Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কুয়োতলা

তিরিশ ফুট, চল্লিশ ফুট মাটি কেটে নীচে নেমে যান ওঁরা। কখনও মাটির ধস, কখনও বিষগ্যাস চেপে ধরে শরীর। আর উঠতে দেয় না। আর্যভট্ট খানআমরা পালমশাইয়ের দল। ইঁদুরের পালের মতো আমরা গর্ত খুঁড়ে নীচে নেমে যাই। সারা দিনে যত ক্ষণ না পৃথিবীর আলো দেখি তার থেকে বেশি সময় মাটির তলার গর্তের আলো-আঁধারির মধ্যে থাকি। আমরা এক এক দিনে ৩০ ফুট থেকে ৪০ ফুট, মানে চার তলার সমান মাটি কেটে গর্ত খুঁড়ে ফেলতে পারি। বিশ্বাস হচ্ছে না তো চলে যান, বেহালা ট্রাম ডিপো থেকে নাগেরবাজার। চলে যান শিলিগুড়ি, আসানসোল, শান্তিনিকেতন, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, সুন্দরবন, অথবা ওড়িশার আঙ্গুলে। দেখতে পাবেন আমাদের কাজ।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

অমর পালের কথা

আমরা পালমশাইয়ের দল। ইঁদুরের পালের মতো আমরা গর্ত খুঁড়ে নীচে নেমে যাই। সারা দিনে যত ক্ষণ না পৃথিবীর আলো দেখি তার থেকে বেশি সময় মাটির তলার গর্তের আলো-আঁধারির মধ্যে থাকি। আমরা এক এক দিনে ৩০ ফুট থেকে ৪০ ফুট, মানে চার তলার সমান মাটি কেটে গর্ত খুঁড়ে ফেলতে পারি। বিশ্বাস হচ্ছে না তো চলে যান, বেহালা ট্রাম ডিপো থেকে নাগেরবাজার। চলে যান শিলিগুড়ি, আসানসোল, শান্তিনিকেতন, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, সুন্দরবন, অথবা ওড়িশার আঙ্গুলে। দেখতে পাবেন আমাদের কাজ। কোথাও বালি মাটি, কোথাও এঁটেল মাটি, কোথাও পাথুরে মাটি খুঁড়ে নেমে যাই। কোথাও আবার মাটির তলায় গর্ত খুঁড়ে পাই জাগ্রত পাথর। সেই পাথর বাড়িতে এনে ঠাকুর জ্ঞানে পুজো করি। আমরা বেশির ভাগই কৃষ্ণঠাকুরের ভক্ত।

আমরা থাকি বারাসতের কাছে গঙ্গানগরে। পাল-পাড়ার বেশির ভাগ ঘরেই পেয়ে যাবেন কুয়ো-মিস্ত্রিকে। আমাদের বেশির ভাগের পদবিই পাল, তাই লোকে আমাদের আদর করে পালমশাই বলে ডাকে। এখন জল খাওয়ার কুয়ো কমে গেলেও, আমাদের কাজের অভাব নেই। আছে বাড়ি তৈরি করার কুয়ো খোঁড়ার কাজ, সেফটি ট্যাংক-এর জন্য কুয়ো খোঁড়ার কাজ, কারখানার ভেতর জল সরবরাহের জন্য কুয়ো খোঁড়ার কাজ।

আমার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, তবে আমাদের কাজের অবসর নেই। এই আমাদের গুরু নিতাই পাল, চুলগুলো সব সাদা হয়ে গিয়েছে, তবু ৩০ ফুট গভীর কুয়ো এক দিনে কেটে ফেলে সাঁ করে নীচে নেমে বিড়ি ধরিয়ে ফেলে। নীচ থেকে বলে, বালতি দাও। আমরা ওপর থেকে বালতি দিই আর ম্যাজিকের মতো বালতি মাটিতে ভরে যায়।

কে খুঁড়তে খুঁড়তে কতটা নীচে নামতে পারে, তার ওপরেই আমাদের সুনাম। যেমন আমার নামে পাশে বসেছে ৪০ ফুটের মিস্ত্রি। কিন্তু তাতে আমি খুব একটা কেউকেটা নই। কেউকেটা হল গুরু নিতাই। তার নামের পাশে বসেছে ৮০ ফুট। গোটা কলকাতা জুড়ে ওর কাজ ছড়িয়ে। শ্যামবাজারে বেকারি কারখানার জন্য কুয়ো খুঁড়েছিল ৭০ ফুট। ধাপার মাঠে মুরগির পোলট্রির জন্য খুঁড়েছিল ৬৮ ফুট। আর পুরুলিয়ায় একটা কুয়ো খুুঁড়তে গিয়ে ৮০ ফুট নীচে নামতে হয়েছিল। আট তলা বাড়ির সমান। শুধু একটা কোদাল আর শাবল দিয়ে ওই ৮০ ফুটের রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি।

মনে পড়ে বাঁকুড়ার একটা ছোট্ট গ্রামের কথা। গুরুদেবের সহকারী হিসাবে আমি গিয়েছি। সে বড় শক্ত মাটি। কিছুতেই জল বেরোয় না। কুয়ো কাটা হচ্ছে, গ্রামের লোকেরা ভিড় করে আছে। যেন ক্রিকেট ম্যাচ। এই বেরোল এই বেরোল জল, কিন্তু কোথায় জল? শেষ পর্যন্ত সাত দিন ধরে মাটি কাটতে কাটতে যখন জল বেরোল তখন গুরুদেব ওই গ্রামের অমিতাভ বচ্চন। কুয়োর নীচে একটা পাথরে গুরুদেব নিজের নামটা খোদাই করে রেখে এসেছিল। যেগুলো বেয়াড়া কুয়ো, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের পর কুয়োয় বসে মাটির নীচে পাথরে নিজের নাম খোদাই করে দিয়ে আসি আমরা। ৪০ ফুট মাটির তলাতে বসে বিড়ি ধরিয়েছিল গুরু। আহ্ কী সুখটান!

কিন্তু এই সুখটান দিতে গিয়েই বিপদ ঘনিয়েছিল এক দিন। সল্টলেকের একটা সিমেন্টের গোডাউন কারখানায় কুয়ো খুঁড়তে গিয়ে, ৪০ ফুট নীচে নেমেছে গুরু, কোদাল চলছে তো চলছেই কিন্তু জল বেরোচ্ছে না। হঠাৎ নাকে একটা গন্ধ ঝাপটা মারল। গন্ধটা চেনা। অ্যামোনিয়া গ্যাস। বেশি গ্যাস হয়ে গেলে আর কাজ করা যায় না। উঠে আসতে হয়। ওঠার আগে একটা বিড়ি ধরাতেই আগুন লেগে গেল কুয়োর ভেতর। মুখের মধ্যে আগুনের ঝাপটা। কোনও রকমে বালতি ধরে ওপরে উঠে এল গুরুদেব। মুখটা পুড়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল। এর পর থেকে সারা জীবনের জন্য গুরুদেবের গলা থেকে গায়ের রং এক রকম, আর মুখের রং অন্য রকম।

এ রকম কত গল্প। কুয়ো কাটতে কাটতে কখনও মাথার ওপরে ইট চাপা পড়ল। মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। সেই অবস্থায় উদ্ধার করা হল আমাদের। কখনও মাটির ধস নামল। মাটি চাপা পড়ার পরও মাটি খুঁড়ে আমাদের জীবন্ত উদ্ধার করেছে আমাদের বন্ধুরা। আমাদের জান বড় শক্ত।

কী ভাবছেন, ঝুঁকির কাজ করতে গিয়ে অনেক সাবধানতা নিতে হয়? কিস্যু না। আজকাল রাস্তায় দেখি যে সব মিস্ত্রি অনেক উঁচুতে উঠছে তাদের কোমরে দড়ি বাঁধা। নীচে সার্কাসের ট্রাপিজের খেলার মতো জাল বিছানো। আমাদের কোমরে ওসব দড়ি-টড়ি কিছুই নেই। মাটির গভীরে অক্সিজেনের অভাব হলেও মুখে অক্সিজেন-মুখোশ নিয়ে নামার বিলাসিতাও আমাদের নেই। যত নীচেই নামি, আমাদের ভরসা শুধু একটা দড়ি-বাঁধা বালতি। মাটির গভীরে, যখন কেউ থাকে না, ওই বালতিটাই আমাদের বন্ধু। বিপদের গন্ধ পেলে বালতিটাকে জড়িয়ে ধরি। টেনে তোলে ওপরের সঙ্গীরা। আবার অক্সিজেনও দেয় ওই বালতি। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? বালতিটা যখন ওপর থেকে নীচে নামায় তখন বেশ জোরে নীচে নামিয়ে দেয় ওরা। বালতির সঙ্গে যে হাওয়া ঢোকে সেটাই আমাদের অক্সিজেন। আবার কুয়োয় যদি দুর্গন্ধ থাকে তা হলে বালতি করেই পাঠিয়ে দেয় লেবুপাতা ভেজানো জল। সেই জল মাটিতে ঢেলে দিই, দুর্গন্ধ চলে যায়।

মেয়েটা নাইনে পড়ে। ছেলে দুটোকেও খুব কষ্ট করে কলেজে পড়াচ্ছি। মাত্র ৪০০ টাকা রোজে কি সংসার চলে? বর্ষাকালে কাজ কমে যায়। আজ সকাল সাতটায় বেরিয়ে পড়েছি বাড়ি থেকে। অনেক সময় কুয়ো কাটতে রাত আড়াইটের সময়ও বেরোতে হয়। বেরোতে গিয়ে দেখলাম বউ ঘুমোচ্ছে। ডাকলাম না। মেয়েটা রাত জেগে পড়াশোনা করেছে। সেও ঘুমোচ্ছে। মাথার পাশে জীবনবিজ্ঞান বইটা পড়ে রয়েছে। এক কাপ চা বানিয়ে খেয়ে বিড়ি ধরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

কাজটা বেশি দূরে নয়, দমদমের মধুগড়ে। একটা বাড়ি তৈরির জন্য কুয়ো কাটা হবে। খাওয়ার জলের কুয়ো নয়, ভিত কাটার জন্য। জামা প্যান্ট খুলে গামছা জড়িয়ে কোদাল নিয়ে কাটতে থাকলাম মাটি। ২০ ফুট কাটার পর দেখি মাটিটা বেয়াড়া। ঝুরঝুর করে পড়ে যাচ্ছে। খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। কাটতে কাটতে আরও নীচে চলে এলাম। মাটিটা একেবারেই ভাল নয়। এই কুয়োটা এতটাই সরু যে এক জনের বেশি নামা যায় না। কাটতেই বেশ অসুবিধে। তার মধ্যে ঝুরঝুর করে মাঝেমধ্যে মাটি পড়ে যাওয়ায় বেশ বিরক্তই লাগছিল। দেরি হচ্ছিল। তার মধ্যে মাটির চারিদিকে বেড় পরায়নি কন্ট্রাক্টর। কত বার বলেছি কুয়োর কাজ করতে গেলে মাটির চারিদিকে বেড় পরানো বা চাড় দেওয়া দরকার। তা হলে মাটির ধস নামা বন্ধ হয়, মাটি চুঁইয়ে জল পড়া বন্ধ হয়। কাজটা তাড়াতাড়ি হয়।

কাটতে কাটতে ৩৫ ফুট নীচে নেমে এসেছি। হঠাৎ একটা চাক এঁটেল মাটি আমার মাথার ওপর পড়ল। না, সুবিধের ঠেকছে না। বালতি ধরে ওপরে উঠে এলাম। বললাম, চারিদিকে বেড় না পরালে কাজ করা যাচ্ছে না। মাটির ধস নামছে বারবার। কিন্তু কে কার কথা শোনে? কাটার কাজ তো প্রায় শেষ। এই কুয়োতে তো জল বের করার কিছু নেই। আর তিন ফুট কাটলেই হয়ে যাবে। সবাই বলল যাও ভাই আর তো মাত্র তিন ফুট। কাজ বন্ধ কোরো না। চলে যাও নীচে।

একটা বিড়ি ধরালাম। কাজটা শেষ না করলে পরের কাজটা ধরতে পারব না। রোজের টাকায় টান পড়বে। মেয়ের জীবনবিজ্ঞান বইটার কথা মনে পড়ল। ফের বালতি ধরে নেমে গেলাম। ‘জয় মা’ বলে শুরু করলাম মাটি কাটা। নীচে নামার সময় শুধু ওদের বললাম, একটু খেয়াল রেখো ওস্তাদরা। ডাকলে সাড়া দিয়ো, গল্পে মশগুল হয়ে যেয়ো না।

তাড়াতাড়ি কোদাল চালাচ্ছি। কেমন যেন চাপ চাপ লাগছে ভেতরটা। হঠাৎ, ঝুরঝুরে মাটি খসে পড়া নয়, মনে হল চার দিক থেকে মাটির ধস নামছে। আর দেরি নয়, ওপরে উঠে যেতে হবে। সাংঘাতিক বিপদ। ফের ধস। আরে, আমি নীচে নেমে যাচ্ছি কেন? মাথার ওপর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ওপর থেকে বালতি ছুড়ে দিয়েছে ওরা। বালতিটা আঁকড়ে ধরলাম। ওরা বালতিটা টানছে, কিন্তু আমি উঠতে পারছি না। ক্রমশ চারিদিকে মাটি আমাকে চেপে ধরছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মাটিতে গেঁথে যাচ্ছি। হাত-পা ছোড়ার চেষ্টা করছি কিন্তু নড়তে পারছি না। ‘বাঁচা আমাকে বাঁচা’ বলে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। কেউ শুনতে পেল কি?

নিতাই পালের কথা

বাজারে গিয়ে প্রথম খবরটা পেলাম। পোলের ধারে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম, শুনলাম অমর মাটি চাপা পড়েছে। কুয়োর শেষ কাজটা করতে গিয়ে হঠাৎ মাটির ধস নেমেছে। মুখটা শক্ত হয়ে গেল আমার। ৪০ বছরের কুয়ো কাটার জীবনে দুর্ঘটনার কথা তো কম শুনলাম না, তবু অমরের মাটি চাপা পড়ার কথাটা মানতে পারছিলাম না। যতই হোক আমার শিষ্য। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছি। শিখিয়েছি গভীর গর্তে মাটির চরিত্র কেমন হয়, কেমন হয় মাটি চুঁইয়ে যে জল বেরোয় তার চরিত্র। কখন বিপদ বুঝে উঠে আসতে হয়, কী ভাবে উঠে আসতে হয় সবই শিখিয়েছি। পারল না কেন?

খবরের কাগজে বড় বড় করে খবরটা বেরিয়েছে। পাড়ার লোকেরা আলোচনা করছিল, ওকে এখনও উদ্ধার করতে পারেনি কেউ। চায়ের কাপটা নীচে নামিয়ে ঠিক করলাম দমদম যেতে হবে। ওর বডি বের করতে হবে মাটি খুঁড়ে। এর আগেও এ রকম মাটি খুঁড়ে বডি বের করেছি। কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম মধুগড়ের দিকে।

সবাই নানা কথা বলছিল, আমি চুপ করে বসেছিলাম। আমার পাশেই বসে রয়েছে বিধান। এই বিধানই তো আমাকে এক বার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। সে দিনটা মেঘলা করে ছিল। মাটি যত কাটছি ততই যেন শক্ত ইট বেরোচ্ছে। কাটতে কাটতে হঠাৎ যেন ইট বৃষ্টি হল মাথার ওপর থেকে। মাটির ধস নয়, ইটের ধস নামল। হাতটা কোনও রকমে মাথার ওপরে রেখে গুঁড়ি মেরে মেরে বসে পড়েছিলাম। তবু ইট চাপা পড়ে গিয়েছিলাম। নিশ্বাস যখন প্রায় বন্ধ, বালতি ধরে ওপরে ওঠার ক্ষমতা আর নেই, দেখি ইট সরিয়ে আমাকে তোলার চেষ্টা করছে বিধান। ও আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ওপরে নিয়ে এসেছিল। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে চার দিনের মধ্যে ফের কোদাল ধরেছি।

কত রকম দুর্ঘটনা। যখন কুয়ো খোঁড়ার তিন টাকা রোজ ছিল, তখন থেকে কাজ করছি! এক বার কুয়োয় নামতে গিয়ে মুখ পুড়ল। আর এক বার, হাসবেন না, কুয়োয় নেমে বালতির আংটার সঙ্গে আটকে গিয়েছিল আমার অণ্ডকোষ। ১৮ বছর আগের ঘটনা। মাটি কাটতে কাটতে প্রায় ২০ ফুটের মতো নীচে নেমে গিয়েছি। সব ভাল, শুধু একটাই অসুবিধে, কুয়োর ভেতরটা খুব সরু। বালতিতে মাটি ভরতে খুব অসুবিধা। বালতি যখন ওপর থেকে ফেলে, আমরা বলি ‘আসুক’। মাটি ভরা হয়ে গেলে, বলি ‘যাক’। যেই ‘যাক’ বলেছি, সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁচকা টান অণ্ডকোষে। দেখি বালতির আংটার সঙ্গে আমার অণ্ডকোষ গেঁথে গিয়েছে। ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার। ওরা বুঝতে পারছে না, ক্রমশই টেনে তুলছে ওপরে। আর আমার ওই জায়গাটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরছে। কিছুতেই আংটাটা ছাড়াতে পারছি না। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। কোনও রকমে ওপরে উঠে অজ্ঞান হয়ে যাই।

এক বার, একটা সেফটি ট্যাংকের কুয়ো খুঁড়তে গিয়ে, পাশেই যে আর একটা সেফটি ট্যাংক আছে সেটা খেয়াল করেনি বিকাশ। কিছুটা কুয়ো খুঁড়তেই পাশের ট্যাংকের নোংরা পায়খানার জল লিক করে চলে এলো কাটতে থাকা কুয়োয়। মুহূর্তের মধ্যে নোংরা জলে ভরে গেল কুয়ো। ওই পায়খানার নোংরা জলে ঝাঁপ দিয়ে নেমে বিকাশকে উদ্ধার করেছিলাম। না হলে হয়তো গ্যাসের ঝাঁজেই মারা যেত।

বয়স তো কম হল না। প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। ছেলে দুটো বড় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে রকম কাজ পায় নি। আমাকেই কাজ করতে হয়। ওদের কুয়ো কাটার কাজে আনিনি।

পৌঁছে গিয়েছি দমদমের মধুগড়ে। কুয়োর চারিদিকে প্রচণ্ড ভিড়। পুলিশ, সাংবাদিক, দমকলের লোক। কাল থেকে কত রকম চেষ্টা করেও ওরা পারেনি লাশটা ওপরে তুলতে। দেখেশুনে বুঝলাম, ওরা যে রকম ভাবে লাশ তুলতে চাইছে তাতে লাশ কোনও দিন উঠবে কি না সন্দেহ। মাটিতে আরও মিশে যাবে। পচে গলে খসে খসে পড়বে মাটিতে। তার পর একটা হাত, একটা পা এমনি টুকরো টুকরো করে অমরের লাশ ওপরে উঠবে।

আরে, লাশ তোলার কায়দা অন্য রকম। দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের সঙ্গে কথা বলে নীচে নামার জন্য তৈরি হলাম। দমকলের এক অফিসার এসে হেসে বললেন, আপনার যা কনফিডেন্স দেখছি, বুঝতে পারছি আপনি পারবেন। আমি কোনও উত্তর দিলাম না। বন্ধুর লাশ, শিষ্যের লাশ, ভাইয়ের লাশ এ রকম তো কতই তুললাম। কনফিডেন্স তো থাকবেই।

নীচে নেমে দেখি, ব্যাপার একেবারেই সুবিধের নয়। মাটির নীচে যেন সেঁধিয়ে আছে অমর। মাটির ওপরে শুধু আঙুল দুটো দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে উদ্ধার করা সত্যিই কঠিন। এ দিকে মাটিটা এতই খারাপ যে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে চারিদিকে। একটু ঝুরঝুর করে মাটিও ধসে পড়ছে। বুঝলাম এখানে কাজ করতে গেলে আমিও মাটি চাপা পড়ব। তাই আগে কুয়োর চারিদিকে পোড়া মাটির বেড় পরাতে হবে।

পোড়া মাটির বেড় পরানোর পর ফের নীচে নামলাম। এ বার খুব তাড়াতাড়ি কোদাল চালানোর পালা। কোদাল চালাচ্ছি মাটিতে, বালতিতে মাটি ভরছি, বালতি ওপরে তুলে দিচ্ছি। এই ভাবে একটু একটু করে অমরের মুখ বেরিয়ে গেল। গলা বেরিয়ে এল। অমরের মুখটা দেখে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত শরীরে খেলে গেল।

অমরের দাঁতকপাটি লেগে আছে। দাঁতের মধ্যেও মাটি, মুখের ভেতর মাটি ঢুকে গিয়েছে। নাকের ফুটোর মধ্যে মাটি গিয়ে নাক বুজে গিয়েছে। চোখের ভেতর এমন ভাবে মাটি লেগে রয়েছে, চোখের পাতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। চোখ আর দাঁতের মাটি পরিষ্কার করে দিলাম। একটু একটু করে লাশের গা থেকে মাটি পরিষ্কার করছি আর চারধারের মাটি কেটে যাচ্ছি।

একটা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠছে। মাটি কাটা থামিয়ে এক বার বমি করে ফেললাম। ওদের বললাম লেবুর জল পাঠাতে। পর পর কয়েক বালতি ভরতি লেবুর জল পাঠাল ওরা। লাশটাকে লেবুর জল দিয়ে স্নান করালাম। দুর্গন্ধ কিছুটা কাটল।

অমরকে বেশ কয়েকটা খিস্তি দিলাম, ‘এই শালা, ওঠ বলছি!’ ‘তাড়াতাড়ি ওঠ!’ প্রায় ৭০ কেজির ওপর লাশটাকে মাটি থেকে টেনে তুলতে গিয়ে ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর। আমারও সারা গায়ে কাদা মাটি।

মাটির নীচে নেমেছি দুপুর তিনটে নাগাদ, এখন আটটা বেজে গিয়েছে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লাশের সঙ্গে রয়েছি। একটু একটু করে গলা বুক, কোমর, পা সবই মাটি খুঁড়ে বের করে ফেলেছি। এ বার অমরের হাতে ও কোমরে শক্ত করে দড়ি বেঁধে দিলাম। আমার কাজ শেষ। এ বার ওরা লাশটাকে ওপরে টেনে নেবে।

ওপরে ওঠানোর সিগনাল দেবার আগে লাশটাকে এক বার জড়িয়ে ধরলাম। কাদা মাটি মিশে থাকা আমি আর অমর যেন এক হয়ে গেলাম। কেন হেরে গেলি তুই অমর? মনে হল অমর যেন আমার কানে কানে বলল, তুমি জিতে গেলে নাকি গুরুদেব? তুমি যে দিন মাটি চাপা পড়বে তখন তোমার লাশ কে ওপরে তুলবে তুমি জানো?

লাশটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলাম। আমাকে দেখে ওপরের জনতার কেউ কেউ হাততালি দিয়ে উঠল। আশপাশে বাড়ির ছাদ লোকে লোকারণ্য। কেউ কেউ লাশ দেখে হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল।

আমি ভিড় ঠেলে চলে এলাম। আমাকে ঘিরে ধরেছে সাংবাদিকরা। আমি ভীষণ ক্লান্ত। আমার কাদা মাখা ছবি তুলে যাচ্ছে ওরা। নানা প্রশ্ন করছে। কোনও কথারই উত্তর দিতে ভাল লাগছে না। এক জন চশমা পরা ঝুলো গোঁফের সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, আপনি এত বড় একটা কাজ করলেন, কিছু কি আশা করেন সরকারের কাছ থেকে? বললাম, কিছুই আশা করি না। আমার আর মাটির নীচে নামতে ভাল লাগে না বাবা। একটা দারোয়ানের কাজ জুটিয়ে দেবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE