Advertisement
E-Paper

মালালা’র নোবেল

কোন কীর্তির জন্য দেওয়া হল? গুলি খাওয়ার জন্য? না কি তাঁকে একটা প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হল? সেই প্রতীকের খাঁচা থেকে তিনি কখনও বেরোতে পারবেন?শাজিয়া রমজান আর কাইনাত রিয়াজ-কে চেনেন আপনারা? না? দোষ আপনাদের নয়। ওদেরই সহপাঠী মালালা ইউসুফজাইয়ের মতো ওরা অত বেশি মিডিয়ালোকিত হয়নি যে! ঠিক দু’বছর আগের এক অক্টোবর-দুপুরে, যখন স্কুলবাসে বাড়ি ফিরছিল পাকিস্তানের সোয়াট জেলার খুশাল স্কুলের ছাত্রীরা, শাজিয়াই প্রথম দেখেছিল, কালো মুখোশপরা একটা শরীর ঝুলছে স্কুলবাসের এক পাশ থেকে। হিসহিসে গলায় সেই লোকটা যখন জিজ্ঞেস করে, ‘মালালা কার নাম?’

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫

শাজিয়া রমজান আর কাইনাত রিয়াজ-কে চেনেন আপনারা? না? দোষ আপনাদের নয়। ওদেরই সহপাঠী মালালা ইউসুফজাইয়ের মতো ওরা অত বেশি মিডিয়ালোকিত হয়নি যে! ঠিক দু’বছর আগের এক অক্টোবর-দুপুরে, যখন স্কুলবাসে বাড়ি ফিরছিল পাকিস্তানের সোয়াট জেলার খুশাল স্কুলের ছাত্রীরা, শাজিয়াই প্রথম দেখেছিল, কালো মুখোশপরা একটা শরীর ঝুলছে স্কুলবাসের এক পাশ থেকে। হিসহিসে গলায় সেই লোকটা যখন জিজ্ঞেস করে, ‘মালালা কার নাম?’, ভয়-আতঙ্কের রিফ্লেক্সে শাজিয়ার চোখ চলে গিয়েছিল ওর ডান দিকে বসে থাকা মালালা ইউসুফজাইয়ের দিকে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে মালালার মাথায় গুলি করে লোকটা, চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ে সে। তারও পরে আরও তিনটে বুলেট বেরিয়েছিল লোকটার বন্দুক থেকে। একটা শাজিয়ার বাঁ কলার বোন ফুঁড়ে ঢুকে যায়, একটা লাগে হাতে, যে হাত গিয়ে নিজেকে আড়াল করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে চাইছিল সে। শেষ গুলিটা বেঁধে শাজিয়ার বাম দিকে বসা কাইনাত-এর কাঁধে।

চারটে বুলেটে যেখানে মৃত্যুর ড্রপ-সিন পড়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তৈরি হল রূপকথা, ইতিহাস। মালালাকে ঘিরে। এবং শুধুই মালালাকে ঘিরে। কেন হবে না, তালিবানি ফতোয়া পরোয়া না করে দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে যাওয়ার, স্কুলে যাওয়ার, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে তো ওই পনেরো বছরের মেয়েটাই। শুধু নিজে গিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, শাজিয়া-কাইনাতদেরও বুঝিয়ে তুলে নিয়েছে স্কুলবাসে। জীবন বাজি রেখে রোজ বাড়ি-স্কুল, স্কুল-বাড়ি করেছে। তালিবান-তর্জনী তোয়াক্কা না করে ওই অজ পাড়াগাঁর মেয়েদের পড়াশুনোর অধিকার নিয়ে কথা বলেছে, বিবিসির হয়ে লিখেছে ব্লগ। ও-ই তো টার্গেট। তাই গুলি খেয়েছে মাথায়। তো গুলি খেয়েও মরে যেতে যেতেও যে মেয়ে মরে যায় না, খবরকাগজ-টিভি-ইন্টারনেট-সোশাল মিডিয়ার মধ্য দিয়ে যাঁর কথা ছড়িয়ে পড়ে বুলেটের থেকেও তুরন্ত, তার জন্য গোটা বিশ্বের হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করবে না? দলাই লামা থেকে বারাক ওবামা, পৃথিবীর তাবড় ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্রনেতাদের স্নেহ-সিমপ্যাথি আছড়ে পড়বে না? পাকিস্তান থেকে সটান প্লেনে ইংল্যান্ড উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না তাকে বাঁচাতে? তার পর এক দিন সে চোখ মেলে চাইলে, ঠোঁট নাড়ালে, নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালে, সেটাই তো রূপকথার রাজকন্যার মতো কামব্যাক। প্রবলেমজর্জর পৃথিবীর নতুন আইকন-লাভ, আইডল-প্রাপ্তি। আর রোল মডেলের পায়ে সর্বস্ব নিবেদন এই গ্রহের বাসিন্দাদের সহজাত।

এবং সহজাত কিছু চোখে-আঙুল-দাদাগিরি। প্রশ্নবোধক আঙুল তোলা। পেল্লায় নিন্দুকরা বলেছে, শাজিয়া বা কাইনাত মাথায় গুলি খেলে কি ওদেরও উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত বিদেশে, আর ওরাও নোবেল পেত? এতটা কর্কশ যাঁরা নন, তাঁরা বলছেন, মালালা কি সত্যিই এই পুরস্কার ডিজার্ভ করেন? সব পুরস্কারেরই সুনির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতামান থাকে। আলফ্রেড নোবেল নিজে লিখে গেছেন: যে মানুষটি বিভিন্ন দেশের মধ্যে সৌহার্দ্য আনা, বা সক্রিয় সেনাবাহিনী বিলোপ বা অন্তত কমানো, বা বিশ্বব্যাপী শান্তি-সম্মেলন সংগঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল কাজ করবেন, শান্তি পুরস্কার দেওয়া হবে তাঁকেই। প্রশ্ন : মালালা এই কাজগুলোর কোনটা করেছেন যে তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হল? তালিবান-পীড়িত পাকিস্তানে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলাটা একটা বড়, সুদূরপ্রসারী আন্দোলনের সূত্রপাত নিশ্চয়ই। কিন্তু সে আন্দোলনটা সময় নিয়ে ডালপালাশেকড় না ছড়াতেই, নিজের দেশ-গাঁ-সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে আবিশ্ব প্রভাব না ফেলতেই যখন সতেরো বছরের একটা মেয়েকে দুম করে নোবেল দিয়ে দেওয়া হয়, কাঁটা খচখচ অনিবার্য: জঙ্গির গুলি খাওয়াটাই কি তবে ওঁর পোর্টফোলিয়োর সবচেয়ে জ্বলজ্বলে পয়েন্ট! আহা বাছা, গুলি খেয়েছ? নোবেল দিয়ে দাও। কে কবে কী নিয়ম লিখে গেছে, মার গুলি!

শান্তির নোবেল নিয়ে বরাবর গুচ্ছের নালিশ-বিতর্ক থইথই। এ পুরস্কারের এমনই ফর্মা, মহাত্মা গাঁধী পাঁচ বার নমিনেশন পেয়েছেন, পুরস্কারটা এক বারও পাননি! অনেকেই বলেন, এটা আসলে কোনও স্বীকৃতি নয়, বরং রাজনৈতিক হাতিয়ার। পুরস্কারটা দেয় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি, তাতে থাকেন ৪ জন রাজনৈতিক নেতা আর ১ জন উকিল। এই কমিটিকে বাছে নরওয়ের পার্লামেন্ট! যে প্রাইজের ব্যাকড্রপে ভর্তি পলিটিক্সের লোকজন, সেটা রাজনৈতিক হাতিয়ার হবে, খুব আশ্চর্য কি? এখানে কে পুরস্কার পাচ্ছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিষয় বা ইস্যুটা গুরুত্বপূর্ণ, যেটার দিকে সারা বিশ্বের চোখ ঘুরিয়ে দিতে হবে। ২০০৯-এ ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ন’মাসের মাথায় নোবেল পেতে তুমুল হাসাহাসি। আসলে ওটা নোবেল কমিটির মেসেজ: শান্তির পথে চলো বাপ, ঝামেলা কোরো না। (ছক চেনা চেনা লাগছে? শক্তিমান বুদ্ধিজীবীর হাতে একটা অমুকশ্রী তমুকবিভূষণ ঠুসে দাও, সে অন্তত কিছু কাল চুপচাপ থাকবে।) বা, বহু বার এমন হয়েছে, শান্তির নোবেল দেওয়া হয়েছে এমন মানুষকে, যাঁর দেশ রাজনৈতিক হিংসায় বা সামাজিক-ধর্মীয় কোঁদলে গরগরে হয়ে আছে। ১৯৯১-এ আউং সান সু চি, ’৯৪-এ ইয়াসের আরাফত-সাইমন পেরেস, ২০১০-এ লিয়োউ চিয়াপাও। ২০১৪-তে, যখন ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক ফের টালমাটাল, নোবেল শান্তি-দূত হিসেবে বাছা হল দুই ঝগড়ুটে প্রতিবেশী দেশের দুই মানুষকে। সমাপতন?

আরও প্যাঁচ আছে। মালালা বিদেশ গেলেন, নতুন জীবন-যশ-সম্পত্তি-প্রতিপত্তি পেলেন, আর সেই উড়ান-গ্রাফের ধাপে ধাপে ঘাপটি মেরে থাকল সাহেবদের কলারতোলা রেলা: তোরা, কালোরা, নেটিভরা, কোনও দিন যা পারিসনি, আমরা এক ঝাপটায় কেমন করে দেখালুম! তোদের দেশের একটা মেয়ে, ‘শিক্ষা চাই, শিক্ষা দাও’ বলতে গিয়ে অসভ্য বর্বর জঙ্গির হাতে গুলি খেল। ন্যালাক্যাবলা তোরা ওকে আদৌ বাঁচাতে পারতিস, যদি না আমাদের সাঁইসাঁই প্লেনে চাপিয়ে আমাদেরই দেশের তকতকে হাসপাতালে উড়িয়ে নিয়ে আসতাম? মেয়েও তোদের, জঙ্গিও তোদের। আর আমরা? রক্ষক, সেভিয়ার, মসিহা! মালালাকে জীবন দিলাম, হাতে ঢেলে দিলাম পাকা ঘর-ইশকুল-খেলার মাঠ-লাইব্রেরি-নাগরিকত্ব। যে কথাগুলো তোদের মাটিতে বলতে গিয়ে মেয়েটার জান চলে যাচ্ছিল, সেই কথাগুলোই বলতে তক্ষুনি বরাত দিলাম য়াব্বড় মাইক্রোফোন, পোডিয়াম, স্টেজ, মিডিয়া, পাবলিক রিলেশন্স ম্যানেজার। এই মেডেল, ওই ডিগ্রি, সেই ইনভিটেশন দিয়ে তিলে তিলে ওঁকে গড়লাম, আর দিনশেষে করে তুললাম নিটোল নিখুঁত একটা সিম্বল। পশ্চিমি, সাদা, সাহেব সভ্যতা কী করতে পারে, তার জলজ্যান্ত লোগো হল মালালা ইউসুফজাই। মেয়ে যা ছিল, মেয়ে যা হয়েছে। তার মানে কী? মানে, নেটিভদের উদ্ধার করবে শেষমেশ এই সাদা চামড়াই। মূর্খ, অশিক্ষিত, বর্বর দেশগুলোয় মানবিকতা প্রতিষ্ঠার পবিত্র দায় আমাদের। সেই গুরুদায়িত্ব পালন করতেই তো আফগানিস্তানে, ইরাকে সেনা-অভিযান করছি, ড্রোন ছাড়ছি। সারা পৃথিবীকে বিশ্বাসও করিয়ে ছাড়ছি, অমুক জাত-ধর্মের মানুষ মানেই ফিদায়েঁ জঙ্গি, জঘন্য। শেক্সপিয়র-এর নাটকে প্রভু প্রস্পেরোর দুই চাকর ছিল, সুভৃত্য এরিয়েল আর কুভৃত্য ক্যালিবান। মালালা এরিয়েলের মতো। লক্ষ্মী মেয়ে, গুড নেটিভ। কক্ষনও আমাদের মিসাইল ছোড়ার সমালোচনা করবে না। কোন প্রাণেই বা করবে? ওকে তো নোবেল দিলাম, এখন ও দেশবিদেশ ঘুরুক। রাষ্ট্রপুঞ্জে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দিক। আমরাও ক্যালিবানদের ঢিট করে যাই।

তা হলে মালালা স্রেফ দম-দেওয়া কলের পুতুল? বৃহত্তর স্বার্থ-হুইলে একটি চকচকে স্পোক? নোবেল শান্তিযজ্ঞে ললিত বলির-পাঁঠা? ছি ছি, কী বলছেন! একটি পত্রিকা বলছে, উনি এই শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী পঁচিশ জনের এক জন। উনি আজ বেকহ্যাম, কাল বিল গেট্স, পরশু পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে স্টেজ শেয়ার করেন। এই নোবেল পাওয়ার পর আরও কত শত লক্ষ লাল কার্পেট মোড়া মঞ্চে ওঁকে শিক্ষার অধিকার নিয়ে বলতে ছুটতে হবে! আর সেই ছোটাছুটির ফাঁকে কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটবে, কখন খসে পড়ে যাবে ওঁর কৈশোর, যৌবন, অনাবিল স্বাভাবিক জীবনের অধিকার! ওঁর কি এখন বন্ধুদের সঙ্গে ফিশফ্রাই-ঝালমুড়ি-ফুচকা খাওয়ার, হ্যারি পটার কি চাঁদের পাহাড় পড়ে অবাক বিস্ময়ে একলা ভাবার, আইনক্সে ভূতের ছবি দেখে পাশের জনের হাত চেপে ধরার, ফিজিক্স কোচিংয়ের বড়-বড়-চোখ ছেলেটার মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে ফিরে তাকানোর সময় আছে? আঃ, বড় বড় মানুষরা ও-সব সিলি নাথিংস নিয়ে মাথা ঘামান না।

ভাবতেই কেমন লাগে, একটা সতেরো বছরের মানুষকে ‘মনীষী’ বানিয়ে দেওয়া হল! সে একটা উত্তুঙ্গ স্ট্যাচু হয়ে, প্রাতঃস্মরণীয় মহীয়সী হিসেবে হাঁটা চলা দাঁড়ানো তাকানোয় দণ্ডিত হয়ে গেল! সে তো মালালা নয়, একটা জ্বলজ্বলে, মহিমময় প্রতীক! বুক ফেটে গেলেও, সে পার্কের রাস্তায় বান্ধবীর গলা জড়িয়ে বা চিনেবাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারবে না। বোকা-বোকা চুটকি শুনে খি-খি করে হেসে উঠতে পারবে না। তাকে হয়ে উঠতে হবে সদা-তাৎপর্যপূর্ণ, নবীনতম নোবেল লরিয়েটের ইমেজের যোগ্য এক মেয়ে, চাইলেও তার ঠোঁট থেকে কক্ষনও সইসুলভ এলাটিং-বেলাটিং খসবে না, যা বেরোবে সব মনীষীবাক্যি, কোটেশন!

আর বন্ধুরাই কি খুব সহজ হতে পারবে ‘ওঁর’ সান্নিধ্যে? ক্লাসরুমে বা ক্যান্টিনে পাশে বসতে তো তাদের গা কাঁপবে! এ তো মানুষ নয়, ইতিহাসের একটা গোটা চ্যাপটার! তারা গভীর বিষয় নিয়ে নম্র স্বরে শ্রদ্ধানত মাথায় মালালার সঙ্গে আলোচনা করবে। তার পর টিফিনটাইমে বাস্তব বন্ধুদের সঙ্গে লঘু স্বতঃস্ফূর্ত খুনসুটি করতে করতে লাফাতে লাফাতে বাড়ি যাবে। কোন ছোকরার সাধ্য আছে, মালালাকে বলবে, অ্যাই তোকে আজ খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে তো!

পনেরো বছরের একটা মেয়ে, চক-ডাস্টার-ব্ল্যাকবোর্ড-রোলকলওলা একটা সুন্দর শৈশব চেয়েছিল। সেই চাওয়াটাকে মান্যি করা হল ঠিকই, কিন্তু তার বদলে, তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল হাসিকান্নাঝগড়াবাগড়ায় নির্মল সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ। এখন সে পাকিস্তানেরও নয়, ইংল্যান্ডেরও নয়, সর্ব ক্ষণ শুধু গুরুত্বপূর্ণ মিশন আর সুদূরপ্রসারী ভিশন-এর রাজ্যের বাসিন্দা। তবে সে জিতল না হারল?

iwritemyright@gmail.com

sisir roy malala yousafzai malala rabibasariya anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy