Advertisement
E-Paper

টিভির ছবি ‘শেকিং’ নয়, ‘ড্যান্সিং’

পাড়াতুতো দাদার তদবির-তদারকিতে অবশেষে চাকরির ইন্টারভিউটা পেলাম। প্রাইভেট অফিস, বিখ্যাত টিভি কোম্পানির সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট। বাঙালি মালিক। সাহেবি কায়দাকানুন। সেই দাদা একটা মক ইন্টারভিউ নিলেন। বললেন, ইংরেজিটা একটু দুর্বল। খুব ধীরে ধীরে কথা বলবে। আর হ্যাঁ, সাজগোজটা একটু... বন্ধুরা বলল, চুলে একদম তেল নয়, শ্যাম্পু।

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০১:২০

পাড়াতুতো দাদার তদবির-তদারকিতে অবশেষে চাকরির ইন্টারভিউটা পেলাম। প্রাইভেট অফিস, বিখ্যাত টিভি কোম্পানির সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট। বাঙালি মালিক। সাহেবি কায়দাকানুন। সেই দাদা একটা মক ইন্টারভিউ নিলেন। বললেন, ইংরেজিটা একটু দুর্বল। খুব ধীরে ধীরে কথা বলবে। আর হ্যাঁ, সাজগোজটা একটু... বন্ধুরা বলল, চুলে একদম তেল নয়, শ্যাম্পু। হালকা পারফিউম, লিপস্টিক... এবং অবশ্যই হাই হিল চটি। চটি কেনার জন্য গড়িয়াহাট চষে ফেললাম— অল্প দাম কিন্তু দেখতে সুন্দর... অত অল্প পয়সায় তো কমফর্টেব্ল হয় না দিদি!

ইন্টারভিউ হল-এ সবাই প্রতিযোগী। কেই কারও দিকে তাকায় না। আমি পাথরের মতো বসে। পায়ে ফোসকা। তার ওপর আবার হিলের জন্য মাঝেমধ্যেই পা মচকে যাচ্ছে। ডাক পড়ল। শক্ত করে আঙুল চেপে চটিকে পোষ মানানোর চেষ্টা করলাম। ঘরে ঢোকার মুখেই অ্যাক্সিডেন্ট! ডোরম্যাটে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে বাঁচলাম, গোড়ালিতে অসম্ভব চোট! কোনও মতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রবেশ।

টেবিলের ও-পারে মস্ত চেহারার ভদ্রলোক, মাথা নিচু করে কাগজপত্র দেখছেন। অনুমতি না দিলে বসতেও পারি না! মাথা নিচু করে মেঝের কার্পেট দেখছি, হঠাত্‌ লক্ষ করলাম, সর্বনাশ! ডান পায়ের হিলটা গায়েব! তাই তখন থেকে পা-টা কেমন ছোট ছোট লাগছিল!

অবশেষে ‘হ্যালো’ সম্বোধনে বসার অনুমতি পাওয়া গেল। শুরু হল প্রশ্নবাণ। ভদ্রলোক সিন্ধ্রি, সামনের নেমপ্লেটে পদবি ‘বাসোয়ানি’। বন্ধুদের কাছে জেনেছিলাম আনি-দোয়ানিরা সিন্ধ্রি। উত্‌কট উচ্চারণ। আমিও আমার জ্ঞানসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে পার্সন, ভার্ব, টেন্স-এর ঠিকঠাক মুক্তো খুঁজে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। খুব একটা খুশি করতে পারছি না, সেটা আমার চেহারার দোষ না ইংরেজির, ঠিক বুঝেও উঠতে পারছি না। এ বার মোক্ষম প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘দেন হোয়াই ইউ...?’

ঘরে ঢুকলেন অসম্ভব সুন্দরী এক মহিলা। বাসোয়ানির পাশে বসলেন। আমার তক্ষুনি ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না’ গানটা মনে পড়ে গেল। উত্তর দিলাম আমার নিজস্ব ইংরেজিতে: ‘আই স্যাটিসফাই মাই কাস্টমার নট উইথ মাই বিউটি বাট উইথ দ্য সার্ভিস’, তার পর খুব আস্তে, অশ্বত্থামা হত ইতি গজ স্টাইলে, ‘হুইচ ইউ প্রোভাইড।’ ভদ্রমহিলা হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এক্সেলেন্ট!’ নির্বাচিত হলাম।

ভদ্রমহিলা আমাদের, মানে এই কমপ্লেন্ট সেকশনের চিফ। আমাকে মানুষ করার দায়িত্ব তাঁর। প্রথম দিনেই বললেন, ‘দ্যাখো, চেহারাটা তো ভগবানের দেওয়া, সেখানে আমাদের কারও হাত নেই। কিন্তু তাকে ঘষেমেজে, প্রেজেন্টেব্‌ল করে, কথাবার্তা ঝকঝকে করে কাস্টমারের সামনে পেশ করতে হবে।’ শুরু হল শিক্ষা।

ইংরেজিতে কথা বলা, হাসা, হাঁটা, অবাক হওয়া, দুঃখ পাওয়া, সব। ইংরেজি ‘আর’-এর উচ্চারণ ঊহ্য হবে, ‘অ্যাটিচ্যুড’ কথাটার আসল উচ্চারণ ‘অ্যাটিট্যুড’ হবে, ইয়েস হবে ‘ইয়া’ বা ‘ইয়াপ্‌’। ক্রমে এমন হল, টেলিফোনের ও-পারের মানুষজনও ভেবে বসতে লাগল, আমরা সব অ্যাংলো বা সাউথ ইন্ডিয়ান।

গ্রেট ইস্টার্ন ইলেকট্রিকাল্‌স থেকে অনুরোধ এল, ‘ম্যাডাম, সেন্ড ম্যান... ওয়াল ডিসি কনভারসেশন হোগা।’ ‘কনভার্সন’, ‘কনভারসেশন’ হয়ে গেছে। কেউ আবার সর্বরোগহর হিন্দি ভাষার শরণার্থী: ‘ম্যাডাম আদমি ভেজ দেনেসে আপকা বহত ধন্যবাদ হোগা।’ যাঁরা সামনাসামনি আসতেন, সাজগোজ আর বাক্যের তোড়ে দিশেহারা হয়ে পড়তেন।

দুঃস্থ চেহারার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, হয়তো সরকারি অফিসের কোনও সাহেবের বেয়ারা হবেন, দু-তিন বার করে সাহেবের বাড়ির ঠিকানাটা বলতেন— ‘ম্যাডাম ওটা কিন্তু থিরি বাই ফাইব্‌ নেগিপুকুর বাই লেন হবে।’ খুব লম্বাচওড়া আর এক বৃদ্ধ এসে বললেন, ছবি ভীষণ কাঁপছে। আমাদের পরিভাষায় লিখলাম, ‘শেকিং’। সন্তুষ্ট হলেন না। ওটা ‘ড্যান্সিং’ লিখতে হবে। কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি চেয়ারে আটকে রেখে উপরটা ভীষণ ভাবে দোলাতে লাগলেন। কোনও মতে হাসি চেপে ‘ড্যান্সিং’ই লিখলাম।

হঠাত্‌ এক দিন ম্যাডাম এসে বললেন, ‘কাল সবাই ঠিকঠাক এসো। সাজগোজ, সময়, খেয়াল থাকে যেন। কাল মিস্টার চৌধুরী নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরছেন।’

পর দিন যথারীতি কল নিচ্ছি। আমাদের কাচের ঘরের সামনে থেকে অতি সুদর্শন, ফ্রেঞ্চকাটদাড়ি চলে গেলেন। ম্যাডাম হুড়মুড় করে ঢুকে বললেন, ‘স্যর এসে গেছেন। একে একে সবাইকে ডাকবেন।’ তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি আজ আবার ব্যাক ক্লিপ লাগিয়েছ কেন, খুলে ফেলো। হ্যাঁ, এ বার একটু ব্রাশ করে... হ্যাঁ ঠিক আছে, ঢোকার আগে লিপস্টিকটা আর এক বার বুলিয়ে নিয়ো।’

মিস্টার চৌধুরী হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। চমকে উঠলাম। চিনি তো! এ বার সৌজন্যমূলক বার্তালাপ। যা আশঙ্কা করছিলাম— ‘আপনি ছেলেবেলায় কালীঘাটে থাকতেন?’ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। ‘আমার মামাবাড়ি। খুব বড় করে জগদ্ধাত্রীপুজো হত, মনে আছে?’ মনে আবার নেই! মন তো অতীতের ছবিটা ঝেড়ে ফেলেছে। দরিদ্রনারায়ণ বাচ্চাদের খিচুড়ির লাইন। প্রায় সবারই খালি-গা, খালি-পা। কারও পোশাক থাকলেও তা গয়তো একটা হাত গলানো বা কাঁধে ফেলা।

শুধু ওই অপার্থিব সেমি-লিকুইড খিচুড়ির লোভে দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন মা’কে ফাঁকি দিয়ে, ওদের সঙ্গে পোশাকের সামঞ্জস্য রেখে, বাটি-হাতে আমি ওদের পেছনে, আর খিচুড়ির বালতি হাতে সদ্য-যুবক হয়ে ওঠা সামনের ওই ভদ্রলোক। উনি কি চিনতে পারলেন? দেশি মেমসায়েব হয়ে ওঠার দুরন্তগতির প্রতিযোগী আমি, ম্যাডামের উপদেশ মতো অতি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘নাহ্‌ স্যর, ঠিক মনে পড়ছে না।’

মিনতি ঘোষ, মধ্যমগ্রাম

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান। ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy