Advertisement
E-Paper

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করত

আজ ফের মনে এসে ভিড় করছে হরিভাইয়ের নানা রকম গল্প, ওর মশকরা, ওর অভিমান। তবে এ সবের মধ্যে মজা করাটা ছিল ওর মজ্জাগত। বিয়ে তো করল না কিছুতেই। ওর মায়ের সেই নিয়ে ভারী আক্ষেপ ছিল। দেখা হলে আমায় প্রায়শই বলতেন, আমি যেন হরিকে বোঝাই, বিয়ে করা কতটা জরুরি। সান্ধ্য-আড্ডার সে রকমই একটা আটপৌরে আসর বসেছিল সে দিন হরির বাড়িতে।

গুলজার

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫

আজ ফের মনে এসে ভিড় করছে হরিভাইয়ের নানা রকম গল্প, ওর মশকরা, ওর অভিমান। তবে এ সবের মধ্যে মজা করাটা ছিল ওর মজ্জাগত। বিয়ে তো করল না কিছুতেই। ওর মায়ের সেই নিয়ে ভারী আক্ষেপ ছিল। দেখা হলে আমায় প্রায়শই বলতেন, আমি যেন হরিকে বোঝাই, বিয়ে করা কতটা জরুরি। সান্ধ্য-আড্ডার সে রকমই একটা আটপৌরে আসর বসেছিল সে দিন হরির বাড়িতে। সময়টা ১৯৭৫-৭৬ হবে। সাদা-কালো টেলিভিশনে নানা রকম জ্ঞান-সমৃদ্ধ আলোচনা হত তখন। আর টেলিভিশনে যা-ই হোক না কেন, সব বাড়িতেই গোটা সন্ধেবেলাটা টিভি চালানোই থাকত। মানুষজন সাপ্তাহিক নাটক, চিত্রমালা, কৃষি সম্পর্কে আলোচনা, সব দেখত ও শুনত। সে দিন সেই রকমই একটা ওজনদার আলোচনা চলছিল— কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে। সেই আলোচনায় একটা সময় বলা হল যে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট খুব সহজ কাজ নয়। অসুস্থ ব্যক্তিকে কিডনি সে-ই দিতে পারে যার সঙ্গে রোগীর রক্তের সম্পর্ক আছে এবং অবশ্যই ব্লাড গ্রুপ মিলবে। এমনকী স্ত্রী চাইলেও দিতে পারবেন না কিডনি।

যেই শেষ লাইনটা বলা হল, হরি খুব জোরের সঙ্গে বলে উঠল, ‘তা হলে? বিয়ে করে কী লাভটা হবে আমার? বউ কিডনিও দিতে পারবে না? তা হলে আর কী কাজে লাগবে, বলো মা?’ তার পর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘তুই বল, আমি কি ভুল কিছু বলেছি? বিয়ের তো একটা লাভজনক ফ্যাক্টরও থাকবে। যদি কিডনিই দিতে না পারল, তা হলে আর আমি বিয়ে কেন করব?’ যেন ওই একটা কারণের জন্যই হরি অপেক্ষা করছিল এত দিন। আর বিয়ে না করার পক্ষে তো এত জোরদার যুক্তি হয়ই না।

হরি এক দিকে খুব দিলখোলা আবার অন্য দিকে ভারী হিসেবি লোক ছিল। আমায় এক বার বলেছিল, ‘দ্যাখ, তোর বাড়িতে আমি কিন্তু যখন তখন আসব। আর এলে আমার একটা ড্রিঙ্ক চাই। এটাই আমার ডিমান্ড। তখন যেন বলিস না, বাড়িতে ড্রিঙ্ক নেই। যদি না থাকে তো বল, আমিই কিনে রেখে যাচ্ছি। কিন্তু তখন আমি কোনও অজুহাত শুনব না।’ হরি যখন আমার সিনেমায় অভিনয় করত, তখন কত যে থিয়েটার আর্টিস্টকে নিয়ে আসত অভিনয়ের জন্য। আমার সিনেমা জুড়ে চরিত্রাভিনেতারা সব বেশির ভাগই থিয়েটারের লোক। বলত, ‘ওদের অভিনয়ের তেমন দর তো কেউ দেবে না। তুই অন্তত দে।’ সারা জীবন কত দুঃস্থ অভিনেতাকে হরি সাহায্য করে গিয়েছে নীরবে। আবার অন্য দিকে বিখ্যাত এক জন গীতিকারকে সারা ক্ষণ খোঁটা দিত, ‘অ্যাই তোকে আমি চল্লিশ টাকা ধার দিয়েছিলাম টাইপ-রাইটার কেনার জন্য, তুই এখনও শোধ করিসনি। দে আমায়। মনে রাখিস তোর সাফল্যে আমার ওই চল্লিশ টাকার সবচেয়ে বড় অবদান।’

জীবনকে কোনও দিন সিরিয়াসলি নেয়নি হরি। নিলে হয়তো নিজের এত বড় অসুখ নিয়ে অত হেলায় থাকতে পারত না। সেই থাকাটা ঠিক ছিল না ভুল বলতে পারব না। তবে ও ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমার জীবনে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়ে গেল।

হরির হার্টে একটা জন্মগত সমস্যা ছিল। অনেক কষ্টে এক বার বাইপাস সার্জারি করানোর জন্য রাজি করালাম। অপারেশন হল। তার পর কয়েক দিন ব্যস্ত ছিলাম, যেতে পারিনি। এক দিন ফেরার পথে দেখি রাত বারোটা নাগাদ ওর বাড়ির নীচে বন্ধুদের সঙ্গে এন্তার আড্ডা দিচ্ছে। গাড়ি থামিয়ে নেমে রাগারাগি করলাম। ‘তোর না এখন ঘুমনোর সময়। তুই আড্ডা মারছিস?’ একটু পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘শোন না, একটু সমস্যা হচ্ছে। বাইপাস সার্জারির জন্য যে শিরাটা প্রয়োজন সেটা ওরা আমার পা থেকে নিয়েছিল তো, এখন হার্ট সেই জন্য প্রচণ্ড লাথি চালাচ্ছে, কী করে ঘুমোই বল?’ একটা অত বড় লোক, সে নিজেকে নিয়ে এই রকম ইয়ার্কি মারছে!

এর কিছু দিন পর হরি চলে গেল। আমি প্রথমে জানতেই পারিনি। আমার মেয়ে মেঘনা এসে বলল, ‘সঞ্জীব আংকল মনে হয় মারা গিয়েছে, আমি স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম ওঁর বাড়ির সামনে অনেক লোকজন জমা হয়েছে।’ আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ছুটে গেলাম। দু’দিন ওর দেহটা রাখা ছিল, আত্মীয়দের জন্য। আর এই দু’দিন হরির সঙ্গে আটচল্লিশ ঘন্টা ছিল শত্রু, মানে শত্রুঘ্ন সিনহা। এক সেকেন্ডের জন্য ছেড়ে যায়নি। কী আশ্চর্য, যখন কেউ ঘিরে থাকে তখন তার সঙ্গে আমরা কতটা বেঁচে নিই? প্রয়োজন মনে করি না হয়তো।

হরি আমার সঙ্গে কত সিনেমা করেছে হিসেব রাখিনি। এক বার একটা পার্টিতে একটু রাত করে গিয়েছি। ঢুকতেই পার্টির হোস্ট আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে তুমি এত দেরি করে এলে?’ বললাম, ‘শুটিং চলছিল, প্যাক-আপ হতে একটু দেরি হল।’ পাশে হরি ছিল। ও বলল, ‘শুটিং? তা তো সম্ভব নয়। কারণ আমি যখন অভিনয় করছি না, তার মানে তোর সিনেমাও হচ্ছে না। আমি ছাড়া তোর সিনেমা হয় কী করে? না না, এ সব বাজে কথা বলছে।’

সত্যি বলছি, আমার সব সিনেমায় হরি যেন আলাদা করে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করত। ও অভিনয় করত কি? জানি না। ‘মৌসম’ কিংবা ‘আঁধী’, ‘কোশিশ’ কিংবা ‘নমকীন’, সব কিছুতে, ও তো আমার জীবন জুড়ে ছিল। হরি চলে যাওয়ার পর যখন সিনেমা বানাতে শুরু করি, সব সময় এটাই মনে পড়ত, ‘আমি নেই যখন, তোর আবার কীসের সিনেমা?’ হরি চলে যাওয়ার পর সিনেমাগুলো সব সময় আমায় বন্ধুর সঙ্গে প্রতারণার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি কেমন মানুষ যে হরি চলে যাওয়ার পরেও সিনেমা করতে পারলাম?

rabibasariya anandabazar sanjeev kumar gulzar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy