Advertisement
E-Paper

নববর্ষের বৈঠক রেল, নৌকো, মেট্রোয়

কলকাতায় টিভির সূত্রপাতে ডিরেক্টর মীরা মজুমদার বললেন, পুজো আসছে, তোমাকে মহালয়ার অনুষ্ঠান করতে হবে। আমি বরং অনুমতি চাইলাম বাংলা নববর্ষ নিয়ে অনুষ্ঠান করে ধর্মনিরপেক্ষ একটা নতুন ট্র্যাডিশন গড়ে তোলার জন্য। পরের বছর থেকে শুরু হল ‘নববর্ষের বৈঠক’। বাংলার নিজস্ব আড্ডা-বৈঠকি চালকে অনুষ্ঠানের ফর্ম্যাট হিসেবে বেছে নিলাম। এই ফর্ম্যাট সেই প্রথম চালু হল।

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০১:১৫
কলকাতা দূরদর্শনের ‘নববর্ষের বৈঠক’ চলছে ট্রেনের মধ্যে।

কলকাতা দূরদর্শনের ‘নববর্ষের বৈঠক’ চলছে ট্রেনের মধ্যে।

কলকাতায় টিভির সূত্রপাতে ডিরেক্টর মীরা মজুমদার বললেন, পুজো আসছে, তোমাকে মহালয়ার অনুষ্ঠান করতে হবে। আমি বরং অনুমতি চাইলাম বাংলা নববর্ষ নিয়ে অনুষ্ঠান করে ধর্মনিরপেক্ষ একটা নতুন ট্র্যাডিশন গড়ে তোলার জন্য। পরের বছর থেকে শুরু হল ‘নববর্ষের বৈঠক’। বাংলার নিজস্ব আড্ডা-বৈঠকি চালকে অনুষ্ঠানের ফর্ম্যাট হিসেবে বেছে নিলাম। এই ফর্ম্যাট সেই প্রথম চালু হল। বাঙালিত্বের স্বরূপ, বাঙালির শেকড়ের সন্ধান, আমাদের ঐতিহ্যের পরিক্রমাকে রাখতে লাগলাম অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে। প্রত্যেক বছর নববর্ষের বৈঠকের জন্য বেছে নেওয়া হত এক একটা বিষয়ভাবনা বা থিম, তারই ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারীদের আমন্ত্রণ জানানো হত এবং বৈঠক কোথায় হবে তা ঠিক করা হত। এত শিল্পী-সাহিত্যিক-গুণী ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে এই বৈঠকে এসেছেন, তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। এক সময় যেমন আসতেন আঙুরবালা, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, হীরুবাবু, নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র অভিনেতা তারা ভট্টাচার্যের মতো প্রবাদ হয়ে যাওয়া শিল্পীরা, পরে এসেছেন সৌমিত্র, সুনীল, শীর্ষেন্দু, জয় গোস্বামীর মতো দিকপালেরা। বার বার বৈঠকি গানে বৈঠক জমাতে আসতেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়।

কখনও কখনও হয়েছে চলমান নববর্ষের বৈঠক। এক বার হল চলন্ত রেলগাড়িতে। ঘটনাক্রমে ভারতে যে দিন প্রথম রেল চলেছিল, সেটা ছিল এক পয়লা বৈশাখ। রেলের আধিকারিক সমীর গোস্বামীর সহযোগিতায় বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিত কয়েক কামরার এক রেলগাড়ি পাওয়া গেল। স্পেশাল ট্রেন হিসেবে সে রেলগাড়ি চলল শান্তিনিকেতনের দিকে। রেলগাড়িতে আঞ্চলিক গান গাইছেন প্রতিমা বড়ুয়া, সুখবিলাস বর্মা, শাস্ত্রীয় সংগীত শোনাচ্ছেন অরুণ ভাদুড়ি, আবৃত্তি করছেন শাঁওলি মিত্র, স্মৃতিকথা শোনাচ্ছেন প্রতিভা বসু এবং নিমাইসাধন বসু। সপরিবারে সলিল চৌধুরী গানে গানে মাতিয়ে দিচ্ছেন। নববর্ষের বৈঠকের জন্য তিনি গান বাঁধলেন ‘এসো এসো নববর্ষ’। নোয়াদার ঢাল স্টেশনে ট্রেন থামল। সেখানে বাউল মেলার আয়োজন করেছিলাম আমরা। গান কণ্ঠে নিয়ে বাউলরা ট্রেনে উঠে এলেন। রেলযাত্রায় রবীন্দ্রনাথ রচিত গান ‘চলি গো, চলি গো, যাই গো চলে’ গাইতে গাইতে বিশ্বভারতীর ছেলেমেয়েরা শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেনে উঠলেন।

এক বার গঙ্গায় নৌকো ভাসিয়ে হয়েছিল নববর্ষের বৈঠক। মনে হচ্ছিল, নৌকাডুবি হলে বাংলা যেন গুণিজনশূন্য হয়ে যাবে। এত নক্ষত্র ছিলেন সে বারে। নদী, নববর্ষ, নদীর মতো সময়ের বয়ে যাওয়াকে থিম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সে বারের অনুষ্ঠানের প্রযোজক অভিজিত্‌ দাশগুপ্ত গঙ্গাবক্ষে লঞ্চে সব শিল্পীর রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করেন, যাতে দিনের আলো ফুটতেই শুটিং আরম্ভ করা যায়। সুবিনয় রায় যখন ‘নব আনন্দে জাগো’ গাইছিলেন, তখন গঙ্গার জল স্পর্শ করেছে দিনের প্রথম আলো। শুটিং-এ বিরতিতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সবার গলা নকল করে গান গেয়ে মজা করতে লাগলেন।

ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে চলন্ত মেট্রো রেলে নববর্ষের বৈঠক হয়। মেট্রো রেলের স্টেশনের নামগুলো থেকে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের অনুষঙ্গ খুঁজে দেখার বিষয় ছিল সে বারের থিম। কয়েক রাত সারা রাত রেকর্ডিং চলেছে, আর দিনে চলেছে এডিটিং। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বুদ্ধদেব গুহ, বাংলাদেশের ফতেমা তুজ জোহরা, বিলেতের শিল্পী হিমাংশু সবাই মিলে খুব জমিয়ে দিলেন অনুষ্ঠান। বেলগাছিয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নান্দীকার পরিবেশন করল মেঘনাদবধ কাব্য। কালীঘাট স্টেশনে ছিল ক্যালকাটা কয়্যার-এর জমজমাট নাচগান। রেবা মুহুরী অবশ্য আমন্ত্রণ পেয়ে বলেছিলেন, উরেবাবা, আমাকে এক লক্ষ টাকা দিলেও আমি পাতালে নামতে পারব না।

নববর্ষের বৈঠক অনুষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে থাকতেন শঙ্খ ঘোষ। পরামর্শ দিয়েছেন পবিত্র সরকারও। প্রযোজনার দায়িত্বে থাকতেন শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত, মালতী বন্দ্যোপাধ্যায়, চম্পা ভৌমিক, সজয় দাশগুপ্তরা। প্রযোজনার টিমে থাকতেন দেবাশিস সেনগুপ্ত, সুচন্দ্রা চৌধুরী, অভিজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়, সবীর চক্রবর্তী, জয়িতা নন্দী মজুমদার এবং আরও অনেকে। প্রযুক্তির নেতৃত্বে থাকতেন প্রিয়দর্শী সেন, আশিস দে, সুদীপ চৌধুরী এবং অন্যান্য সহকর্মীরা।

নববর্ষের বৈঠক যখন শুরু হয়, তখন বিশেষ করে শহরে নববর্ষ বলতে বোঝাত হালখাতা, গঙ্গাস্নান, কিছু পরিবারে কিছু রীতিনীতি, আর বিচ্ছিন্ন দু-একটা অনুষ্ঠান। আমি চেয়েছিলাম, নববর্ষের বৈঠক শুধু একটা টিভি অনুষ্ঠান হয়ে না থেকে, একটা সামাজিক উত্‌সবের প্রেরণা ও প্রভাবস্বরূপ হয়ে উঠুক। এটাই তৃপ্তির, এখন নববর্ষ সামাজিক উত্‌সবের চেহারা নিয়েছে। নানা জায়গায় তো বটেই, সব টিভি চ্যানেলেও চলে নববর্ষের অনুষ্ঠান। নববর্ষের দিনটি এখন বাঙালির সংস্কৃতি চর্চারও দিন।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy