কালীপদ চক্রবর্তী
তোমরা তো সকলেই জানো, মারাত্মক অপরাধ করলে তবেই তাকে শাস্তি হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়। আজ তোমাদের একটি ঘটনার কথা শোনাব। ঘটনাটি আমেরিকার এক শহরের। আমেরিকার একটি সার্কাস দলে কাজ করত ম্যারি নামের একটি হাতি। ম্যারি সেই সার্কাসে খুবই জনপ্রিয় ছিল। নানা রকম খেলা দেখিয়ে সে দর্শকদের মন কেড়ে নিত। আর এই সার্কাস দেখতে বেশি ভিড় হত ম্যারির জন্যই। সার্কাস দলটির নাম ছিল স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো’জ।
এই সার্কাস দলের মালিক এক দিন পুরনো মাহুতকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নতুন এক জন মাহুতকে রাখেন হাতিদের দেখাশোনা করতে। এই মাহুতটির নাম ছিল রেড এলড্রিজ। রেড কিন্তু খুব বেশি অভিজ্ঞ ছিল না। সে হাতিদের আচরণ, ইচ্ছে এ সব ঠিকমত বুঝতে পারত না। এক দিন সার্কাস চলাকালীন রেড ম্যারির ওপরে বসে খেলা দেখাচ্ছিল। ম্যারিও দু’পা তুলে পেছন পায়ে ভর করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছিল। কিন্তু মাহুত রেড বিনা কারণেই ম্যারির কানে লোহার শিক দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এক সময় ম্যারি আর সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে খুব রেগে গিয়ে কষ্টে চিত্কার করতে করতে রেডকে টেনে নামিয়ে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলে।
এ দৃশ্য দেখার পর সার্কাসের দর্শকেরা সবাই মিলে ম্যারিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য চিত্কার চেঁচামেচি শুরু করে দেন। তাঁরা বলতে থাকেন, একটা হাতির চেয়ে একটা মানুষের জীবনের দাম অনেক বেশি। এর পর এমন হল লোকজন রাগে আর কেউ সার্কাস দেখতে যাচ্ছিল না। ফলে, সার্কাস দলটা এক সময় উঠে যাওয়ার জোগাড়! সার্কাসের মালিক লোকজনদের কিছুতেই বোঝাতে পারছিলেন না যে, রেড হত্যায় ম্যারির দোষ যতটা, তার চেয়ে বেশি দোষ ছিল রেড-এর। সে অকারণে ম্যারিকে ওই ভাবে আঘাত না করলে, এ ঘটনা মোটেই ঘটত না। কিন্তু কেউই তা বুঝতে চাইছিলেন না। তাই শেষে বাধ্য হয়েই সার্কাস মালিক ঠিক করলেন ম্যারিকে হত্যা করা হবে।
কিন্তু কী ভাবে? বিশালদেহী এশিয়ান এই হাতিটির মৃত্যু নিশ্চিত করা যায় কী ভাবে, এ নিয়ে সকলেই চিন্তায় পড়লেন। অবশেষে ঠিক হল ক্রেনে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হবে। এর পর ম্যারির ফাঁসির জন্য যাঁরা সরব হয়েছিলেন, তাঁদের ডাকা হল। একটি বড় চেন দিয়ে ক্রেনে বাঁধা হল ম্যারিকে। কিন্তু বিপদ ঘটল তখন, যখন ক্রেন চালু করা হল। ম্যারিকে একটানে ২০ ফুট ওপরে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু ক্রেনটি ম্যারির ওজন সহ্য করতে না পেরে চেন ছিঁড়ে মাটিতে ধপাস। এর ফলে ম্যারির মেরুদণ্ড ভাঙল, ভাঙল পা। গলা কেটে প্রচুর রক্তপাতও হল। কিন্তু ওই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কোনও অনুশোচনা হল না। আবার ম্যারিকে ক্রেনের চেনে বেঁধে ঝোলানো হল। এ বার আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ম্যারি ছটফট করতে করতে মারা গেল। আসলে, ম্যারি সে দিন মারা যায়নি, মারা গিয়েছিল মানুষের মানবতা।
সমীর মজুমদার
মানবাজার-ওদলাবাড়ি হয়ে যে জাতীয় সড়ক তিস্তার দিকে চলে গিয়েছে তার বাঁয়ে এলেনবাড়ি চা-বাগান। দুটো বুনো হাতির নিথর দেহ পড়ে আছে। একটার প্রায় চার ফুটের মতো লম্বা সাদা চকচকে দাঁত। অন্যটার দাঁত নেই। মৃত্যুর কারণ, হাই-টেনশন বিদ্যুত্বাহী তারে শক। যে বিদ্যুত্ পরিবহণ আবার মানুষেরই প্রয়োজন মেটাতে!
যা-ই হোক, এই লেখার বিষয়বস্তু একটু আলাদা। এখানে অভিজ্ঞতার কথা শোনাব। এশীয় হাতির ওজন প্রায় পাঁচ-ছয় কুইন্টাল হয়। এদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। তাই কয়েক জন কর্মচারী রেখে ছুটলাম পশুচিকিত্সকের কাছে, তার পর ট্যানারির কাছে। দাঁত দুটো কেটে নিতে হবে। এই দাঁতের জন্য বহু হাতি চোরাশিকারির হাতে মারা যায়। বিদেশে হাতির দাঁতের বেশ কদর। হাতির দাঁত বাইরে যতটা দেখা যায়, দেহের ভেতরে প্রায় তিরিশ শতাংশ থাকে।
ট্যানারির লোক জন আসতে পারবে না জানিয়ে দিল। এখন উপায়? হাতির দাঁত কাটা সহজসাধ্য নয়। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও আমাদের কাছে নেই। বিকেল নাগাদ নিরুপায় হয়ে যখন ভাবছি, তখন ইসমাইল বলল, স্যর, কুড়ুল, ছেনি, হাতুড়ি আনতে পাঠান আমরাই দাঁত দুটো কেটে নেব।
বললাম, ঠিক আছে আনার ব্যবস্থা করছি। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও নেই। দাঁত দুটো আমাদের কাটতেই হবে।
আশেপাশে বাজার বা লোকালয় নেই। সেই ওদলাবাড়ি। এখান থেকে প্রায় আট-দশ কিলোমিটার। ওখান থেকে দাঁত কাটার যন্ত্রপাতি আনা হবে। এশীয় হাতির দৈনিক গড়ে ১০০ কেজি খাবার আর ২০০ লিটারের মতো জল লাগে। আমাদের মতো এদেরও এক ধরনের খাবার পছন্দ নয়। তাই ঘুরে ঘুরে খাদ্যসংগ্রহ করে। এদের উচ্চতা গড়ে ২৫০-৩০০ মিটার পর্যন্ত হয়।
ওদলাবাড়ি থেকে দাঁত কাটার যন্ত্রপাতি এল বিকেল চারটেয়। জানুয়ারি মাস। একটু পরেই সন্ধে নেমে আসবে। ওয়্যারলেস-এ মানবাজারে রেঞ্জ অফিসে জানালাম, সারা রাত হাতি তাড়াতে হবে। সার্চ লাইট, ব্যাটারি, পটকা, টিন, খাবার জল... সব নিয়ে বৈরাগীবাবু যেন চলে আসেন।
ইসমাইল আর তিন-চার জন দাঁত কাটতে লেগে গেল। আমি দূরে গাড়িতে বসে। দাঁত কাটার শব্দ পাচ্ছি। অন্ধকার নেমে এল।
কিছুক্ষণ পর ইসমাইলদের আর আলো দেখা যাচ্ছে না। দাঁত কাটার শব্দও বন্ধ। ভয় পেয়ে গাড়ির ড্রাইভার বিশ্বাসবাবুকে বললাম, ওদের কোনও শব্দ পাচ্ছি না কেন?
বিশ্বাসবাবু বললেন, মনে হচ্ছে বুনো হাতির দল এসে পড়েছে।
সে কী! এখন উপায়?
বিশ্বাসবাবু গাড়ি স্টার্ট করে আলো জ্বেলে দিলেন। চারি দিক এত ঘন অন্ধকার কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। বেশ কয়েক মিনিট পর ইসমাইলসহ লেবারেরা আমার গাড়িতে ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ল। ওরা যতটা কাঁপছে ঠান্ডায়, তার চেয়ে বেশি কাঁপছে ভয়ে! ওরা কাঁপতে কাঁপতে বলল, স্যর, পালিয়ে চলুন। হাতির পুরো দলটা এসে পড়েছে।
সমস্ত শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল। নতুন চাকরি। বুনো হাতির সামনে পড়ার অভিজ্ঞতা নেই। এখান থেকে আমাদের কোথাও নড়ার উপায় নেই। চোরাকারবারিরা দাঁত দুটো যদি নিয়ে যায়? তবে? চাকরি যাবে। চুপ করে গাড়ির ভেতর কাচ তুলে বসে থাকলাম।
ভয় হচ্ছে পাছে হাতি বাবাজিরা আমাদের ফুটবলের মতো খেলতে না শুরু করে। ভয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি, কখন আমাদের গাড়ি আসে। উঃ, সে কী মানসিক যন্ত্রণা!
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর গাড়ি এল। বৈরাগীবাবু অভিজ্ঞ মানুষ। গাড়ি থেকে নেমে বললেন, জিনিসপত্র নিয়ে জলদি নেমে পড়। কাজ শুরু করতে হবে। আমাকে বললেন, স্যর, আপনি গাড়িতে বসুন আমি যাচ্ছি ওদের সঙ্গে।
দুটো বড় ব্যাটারি, স্পট লাইট, পটকা, আলো, টিন নিয়ে বৈরাগীবাবুরা একশো মিটার দূরে যুদ্ধ করতে চলে গেলেন! টিনের শব্দ, পটকার শব্দ, ব্যাটারির তীব্র আলো দিয়ে হাতির দলবলকে ঠেকানো আর দাঁত কাটার কাজ শুরু হল।
বিশ্বাসবাবু বললেন, হাতি মারা গেলে দিনের মধ্যেই সব কাজ সেরে ফেলা উচিত। আমি বললাম কেন? হাতি মারা গেলে তাদের পরিবারের সদস্যরা ওই দেহ নিয়ে আমাদের মতন শোকপালন করে। কাঁদে। দিনে কাছে আসতে পারে না বলে রাতের অন্ধকারে ওরা প্রিয়জন হারানোর বেদনা জানায়। এই কারণে ওদের দলবল কাছে আসতে চাইছে। এদের ঠেকানো জীবন-মরণ-যুদ্ধ।
সারা রাত সার্কাসের স্পট লাইটের আলো ঘুরছে, পটকা ফাটছে, টিন বাজছে আর শোনা যাচ্ছে আমাদের কর্মচারীদের চিত্কার। ওরাও থেমে নেই ভূমিকম্পের মতো হুঙ্কার ছাড়ছে থেকে থেকে।
ভোরের দিকে আমরা জিতলাম। দাঁত দুটো কেটে ফেললাম। প্রায় ছ’ফুট লম্বা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy