Advertisement
E-Paper

পরদা উঠলেই চেঁচামেচি শুরু

এক সময়ে আমাকে ‘দাদা’ বলে ডাকার নবীন সহনাগরিক ছিলেন অনেক। আজ আমি ‘দাদা’ থেকে পর্যায়ক্রমে ‘কাকু’ এবং ইদানীং ‘জেঠুতে’ উত্তীর্ণ হয়েছি। জীবনের এই পর্যায়ে বেশ লাগে শুনতে। এই জেঠুটাকে ফোন করে কত নবীন যে বলেন, ‘আপনার অনুপ্রেরণায় আমিও গান গাইছি, গান লিখছি, সুর করছি।’

কবীর সুমন

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০২
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

এক সময়ে আমাকে ‘দাদা’ বলে ডাকার নবীন সহনাগরিক ছিলেন অনেক। আজ আমি ‘দাদা’ থেকে পর্যায়ক্রমে ‘কাকু’ এবং ইদানীং ‘জেঠুতে’ উত্তীর্ণ হয়েছি। জীবনের এই পর্যায়ে বেশ লাগে শুনতে। এই জেঠুটাকে ফোন করে কত নবীন যে বলেন, ‘আপনার অনুপ্রেরণায় আমিও গান গাইছি, গান লিখছি, সুর করছি।’

এঁদের বয়স উনিশ বছর থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশের মধ্যে। ছেলেই বেশি। প্রায় সকলকেই জিজ্ঞাসা করি গান শিখছেন কি না। ‘শিখছেন’ না, ‘শিখেছেন’— এটাই শুনতে পাই বেশি। অর্থাৎ, গান শেখা হয়ে গিয়েছে। বাইশ বছর বয়সেই। কেউ কেউ বলেন, জেঠু, সিডি-ও করেছি। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে দু’বছর শিখে নিয়েছি ক্লাসিকাল, এখন একটু ‘ওপেনিং’ খুঁজছি।

বাড়িতে এসে শোনাতেও চান তাঁরা। আসেন কেউ কেউ। সঙ্গে আনেন গিটার। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেন এমন কাউকেই আর দেখি না। কেউ কেউ দেখেছি গানের গলা নিয়ে জন্মেছেন। ভাল কারও কাছে কিছু বছর শিখলে ও প্রচুর ভাল গান শুনলে হয়তো মোটামুটি গাইতে পারবেন এক সময়ে। কিন্তু লেখা অনেকেরই আসে না। আর সুর?

বেশির ভাগ কেন, অল্প দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সকলেই দেখছি একই ধরনের সুর দিচ্ছেন। ইদানীং মনে হয়— সুরটা আলাদা ভাবে কেউ দিচ্ছেন না। কলকাতার হাওয়ায় হয়তো দু’একটা সুরের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছে, গ্রামবাংলার হাওয়ায় যেমন কিছু পল্লিসুর দীর্ঘ কাল ভেসে বেড়িয়েছে। কলকাতার অনুপ্রাণিত তরুণরা সেই ভেসে-বেড়ানো সুরই জুড়ে দিচ্ছেন তাঁদের কথার সঙ্গে। আর ছন্দে ছন্দে গিটারে ‘স্ট্রাম’ করছেন। ফলে সবার গান মোটের ওপর একই শোনাচ্ছে। এই একই শোনানোর আর একটা কারণ, আমার চেনাজানা নবীনরা সকলেই, কেন জানি না, বেশ উঁচু পরদায় গান ধরছেন। স্কেলের হিসেবে ডি-এর নিচে কমই। আর একটু নিচু পরদায়, ধরা যাক ‘বি’ বা ‘বি-ফ্ল্যাট’-এ, কেউ গাইছেন না। আজকের কলকাতার এবং ঢাকারও (যত দূর শুনেছি) স্বরচরিত্র মুম্বই-ছবিজগতের নেপথ্য-গানের স্বরচরিত্রের মতো, হুবহু।

চিত্রপরিচালক বিধু বিনোদ চোপ়ড়া তাঁর ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’ ছবির একটি গান গেয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৯৪ সালে আমায় মুম্বই নিয়ে গিয়েছিলেন। স্টুডিয়োতে তখন আশা ভোঁসলে মহোদয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যে গানটির জন্য বিনোদ আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটির অ্যারেঞ্জমেন্ট ও মিউজিক ট্র্যাক রেকর্ডিং রাহুল দেববর্মন করে রেখে গিয়েছিলেন ডি স্কেলে। ওটা আমার ‘পিচ’ নয়। এই উঁচু পিচ বা স্কেল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শ্রীমতী ভোঁসলে বেশ চটেই গেলেন। বললেন, ‘জানো, এই মুম্বই ইন্ডাস্ট্রি আমার গলার ওপর কী চাপ-ই না দিয়েছে। মহা উঁচু স্কেলে গান। গলার আর কিছু থাকে না, গানও সব এক রকম শোনায়। আমি শেষ কালে করতাম কী— একটা চেনা স্টুডিয়োয় স্কেল নামিয়ে গেয়ে ফের স্কেল উঁচু করে দেওয়ার যন্ত্র আছে, সেখানে গিয়ে গান রেকর্ড করতাম।’

১৯৪২ ছবির ঐ গানটি কলকাতার শিবাজী চট্টোপাধ্যায় রাহুল দেববর্মনের জীবিত কালেই প্রথমে রেকর্ড করে রেখেছিলেন বলে, বিধু বিনোদ চোপড়া আমায় বহু পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও গানটি আমি গাইনি, রেকর্ড করিনি। বিনোদ বার বার বলছিলেন, মুম্বইতে এমন কাজ হামেশাই করা হয়ে থাকে। তিনি, তাঁর ভাই ও রেকর্ডিস্ট আমায় একাধিক বার বলছিলেন, ‘সুমন, লোকে মুম্বইয়ের ছবিতে গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য ভিক্ষে করে, এ শহরে এসে সংগীত পরিচালকদের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায়। আর আমরা তোমায় চেয়েছি, তোমার কাছে গিয়েছি, তোমায় সপরিবারে ধরে নিয়ে এসেছি এখানে। মুম্বইয়ের ছবির দুনিয়া আজ তোমায় স্বাগত জানাতে চাইছে, আর তুমি আমাদের অবহেলা করছ!’

আমার যুক্তি ছিল, শিবাজীবাবু কত আশা নিয়ে গানটি রেকর্ড করেছেন, আপনজনদের নিশ্চয়ই বলে রেখেছেন, আর আমি হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসে তাঁর গলা মুছে দিয়ে নিজের গলাটা বসিয়ে দেব! সহশিল্পীকে এই আঘাত দেওয়ার শিক্ষা গুরুরা আমায় দেননি। তা ছাড়া, ডি-তে গাইলে আমায় চেঁচাতে হবে, আমার স্বাভাবিক আওয়াজ নষ্ট হয়ে যাবে, যা আমি কিছুতেই হতে দেব না। শ্রীমতী আশা ভোঁসলে আমায় সমর্থন করেছিলেন এবং তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তখনই বলেছিলেন। যে কোনও স্বাভাবিক মানুষই এমন কথা বলবেন, তাঁর মতো ক্ষণজন্মা শিল্পী ও সংগীতবোদ্ধা তো বলবেনই। উল্লেখযোগ্য, পরে জানতে পেরেছি যে মুম্বইয়ের স্টুডিয়োতে গিয়েও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকায়, ছবির পরিচালক গজল শিল্পী জগজিৎ সিংহের কাছে গিয়েছিলেন। গানের স্কেল ডি শুনে তিনিও গাননি।

এখন, জগজিৎ সিংহ বা আমি কি গানটি ওই স্কেলেই গেয়ে দিতে পারতাম না? অন্তরা ছিল তারসপ্তকের রে পর্যন্ত। একটু চেঁচালে গেয়ে দেওয়াই যেত। কিন্তু তাতে আমাদের গলার স্বাভাবিক আওয়াজ হত নষ্ট। এক কালের সুপারহিট গায়ক কে এল সায়গল যখন নিউ থিয়েটার্সে গাইতে এলেন, আচার্য পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁর স্কেল এক পরদা নামিয়ে দিয়েছিলেন। আরও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল তাঁর গলা, তাঁর গান।

আমাদের দেশের একাধিক পুরুষ শিল্পী আজ এমন উঁচু পরদায় গাইছেন যে, তাঁদের গলার আওয়াজ যে আসলে কেমন— তা আর বোঝা যাচ্ছে না। একটা গড় কর্কশ আওয়াজই যা শুনছি আমরা। আর হিট গায়িকাও (মুম্বই/ দক্ষিণ ভারত) তাঁরাই হন, যাঁরা পাল্লা দিয়ে উঁচু পরদায় গাইতে পারেন এবং যাঁদের গলা মিহি। বেশির ভাগের গলা শুনে মনে হয়, বয়ঃসন্ধি এখনও পেরোয়নি। ইউরোপে এক কালে মেয়েদের প্রকাশ্যে গান গাওয়া, এমনকী গির্জার বৃন্দসংগীতেও গাওয়া বারণ ছিল বলে, উঁচু-পরদার চিকন-গলা ‘সোপ্রানো’র জন্য ছোট ছেলেদের খোজা করে দেওয়া হত। ফলে বেচারিদের গলা ভেঙে মোটা বা ভারী হতে পারত না। বয়স বেড়ে যাওয়ার পরেও এঁরাই কয়্যারের ‘মেৎজো সোপ্রানো’ ও ‘সোপ্রানো’ অংশগুলি গাইতেন।

আজকের নাগরিক বাংলার নবীন গানোৎসাহীরা যদি বাজারসফল গায়কদের গলাগুলোকে আদর্শ না বানিয়ে, কোনও ভাল শিক্ষকের কাছে যান এবং গান শিখতে শুরু করেন, তা হলে শিক্ষকই নিশ্চয়ই বলে দেবেন— কার কোন পরদায় গান গাওয়া উচিত।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy