Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২

পান্তাভাতে...

গুলজার
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:২২
Share: Save:

যদি বিমলদা’র কথা বলতে শুরু করি, শেষ করা শক্ত। আজকের কলামটাও তাই তাঁকে নিয়েই।
আমার বাবা যখন মারা গেলেন তখন আমি সিনেমার কাজে ব্যস্ত যথারীতি। এমনকী ঠিক সময়ে খবরও পাইনি। আমার বড়দা থাকতেন বম্বেতেই। তিনি খবর পেয়েছিলেন, কিন্তু আমায় সেটা জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। বাড়ির উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের কাছে বাবার মৃত্যু কি ইম্পর্ট্যান্ট হতে পারে? দিন চারেক পর আমি একটা পোস্টকার্ড পেলাম, আমার দিল্লির এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। চিঠিটা পেয়ে রাগে, অভিমানে, কান্নায় ভেতরে একটা তোলপাড় চলতে লাগল। বিমলদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখুনি বিমলদা ম্যানেজারকে বললেন আমার টিকিটের ব্যবস্থা করতে। দিল্লি গেলাম। বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা করলাম, শোক ভাগ করে নিলাম। কিন্তু দাদার প্রতি সেই অভিমান আমার গেল না। বম্বে ফিরে এলাম। মনের সেই তোলপাড় আস্তে আস্তে একটা বড় বুদ্বুদ হয়ে বুকের কোথাও আটকে থাকল।
ফের কাজ, হাসি, বকুনি, ঠাট্টা-ইয়ার্কি। আর মনে হচ্ছিল বিমলদার ছায়াটা আমার ওপর ক্রমশই বড় হচ্ছে। বেশ আরাম হত। ইতিমধ্যে আমার বোনের বিয়ে ঠিক হল। গিয়ে বললাম, ‘বিমলদা, আমার বোনের বিয়ে, ক’দিন ছুটি চাই।’ বিমলদা বললেন, ‘হুঁ, তুমি বরং এডিটিং-এ অ্যাসিস্ট করো।’ মুখ নিচু করে চলে এলাম। দিন দুই পর আবার গেলাম। ‘বিমলদা, ছুটি... বোনের বিয়ে।’ বিমলদা: ‘হুঁ, সাউন্ড এফেক্টগুলো লিস্ট করো তো গিয়ে।’ এক দিন দেখি, ঝালানি, মানে বিমলদার চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট গিয়ে বিমলদাকে বলছে, ‘আমার বিয়ে। ছুটি চাই।’ বিমলদা: ‘হু।ঁ’ পরের দিন ঝালানি বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে চলল। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘কিন্তু বিমলদা তো এখনও হ্যাঁ বলেনি।’ ঝালানি বলল, ‘ভাই, আমার বিয়ে। আর তোর বোনের বিয়ে। আমি না গেলে আমার বিয়ে হবে না রে! বিমলদা হুঁ-হুঁ করতেই থাকবে, আর সময় পেরিয়ে যাবে। আমি চললাম।’ আমি বেজার মুখে কাজ করে চলি। বোনের বিয়ের এক দিন আগে বিমলদা আমায় ডাকলেন, আর ম্যানেজারবাবুকে বললেন, ‘ওর জন্য একটা প্লেনের টিকিট কেটে দিন তো দিল্লির।’ আমি স্তম্ভিত। বিমলদা আমায় এত ভালবাসেন? প্লেনের টিকিট! ষাটের দশকে!
আমার আর বিমলদার অন্যান্য কাজের সঙ্গে একটা কনটিনিউয়াস কাজ চলছিল ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’র স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। আমায় উনি বইটি পড়িয়েছিলেন বার বার। যাতে একটা পাকাপোক্ত স্ক্রিপ্ট হয়। বিমলদা বইটার মার্জিনে এত নোট লিখেছিলেন যে সেটা থেকে আরও একটা বই লেখা যায়। এক দিন বললেন, গল্পের একটা জিনিস কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। বলরাম নামের একটি চরিত্র মেলা শুরুর প্রথম দিনই মারা যায়। বিমলদা বললেন, ‘কী করে হবে গোলজার? আরও আট দিন পর যোগস্নান। প্রথম দিনেই যদি এই ক্যারেক্টার মারা যায় তা হলে চিত্রনাট্য টানটান হবে না।’ তখন আমরা আশাপূর্ণা দেবীর একটা উপন্যাস থেকে ‘সাহারা’ ছবির শুটিং করছিলাম। কথা ছিল, এটা শেষ হলে ১৯৬৬ সালের পূর্ণকুম্ভের সময় ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’র শুটিং হবে। এক দিন সাহারা-র সেট রেডি হচ্ছে, কমলদা শট রেডি করে আমায় বললেন, ‘যাও, বিমলদাকে ডেকে নিয়ে এসো।’ আমি নীচে এসে বললাম, ‘দাদা, শট রেডি।’ কিছু ক্ষণ মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকলেন, তার পর বললেন, ‘কমলকে বলো, শট নিয়ে নিতে।’ মাথা ঝনঝনিয়ে উঠল। মানে? যে লোকটা অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকার সময়ও একটা শট মিস করেননি, সে আজ অন্যকে বলছে শট নিতে? রোবটের মতো এসে কমলদাকে বললাম, ‘দাদা শট নিয়ে নিতে বলেছেন।’ কমলদা বিশ্বাস করলেন না। বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। নীচে গিয়ে বললেন, শট রেডি। ‘তুমি নিয়ে নাও কমল।’ আমরা চুপ। কোথা থেকে একটা অদৃশ্য ঠান্ডা তরোয়াল আমার মাথায় ঝুলে পড়ল, হঠাৎ। কমলদা শট নিতে শুরু করলেন। শর্মিলাজি ছিলেন সেই শটে। শট শুরু হওয়ার এক সেকেন্ডের মধ্যে পেছন থেকে শুনতে পেলাম, ‘রিঙ্কু, প্রথমে ব্যাকে এসে তার পর আলোটা নাও তোমার মুখে।’ বিমলদার গলা। যাক।
কিন্তু সেই দিন বিমলদা শেষ সেট থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন না। তার পর কয়েক দিন জ্বর। শরীর খারাপ। এবং অমোঘ ছুরি আমাদের বুকে। ক্যানসার।
বিমলদার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস দুটো ছিনিয়ে নেওয়া হল। চা আর সিগারেট। উনি লন্ডন গেলেন চিকিৎসার জন্য। হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। তবু অমৃতকুম্ভের চিত্রনাট্য নিয়ে খুঁতখুঁত গেল না। আমরা ওঁর বাড়ি গিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। বলরামের মৃত্যু অনেক টানাহেঁচড়া করে মেলার পঞ্চম দিনে নিয়ে যাওয়া হল। আমি তর্ক করতাম, তখনও। কিন্তু তা স্রেফ তর্ক করার জন্য। এক রাশ ব্যথা আমার বুকে হাতুড়ি মারত। আর কিছু দিন পর বিমলদাকে দেখতেও পাব না? কাজ থামেনি তবুও। এক দিন ডেকে বললেন, ‘শোনো, এলাহাবাদে গিয়ে কিছু শট তুলে নিয়ে এসো।’ আদেশ পালন করলাম। আমি আর কমলদা। কিন্তু সাত-আট দিন শুটিং-এ দু’জনে প্রায় কোনও কথা বললাম না।
ফিরে এলাম। এবং বিমলদার কাছে গিয়ে সে দিনই যা কাজ করার করে এলাম। বিমলদা কুঁকড়ে গেছেন, ছোট্ট হয়ে গেছেন। যেন সোফার মধ্যে একটা কুশন। আমি বীরপুরুষ নই, আমি পারব না বিমলদাকে এ রকম দেখতে। বেশ ক’দিন পর এক দিন হঠাৎ ফোন। উত্তেজিত গলা, ঠিক বিমলদার মতো। ‘গোলজার, এসো। অমৃতকুম্ভ নিয়ে আলোচনা আছে।’ আমি তখন জেনে গিয়েছি, এই সিনেমা হবে না। বিমলদা থাকবেন না। তবু, গুরু আমার। আমি গেলাম। উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘যোগস্নান-এর দিন বলরাম মারা যাবে। প্রথম মৃত্যু। এখান থেকে স্ট্যাম্পিড-এর দৃশ্যটা শুরু হবে।’ সব শুনলাম আর মাথার ওপর তরোয়ালের ঠান্ডা অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম।
৮ জানুয়ারি ১৯৬৬। বিমলদা চলে গেলেন। খবর পেয়ে প্রথমেই মনে হল, যাক, তরোয়ালটা খসে গেল আমার মাথার ওপর থেকে। সেন্স ফিরে এল অসহ্য কষ্টের অনুভূতিতে। ছুটলাম বিমলদার বাড়ি। তার পর শ্মশান। শ্মশানে আমার বুকের মধ্যে ওঠানামা-করা, কিছুটা ঘুমন্ত কিন্তু অ্যাক্টিভ সেই বুদ্বুদটা ফাটল। জোরে। কাঁদলাম, খুব কাঁদলাম। আমার বাবার জন্য তুলে রাখা কষ্টটা পূর্ণ করে দিয়ে গেলেন বিমলদা। সে দিনটা ছিল পূর্ণকুম্ভের যোগস্নানের দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE