Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পা ন্তা ভা তে...

একটা ঈশ্বরদত্ত গলা ছিল বটে কিশোরদার। তবে তার চেয়েও বেশি ছিল ঈশ্বরদত্ত মাথা, মানে মগজ। কিশোরদা যেমন ভাবেই জীবন কাটিয়েছেন, সেটা রংবেরং পাগলামি-ভর্তি হোক বা গান-নির্ভর হোক— খুব সচেতন ভাবে কাটিয়েছেন। তাঁর পাগলামির মধ্যেও সচেতনতা ছিল একশো ভাগ। লতাজি বলতেন, কিশোরদার সঙ্গে ডুয়েট গাইতে নাকি ওঁর খুব টেনশন হয়। তখনকার দিনে স্টুডিয়োতে একসঙ্গেই ডুয়েট রেকর্ড করা হত।

গুলজার
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

একটা ঈশ্বরদত্ত গলা ছিল বটে কিশোরদার। তবে তার চেয়েও বেশি ছিল ঈশ্বরদত্ত মাথা, মানে মগজ। কিশোরদা যেমন ভাবেই জীবন কাটিয়েছেন, সেটা রংবেরং পাগলামি-ভর্তি হোক বা গান-নির্ভর হোক— খুব সচেতন ভাবে কাটিয়েছেন। তাঁর পাগলামির মধ্যেও সচেতনতা ছিল একশো ভাগ। লতাজি বলতেন, কিশোরদার সঙ্গে ডুয়েট গাইতে নাকি ওঁর খুব টেনশন হয়। তখনকার দিনে স্টুডিয়োতে একসঙ্গেই ডুয়েট রেকর্ড করা হত। লতাজি আর কিশোরদা একসঙ্গে গান আরম্ভ করলেন, তার পর যেই লতাজির সোলো অংশটা এল, তখন কিশোরদা মাইক থেকে অনেক দূরে গিয়ে এই বাজনদারের সঙ্গে খুনসুটি, তার মাথায় গাঁট্টা মেরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লতাজি বলতেন, ‘আমি গাইব কী, আমার তো টেনশন হত, ডুয়েট লাইনের সময় কিশোরদা এসে পৌঁছবেন কি না! ঠিক সময় ধরতে পারবেন তো লাইনটা? রিটেক হবে না তো?’ কিন্তু প্রত্যেক বার এ সব জল্পনা মিথ্যে করে দিয়ে, সবার হৃৎপিণ্ডে দামামা বাজানোর পর নিজের লাইনটি একদম মোক্ষম ঠিক সময়ে এসে ধরতেন। কোনও দিন মিস হয়নি। যাঁরা এই সব সময় কিশোরদার সঙ্গে স্টুডিয়োতে থাকতেন, তাঁরা বলতেন, ‘অবাক লাগত, এত কাণ্ডের পর যখন কিশোরকুমার এসে গানের লাইন ধরতেন, সুরে ভুল নেই, তালে ভুল নেই, ইমোশনে ভুল নেই এমনকী অত লম্ফঝম্প করার পরও কক্ষনও হাঁপাতেন না।’ অর্থাৎ কিনা মাথাটা ছবির মতো পরিষ্কার। গলাটা তো বটেই। এঁর প্রতি ঈশ্বরের পার্শিয়ালিটি না থাকলে আর কার প্রতি আছে?

আর আমরা এমন একটা লোককে কেবল মজাদার মানুষ বলেই চিনলাম। তাঁর ডেডিকেশন, গানের চয়ন, গানে তাঁর অভিনয়— এ সব নিয়ে ভাবলাম না। কিশোরদার ঘরে একটা বিরাট সাইজের কে এল সায়গল-এর ছবি ছিল। কিশোরদা সায়গল সাহেবের বিরাট ভক্ত ছিলেন এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু কিশোরদা অমন মজাদার মানুষ হয়েও সায়গল সাহেবের গানের মধ্যে যন্ত্রণার অনুভূতির প্রকাশের খুব বেশি ভক্ত ছিলেন। সায়গলের গানের মধ্যে যে একটা আশ্চর্য করুণ রস ছিল, সেটাকে কিশোরদা আত্মস্থ করে তাঁর গলায় সেই দ্যোতনাকে ম্যাজিক করে তুলেছিলেন। তেমন গান কিশোরদার গলায় শুনলে মন নিভে আসে, আর না শুনলে প্রাণ ছটফট করে। অথচ কিশোরদাকে সবাই শুধু কমেডির রাজা বলে জানল। কেবল শচীন দেববর্মন আর রাহুল ছাড়া এই বিষাদ প্রায় কেউই বোঝেনি। আর তাই রাহুল এমন সব গান গাইয়েছে কিশোরদাকে দিয়ে, সেগুলো যেন ব্যথার দাগ, যার ওপর হাত বোলালে আরাম লাগে। কিশোরদা যখন নিজের সিনেমা করতেন বা গানে সুর দিতেন, তার মধ্যে বেদনার ঝনঝনানি অনেক বেশি থাকত। বেদনার প্রতি তাঁর আকর্ষণ হয়তো খুব বেশি ছিল, বা বলা যেতে পারে খুব ‘এক্সক্লুসিভ’ ছিল। সেই জন্যই বোধহয় খুব গোপনে বেদনা যাপন করতে চাইতেন। তাঁর এই দিকটা সযত্নে আড়াল করে রেখেছিলেন, যেখানে অন্যের প্রবেশ নিষেধ।

কিশোরদা’র মনটা ছিল একদম পিয়োর, শুদ্ধ। কোনও দাগ, কোনও আঁচড় কখনও গভীর হতে পারেনি তাঁর ভিতর। তার মানে আঘাত কি আর লাগেনি, নিশ্চয়ই লেগেছে। কিন্তু তিনি সেই আঘাতের দাগ পদ্মপাতার ওপর শিশিরকণার মতো বয়েছেন। গ্রহণও করেননি, ত্যাগও করেননি। ওঁর মনটা যে একদম ঝকঝকে তকতকে ছিল তার একটা বড় প্রমাণ তাঁর এত বার প্রেমে পড়া। প্রতি বারই কিন্তু কিশোরদা মন-প্রাণ-আত্মা নিয়ে ডুব মারতেন প্রেমে। প্রতিটি প্রেম সেই সময়টায় বিশুদ্ধ। তার পর সেটা যখন আর প্রেম থাকেনি, তখন কিশোরদা সরে গিয়েছেন। প্রেমের প্রতি এত বড় শ্রদ্ধা, এতটা সম্মান আমরা কেউ দেখাতে পারি কি? রুমা চলে যাওয়ার পর যখন মধুবালার প্রেমে কিশোরদা পড়লেন, দেখেছি ওঁকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে। এর বিরুদ্ধ মতও অনেক শুনেছি, কিন্তু আমি তো নিজে দেখেছি, ছ’টা বাজলেই কিশোরদা বলে উঠতেন, ‘ঘন্টি বাজ গয়ি ইয়ার। যানা পড়েগা।’ মধুবালা তখন অসুস্থ, কিশোরদা তাঁর কাছে যাবেন। সেখানে কিন্তু কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।

আরও একটা ঘটনা বলি, সেটায় বোঝা যায়, যখন কিশোরদা মনে করতেন কম্প্রোমাইজ করবেন না, ব্যাপার কত দূর যেতে পারত। কিশোরদা যখন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন, অশোককুমার এক দিন তাঁকে নিয়ে গেলেন বি আর চোপড়ার কাছে। বি আর চোপড়া নাকি কিশোরদাকে দেখে বলেছিলেন, ‘আরে, ইয়ে তো কালা হ্যায়।’ ব্যস, কিশোরদা সেই যে বিগড়ে গেলেন, বেশ কিছু বছর ওঁদের ব্যানারে গান গাইলেন না, ছবিতেও অভিনয় করলেন না। অত বড় ব্যানার! জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘নেহি গাউঙ্গা ইয়ার। মুঝে কালা বোলা।’ এটাকে ছেলেমানুষি বলব কি না জানি না। কিন্তু প্রতিজ্ঞার মনোভাবটা জেনুইন, এটুকু বলতে পারি। পরে অবশ্য মান ভেঙে গিয়েছিল।

আসলে কিশোরদা শৈশবের নির্মল আবরণটা ভেঙে বেরোতে চাননি। তিনি বোধ হয় বিশ্বাস করতেন, রূপকথা আসলে সত্যি। ম্যাজিক কার্পেটও সত্যি। আর সেই সত্যি অনুযায়ীই জীবনটা বাঁচতে চেয়েছিলেন। জীবনের একঘেয়েমি যাতে সেই ভোজবাজির ওপর কোনও ভাবেই আস্তরণ না ফেলতে পারে, তাই এত মজা করে বাঁচতে চাইতেন। জীবন যেন টাট্টু ঘোড়ার মতো ছটফটে থাকে, কখনও যেন না বোর হয়ে যায়।

তবে, কিশোরদা বাস্তব বুঝতেন না, এ কথা বললে অন্যায় হবে। আসলে আমাদের বাস্তবটা ওঁর বাস্তব ছিল না। উনি এই বাস্তবকে প্রত্যাখ্যান করে ওঁর বাস্তবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। যেটাকে আমরা হয়তো না-বুঝে বলব পাগলামি, সেয়ানাগিরি। আর কিশোরদা তার উত্তরে গাইবেন, ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gulzar kishore kumar rabibasariya anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE