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন সেরে ব্যান্ডেল-হাওড়া লোকালে হাই তুলছি। সাড়ে আটটার ট্রেন। ভিড় নেই, আবার কামরায় বসারও জায়গা নেই বিশেষ। মোটা লোক ঢুলে পড়ছে পাশের লোকের ঘাড়ে, ছোট বাচ্চা মাঝে মাঝেই প্যাঁপোঁ জুড়ে দিচ্ছে।

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০

সন্ধে তখন গড়িয়ে রাতের দিকে ঢলছে, ঝিমঝিম চোখের পাতা, কু ঝিক ঝিক লোকাল ট্রেন। অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন সেরে ব্যান্ডেল-হাওড়া লোকালে হাই তুলছি। সাড়ে আটটার ট্রেন। ভিড় নেই, আবার কামরায় বসারও জায়গা নেই বিশেষ। মোটা লোক ঢুলে পড়ছে পাশের লোকের ঘাড়ে, ছোট বাচ্চা মাঝে মাঝেই প্যাঁপোঁ জুড়ে দিচ্ছে।

আর একটা লোক ঘুমোচ্ছে উলটো দিকের বেঞ্চে। একটা লম্বা লাঠির ওপর মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিয়েছে। তার লাঠির আগায় প্লাস্টিকের পাখির সার, তার নীচে গোলাপি ঝুমঝুমিরা, বাঁ দিক করে রয়েছে লাল-নীল হাওয়া-চরকি, সঙ্গে প্লাস্টিকের গদা, মৌরি লজেন্স, দশ টাকার লাফানো বাঁদর, সেফ্টিপিনের ঝাঁক, সরু চিরুনি, ব্যঁাকানো ছুঁচের ছোট্ট প্যাকেটরা। সারা দিনে কত বিক্রি হয়েছে, বা আদৌ বিক্রি হয়েছে কি না, কে জানে। তবু সে পরোয়া না করে অঘোরে ঘুম যাচ্ছে। এটা একটা আশ্চর্য দৃশ্য বটে, অদ্ভুত গলায় সে হাঁকাহাঁকি করছে না, লোভ দেখাচ্ছে না, ‘দাদারা, দিদিরা, মাত্র দশ টাকায় আঠারোটা চিরুনি। এ অফার আপনার জীবনে এক বারই আসবে...’ সে চুলোয় দিয়েছে তার পসরার বিকিকিনি। স্বপ্নও দেখছে বোধ হয়। কষ গড়িয়ে পড়ছে ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে। সে সব বেখেয়াল, সে ঘুমোয়।

ট্রেন থামল একটা স্টেশনে। এক ভদ্রলোক উঠলেন। এ দিক ও দিক তাকালেন। তার পরেই সোজা গিয়ে সেই ফিরিওয়ালাকে বললেন, ‘অ্যাই, ওঠো!’ সে এতই ঘুমোয় যে সাড়াও দিল না। ভদ্রলোক বিরক্ত। এ বার একটু জোরেই ডাকলেন। তাতেও সাড়া নেই। এ বার ভদ্রলোক ভয়ানক বিরক্ত হয়ে ফিরিওয়ালাকে ঠেলে ঠেলে তুললেন। ‘ওঠো সিট থেকে। তুমি এই সিটে বসে আছ কেন? এটা তো প্যাসেঞ্জারের সিট।’ বেচারা খুব থতমত খেয়ে গেল। জিনিসপত্র গুছিয়ে উঠতে তার একটু সময় লাগল। সত্যি, এত ক্ষণ ধরে দেখছি, ভাবিনি তো যে ওর এই সিটে বসার অধিকার আছে না নেই? অনেকেই তো বিনা টিকিটে খুব রেলা নিয়ে ট্রেনে যাতায়াত করে। তারা কি সিটে বসে না? না কি তারা ফিরিওয়ালা নয় বলে বসতে পায়? আচ্ছা, ভদ্রলোক অন্য কাউকে তো সিট ছাড়তে বললেন না? কোনও মানুষ অকাতরে ঘুমোলে, সে ফিরিওয়ালা বলে তাকে কি এ ভাবে ডেকে তুলে তার ক্লান্তির তলানি লেগে থাকা সিটে আরামসে বসে পড়া যায়?

কোনও প্রতিবাদ করেনি বছর পঁয়তাল্লিশের রোগা ঘুম-কাতর লোকটি। সে ভারী লজ্জাই পেল। যেন লাইন ভেঙে সে বাবুদের আখড়ায় গুঁতিয়ে ঢুকে পড়েছিল। আস্তে আস্তে তার জিনিসপত্র গুটিয়ে নিয়ে সে গিয়ে বসল দরজার সামনের মাটিতে। অনেক জায়গা, ফেলে ছড়িয়ে বসা যায়, হুহু হাওয়া আসছে। এ বার সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল । মাথাটা হেলে পড়ল এক দিকে। তার পসরা-বাঁধা লাঠিকে আর ঘুমের মধ্যেও দাঁড় করিয়ে রাখার দায় সে বোধ করল না। তাকেও শুইয়ে দিল।

আমি কেবল স্টেটাস ও অধিকার-সচেতন মধ্যবিত্ত মানুষটির দিকে বার বার তাকিয়ে ফেললাম। প্রথমে তিনি একটু ভুরু কঁুচকে বার কয়েক আমার দিকে তাকালেন। তার পর বোধ হয় অস্বস্তি এড়াতে চোখ বুজে ফেললেন। তবে তাঁকে জোর করে চোখ বুজতে হল, তাই চোখের পাতাগুলো পিটপিটিয়ে বিট্রে করতেই থাকল। আমি ফিরিওয়ালাকে এক বার দেখলাম। বেশ ঘুমোচ্ছে সে, আর হাওয়া-চরকিগুলো এ বার ফুল-বাতাস পেয়ে বাঁইবাঁই ঘুরছে নিজের মনে।

rabibasariya probondho sanchari mukhopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy