Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৬....

একটাভয়কষ্ট[লজ্জা]

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকত। ঠিক বন্ধু বলা যায় না, আবার ঠিক যেন না-বন্ধুও নয়। সে ভারী হামবড়া ছিল। যখন তখন বিশেষ করে আমাকে আর দিদিকে কথায় কথায় ডাউন দিত। আমরা মুখের ওপর তেমন কিছু বলতে পারতাম না আর ভেতরে ভেতরে তড়পাতাম।

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকত। ঠিক বন্ধু বলা যায় না, আবার ঠিক যেন না-বন্ধুও নয়। সে ভারী হামবড়া ছিল। যখন তখন বিশেষ করে আমাকে আর দিদিকে কথায় কথায় ডাউন দিত। আমরা মুখের ওপর তেমন কিছু বলতে পারতাম না আর ভেতরে ভেতরে তড়পাতাম। এক দিন হয়েছে কী, আমি আর দিদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এন্তার গুলতানি করছি, আর দেখছি ওই মেয়েটা হনহনিয়ে আমাদের বারান্দার নীচ দিয়ে যাচ্ছে। ভাবখানা এমন, যেন ওরই বিস্তর দায়িত্ব রয়েছে এই অসীমকে সামলানোর। বয়সের তেজ আর কী।

এমন সময় দেখি এক জন মহিলা ওর রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে কী সব বলছেন। প্রথমটা বুঝতে পারিনি। তত পাত্তাও দিইনি। কিন্তু মহিলার গলার আওয়াজ বাড়ল আর তাঁর কথা বলার ভঙ্গি থেকে মালুম পেলাম, উনি আমাদের পাড়ারই এক জন রেসিডেন্ট পাগলি। ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু বোঝার আগেই সেই পাগলি কষে এক চড় মারলেন পাশের বাড়ির মেয়েটিকে। আমরা কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব, মেয়েটিও। কিন্তু তক্ষুনি যেন সোডার বোতল অচানক খোলার মতো আমার আর দিদির বুকবুকিয়ে হাসি উঠে এল। প্রাণপণ চেষ্টা করে হাসি থামালাম, তবে মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল মেয়েটির এই পরিস্থিতি নিয়ে আমরা তেমন পীড়িত নই। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সামলে নিয়ে আমরা নীচে দৌড়লাম।

মেয়েটির সাংঘাতিক অবস্থা তখন। যত না চড় খেয়ে তার লেগেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি লেগেছে এই আকস্মিকতায়। অপমানে, লজ্জায় সে খানখান হয়ে যাচ্ছে। জড়িয়ে ধরে বাড়ি নিয়ে এসে বসিয়ে জল-টল খাইয়ে বললাম, এক জন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের এই অসভ্যতায় কেউ দুঃখ পায় না কি? কেবল সে লাল টকটকে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সবাই খুব হাসছিল, না?’ আরে ও সব কথায় কান দিতে নেই, এই সব বলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তার পর নিজেরাই বলাবলি করতে লাগলাম যে অন্যকে কখনও ডাউন দিতে নেই ইত্যাদি।

এই ঘটনার মাস চার-পাঁচ পর এক দিন লিন্ডসে স্ট্রিট-এর মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি বাস ধরব বলে। ভরভত্তি দুপুর। বেশ গরম। দোকানের এক টুকরো ছায়া বাগিয়ে ফুটপাতের কিনারায় দাঁড়িয়েছি, যাতে বাস এলেই একটা ছোট্ট লাফে উঠে পড়তে পারি। এমন সময় হাঁটুর ঠিক নীচে একটা জোরসে আঘাত অনুভব করলাম। কেউ যেন ধাঁই করে ঘুষি মারল। কোনও মতে টাল সামলাতে সামলাতে রাস্তার ওপর দাঁড়ালাম। পেছন ফিরে দেখি, এক জন পাগল বসে আছে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠিক তার পাশে। খুব লাগল। তার চেয়ে বেশি লাগল, লিন্ডসে স্ট্রিটের অমন রমরমে জায়গায় অন্তত কয়েকশো লোক একটা পাগলের কাছে আমায় ঘুষি খেয়ে পড়ে যেতে দেখল! কান গরম হয়ে উঠল। বেশ বুঝতে পারলাম কয়েক জন লোক ইতস্তত দাঁড়িয়ে, উত্‌সুক। এক জন তো এগিয়ে এসে জিজ্ঞেসই করে বসল, ‘ব্যাপারটা ঠিক কী বলুন তো ম্যাডাম? চেনেন না কি?’ কোনও মতে মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম। বাসটা কিছুতেই কেন আসছে না? আমার মুখটা কি লাল হয়ে গেছে? নিশ্চিত ভাবেই অনেকের বুকবুকিয়ে হাসি উঠে আসছে পেট থেকে? এ বার কি আমায় কেউ সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসবে? মাথা ভোঁ ভোঁ। কানেও যেন অল্প শুনছি। আর বেশ বুঝতে পারছি পাশের বাড়ির মেয়েটার মুখটা আস্তে আস্তে এসে আমার মুখের ওপর কাট অ্যান্ড পেস্ট হয়ে যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasoriyo sanchari mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE