Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

একটা [ভয়] কষ্ট লজ্জা

গান শুনছিলেন? ফেভারিট সিঙ্গার কে? বাংলা ব্যান্ড না গুড-ওল্ড রবি ঠাকুর? প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। আমি তখন ঠান্ডা একটা স্টিলের বিছানায় শুয়ে। মাথার ওপর গোল আলো, যার মধ্যে চার চারটে ল্যাম্প ফিট করা। এ রকমটাই কি সিনেমায় দেখায় যখন কারও অ্যাক্সিডেন্ট হয় আর তখুনি অপারেশন করতে হয়? অপারেশন থিয়েটারের বাইরে লাল আলো জ্বলছে কি?

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

গান শুনছিলেন? ফেভারিট সিঙ্গার কে? বাংলা ব্যান্ড না গুড-ওল্ড রবি ঠাকুর? প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। আমি তখন ঠান্ডা একটা স্টিলের বিছানায় শুয়ে। মাথার ওপর গোল আলো, যার মধ্যে চার চারটে ল্যাম্প ফিট করা। এ রকমটাই কি সিনেমায় দেখায় যখন কারও অ্যাক্সিডেন্ট হয় আর তখুনি অপারেশন করতে হয়? অপারেশন থিয়েটারের বাইরে লাল আলো জ্বলছে কি?

আমার হাতের শিরা নিয়ে তত ক্ষণে বিস্তর অশান্তি শুরু হয়ে গিয়েছে। স্যর, এনার শিরা ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না, চ্যানেল করব কী করে? এ সব অভিযোগের সঙ্গে চলছে তামাম খোঁচাখুঁচি, চেষ্টা, কী উপায়ে শিরায় চ্যানেল করে ড্রিপ চালু করা যাবে। আমার পিঠে ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। আমি পিঠ-খোলা একটা গাউন-মতো ড্রেস পরে কাঠ হয়ে শুয়ে রয়েছি প্রায় অন্তিমের অপেক্ষায়।

চাকরি করেন? মৃদু উত্তর দিই। ও বাবা! কাগজের লোক! আপনার থেকে তো সাবধানে থাকতে হয় মশাই— অজ্ঞানবাবু বলে ওঠেন, অনেকটা জটায়ুর ঢঙে। ‘হয়ে গেছে স্যর। আপনি পুশ করতে পারেন।’ বাক্যগুলো শুনেই পেটের ভেতর গুড়গুড়গুড়, বুকের ভেতর আজেবাজে শব্দে মাদল বাজতে থাকে। এখুনি হার্টটা ছলাৎ করে নিশ্চয়ই আমার মুখের কাছে চলে আসবে। আমি বিলক্ষণ জানি, আর কিছু ক্ষণ পর আমার জ্ঞান থাকবে না।

প্রকাণ্ড টেনশন হয়। জ্ঞান না-থাকা মানে কী থাকা? কিচ্ছু না? সেটা কেমন? ‘নাথিং’কে আন্দাজ অবধি করতে পারি না, অসহ্য একটা ছটফটানি ধরে যায়। আর একই সঙ্গে একটা ক্ষোভ ঠেলে ওঠে। কী আশ্চর্য! এটা কী ধরনের অন্যায়! জীবনের এতটা সময় মিসিং হয়ে যাবে? মুহূর্তগুলো আমার জীবনে জাস্ট ‘নেই’ হয়ে যাবে? বেঁচে থাকব কিন্তু জানতে পারব না চার পাশে কী ঘটছে? হয়তো সাংঘাতিক আশ্চর্য কিছু ফাঁকি পড়ে যাবে জীবন থেকে।

আচ্ছা, আলোর টানেল দেখতে পাব না কি? কিংবা নিজের সাব-কনশাস, যেখানে গচ্ছিত আছে নিষিদ্ধ বা অনৈতিক সব ঘুটঘুটে ভাবনা-ঘূর্ণি? সে সব জেনে কি আমার ভাল লাগবে? জ্ঞান ফিরলে কি সে সব মনে থাকবে? মনে থাকলে বরং ভাল হত। এতটা শূন্য লাগত না। কিন্তু যদি কেবল একটা অন্তহীন ‘কিচ্ছু না’-র মধ্যে এতটা সময় পড়ে থাকতে হয়, তা হলে আমি সব কিছু থেকেই তো বিযুক্ত, এমনকী সময় থেকেও। ভেবে ভেতরটা ভীষণ থরথর করে, নিজেকে আল্টিমেট বঞ্চিত মনে হয়। যেন জোর করে আমাকে একটা মিনি-মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। উফ, মানুষের হার্ট-লাং বোধহয় তেমন জরুরি নয়, যতটা তার চেতনা!

তার মানে আমার জীবনটা এই বার দু-ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। জ্ঞান হারানোর আগে আর জ্ঞান ফেরার পরে। মাঝখানটা শূন্য। মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের মতোই ঝুলন্ত, যোগ-সূত্র নেই। দেখতে পাই, ডাক্তারবাবু একটি সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যান ড্রিপ-এর বোতলের দিকে। ছুঁচ ফুটিয়ে একটা কী যেন তরল চালান করেন বোতলে। আমি নিঃশব্দে তীব্র কমপ্লেন করতে থাকি, ‘এটা কী হচ্ছে, আমার জীবন থেকে কেন এতটা সময় নিয়ে নেওয়া হচ্ছে?’ চেতনা আর আমি যমজ, ওকে ছাড়া আমি কক্ষনও থাকিনি যে! প্রকাণ্ড ধড়ফড়ানির মধ্যেও সময় চুরি করার চেষ্টায় আপ্রাণ খুলে রাখার চেষ্টা করি চোখ, যাচিয়ে নিতে থাকি আমার ইন্দ্রিয়দের ক্ষমতা। আর তার পর, ঝপ্পাস!!!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sanchari mukhopadhyay rabibasariya anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE