Advertisement
E-Paper

বড় শূন্য

শিমুলতলা জুনিয়র হাই স্কুলে আজ সাফল্য উৎসব। ক্লাস এইটের বিদায়ী ছাত্রেরা এই স্কুলে পড়াকালীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের কথা আজ জানাবে।

সুদীপ জোয়ারদার

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:৩৯

শিমুলতলা জুনিয়র হাই স্কুলে আজ সাফল্য উৎসব। ক্লাস এইটের বিদায়ী ছাত্রেরা এই স্কুলে পড়াকালীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের কথা আজ জানাবে। কারও সাফল্য নিয়ে কোনও স্যর বা তার অভিভাবকও ইচ্ছে করলে মঞ্চে উঠে বলতে পারবেন। প্রতি বার এইটকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায়ের দিনটা এই স্কুলে এ ভাবেই পালিত হয়। জেলাশাসক উপস্থিত থাকেন এবং সেরা সাফল্যকে পুরস্কৃত করেন। সাফল্য উৎসব ঘিরে তাই প্রতি বারই একটা সাজ সাজ রব পড়ে যায়।

ক্লাস এইটে এ বার বত্রিশ জন ছাত্র। সবাই বসে আছে সার দিয়ে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্র উজ্জ্বল। বরাবর ও ফার্স্ট। ওর সাফল্য পড়ায়। হাসিমুখে বেশ গর্ব নিয়ে ও বসে আছে। হেডস্যর নিজে ওর হয়ে বলবেন, এমনই কথা। বনি নিয়ে এসেছে একটা ছোটদের পত্রিকা। গত বছর এই পত্রিকায় বনির একটা লেখা প্রথম হয়েছিল। এটা কম সাফল্য নয়। সে সময় স্কুলে বনিকে নিয়ে বেশ হইচইও হয়। বনি পত্রিকাটা বগলে নিয়ে বসে আছে। ও ওর এই সাফল্যের কথা আজ বলবে, লেখাটাও পড়ে শোনাবে। তিমির খুব ভাল নারকেলের মালার কাজ জানে। ওর বাবা এক জন হস্তশিল্পী। তিমির বাবার কাছে কাজ শিখে, নারকেল মালা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বানিয়েছিল এ বছর জেলার হস্তশিল্প মেলায়। ওর কাজ দেখে মেলা কর্তৃপক্ষ ওকে সেরা শিশু হস্তশিল্পীর পুরস্কার দিয়েছিল। তিমির ওর বাবাকে নিয়ে এসেছে। বাবাকে নিয়েই ও মঞ্চে উঠবে। তবে ওর কাজ নিয়ে যা বলার তিমিরই বলবে। একেবারে কোনায় বসে আছে অনির্বাণ। ক’দিন আগে রাজ্যের অনূর্ধ্ব চোদ্দো ক্রিকেট দলে ও নির্বাচিত হয়েছে। এমন সাফল্য এই স্কুলে তো বটেই আশেপাশের স্কুলগুলোতেও আজ অবধি আসেনি। অনির্বাণের হয়ে বলার জন্য গেমসটিচার তৈরি হয়ে রয়েছেন।

এমন সব কৃতীর মধ্যে কেবল এক জনই অকৃতী। রিদয়। একেবারে নিভে যাওয়া মুখ নিয়ে ও বসে আছে জড়সড় হয়ে। ওর আজ কিছুই বলার নেই। কারণ, অঙ্কস্যরের ভাষায়, রিদয় মানেই একটা বড় শূন্য। না পড়া না অন্য কিছু, রিদয় নেই কোনও দিকেই। এ বারে যিনি ওদের ক্লাসটিচার, তিনি বলেন, ‘ভাগ্যিস এইট অবধি পাশফেল নেই! পাশফেল থাকলে তো রিদয়ের এই স্কুল ছেড়ে যাওয়াই হত না।’

রিদয়ের বাবা নেই। ওর মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করেন। খুব সামান্যই আয়। তবে রিদয়ের তাতে অসুবিধে নেই। দুপুরের খাওয়াটা স্কুলেই হয়ে যায়। রাতে কিছু জুটলেও চলে, না জুটলেও। খিদেরপেটে খায় বলে দুপুর দেড়টায় মিড ডে মিলটা ও একটু বেশিই খেয়ে ফেলে।

রিদয়ের বাড়িতে ওর পড়ার ব্যাপারে বারে বারেই চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনও উন্নতি হয়নি। রিদয়ের মা একটু আধটু লেখাপড়া জানেন। কিন্তু সারা দিন লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে তিনি ওর দিকে কী ভাবে নজর দেবেন! রিদয় কিন্তু বরাবর এত খারাপ ছিল না। ফাইভে ভর্তির আগে পর্যন্ত তো ও খুবই ভাল। এর পর ফাইভ-সিক্সটাও কোনও রকমে গিয়েছে। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ল সেভেনে। পড়াতে কিছুতেই মন বসাতে পারল না। পড়া না করে অবশ্য ও বাজে কোনও দিকে মন দেয়নি। কিন্তু যা করেছে, সেটা তো একেবারে অকাজ। অন্তত ওর মা’র মতে। মা’র কথা অবশ্য ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। কেননা, ও সব না করে যদি ও নিজের দিকে একটু নজর দিত, তা হলে হয়তো স্কুলে ওর রিদয় নামটা পাল্টে ‘বড় শূন্য’ হত না। রিদয় এ ব্যাপারটা বোঝে না, তা নয়, কিন্তু পাড়ার খেলার সাথিদের প্রতি ওর একটা দায়িত্বও তো আছে! পড়ার সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না। বন্ধুদের দিকটা একটু সামলে উঠলেই নিজের পড়ার দিকে মন দেবে, এমনই রিদয়ের ভাবনা।

রিদয়ের স্কুলটা যেহেতু বাড়ি থেকে পাঁচ কিমি দূরে এবং ওর সঙ্গে ওদের গ্রামের কেউ পড়েও না, তাই ওর পড়াশোনার ক্রমাবনতির আসল কারণটা অন্যজনবাহিত হয়ে স্কুলে এসে পৌঁছয়ওনি। রিদয় এতে অবশ্য বেশ নিশ্চিন্তই বোধ করে। কারণ, এমনিতেই ও অঙ্কস্যরের বড় শূন্য, ও সব খবর স্কুলে এসে পৌঁছলে নতুন আবার কী উপাধি জুটে যেত, কে জানে!

কিন্তু আজকের দিনটা ও পার করবে কী ভাবে! উজ্জ্বল আর অনির্বাণ সুপরামর্শ দিয়েছিল। বলেছিল, ‘তুই বরং সাফল্য দিবসে অ্যাবসেন্ট হয়ে যা।’ কিন্তু সাফল্য দিবস হল এই স্কুলে ওর শেষ দিন। এমন একটা দিন মিস করা কি ঠিক? কিন্তু স্টেজে উঠে কিছু তো বলতেই হবে। বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলবে কি? না থাক। মিথ্যা কথা বলার চেয়ে সবার কাছে সত্যি কথাটা বলে মাপ চেয়ে নেওয়া ভাল। রিদয় ঠিক করল, এখনও ও কোনও ক্ষেত্রেই যে সফল হতে পারেনি, বলবে সেটাই।

একত্রিশ জন একে একে মঞ্চে কেউ একা, কেউ শিক্ষকসহ, কেউ অভিভাবকসহ উঠে তাদের সাফল্য তুলে ধরল। এ বারে রিদয়ের ডাক।

ছাত্রদের মধ্যে ফিসফাস। মাস্টারমশায়রা অস্বস্তিতে। সবাই চাইছে সাফল্য উৎসবের এই অংশটা যত তাড়াতাড়ি পার হয়। বনি উজ্জ্বলের কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘তোরা বারণ করেছিলি, তবু দেখ বড় শূন্যটা এসেছে। স্যরদের মাথা হেঁট না করালেই ওর চলছিল না!’

ছেঁড়া জামা আর ছেঁড়া প্যান্ট পরা ছেলেটা কিন্তু ততক্ষণে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। সত্যের সম্মুখীন হওয়ার জন্য ও প্রস্তুত। স্টেজের দিকে এগোতে থাকে মাথা উঁচু করেই। কিন্তু স্টেজে ওঠার পরে ও কিছু বলার আগেই বাধা। ঘোষণা, ‘রিদয় হালদারের কথা আমরা শুনব। কিন্তু তার আগে ওর হয়ে স্থানীয় সবুজ সঙ্ঘের সেক্রেটারি জীবেশ সিংহরায় কিছু বলবেন।’
রিদয় অবাক। সবুজসঙ্ঘের সেক্রেটারিকে ও চেনেও না। অথচ ওর হয়ে উনি...।

সবুজ সঙ্ঘের সেক্রেটারি মঞ্চে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ান। রিদয়ের মতো বিস্মিত অবস্থা স্কুলের সব শিক্ষক এবং ওর ক্লাসের বন্ধুদের।

জীবেশবাবু শুরু করেন, ‘সমবেত সুধীবৃন্দ, এই ছেলেটির সাফল্যের কথা আমি শুনেছি আজ সকালেই। আমাকে কেউ বলেনি, আমি নিজেই এসেছি এখানে ওর কথা আপনাদের সবাইকে জানাব বলে। তবে তার আগে আমি মঞ্চের সামনে জামিল, তুহিন, শুভ্র তোমাদের সবাইকে আসতে বলছি।’

এক দঙ্গল ছেলে হলঘরে ঢুকে মঞ্চের নীচে এসে দাঁড়ায়।
‘এরা আবার কারা!’ উজ্জ্বল অনির্বাণদের আজ যেন বিস্ময়ের শেষ নেই।

জীবেশবাবু বলেন, ‘এই যে দলটা দেখতে পাচ্ছেন, এরা সংখ্যায় তিরিশ জন। এদের পরিচয়? এরা সবাই শিশুশ্রমিক। এদের আরও একটা পরিচয় আছে। এরা সবাই রিদয়ের বন্ধু। শুনলে অবাক হবেন এরা কেউ স্কুলে যায়নি কোনও দিন, তবু এরা আজ সবাই সাক্ষর। সবাই লিখতে পারে, পড়তে পারে। এদেরকে এই জায়গায় কে নিয়ে এসেছে জানেন? আমার পাশে দাঁড়ানো এই ছোট্ট ছেলেটা। গত দু’বছরের চেষ্টায় ও এই বিরাট সাফল্যের নজির গড়েছে।’ সারা সভা জুড়ে তুমুল হাততালি। জেলাশাসক চেয়ার ছেড়ে উঠে আসেন। রিদয়কে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, ‘তোমার সাফল্যের জন্য শুধু শিমুলতলা জুনিয়র হাইস্কুল নয়, গোটা রাজ্য গর্ব করতে পারে।’

রিদয়ের কাণ্ড শুনে ওর স্কুলের বন্ধুরা তো তাজ্জব। আর বড় শূন্যের দিকে তাকিয়ে শুধু অঙ্কস্যরের নয় অন্য স্যরদের চোখের কোনায়ও ততক্ষণে একটা করে জলের বড় শূন্য তৈরির প্রস্তুতি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy