Advertisement
০৪ মে ২০২৪

খু দ কুঁ ড়ো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তার কিছু দিনের মধ্যেই বাবা রেলের চাকরি পেলেন। ক্রু ইন চার্জ। আর আমরা ময়মনসিংহ ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম। মনোহরপুকুরে যদু ঘোষের বাড়ির দোতলায় আমাদের বাসা। দুটি মাত্র ঘর। সামনে দুটো ছোট ছোট ওপেন টেরাস, পিছনে বারান্দা, কলঘর। দিব্যি বাড়ি। কোনও আসবাবপত্র ছিল না তখন আমাদের, মেঝেয় বিছানা করে শোওয়া হত। দিনে ফাঁকা ঘরে আমি ট্রাইসাইকেল চালাতাম।

ছবি: সুমিত্র বসাক

ছবি: সুমিত্র বসাক

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০১:২০
Share: Save:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তার কিছু দিনের মধ্যেই বাবা রেলের চাকরি পেলেন। ক্রু ইন চার্জ। আর আমরা ময়মনসিংহ ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম। মনোহরপুকুরে যদু ঘোষের বাড়ির দোতলায় আমাদের বাসা। দুটি মাত্র ঘর। সামনে দুটো ছোট ছোট ওপেন টেরাস, পিছনে বারান্দা, কলঘর। দিব্যি বাড়ি। কোনও আসবাবপত্র ছিল না তখন আমাদের, মেঝেয় বিছানা করে শোওয়া হত। দিনে ফাঁকা ঘরে আমি ট্রাইসাইকেল চালাতাম।

তখন আমার বয়স বছর চারেক বোধহয়। তখনও মায়ের দুধ খাই। আর ভীষণ দুষ্টু আর চঞ্চল। আমাকে শান্ত রাখতে মা দুপুরে মাদুর পেতে পাশে নিয়ে শুয়ে আমাকে মহুয়া, বলাকা থেকে কবিতা শোনাত। আমি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার চেয়ে দু’বছরের বড় দিদি তখন কর্পোরেশন স্কুলে পড়তে যেত।

পাড়াটি ছিল ভারী শান্ত, নিরিবিলি। অনেক তাল আর নারকোল গাছ ছিল, পুকুর ছিল— যাতে সারা দিন কয়েকটা মোষ গা ডুবিয়ে বসে থাকত। চিল ছিল, বাদুড় ছিল, পেঁচা ছিল, চড়াই বা শালিখ বা টিয়ারও অভাব ছিল না। আর যুদ্ধের কারণে তখন ব্ল্যাক-আউট ছিল বলে ল্যাম্পপোস্টে ঠুলি লাগানো থাকত, ঘরেও সাইরেন বাজলে আলো নিবিয়ে রাখতে হত। বাড়ির সামনে বড় বড় ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছিল, তার মধ্যে আমরা লাফ দিয়ে দিয়ে নামতাম আর হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠতাম। ভারী মজার খেলা।

সেই পাড়ায় আসার পরই পড়শিদের সঙ্গে দিব্যি আমাদের ভাব হয়ে গিয়েছিল। এ বাড়ি, ও বাড়িতে খুব যাতায়াত, পরনিন্দা, পরচর্চা চলত। কারও কোনও খবরই গোপন থাকত না বড় একটা। আর কে জানে কী ভাবে সব বাড়িতেই আমাকে ডেকে নিত। সুতরাং প্রায় সব বাড়িতেই ছিল আমার অকুণ্ঠ যাতায়াত, আর ওই ভাবেই ভাব হয়েছিল টেকো বাড়ির মানুষদের সঙ্গেও।

টেকো বাড়িতে চার জন মোটে প্রাণী: বুড়ো, বুড়ি, আর আছেন দুজন যুবতী মেয়ে। টেকো বাড়ি নামটা কে দিয়েছিল তা জানা নেই। তবে সবাই টেকো বাড়িই বলত, কারণ সেই বাড়ির বুড়ো আর বুড়ির মাথায় টাক, দুটি মেয়েরও যুবতী বয়সেই মাথার চাঁদিতে দিব্যি টাকের লক্ষণ। দুই মেয়ের বয়স তখন অনুমান পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। কোনও কারণে তাঁদের বিয়ে হয়নি। তাঁরা ঘরের বাইরে কদাচিৎ বেরোতেন।

টেকো বুড়ো ছিলেন বিখ্যাত কৃপণ। কয়েক দিন যাতায়াতের পরই এক দিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, তোদের বাড়িতে মাসে কয় সের তেল লাগে বল তো?

তথ্যটা আমার জানা ছিল না বলে বললাম, মাকে জিজ্ঞেস করে আসি?

যা জিজ্ঞেস করে আয়।

দৌড়ে গিয়ে মাকে বললাম, মা, মাসে কয় সের তেল লাগে?

মা অবাক হয়ে বলে, কেন রে?

টেকো দাদু জানতে চাইছে।

মা হেসে বলে, তিন সের।

তিন সের শুনে টেকো দাদুর মাথায় হাত, সর্বনাশ! তোর মা কি তেল দিয়ে আঁচান?

টেকো দাদু সকালে বাজারে যেতেন না। তখন নাকি সব জিনিসের দাম বেশি থাকে। বেলায় গিয়ে ঝড়তিপড়তি আনাজ বেশ সস্তায় কিনতেন। পেট নরম হয়ে যাওয়া চুনো মাছ কিনতেন রোজ। আর তাদের বাড়ি থেকে সর্বদাই একটা পচা মাছ রান্নার গন্ধ পাওয়া যেত।

মেয়ে দুটিকে আমি পিসি ডাকতাম। তা সেই দুটি টেকো পিসি তখনও পড়াশুনো করতেন। কী পড়তেন তাঁরা জানি না। কিন্তু দেখতাম, তাঁরা কাগজের বদলে পুরোনো খবরের কাগজে দোয়াতের কালি আর হ্যান্ডেলে সস্তা নিব পরানো কলমে লিখতেন।

সব বাড়িতেই আমি গেলে কিছু না কিছু খাদ্যদ্রব্য জুটে যেত। কেউ বিস্কুট, কেউ বা মোয়া কিংবা নাড়ু, রসগোল্লা বা কালোজাম কিছু না কিছু দিত, শুধু টেকো বাড়িতেই কিছু জুটত না।

তবে দুই পিসি আর টেকো দিদা আমাকে কম ভালবাসতেন না। গেলে কাছে বসিয়ে কত গল্পই না করতেন।

কিন্তু টেকো দাদু একটু অন্য রকম। তিনি এক দিন জিজ্ঞেস করলেন, তোর বাবা কত মাইনে পায় জানিস?

এটা আমার জানা ছিল। বাবা আর মায়ের কথাতেই শুনেছি, এ বাজারে নাকি আশি টাকায় সংসার চলে না।

আমি বললাম, আশি টাকা।

আশি! আশি? সে তো অনেক টাকা রে! অ্যাঁ! আশি! বলে কী?

তখন আশি টাকায় বিস্ময় বোঝার বয়স আমার হয়নি। কিন্তু বুঝেছিলাম, আশি টাকাটা বোধহয় অন্যায্য রকমের একটা বাড়াবাড়ি।

মা’কে এসে ব্যাপারটা বলতেই মা হেসে ফেলেছিল। তার পর বলল, কৃপণ হলেও লোকটা তো আর এলেবেলে নয়। ফিলজফির এম এ।

পরে শুনেছিলাম, আমার দুই টেকো পিসিও খবরের কাগজে লেখা নোট পড়ে পড়ে দর্শনশাস্ত্রে অতি কৃতিত্বের সঙ্গে এম এ পাশ করেছিলেন। বইপত্র জুটত না তাঁদের, ধারেকাছে তেমন লাইব্রেরিও ছিল না। কী ভাবে সে সব অভাব পূরণ করতেন কে জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sharadindu mukhopadhyay rabibashariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE