Advertisement
E-Paper

ব্ল্যাকির কাণ্ড

অমিতের ছোটবেলা থেকেই নানা রকম পশুপাখি পোষার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পশু-ছাড়া জীবন তাঁর কাছে নুন-ছাড়া ডিম সেদ্ধর মতন। অগাধ পশুপ্রেম। অমিতের বৈশিষ্ট্য হল হাসলে তাঁর চোখে হাসি ফুটে ওঠে। মা আর বউ পাপিয়া ছাড়া তাঁর সংসারে আর এক জন আছে। ব্ল্যাকি। সারমেয় নন্দন। বিশাল ডোবারম্যান। বাঘের মতো গলার আওয়াজ।

মালবিকা রায়

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৭
ছবি: দেবাশীষ দেব

ছবি: দেবাশীষ দেব

অমিতের ছোটবেলা থেকেই নানা রকম পশুপাখি পোষার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পশু-ছাড়া জীবন তাঁর কাছে নুন-ছাড়া ডিম সেদ্ধর মতন। অগাধ পশুপ্রেম। অমিতের বৈশিষ্ট্য হল হাসলে তাঁর চোখে হাসি ফুটে ওঠে। মা আর বউ পাপিয়া ছাড়া তাঁর সংসারে আর এক জন আছে। ব্ল্যাকি।

সারমেয় নন্দন। বিশাল ডোবারম্যান। বাঘের মতো গলার আওয়াজ।

বাড়িতে কেউ এলেই ব্ল্যাকিকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখান থেকেই সে রণবাদ্য বাজিয়ে সবাইকে আতঙ্কিত করে তোলে। অমিত সবাইকে বলেন, ‘ও একটা মশাকেও কামড়াবে না।’ এটা সত্যি। ওর হচ্ছে ‘মুখেনং মারিতং জগৎ’।

যারাই কুকুর পোষে, তারাই বাড়িতে অতিথি এলেই বলে, ‘আসুন, আসুন, ও কিছু করবে না।’ এ ভাবে গ্যারান্টি দিয়ে বলাটা অমিতের মায়ের ভীষণ অপছন্দ। এই অপছন্দের কথাটাই এক দিন তাঁকেও বলতে হল।

এক বার নয়, বহু বার। কেন? সেটাই বলব, তা ছাড়া আর একটা ঘটনাও বলব।

এই দুটো ঘটনা থেকেই বোঝা যাবে যে, ব্ল্যাকি কী সব কাণ্ড করে।

অমিতদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাবলু অনেক দিন পর হঠাৎ এক দিন দুম করে এসে হাজির। বাবলু জানত না যে, এ বনে বাঘ আছে। ধোপদুরস্ত পোশাকের অচেনা লোক— বাঘ ঘাপটি মেরে রইল। ভাবল, আজ আমাকে চেন পরিয়ে অন্য ঘরে নেওয়ার কথা কারও খেয়াল নেই। এই সুযোগ ছাড়ব না। আজ বাছাধনকে মুরগি বানাবই।

বাবলু অমিতের মাকে প্রণাম করল। উনি খুশি হয়ে বললেন, ‘আরে বাবলু যে! বাড়িতে সবাই ভাল আছে তো?’ বাবলু বলল, ‘বাড়িতে সবাই ঠিকই আছে। খালি আমারই কোমরে, হাঁটুতে খুব ব্যথা। আথ্রাইটিস।’

ব্যস, এইটুকু কথা ভাল ভাবে হল। তার পরেই হঠাৎ ঘটল কাণ্ডটা। আচমকা ব্ল্যাকি প্রচণ্ড রণহুঙ্কার দিয়ে ধাঁ করে বাবলুর সামনে এসে হাজির। তক্ষুনি বাবলু ‘বাপ রে এ কী? কুক-কুক-কু’ বলেই হাইজাম্প দিয়ে ডাইনিং টেবিলে উঠে পড়ল। উঠেই তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল ‘বাঁচাও-বাঁচাও, ও দাদা ওকে বাঁধুন।’ ব্ল্যাকি কথা বোঝে। সব পোষা কুকুররাই কমবেশি বোঝে। ব্ল্যাকি ভাবল, আমাকে বাঁধতে বলে! আস্পর্ধা মন্দ নয়। বলেছিলাম না, মুরগি বানাব? এই তো বেশ মুরগির মতো কুঁক-কুঁক করছে। এ বার দেখাচ্ছি আসল মজা!

হঠাৎ ভয়ঙ্কর গরর-ঘোঁয়াক-ঘোঁয়াক করে গর্জন করতে করতে সে তীব্র গতিতে টেবিল প্রদক্ষিণ করতে আরম্ভ করল। টেবিলে দাঁড়ানো বাবলুর ত্রাহি চিৎকার চলেইছে— ‘ও মাসিমা, ও দাদা— আ, ও বউদি-ই-ই ওকে থামান। ওকে বাঁধুন।’ মাসিমা ভাঙা রেকর্ডের মতো বলেই চলেছেন, ‘ও কিছু করবে না...’ অমিত সমানে বলছেন, ‘ও একটা মশাকেও কামড়াবে না।’ পাপিয়া দরজার খিল হাতে নিয়ে চৌকিদারের মতো ঠক-ঠক করে মেঝেতে ঠুকে বলেই চলেছেন, ‘ব্ল্যাকি থাম। থাম বলছি। থামলি? এটা দেখেছিস?’ ওটা দেখতে ব্ল্যাকির ভারি বয়েই গেছে। সে এখন ভয় দেখানোর নেশায় উন্মত্ত। তাকে পেয়ে বসেছে এক পৈশাচিক উল্লাসের মত্ততা।

ব্ল্যাকির হাড়-কাঁপানো আস্ফালন আর বাবলুর প্রাণ মাতানো চ্যাঁচানির দ্বৈত-সঙ্গীতের সঙ্গে পাপিয়ার খিল ঠকঠকানি সঙ্গতে অমিতের কপালে ফুটল বিরক্তি রেখা। বিরক্তিটা অবশ্যই বাবলুর ওপর, কখনওই ব্ল্যাকির ওপর নয়। একটু কড়া সুরে বাবলুকে বললেন, ‘আমি কী বলে চলেছি তুমি শুনতে পাচ্ছ না?’

মুহূর্তের জন্য আর্তনাদ থামিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বাবলু বলল, ‘শু-শুনেছি দাদা, কিন্তু মশাকে কেউ কামড়াতে পারে না, ওরাই সবাইকে কামড়ায়। মশাকে কোথায় কামড়াবে?

ওদের না আছে হাড্ডি, না আছে মাংস। আমার তো দুটোই আছে। ভগবানের দোহাই দাদা, ওকে বাঁধুন।’

— বনবনিয়ে ঘুরন্ত কুকুরকে বাঁধতে গেলে ওর লেগে যেতে পারে। তা ছাড়া তুমি কি জানো না, বার্কিং ডগ নেভার বাইটস?

— আমি মানি না। নিশ্চয়ই বাইটস। ভীষণ বাইটস। উফ্, কী কুক্ষণে যে মরতে এখানে এসেছিলাম!

— তুমি ভয় পাচ্ছ বলেই ও ভয় দেখাচ্ছে। এতক্ষণেও তুমি বুঝলে না যে তোমার কোনও ক্ষতি করাটা ওর উদ্দেশ্য নয়। টেবিলে দুটো থাবা রেখে দু’পায়ের ওপর দাঁড়ালেই তো...

কথার মাঝেই কঁকিয়ে ওঠে বাবলু, ‘প্লিজ দাদা, ওকে আর কুবুদ্ধি শেখাবেন না।’

ব্ল্যাকি ভাবল, এই বেজায় ভিতু লোকটা চ্যাঁচানি থামিয়ে কথা বলছে কোন সাহসে? সে ফট করে চরকি ঘোরা থামিয়ে বাবলুর চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিল— ঘরর ঘ্যাঁক। ব্যস, বাবলু হাঁউ-মাঁউ করে কেঁদে উঠল। তার পর সব যেন ম্যাজিকের মতো ঘটে গেল। অমিত ফস করে ব্ল্যাকিকে চেন পরালেন, তক্ষুনি বাবলু একলাফে নেমে দে ছুট। কোথায় লাগে রেসের ঘোড়া!

অমিতের মা বললেন, ‘ছি, ছি, কী কাণ্ড! ভয়ে যদি হার্টফেল করত?’

অমিত বললেন, ‘ও রকম লোকের হার্টফেল করবে না তো কী, পাশ করবে? কোত্থেকে ধুমকেতুর মতো এসে হাইজাম্প মারছে, হরিণের মতো ছুটছে, তার নাকি আথ্রাইটিস! উত্তমকুমার হয়ে ঢুকে বামাখ্যাপা হয়ে বেরিয়ে গেল।’

সে দিন রাত্তিরে ঘটল আর একটা অতি অদ্ভুত ঘটনা। রাত্তিরে খাওয়ার পর সবাই দোতলায় গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। একঘরে অমিতের মা, অন্য ঘরে অমিত-পাপিয়া, আর এক ঘরে ব্ল্যাকি ঘুমোচ্ছে। খিড়কির দরজাটা ভুলবশত খোলা ছিল। একটা বে-পাড়ার চোর ঢুকে সোজা দোতলায় উঠে অমিতদের ঘরে ঢুকে পড়ল। খুটখাট শব্দে ব্ল্যাকি তড়াক করে উঠেই শব্দ অনুসরণ করে অমিতদের দরজার সামনে গিয়ে একটু শুঁকে বলল, হুঁ, একটা অচেনা গন্ধ পাচ্ছি! দেখতে হচ্ছে! নিকষ কালো ব্ল্যাকিকে চোর দেখতে পায়নি। ব্ল্যাকি দেখেছে একটা লোক ড্রয়ার হাটকাচ্ছে। চোর চাবি খুঁজছে। আতঙ্কে ব্ল্যাকির গলা দিয়ে বিকট শব্দ বেরোল। সেই শব্দে চোরের প্রাণপাখি খাঁচা ছাড়া, ‘এ ঘরে যে তুমি কে তা জানত?’

অমিত বেড সুইচ টিপে দেখলেন একটা লোক পড়িমড়ি করে পালাচ্ছে। পাপিয়া চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘চোর, চোর’। ব্ল্যাকি ভাবল, এই মরেচে! চোর আবার কী? বাপরে! সে স্যাঁৎ করে বেরিয়ে গেল। অমিতের মাও জেগে গেছেন। চোর তাড়া করেছে ভেবে ব্ল্যাকি উল্কার বেগে ছুটছে। আর ব্ল্যাকি তাড়া করেছে ভেবে চোর প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে দৌড়চ্ছে।

অমিতরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার আলোয় এই অভিনব, অভূতপূর্ব, অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখতে লাগলেন।

চোর আর ব্ল্যাকি দু’জনেই প্রাণভয়ে ছুটছে! চোর কখনও ব্ল্যাকির সঙ্গে দৌড়ে পারে? ব্ল্যাকি চোরকে বিট মেরে তিরের মতো সাঁ করে বেরিয়ে গেল।

ভয়ানক সারমেয়তনয়কে উড়ে যেতে দেখে চোর টুক করে একটা গলিতে ঢুকে গেল। চোর আর তাড়া করছে না দেখে ব্ল্যাকি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে এল।

বারান্দায় পাপিয়া এমন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন যে, মনে হল সাইক্লোন বয়ে গেল। আর অমিত প্রেস্টিজ বাঁচাবার জন্য চোখে হাসি ফুটিয়ে সেই বিশেষ হাসিটা হাসলেন।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy