Advertisement
E-Paper

মায়ের ভালবাসা

ও সে-ই। আপনারা কিছু মনে করতে পারছেন না? আমার মেয়ে মারিয়াননে, যে আমার পাশে, এই দোলনাতে বসে আছে, ও-ই সে। এই ক’বছরে যে ঝড় আমার ওপর দিয়ে গেল, তা আন্দাজও করতে পারবেন না। এমন মেয়ে যদি আমার না হত, নিশ্চিত ভাবে আমি প্রতি সোম-বেস্পতি এই সভাতে আসতাম না। আপনারা জানেন না, ছোট থেকে ও কী পরিমাণ বাঁদর হয়েছে! একটা দুর্দান্ত মিষ্টি খুকি ছিল, হাসিখুশি, বাধ্য। ওকে ওর ছোট্ট গাড়িটা করে ঠেলতে ঠেলতে হাঁটতে বেরোতাম, একশো মিটার যেতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগত।

আলমুদেনা গ্রান্দেস (স্পেন)

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০০:০০

ও সে-ই। আপনারা কিছু মনে করতে পারছেন না? আমার মেয়ে মারিয়াননে, যে আমার পাশে, এই দোলনাতে বসে আছে, ও-ই সে। এই ক’বছরে যে ঝড় আমার ওপর দিয়ে গেল, তা আন্দাজও করতে পারবেন না। এমন মেয়ে যদি আমার না হত, নিশ্চিত ভাবে আমি প্রতি সোম-বেস্পতি এই সভাতে আসতাম না। আপনারা জানেন না, ছোট থেকে ও কী পরিমাণ বাঁদর হয়েছে! একটা দুর্দান্ত মিষ্টি খুকি ছিল, হাসিখুশি, বাধ্য। ওকে ওর ছোট্ট গাড়িটা করে ঠেলতে ঠেলতে হাঁটতে বেরোতাম, একশো মিটার যেতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগত। কারণ ও অ্যাত্ত মোটাসোটা, অ্যাত্ত ঝকঝকে রং, অ্যাত্ত হাসিখুশি... মা-মাসিরা সব্বাই ওকে দেখে আদর করার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ত। বড় হওয়ার পর, ইস্কুলেও দিদিমণিরা বলতেন এত খোলামেলা, এত মিশুকে, সবার সঙ্গেই বনিবনা করে থাকতে পারবে। কে জানত, সেটাই ওর প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। যার-তার সঙ্গে চলে যাবে!

বয়ঃসন্ধির সময়ে অবাধ্য হতে শুরু করল। কুড়ি পূর্ণ হওয়ার আগেই ওর প্রিয় কাজ হয়ে দাঁড়াল আমাকে অসভ্য কিছু দৃশ্যের স্বাদ নিতে বাধ্য করা। একটা বুনো জন্তুর মতো। চিৎকার করে, পা দাপাদাপি করে, অদ্ভুত, উত্তপ্ত, বিশ্রী কাজকর্ম, কী লজ্জা! সমস্ত প্রতিবেশী ওর গলা শুনছিল। আমার ওপর এত গায়ের জোর ফলাচ্ছিল... যখন থেকে সামান্য মদ্যপান শুরু করি, মনে হয় তখন থেকেই এটা শুরু হয়েছিল। আমি স্বীকার করছি। আমি জানি এটা কোনও ভাল কাজ নয়। কিন্তু মারিয়াননে বাইরে, চারপাশে বিপদের মাঝখানে, আশেপাশে গরিব বস্তির ছেলে সব। সেই বিষাক্ত সব ছেলেমেয়ে, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, মদের গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন খুশি নরকের মতো সব আচার-আচরণ করত, অতগুলো পুরুষের গায়ের ঘামের মধ্যে; আর স্কুটারগুলো। ওগুলোকে সবচেয়ে ভয় লাগত। মারিয়াননে একটা স্কুটারে যদি চড়ে, এখন যে পরিমাণ দুর্ঘটনা হয়, আর যে ধরনের ধর্ষণকারী, খুনি, ড্রাগ অ্যাডিক্ট, বিদেশি যাদের এ সবের কোনও অধিকার নেই, তার পর ওর মতো কোনও পরিকে তার মোটরে চড়ানো এবং তার পর একটা নরকে গিয়ে থাকা... সব কিছু, সঅবকিছু আমি চেষ্টা করেছি শান্তি বজায় রাখার জন্য। কিন্তু মেয়েটা আগেকার মতো বাড়িতে পার্টি দিতে রাজি হল না। বলল, ওর বন্ধুরা আসতে চায় না, তাই মাঝরাতগুলোয় ও নিজে তাদের ওখানে চলে যায়। আর আমাকে একা ফেলে রেখে যায়। আমি এক পেগ হাতে নিয়ে সময় কাটাই। তার পর আর একটা, আরও এক।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী

এ কথা ঠিক যে সবচেয়ে খারাপ বিষয়টা তখনও আসেনি। জঘন্য ব্যাপারটা হল, ছেলেটার উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশি ছিল না। কালো চুল, কোঁকড়া, লম্বা আর অদ্ভুত মুখ, সীমাহীন চালাক, মোটা দুটো ঠোঁট না শুধু মোটা না, ভীষণ মোটকা। ঠিকঠাক করে বললে সেগুলো বাঁদরের ঠোঁটের মতো। ও ট্রাম্পেট-বাজিয়ে। ওই ঠোঁট দিয়ে আর কী-ই বা সে করতে পারত! জন্ম ‘এল সালভাদর’-এ। ভাবা যায়? আপনারাই বলুন, কোনও ইউরোপিয়ান রক্ষণশীল মা মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে, যখন সে দেখে যে তার একমাত্র মেয়ে কোনও সালভাদরবাসীর সঙ্গে প্রেম করছে? সেই জন্য আমি মারিয়াননেকে বললাম, দুজনের মধ্যে এক জনকে বেছে নাও। ও বেছে নিল। ছেলেটার সঙ্গে থাকার জন্য বাড়ি থেকে চলে গেল।

পরের তিন বছর খুব কম, কোনও কোনও রবিবার খাওয়ার সময় আসত। বুঝতে পারছিলাম, আমার খারাপ ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল। তবে, মেয়েটার ব্যবহার দিন-কে-দিন আমার চেয়েও বাজে হয়ে যাচ্ছিল। সালভাদরবাসীর পরে এক জন পাকিস্তানি এল। তার পরে এক জন আলজিরীয়, শেষমেশ আমেরিকার সেই টেররিস্ট মুর ছেলেটা। সবচেয়ে অশান্তিবাজ ছোকরা। তার পরের ছেলেটা সম্পর্কে মারিয়াননে বলল, ও এক জন বিখ্যাত ফোটোগ্রাফারের মডেল ছিল। সেই ফোটোগ্রাফার এখন এড্স রোগে মারা গিয়েছে। মারিয়াননে বলেই যাচ্ছিল, ছেলেটা এখন ফ্যাশন আইকন, কারণ ওর প্রদর্শনীগুলো সেন্সর করা হয়েছিল... শেষ পর্যন্ত যখন ছবিগুলো দেখলাম, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যাব। ‘এমন মুখ করে থেকো না মা’, বলল সে, ‘আরে, এগুলো অনেক পুরনো ছবি। এটা ঠিকই, ও হোমোসেক্সুয়াল ছিল, তবে এখন ও মেয়েদেরও পছন্দ করে। আমি কখনও এত সুখী থাকিনি মা...!’ আমি তিন দিন মাতাল হয়ে ছিলাম। পুরো তিনটে দিন, যত ক্ষণ না ছেলেটার সঙ্গে ও স্কুটার চড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

এই রকম পরিস্থিতিতে, আপনারা বুঝতেই পারবেন, দুর্ঘটনাটা আমার মনে হয়েছিল ঈশ্বরের দান। মারিয়াননে বাড়িতে ফিরে এল। ওর বিছানায়, চারপাশে ওর পুতুলগুলো আর টেডি বেয়ারগুলো ওগুলো যেন নতুনের মতো ছিল। কারণ মেয়েটা আমাকে ছেড়ে যখন চলে গেছিল, তখনও আমি নিজের হাতে ওগুলোকে হালকা ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে কেচে রাখতাম। মারিয়াননে যখন ঘুমোত, আমি ওর পাশে বসে ওকে দেখতাম। এত সুখ হত, মনে হত এক পেগ পানীয় নিয়ে সেই আনন্দ উদ্যাপন করি। যখন ও জেগে উঠত, সমানে বলত যে ওর প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, আমি সহ্য করতে পারতাম না। তাই আর এক পেগ পানীয় নিয়ে বসতাম, যাতে মনে দম নিতে পারি। আর ওকে আরও একটা ওষুধের বড়ি দিতাম। ডাক্তারবাবু খুব বিরক্তিকর লোক ছিলেন। একশো বার করে উপদেশ দিয়েছিলেন, ওষুধের মাত্রা যেন বেশি না হয়, তা হলে সাংঘাতিক বিপদ! কিন্তু ওই সব ডাক্তাররা এক জন মায়ের কষ্ট কী করে বুঝবে...! মারিয়াননে সেরে উঠছিল। মুখে রং ফিরে আসছিল। ত্বকের ওপরের ঘা-গুলো শুকিয়ে সমান হয়ে আসছিল। আর ওর আগের স্বভাবও ফিরে আসছিল। ঘরকুনো, বাধ্য, মিষ্টি। আমি ওর মুখে সেই আশ্চর্য ওষুধের বড়ি ঢুকিয়ে দিতাম, ও ওর মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিত, যাতে গিলতে সুবিধে হয়। ওর সাদা চোখ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে হাসত। অনেক ঘণ্টা ধরে ঘুমোত। ঠিক ছোটবেলার মতো। রাতে আমার পাশে বসত টিভি দেখার জন্য। কখনও চ্যানেল পালটাতে বলত না। আমরা দুজন একসঙ্গে। সুখী। আবার।

যখন ওই ডাইনিটা আমাকে বলল, প্রেসক্রিপশন ছাড়া এই ওষুধ আর বিক্রি করবে না, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল। ঠিক করলাম, এখানে এসে থাকার জন্য সব বিক্রি করে দেব। এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে আমার ইস্কুলের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু থাকে। ও এখন একটা ওষুধের দোকানের মালিক ও ফার্মাসিস্ট। প্রচুর ওষুধের ভাঁড়ার আছে ওর। বড় অসুখের বেশি ওষুধ এ কথাই ও আমাকে বলেছে। মারিয়াননে এই খোলামেলা পরিবেশে থাকতে খুব পছন্দ করছে। কক্ষনও কিছু বলে না। কিচ্ছুর জন্য অভিযোগ জানায় না। শুধু হাসে।

ছেলেটা? ছেলেটার নাম ক্লাউস। ও আমার মেয়ের প্রেমিক। ব্যাংকের ক্যাশিয়ার ছিল। ওকে প্রথম দেখেই ভেবেছি, মারিয়াননের সঙ্গে দারুণ মানাবে। লম্বা, রোগা, দারুণ দেখতে। অনেক দিন আগেকার সেই জন্তুগুলোর সঙ্গে কোনও মিল নেই। আর যথেষ্ট সাদাসিধে হ্যাঁ ম্যাডাম, আচ্ছা ম্যাডাম। যদিও সত্যি বলতে কী, আমার মনে হয় একটু অভদ্র। প্রথম দিন বললাম, আমার একটি খুব সুন্দরী মেয়ে আছে, ডিনারে নিমন্ত্রণ করলাম। এলো না। কয়েক দিন পরে মারিয়াননের একটা ছবি দিলাম। আবার ডিনারে নিমন্ত্রণ করলাম। আবার এড়িয়ে গেল।

কিন্তু দিদিমা হওয়ার ইচ্ছে আমি ছাড়িনি, সে কথা সত্যি। আমার মারিয়াননের বয়স তিরিশ হতে চলল। বিয়েতে খুব আনন্দ-ফুর্তি করব, আঞ্চলিক বিয়ের পোশাক পরব। একটু ছোট্ট চোখের জল ফেলব যখন সে পাদ্রীর সামনে বলবে, ‘হ্যাঁ’। এই আনন্দ কোনও মা ছেড়ে দিতে পারে! তাই এক দিন পেছন দিক থেকে ক্লাউসের দিকে এগিয়ে গেলাম। তার পর আমার মৃত স্বামীর পিস্তলটা তার বাঁ-দিকের রগে ঠেকিয়ে: শোনো ক্লাউস! আমার সঙ্গে এসো। ‘আমাকে ছেড়ে দিন ম্যাডাম। ওপরে যা রাখা আছে, সব আপনাকে দিয়ে দেব।’ খুব উদ্ধত ছেলেটা। ‘কিন্তু এটা কোনও ব্যাংক-ডাকাতি নয় বাছা’, আমি বললাম, ‘এটা একটা অপহরণ!’ গুবরে পোকা একটা। কাঁদতে শুরু দিল। কচি খুকির মতো ফোঁপাচ্ছিল!

এখন আমরা তিন জন একসঙ্গে থাকি। মারিয়াননে, ক্লাউস আর আমি। এটা কখনকার তোলা ছবি? দিন চারেক আগেকার... হ্যাঁ, ঠিক, ছেলেটাকে খুব সুখী মনে হচ্ছে না। সব সময় পালানোর সুযোগ খোঁজে। রাতে যাতে ও পালাতে না পারে, তার জন্য ওকে বিছানায় শেকল দিয়ে আটকে রাখি। তবে ওর অভ্যেস হয়ে যাবে। ক্লাউস বাড়ির সমস্ত কাজ করে আর আমি ওর পিছু-পিছু যাই, পিস্তলটা নিয়ে। মারিয়াননে? ওর কাছে সব কিছুই ভাল ঠেকে। আপনারা তো দেখেছেন কেমন করে হাসে ও। দু’হাত ছড়িয়ে... একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে? ইয়ে, যত দিন ধরে ও ওষুধটা খায়, হাত দুটো খুব দুর্বল হয়ে গেছে। নড়াচড়া করে এত হঠাৎ হঠাৎ, এত ছাড়া-ছাড়া... এতে আমার ভালই লাগে। সত্যি। কারণ আমি নিশ্চিত, শেষকালে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। শুধু একটা জিনিসেরই অসুবিধা। সেটা হল মদ্যপানের অভ্যেসটা ছাড়া। আর তার পর এক শুভ দিনে, ওরা একে অন্যের দিকে তাকাবে। নিজেদের বুঝবে। আমার সমস্ত আত্মত্যাগ তো এই একটা উদ্দেশ্যেই। কারণ, ইয়ে... এক জন মা তার একমাত্র সন্তানের জন্য কী না করতে পারে, বলুন তো?

(সংক্ষেপিত)

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy