Advertisement
E-Paper

কংসাবতী

খু-উ-ব মুশকিলে পড়েই তোমায় চিঠি লিখছি। আশেপাশে কেউ নেই, যাকে আমার প্রবলেমটা বোঝাই। আমার নাম বৈজয়ন্ত, থাকি দিল্লিতে। তা বলে ভেবো না কিন্তু বাংলা জানি না! আমি রুটেড হব বলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও মা আমাকে বাংলা শিখিয়েছে। পাগলা দাশু জল চিবিয়ে খায়, প্রফেসর শঙ্কুর বেড়ালের নাম নিউটন, হিজিবিজবিজ বড় নিরীহ, ফেলুদার ভীষণ বুদ্ধি— এ সবই আমি জানি। রুটেড হয়েছি বলেই না আমি সব কিছুর রুট খুঁজি আর তাতেই যত গোল বাধে।

দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ডিয়ার আনন্দমেলা,

খু-উ-ব মুশকিলে পড়েই তোমায় চিঠি লিখছি। আশেপাশে কেউ নেই, যাকে আমার প্রবলেমটা বোঝাই। আমার নাম বৈজয়ন্ত, থাকি দিল্লিতে। তা বলে ভেবো না কিন্তু বাংলা জানি না! আমি রুটেড হব বলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও মা আমাকে বাংলা শিখিয়েছে। পাগলা দাশু জল চিবিয়ে খায়, প্রফেসর শঙ্কুর বেড়ালের নাম নিউটন, হিজিবিজবিজ বড় নিরীহ, ফেলুদার ভীষণ বুদ্ধি— এ সবই আমি জানি। রুটেড হয়েছি বলেই না আমি সব কিছুর রুট খুঁজি আর তাতেই যত গোল বাধে। কলকাতায় গেলে আমরা ‘কংসাবতী’তে থাকি। ভাবছ কিনা যে, সে তো পুরুলিয়ার নদী! ‘কংসাবতী’ হল আমার বাবাদের পুরনো বাড়ি। নামের মতনই আজব। একটা বাড়ির দুটো ঠিকানা! বাড়িটাতে ঢোকার দু’দিকে দুটো পেল্লায় দরজা। একটার নম্বর তিনশো পঁয়তাল্লিশ, অন্যটার তিনশো সাতচল্লিশ। এগুলো সদর দরজা। এ ছাড়াও ছাইগাদার পাশে আছে খিড়কি দরজা। খিড়কি মানে তো জানলা। সেটা দরজা কেমন করে হবে? এ সব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু মোটাসোটা ধমক। তিন তলার ছাদে কেউ ওঠে না। সেটা নাকি ন্যাড়া ছাদ। কাদের বাড়ির ছাদের আবার এক কোমর চুল থাকে? দোতলার ছোট ছাদটা হল কোলছাদ। ছাদ আবার কারও কোলে থাকে? মা বলে ও বাড়ির লোকেরা মানুষ ভাল তবে সকলেই আধপাগল। কংসাবতীতে কেউ কাউকে ঠিক সম্বোধনে ডাকে না। দাদুর সব থেকে বড়ভাইকে সবাই বলে জেতারা। তার যেখানে যত টাকা ছিল কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে সেই সব টাকা দিয়ে বাড়ির পিছনে একটা কালী মন্দির করেছে। ভোরবেলা ভিজে জামাকাপড়ে ‘তারা তারা ব্রহ্মময়ী’ বলে ভয়ানক চেঁচাতে চেঁচাতে সক্কলকার ভোরঘুম মাটি করে মন্দিরে চলে যায়। শুকনো না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফেরে না। শনিবার ঘোর রাত অবধি বিকট বেসুরো গলায় ‘নেচে নেচে আয় মা শ্যামা’ গাইতে গাইতে সাধনা করে। দেখা হলে যদি প্রণাম করো তা হলে ‘জ্যে ত্তারা’ বলে এমনি চেঁচাবে যে আশেপাশে ছোট বাচ্চা থাকলে কঁকিয়ে উঠবে। এ বার বুঝলে কেন ‘জেতারা’ বলে ডাকে সবাই। বাবার এক দিদির মাথায় অনেক চুল। তবু তাকে সক্কলে টাকি বলে। ছোটবেলায় বাবার এক দুষ্টু দাদা চুপিচুপি তার মাথায় গোল টাকের মতন করে চুল কেটে দিয়েছিল। সেই দাদাকে আবার সবাই ‘উড়ে’ বলে ডাকে। বাবার এক টুকটুকে ফরসা বোনকে সবাই জ্যান্ত কালী বলে আর তার বরকে আতপ চাল। বাবার গাঁট্টাগোট্টা মিষ্টি ভাইপো দু’জনকে সবাই পেঁচো আর নেচো বলে ডাকে। দাদুর ছোটভাই হল চাটুম। মাঝেমাঝেই না বলেকয়ে চাটুম বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। চেঁচামেচি, কান্নাকাটি, লোক জানাজানির পর রাস্তাঘাট, খাটের তলা মায় হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত খুঁজে হয়রান হয়ে যেই না খেয়েদেয়ে সকলে দু’চোখের পাতা এক করবে সে সুড়ুৎ করে বৈঠকখানার সোফায় এসে বসে পা দোলাতে থাকবে। কোনও কথা জিজ্ঞেস করলেই তথাস্তুর ভঙ্গিতে হাত তুলবে। ও বাড়িতে কেউ কোনও ব্যাপারে একমত হয় না।

তিন তলার মস্ত ঘরে দিদিভাই থাকে। সে কিন্তু কারও দিদি নয়। সে হল বাবার ঠাকুমা। অনেক বয়েস হলে কী হবে, এখনও খালি চোখে ‘কথামৃত’ পড়ে; জাঁতি দিয়ে এমন সুপুরি কুঁচোয়, মনে হয় যেন মেশিনে কাটা। না মোবাইল, না ফেসবুক; স্বয়ং শিবের সঙ্গে তার সরাসরি কথা হয়! স্বপ্নে বাবা দিদিভাইকে পুজোর মেনু বলে দেয়, কে কখন দিদিভাইকে কালীঘাটে ঘুরিয়ে আনবে তার নাম বলে দেয়। পাশফেল, রোদবৃষ্টি, চোরাই জিনিসের হদিশ— তাও বলে দেয়। সব যে মেলে, এমনটা নয়। অবিশ্বাসী মন নিয়ে শুনলে তো মিলবে না বটেই।

আমরা বছরে অন্তত এক বার কলকাতায় আসি। আর আসি ভোটের সময়। সে অবশ্য প্রতি বছর হয় না। শেষ বারের ঘটনাটা বলি। সকাল থেকে জেতারা, চাটুম, টামটাম, হরবোলা, বাঁধাকপি সব্বাই এক বার করে দিদিভাইকে ভোটের ব্যাপারটা বুঝিয়ে এসেছে। এই একটা জিনিস দিদিভাই কিছুতেই বুঝতে পারে না। সকলেই আসলে নিজে যে পার্টিকে সাপোর্ট করে তার চিহ্নে ছাপ দিতে বলেছে। দিদিভাই কাউকে বঞ্চিত করবে না বলে সব্বাইকেই ছাপ দিয়েছে। রাত্তিরবেলা পাঁঠার মাংস দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে সবাই যখন জানতে পারল, সে কী কেলেঙ্কারি! শুরু হয়ে গেল ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’। কেউ খেলই না, তো কেউ একাই চার জনের মাংস খেয়ে নিল, কেউ ভীষণ জোরে স্বাধীনতার গান গাইতে লাগল তো কেউ সেই রাতদুপুরেই চান করতে চলে গেল। মোটকথা কেউ কাউকে আর সহ্য করতে পারল না। শুনছি নাকি সামনে ভোট। আচ্ছা, দিদিভাই ভুলটা কী করেছিল? ঠাকুরদেবতা থেকে মতামত অবধি সব কিছুর গরমিল সত্ত্বেও কংসাবতীতে সব্বাই যেমন এক সঙ্গে থাকে, তেমনি করে ভোট করলে মন্দটা কী হয়? তোমাকে চিঠি লিখছি জানতে যে, এ বার ভোটের সময় প্রস্তাবটা কি আমি দিতে পারি, নাকি আবার বকুনি জুটবে? শুধু ভোটের নামটা পাল্টে একজোট রাখলেই হবে।

ইতি

গিল্টু (এটা আমার কংসাবতীর নাম)

dipanwita ghosh mukhopadhyay dipanwita
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy