সত্তরের মাঝামাঝি। ছোটমামার বিয়ে। সন্ধ্যায় নতুন বউ আসছে। পেট্রোম্যাক্সের আলো জ্বালিয়ে তাসাপার্টি নিয়ে বড়মামার সঙ্গে ছোটদের দল অপেক্ষায়। এলাকা ব্যতিব্যস্ত করে ‘ইনহি লোগোঁ নে’ গান বেজে চলেছে। বউ এল। সামনে তাসাপার্টি। বরণ করার জন্য নতুন বউ বাড়ির ভেতরে গেল। তাসাপার্টির লোকেদের চা দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ দেখি মা আর বড়মামা নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছে। তার পরেই দুজনে গুটিগুটি এগিয়ে গেল মাস্টার-এর দিকে। মাস্টার মানে, যিনি সানাই বাজান। তাঁকে বলল, ‘বিরহ বড় ভাল লাগে’ গানটা বাজাবেন? নতুন বর-বউয়ের ভাল লাগবে।’ এখনও মনে পড়ে সেই সানাইবাদকের বিশাল হ্যাঁ অবশ্য ব্যাপারটাকে এ ভাবে দেখা যেতে পারে, সাধারণ মানুষের তখন ধারণা ছিল, তাসাপার্টি যে কোনও গানই বাজাতে পারে।
এখন সে সব ধারণা তো উবে গেছেই, তাসাপার্টি সম্পর্কে কারও কোনও ধারণাই আছে বলে মনে হয় না। আমি এক গাদা প্রশ্ন তৈরি করে রওনা হলাম। এখনকার তাসাপার্টির হাল-হকিকত জেনে আসতে হবে!
পৌঁছনো গেল মহাত্মা গাঁধী রোডে। কিন্তু নাক কুঁচকোতে লাগলেন সব লোক। তাসাপার্টি? না না, তাসাপার্টি আমরা না। আমরা হলাম ব্যান্ড। ও দিকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ও-পারে প্রভাতী সিনেমা হল আছে, ও দিকে যান। ওখানে তাসাপার্টি পাওয়া যায়। সিনেমা হলের পেছন দিকে।
প্রভাতীর পেছন দিকে গিয়ে দেখা গেল দোকানের পর দোকান। বেশির ভাগটাই খাবারের। আর রয়েছে নতুন বছরের ক্যালেন্ডার আর ডায়েরির দোকান। রয়েছে কলকাতা শহরের সবচেয়ে বেশি মুসুম্বি-কমলালেবু সাপ্লাই দেওয়ার বাজার। কিন্তু কোথায় তাসাপার্টি! নীলচে-সব্জে রঙের একটা চৌকিতে বসে জনা তিনেক। প্রশ্ন করি, দাদা এখানে তাসাপার্টির কোনও অফিস আছে?
— তাসাপার্টি? পালটা প্রশ্ন।
— হ্যাঁ, তাসাপার্টি।
— আরে, আমরাই তো তাসাপার্টি চালাই।
— আপনাদের দলের নাম কী?
— কেন? ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আলেকজান্ডার ঢোল-তাসা। যে কোনও গানবাজনায় দোমা মাস্টার। দোমা মাস্টার বিড়ি খেয়েই যাচ্ছেন। কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘কেউই ডাকে না। কী করব। কোথায় যাব। তখন ফল বিক্রি করি। মুসুম্বি, আপেল এই সব। শুধু ভাবুন আমার এই লোকগুলো তাদেরই বা কী-ই হয়। কী-ই হবে! ওরাও আমারই মতনই তো। ওরাও ফল বিক্রি করে। টিকিট ব্ল্যাক করে।’
— কিন্তু যখন আপনার বাজানোর ডাক থাকে তখন?
— তখন আর কী, লোক তো বলতে মোটে চার-পাঁচ জন।
— কেন চার-পাঁচ জন?
— হ্যাঁ, তাসা মানে তো চোল-ঝাঁজ-চড়বড়ি-ঢোল। ব্যস।
— এ ছাড়া আর কোনও বাজনা বাজে না?
— না না। এটাই তাসা। এখন এখানে মানে কলকাতায় দুটো অরিজিনিল তাসাপার্টি আছে। আমরা আর ‘বম্বে তাসাপার্টি’। আমার সঙ্গে আছে রাজু, শেরু।
— এক্কেবারে সব মিলিয়ে লোক কত জন থাকে আপনার দলে?
— খুব বেশি হলে পাঁচ থেকে সাত জন।
— টাকাপয়সা কত নেন?
— লোক পিছু ৫০০ টাকা। আমি ২০০ টাকা করে রাখি। ৩০০ দিয়ে দিই।
— কারা ডাকে?
— যে কেউই। তবে বিহারিদের কাছ থেকে ডাক আসে বেশি। এক বার বম্বে গিয়েছিলাম। ব্যস, এর পর আর কেউ কোথাও ডাকেনি।
— ট্রামরাস্তার ধারে ওরা তো আপনাদের পাত্তাই দিতে চাইল না।
— দাদা, আমরা গরিব মানুষ। ওরা ব্যানপার্টিওয়ালা। পয়সাকড়ি ওদের অনেক। অনেক রকমের বাজনা ওদের আছে। আমরা গরিবের দল। ছটপুজো কি ছোটখাটো বিয়েবাড়ি বা ভাসানে ডাক পাই আমরা।
— যারা ডাকে তারা কেমন লোক?
— কেমন আবার? লোক যেমন হয়। ওই আর কী। চলে যায়। এখন যেমন। আর কিছু দিন বাদে সিজন চলে যাবে। আচ্ছা, দাদা চা খান।
— দু’একটা কথা বলতে পারি?
— হ্যাঁ হ্যাঁ দাদা, আসুন।
— বলছিলাম, আপনাদের তাসাপার্টি নিয়ে একটু কথা ছিল।
— আমরা তাসাপার্টি নই। আমরা ব্যান্ড।
— মানে, তাসাপার্টির সঙ্গে আপনাদের কোনও সম্পর্ক নেই?
— না না, ওরা আলাদা ব্যাপার। আমরা আলাদা। আমরা ইংলিশ ব্যান্ড, ইংলিশ গান বাজাই।
— ইংলিশ মানে?
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে যা চলছে। তবে একটা কথা বলি। এখন সিজন টাইম। আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খদ্দের নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি একটা কাজ করুন। ওই, ও দিকে মেহেবুব ব্যান্ডের কাছে যান। ওরা আপনাকে সব বলে দেবে।
আরও কিছু বলতে যেতেই জবাব —
দাদা, ভালয় ভালয় উঠে গেলে ভাল। তা নইলে আমরা কেউ কথা বলব না, ধাক্কা মেরে তুলে দেব। কেন আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা সিজন টাইম। আপনার সঙ্গে কথা বলার চেয়ে অনেক ইম্পর্ট্যান্ট আছে কাস্টোমার। আপনি কি আমায় কোনও কাস্টোমার দেবেন? দেবেন না তো। তবে ওই ও দিকে যান। ওরা যা বলার বলবে।
এর পর আর কোনও কথা হয় না। এর পর? এর পরের দোকান। না কেউ কোনও কথা বলবে না। সবাই বললেন, যান ভাই, মেহেবুব ব্যান্ড কোম্পানিতে যান।
অবশেষে মেহবুব ব্যান্ড। মালিক মহম্মদ শওকত আলি। হালকা ইন্দ্রলুপ্ত। গালে সাদা দাড়ি। ওয়েল মেনটেন্ড। এই সেই মেহবুব ব্যান্ড। যারা যে কোনও অনুষ্ঠানে ‘ম্যায় হুঁ ডন’ থেকে ‘ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে’ — সবই বাজায়।
— ভাই বসুন। কী খাবেন বলুন?
— চা।
— ডাব খান।
— আচ্ছা আনুন। একটা কথা বলুন তো, আপনারা তাসাপার্টি নন?
— তাসাপার্টি? কেন আমরা তাসাপার্টি হব? আমরা ব্যান্ড। আমাদের যখন সিজন তখন লেবার পিছু ২০০০ টাকা অবধি নিই।
— লেবার মানে?
— যারা বাজায়। দু’ঘণ্টার জন্য আমরা এক এক জন লেবারের জন্য ২০০ থেকে ২০০০ টাকা অবধি নিই। মানে, সিজন অনুযায়ী ভ্যারি করে। মালিক, মানে আমরা একটা টাকা কেটে নিই। বাকিটা যারা বাজায় তাদের।
— আপনারা কী কী ইন্সট্রুমেন্ট বাজান?
— ট্রাম্পেট, ব্রাস, ক্ল্যারিনেট, ড্রাম, ট্যাম্বুরিন। আরও আরও অনেক কিছু।
— কারা খদ্দের আপনাদের?
— আমাদের খদ্দের বাঙালি-পঞ্জাবি আর মাড়ওয়ারিরা। কিন্তু জানেন তো, আমাদের বেশির ভাগ লোক কিন্তু মুসলিম।
— খদ্দেররা কেমন?
— বাঙালি আর পঞ্জাবি কাস্টমারদের তুলনা হয় না। কোনও বাঙালি বাড়িতে বাজানো মানে তারা বসিয়ে পেট ভরে খাইয়ে দেয়। কেউ কেউ আবার খাবার প্যাক করে দিয়েও দেয় সঙ্গে। আর পঞ্জাবিরা টাকা ওড়ায়। এমনকী রাস্তায় বাজাতে বাজাতে যাওয়ার সময়ও টাকা ওড়ায়। বাজনা শুনে খুশি হলে ভীষণ ভাল বকশিশ দেয়। ওই যে দেখুন মুন্নাকে। ও এখানে এসেছিল শিখতে। এখন ও-ই মাস্টার। মাস্টার মানে ও সানাইয়ে গান শুরু করে। কিন্তু লাভ কী বলুন?
— কেন?
— আরে, পুলিশ অনেক টাকা চায়।
— তাই নাকি?
— কোনও ঝুটা বাত বলব না। সচ্ বলব। এক বার পার্ক স্ট্রিটের ১৯ নম্বরে, আর এক বার থিয়েটার রোডে আমাদের বাজনা শুনে পঞ্জাবিরা খালি টাকা ওড়াচ্ছে। টাকাই ওড়াচ্ছে। চার পাশে লোকজন জমে গিয়েছে। ভিখারিরাও টাকা কুড়োচ্ছে। ব্যস, পুলিশ এসে আমাদের ফাইন করে দিল। আরে, আমাদের যে ভাড়া করেছে তাদের সঙ্গে কথা বল, তা না। আমাদেরকে। জানে গরিবের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া সহজ।
— কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও যাননি?
— হ্যাঁ, কেন যাব না? নেপালের বীরগঞ্জে গেছি বারো জনের দল নিয়ে। রাজস্থানে গেছি দল নিয়ে। দাদা বুঝলেন তো, মেহবুব ব্যান্ড সবাই চিনে, সবাই নাম জানে।
— সবাই মানে?
— কার নাম জানতে চান বলুন?
— আপনিই বলুন?
— উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ।
— ওঁদের বাড়িতে আপনারা বাজাতে যেতেন?
— কেন, খুব অবাক লাগছে? উত্তমকুমার আমাদের খুব যত্ন করতেন। বাজনা শেষে সবাইকে বসিয়ে খাওয়াতেন। বকশিশ ভি দিতেন।
— আর বিশ্বজিৎ?
— উনিও তাই। আমাদের দলের সব লোককে খুব সম্মান দিতেন। খাইয়ে দিতেন।
এর পর কথা শেষ হয়ে আসে। এ বার তাঁকে আমি বলি, ‘জানেন তো, এখন আরও নতুন নতুন ব্যান্ড এসেছে। তাদের সঙ্গে পারবেন তো?’
— কী নাম বলুন তো?
— চন্দ্রবিন্দু, ক্যাকটাস, ভূমি, শহর।
— আরে ছোঃ। কী যে বলেন। ও সব নতুন দল। ওরা কেন পারবে আমাদের সঙ্গে। ওরা পারবে, আমাদের মতো ‘আরে দিওয়ানো মুঝে পহেচানো’ বা ‘আ যা আয়ি বাহার’ বাজাতে?
— কেন, ওরা তো নতুন দল।
— তা-ই তো। নতুন ছেলেদের ট্রেনিং কী? কিচ্ছু না। থাকবে শেষ অবধি এই মেহবুব ব্যান্ড।
— আর তাসাপার্টি?
— ওঃ ওদের কথা এই বিকেলবেলায় বলবেন না।
— মানে, আপনাদের সঙ্গে ওদের তুলনাই হবে না?
— না, কোনও তুলনাই হবে না। তাসাপার্টি আর ব্যান্ড এক নয়। ব্যান্ড অনেক বড়, তাসাপার্টি ছোটখাটো জিনিস। আমরা বড়লোকের কাজ করি। আর ওরা?
শেষে জাস্ট একটা ঘটনার কথা বলি। একটা তাসাপার্টি বা ব্যান্ডপার্টিকে দেখি এক রাতে। তারা ফাঁকা রাস্তায় পেট্রোম্যাক্সের আলো জ্বালিয়ে নিজেদের বাজনা নিজেরাই বাজাচ্ছে। কিছু ক্ষণ দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, এটা কি আপনাদের রিহার্সাল?
না না ও সব কিচ্ছু নয়। আমাদের আলতাফের মেয়ের জন্মদিন। ওর তো আজ ডিউটি ছিল। বাড়িতে যেতে পারেনি সময় মতো। আমরা ওকে ওর মেয়ের জন্য কেক কিনে দিয়েছি আর বিরিয়ানি। আর সময় আছে বলে লেড়কির জন্য গান বাজাচ্ছি।
তারা তাসা ছিল না ব্যান্ড, বুঝতে পারিনি!