Advertisement
E-Paper

বাঞ্ছারামচরিত

২ অক্টোবর ছিল তপন সিংহের জন্মদিন। ‘সাজানো বাগান’ নাটক দেখতে গিয়ে যিনি ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ভেবে ফেলেছিলেন। সেই আশ্চর্য গল্প।দিনভর ইতস্তত বৃষ্টির পিচ্ছিল সন্ধ্যায় নামমাত্র দর্শক। ইন্টারভ্যালে খবর এল— তপন সিংহ ও অরুন্ধতী দেবী নাটক দেখছেন। শোনামাত্র কপালে করাঘাত। নদীতে ঢেউ না লাফালে কী মজা নৌকা বেয়ে, দর্শকের সাড়া না মিললে কী বা সুখ অভিনয়ে! আর ‘সাজানো বাগান’ নাটকটার শেকড়ে-কাণ্ডে যতই থাক না ‘বেঁচে ওঠার সংগ্রাম’-এর কথা, তার শাখায়-পাতায় ফুলে-ফলে এতই কৌতুক, থিয়েটার সরগরম থাকে সারা ক্ষণ।

মনোজ মিত্র

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবির শুটিংয়ে নির্মলকুমার, মনোজ মিত্র, দীপংকর দে ও পরিচালক তপন সিংহ।

‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবির শুটিংয়ে নির্মলকুমার, মনোজ মিত্র, দীপংকর দে ও পরিচালক তপন সিংহ।

দিনভর ইতস্তত বৃষ্টির পিচ্ছিল সন্ধ্যায় নামমাত্র দর্শক। ইন্টারভ্যালে খবর এল— তপন সিংহ ও অরুন্ধতী দেবী নাটক দেখছেন। শোনামাত্র কপালে করাঘাত। নদীতে ঢেউ না লাফালে কী মজা নৌকা বেয়ে, দর্শকের সাড়া না মিললে কী বা সুখ অভিনয়ে! আর ‘সাজানো বাগান’ নাটকটার শেকড়ে-কাণ্ডে যতই থাক না ‘বেঁচে ওঠার সংগ্রাম’-এর কথা, তার শাখায়-পাতায় ফুলে-ফলে এতই কৌতুক, থিয়েটার সরগরম থাকে সারা ক্ষণ। আজ গোড়া থেকেই দর্শকের প্রতিক্রিয়া ভিজে তুবড়ির মতো। ভাবছি, এমন অপ্রত্যাশিত বিশিষ্ট দুজনের সামনে আজই কিনা একটা আত্মবিশ্বাসী উপস্থাপন ঘটছে না! শো ভাঙতেই গ্রিনরুমে চলে এলেন যুগলে। মৃদুভাষী ভদ্রলোকটির মুখে মৃদু হাসি: ‘ভাল লেগেছে ভাই।’ আর একটিও কথা না!
পর দিন কলেজে বেরব বলে তৈরি হচ্ছি, টালিগঞ্জ পাড়ার স্বল্প পরিচিত এক জন আমাদের বেলগাছিয়ার বাড়ির দরজায় টোকা দিলেন: ‘তপনবাবু আপনাকে একটা ফোন করতে বলেছেন, এই ওঁর ফোন নম্বর। এখনই করুন।’ ১৯৭৯-র কলকাতায় ক’জন মধ্যবিত্তের ঘরেই বা টেলিফোন ছিল? ভাবলাম, কলেজে গিয়ে করব। কিন্তু সত্যি মন থেকে কোনও সাড়া পাচ্ছিলাম না। বয়েস তখন উনচল্লিশ। সতেরো বছর কলেজে পড়াচ্ছি। ছাত্রাবস্থা থেকে বেশ কিছু নাটক লিখেছি— ‘চাকভাঙা মধু’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘পরবাস’, ‘নরক গুলজার’, ‘সাজানো বাগান’, আরও। শিল্পতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার কাজটাই চলছিল ঢিমে তালে। এ সব সামলে খেলাচ্ছলে আমার থিয়েটার এবং অভিনয়। এর মধ্যে চলচ্চিত্রাভিনয় রাখি কোথায়?
কলেজে ঢুকে তক্ষুনি ফোন করার ফুরসত মেলেনি। দুপুরবেলা খবর এল: প্রিন্সিপালমশাই ডাকছেন, তাড়াতাড়ি আসুন। অধ্যক্ষমশাই রিসিভারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিতে, টেলিফোনে তপনবাবুর গলা: ‘আজই আমরা এক বার দেখা করতে পারি?’ কোথায়? ‘এন.টি দু’নম্বরে...’ সেটা কী? কোথায় সেটা?
অতঃপর অপর প্রান্তে দীর্ঘ নীরবতা। ‘আপনি তো আমাদের পাড়ার কলেজে অধ্যাপনা করেন। আমার বাড়িটা কিন্তু খুব কাছে। গাড়ি পাঠিয়ে দেবো ভাই?’ তার আর দরকার কী? আমিই যাচ্ছি।

আধ ঘণ্টা পরে। দোতলার গ্রিলের গায়ে এসে দাঁড়ালেন তপন সিংহ: ‘কে ভাই? কাকে চাই?’ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত গলায় বলে ফেললাম, আপনি যে ডাকলেন! তপনবাবুর উত্তর আরও পাশ কাটিয়ে গেল: ‘কেন ডাকলাম?’ ইতিমধ্যে অরুন্ধতী দেবী গ্রিলের ধারে এসে দাঁড়াতে তপনবাবু তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কাউকে ডেকেছ?’ আর ধৈর্য না রাখতে পেরে চেঁচিয়ে নিজের নামটা বললাম। দুজনে ঝুঁকে দাঁড়ালেন নীচের দিকে।

ঘরে ঢুকতে দুজনের চোখের নিরুচ্চার হাসিটা দৃষ্টি এড়াল না। তপন সিংহ বললেন, ‘কাল অমন চড়া মেক-আপে দেখেছি তো, এখনও মেলাতে অসুবিধা হচ্ছে।’ অরুন্ধতী দেবী বললেন, ‘শুনছিলাম আপনার বয়েস কম। তা বলে এত কম, ধারণা করতে পারিনি ভাই। জানেন, থিয়েটার দেখতে দেখতে, বা ইন্টারভ্যালে কোনও কথাই বলিনি আমরা, গ্রিনরুমে দেখা করে বেরিয়ে এসেও চুপচাপ। ফেরার পথে রেসকোর্স পেরিয়ে আলিপুরের দিকে মোড় ঘুরতে উনি আমার হাত চেপে ধরলেন: ছবি করলে কিন্তু দারুণ হবে! আমি বললাম, তোমায় তাই বলব ভাবছিলাম।’

‘আপনার আপত্তি নেই তো?’ তপনবাবু জানতে চাইলেন। আমি অনেকটা দুশ্চিন্তামুক্ত তখন। যাক, অভিনয় নয়! নাটকটার সিনেমা হবে! ‘কোনও অসুবিধে নেই!’ বলেই থমকে গেছি। ছবির জন্যে থিয়েটার বন্ধ করতে হবে না তো? ‘থিয়েটার কাল আমাদের বিহ্বল করেছে বলেই না ছবি তৈরির ইচ্ছেটা হল ভাই। কেন বন্ধ করতে বলব! নাটক কি ছবি কেউ কারও পথ আটকাতে পারে না ভাই। বরং ছবিটা হলে, ভাল হলে, নাটকটা আরও বেশি করে চলবে, বেশি দিন বেঁচে থাকবে!’ বলেছিলেন অরুন্ধতী দেবী। ‘তবে মুশকিল কী জানেন ভাই,’ আধবোজা চোখে আপন মনেই গুনগুন করছিলেন অভিজ্ঞ প্রবীণ চলচ্চিত্রকার: ‘গল্প-উপন্যাস থেকে যত অনায়াসে চিত্রনাট্য বানানো যায়, নাটক থেকে তেমন বুঝি হয়ও না। নাটকের গঠনে থাকে এমন একটা নিটোল অরগ্যানিক ইউনিটি, একটা সামান্য প্রবেশ-প্রস্থানও এমন অচ্ছেদ্য বাঁধনে জড়ানো, চট করে তাকে ভাঙতেও ভরসা হয় না। সিনেমার আবার পছন্দ ছড়ানো-গড়ানো ঢিলেঢালা জীবন। নাটক ভেঙে ভাল ছবি খুব বেশি হয়ওনি সিনেমায়— না দেশে, না বিদেশে।’ বললেন, ‘সকালে পাড়ার বইয়ের দোকান থেকে ‘সাজানো বাগান’ নাটকটা আনিয়ে পড়লাম। সংলাপ বড় সুন্দর। থিয়েটারে দেখলাম, একটা গোপন ছন্দ রেখেছেন, যার অন্তরালে ঢেউ আছে। চিত্রনাট্যে এ-সব হুবহু রাখব কি না দোটানায় আছি। রাখাও যায় না, আবার না-রাখাটাও হয়তো ঠিক হবে না। সত্যি ভাই, নিরীহ মুখে বৃদ্ধ বাঞ্ছারামের বেফাঁস মন্তব্যে লোভী ধূর্ত মানুষের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন চমৎকার লাগছিল কাল!’

‘এ-সব মানুষ আপনি পেলেন কোথায়?’ অরুন্ধতী দেবীর ভারী কৌতূহল ‘সাজানো বাগান’ নিয়ে। সদ্য-দেখা অভিনয়ের নানান মুহূর্তের কথা তুলে জানতে চাইলেন, এমন বুড়ো মানুষ আমি দেখেছি কি না, যার সঙ্গে গাছপালা জলমাটির এতটাই মাখামাখি। বাধ্য হয়ে সব সংকোচ সরিয়ে কোন ছোটবেলায় ও-পার বাংলায় খুলনা জেলায় ফেলে আসা আমাদের সেই গ্রামটির কথা শোনাতে হল তাঁকে— যেখানে নিরানব্বই ভাগ মানুষের জীবন ছিল গাছপালা চাষবাস নির্ভর। যেখানে গাঁয়ের ফলন্ত তেঁতুলগাছটা ঝড়ে ভেঙে পড়লে সারা গ্রাম আত্মীয়বিয়োগ ব্যথায় নিঝুম হত। ভর দুপুরে গাঁয়ের চাষিপাড়ায় এক বার এক থুত্থুড়ে বুড়ো মানুষকে দেখে ভয়ে ডরিয়ে আমার অভিভাবিকার আঁচল আঁকড়ে ধরেছিলাম। লোকটার দেহটা এইটুকু, গাঁয়ের রং ফকফকে সাদা, ঠিক যেন একটা ডিম ফেটে বেরল। লোকটা ছিল পানচাষি। আমরা গিয়েছিলাম পান কিনতে। ‘কই গো, ও বাঞ্ছাদা, কই গো, আমরা পান কিনতে এলাম...’ বাড়িতে দ্বিতীয় প্রাণী ছিল না। অনেক ডাকাডাকির পর কোন দিক থেকে যে বাঁশির আওয়াজের মতো উত্তর এল, বুঝতেই পারলাম না: ‘আসি গো!’

কত ক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, কারও দেখা নেই। হঠাৎ দেখি, পানমাচানতলার ঘুরঘুট্টি আঁধার ঠেলে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বেরল সেই বুড়ো। বাঞ্ছারাম কাপালি। ‘বাঞ্ছারাম’ নামটা সেই দিন পাওয়া! সঙ্গিনী বৃদ্ধার মুখে আমার পরিচয় শুনে বুড়ো বলল, ‘তাই নাকি? তবে বসো, একটা পেন্নামি দিই।’ ওই ভাবে হামাগুড়ি দিয়ে একটা আঁকশি জুটিয়ে উঠোনের বাতাবিলেবুর গাছ থেকে বড়সড় ফুটবলের আকারের একটা ফল পাড়ার চেষ্টা করতে লাগল বারবার। সত্যি যখন বোঁটাটা ছিঁড়ল, সেই মুহূর্তটা ভুলতে পারব না এ জন্মে। চকিতে ওই স্থবির বৃদ্ধ অস্ফুট চিৎকার করে দু’হাতে নিজের মাথাটি ঢেকে ঝুঁকে পড়ল, যেন ওই ফলটি তাঁর ব্রহ্মতালু ফাটিয়ে না দেয়! যে কোনও কারণেই হোক, ওই মুহূর্তটা আমি নাটকেও রাখতে চেয়েছিলাম। দু-চার রাত্রির পরে বুঝলাম, সেই ছোটবেলায় যে অনুভব বিদ্যুৎচমকের মতো দেখা দিয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও নজরে পড়ছে না দর্শকের। উলটো প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। স্মৃতি যে কত ভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে ঠকায় বা লাভবান করে, তার কি কোনও শেষ আছে?

‘সাজানো বাগান নয়, ছবির নাম হবে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, চায়ের টেবিলে চার আঙুলে তরঙ্গ তুলে তপন সিংহ জানালেন, ‘সকালে উঠে উত্তমকে গল্পটা বললাম!’ উত্তম বেশ উত্তেজিত। একটা মনের মতো চরিত্রের খোঁজ পেলে শিল্পীদের ভেতরটা কেমন ছটফট করে বোঝেন তো? আমায় যদি বিশ্বাস করেন, কমেডি অ্যাক্টিংয়ে এ দেশে উত্তমকুমার তুলনাহীন! অসাধারণ ওর সেন্স অব টাইমিং! এক লহমার হেরফেরে কৌতুক যে কতটা কটু স্বাদের হয়ে যায়, থিয়েটার যখন করছেন, বোঝেন নিশ্চয়ই। চেষ্টা করে যাকে লোক হাসাতে হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে আছে, জীবনে কি অভিনয়ে? আমি উত্তমের গুণমুগ্ধদের এক জন। ওর কৌতুকসৃজন অনায়াসলব্ধ! তাই না?’

একটু ফাঁক পেতেই আমি বললাম, উনি বাঞ্ছারাম হলে সে এক দারুণ কাণ্ডই হবে। ওঁর বিপরীতে বাগানের ভূত জমিদারের পুত নকড়ি দত্ত কে করবেন?

তপন সিংহ মাথা নাড়লেন, ‘না না না! আপনার ওই ভূতপূর্ব জমিদারের ভূত এবং তার ছেলে বর্তমান জোতদার— দ্বৈত চরিত্রেই উত্তমকুমার।’ ‘উত্তমকুমার গাছের ডালে বসে গড়গড়া টানছে— দর্শকের অবস্থাটা এক বার আন্দাজ করুন ভাই,’ অরুন্ধতী দেবীর সংযোগ। কিন্তু ওঁর পাশে বাঞ্ছারাম কে? জানতে চাইলাম আর এক বার। ‘হিন্দি হলে আমার পছন্দ হত রাজ কপূর...’ তপন সিংহকে থামিয়ে দিয়ে অরুন্ধতী দেবী শোনালেন, ‘আমরা এক জনকে ভেবেছি। তবে তার কতটুকু ইচ্ছে আছে, বুঝতে পারছি না। বাঞ্ছারাম না পাওয়া গেলে কিন্তু ছবিটাই করা হবে না।’

তপনবাবু প্রসঙ্গটা পালটালেন। ‘আচ্ছা, থিয়েটারে বাঞ্ছারাম অমন বসে বসে চলে কেন? সে কি তার বয়সের কারণে?’ বিনীত কণ্ঠে বললাম, বয়সের কারণেই বসে বসে চলাফেরা করে। তবে চাষি দু’শ্রেণির— মাঠচাষি আর খেতচাষি। মাঠচাষিরা বড় বড় মাঠে ধান-পাট-শস্য-কলাই চাষ-আবাদ করে। আর খেতচাষিদের কাজ সবজি চাষবাসে। ধরুন, একটা কপিচারা কি আলুচারার পরিচর্যা করতে, একটা থেকে আর একটার কাছে পৌঁছতে সব সময় ওরা বসে বসেই চলাফেরা করবে। নইলে গোটা বাগানে বার বার ওঠবোস করে তার তো জান কাহিল হবে। বসে বসে এগোলেই তার আরাম। আবার ওই আরামটুকুর জন্য শেষ বয়সে কোমরে ঘুণ ধরে যায়, দুমড়ে যায়! শেষ জীবনে মাটিই তার একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের গাঁয়ের কাপালিরা ছিলেন খেতচাষি।

সন্ধে হয়ে আসছিল। সে দিনের মতো বিদায় নিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতে পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখলেন তপন সিংহ, ‘তা হলে ওই কথাই রইল ভাই— বাঞ্ছারামের বাগানের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করি? কিন্তু আপনাকেও শিগগির এন-টি টু, মানে নিউ থিয়েটার্স দু’নম্বর স্টুডিয়োটা চিনে নিতে হবে ভাই! স্টুডিয়ো না চিনলে টানা এক মাস শুটিং করবেন কী করে? রোজ কি বাঞ্ছারামকে হাত ধরে পথ চিনিয়ে বাড়ি থেকে আনতে হবে?’

চমকে ঘুরে দেখি, চোখের তারায় কৌতুকের ছটা ঝলকাচ্ছে! তপন সিংহের কাছের মানুষরা একবাক্যে স্বীকার করবেন, ঠাট্টা-তামাশা-রহস্যের জাল বোনায় তিনি কতটা সিদ্ধহস্ত, নিপুণ, অব্যর্থ ছিলেন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমায় সানন্দ সম্মতি জানিয়ে নামতে হল।

দুর্গাপুজো পার করে আট-দশ দিনের মধ্যে ডাক পাঠালেন, চিত্রনাট্য শুনে যান। প্রথম দিনের পাঠে শ্রোতা ছিলাম মাত্র দুজন— আমি আর তপনবাবুর দীর্ঘ দিনের সুহৃদ গৌরকিশোর ঘোষ। পড়া শেষ হতেই গৌরদার মন্তব্য, ‘এটা যদি হয় হাসির ছবির চিত্রনাট্য, তবে লড়াইয়ের ছবি হবে কোনটায়?’ এর পর যখন যেখানে যত বার চিত্রনাট্য পাঠ হয়েছে, আমাকে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। কলেজ মিটিয়ে অন্তত ঘণ্টা তিনেক কাটাতাম ওঁর সঙ্গে। ওঁর ইউনিটের শিল্পী, কলাকুশলী, স্টুডিয়ো-কর্মীরা বেশ কিছু দিন যাবৎ কাহিনিকার হিসেবে চিনতেন আমাকে। টালিগঞ্জ আনোয়ার শাহ রোডের সেই স্টুডিয়োয় বড়সড় গোটা দুই আমগাছের ঘন ছায়া পালা করে ছড়িয়ে থাকত তপনবাবুর অফিসঘরটার ওপর। বেলা কেটে যেত দেশবিদেশের ছবি আর অভিনেতাদের কথা শুনতে শুনতে। বিলেত থেকে চলচ্চিত্র শব্দপ্রয়োগবিদ্যা পড়ে এসেছিলেন, বিশেষ মনোযোগ ছিল অভিনয়-কলায়। অভিনয়-সৌকর্যের ওপর ছবির গুণাগুণ আর তার রসও অনেকটাই নির্ভর করে, এমন বিশ্বাস থাকলেও, উনি মানতেন— প্রযুক্তির উৎকর্ষ বিনা অভিনেতার ছোট ছোট অনুভবগুলো ধরে রাখবে কে? সময় পেলে নির্মলকুমারও এসে বসতেন স্টুডিয়োর সেই ছায়াঘরে। টালিগঞ্জ পাড়ায় রটনা ছিল, সিনেমা বানাতে গিয়ে তপনবাবু থিয়েটারের মতো রিহার্সালে বসেন। আসলে যেটা চাইতেন তিনি: ব্যতিব্যস্ত কর্মজীবনের বাইরে বেরিয়ে শিল্পীরা দিনের কিছু ক্ষণ বসবাস করে যাক তাঁর আগামী ছবিটার মধ্যে। সেই ফাঁকে তিনিও তাঁদের পিদিমের সলতেগুলোকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। শিল্পীরা পুতুল নয়, মানুষ। হৃদয়বৃত্তির জীবন্ত সংযোগ না থাকলে ছবিটা মৃতকল্প ঠেকবে। একটা মোটিভেশন— ছোটবড় সব শিল্পীমনে একটা প্রবল ‘প্রেষণা’ সৃষ্টি করতেন।

সাজো-সাজো বাদ্যি বেজে উঠল ডিসেম্বর পড়তে। তত দিনে ঠিক হয়েছে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শুটিং।

ক্যামেরার বিমল মুখোপাধ্যায়, সম্পাদক সুবোধ রায়, শিল্প-নির্দেশক সুনীতি মিত্র, রূপসজ্জাকর শক্তি সেন থেকে পরচুলা তৈরির পিয়ার আলি, সবাই তটস্থ। ছোট-বড় শিল্পী নির্বাচন শেষ। কত বার যে চিত্রনাট্য আগাগোড়া পাঠ করতে হল ওঁকে! বলতেন, ‘যত বার পড়ি, নতুন নতুন ছবি ভেসে আসে। নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ আবিষ্কার করি। সুরকার শচীনদেব কী বলতেন শুনবেন? ভোরের নামজপে আর রেওয়াজে রোজ নগদ প্রাপ্তি জোটে।’

এক দিন দুপুরে তপনবাবুর সঙ্গে হুডখোলা মোটরে চেপে রাজপুর-বারুইপুর পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম শাসন গ্রামে। মজা করে বললেন, ‘আসুন, আপনার বাগানটা আমরা কেমন বানিয়েছি, এক বার চোখের দেখা দেখবেন!’ শুরুর দিন থেকেই উনি বলতেন, ‘আপনার বাগান।’ গোড়ায় লজ্জা পেতাম, পরে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল।

সেই পান-বরজের বুড়োর বাড়ির মতো এখানেও নিকোনো উঠোন। দোচালা দুটো ঘর, ঘরের পিঠে আম-কাঁঠাল-সুপুরি-নারকেল-আতা-নোনা যে যেখানে ফাঁক পেয়েছে, মাথা তুলেছে। বাঁশবন-কলাঝোপের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জবা-করবী-শিউলি-কলাবতী। গাছপালা পেরিয়ে বিশাল সবজিখেত। কপি-মুলো-বেগুন-লাউকুমড়ো-শসা... সতেজ স্বাস্থ্যবান ফসল। ঝাঁক বাঁধা টিয়ে পেয়ারাগুলোকে বেপরোয়া ঠুকরে চলেছে। পাশের সরষেখেতে গায়ে হলুদের উৎসব যেন।

তপন সিংহ বললেন, ‘বাঞ্ছারাম তো যৌবনে জবুথবু ছিল না! নিশ্চয় ছুটত?’ বললাম, নিশ্চয়ই। তৎক্ষণাৎ হুকুম হল, ‘যান, বাগানটা চক্কর দিয়ে আসুন তো দেখি!’ জুতো খুলে আমিও দে-ছুট। অভ্যাস না থাকলে যা হয়, হাঁপাচ্ছিলাম। তপনবাবু এগিয়ে এলেন, ‘কেমন লাগছে?’ বললাম, এত দিন থিয়েটারের সাজানো বাগানে চাষি বাঞ্ছারাম কোনও দিন মাটিতে পা দেয়নি। একটা গাছ ছুঁয়েও দেখেনি। সব দাপাদাপি অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রসদনের ইট-কাঠ-সিমেন্টের মঞ্চে। চাষি আজ মাটির ছোঁয়া পেল! দেখুন শিহরন জাগছে আমার। কিন্তু তপনদা, আমি কিন্তু সিনেমায় অভিনয়ের ‘অ-আ’ও জানি না। নির্ঘাত ডোবাব ছবিটা! তপনদা কাঁধে হাত রাখলেন: ‘অভিনয় জানতে হবে না। তুমি শুধু ছোটবেলার দেখা পানমাচানতলার সেই আঁধার ফুঁড়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসা বুড়োকে ধরে রেখো, আর তার সাধের বাগানটা থেকে মুহূর্তের জন্যও চোখ সরিয়ে নিও না!’

সবাই জানেন, উত্তমকুমার বাঞ্ছারামের বাগানে অভিনয় করতে পারেননি। দ্বৈত চরিত্রে এসেছিলেন দীপংকর দে। উত্তমকুমার চেয়েছিলেন ছবির শুটিং মার্চে শুরু হোক। তার আগে ডেট দিতে পারবেন না। তপন সিংহ রাজি হননি। উত্তমকুমার মামলাও করেছিলেন। আদালতের জিজ্ঞাসা ছিল: মিস্টার সিন‌্হা, উত্তমকুমারের মতো শিল্পীর জন্যে আপনি কি তিনটে মাস ছবির কাজ বন্ধ রাখতে পারেন না? তপন সিংহের জবাব ছিল: ‘তিন মাস পরে উত্তমকুমারকে পাব, কিন্তু শীতের সরষেফুল? কোথায় পাব?’

manoj.mitra.sundaram@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy