Advertisement
E-Paper

মায়ের মেয়ে দ্যুতি

দুপুর থেকে আকাশের মুখ ভারী। গুমোট আবহাওয়া। দ্যুতি চুপচাপ বসে আছে। দ্যুতির মামণি কাজ করতে করতে ডাক দিল— ‘দ্যুতি’! কোনও সাড়া নেই। একটু আগে বকুনি খেয়েছে। তাই মামণির ডাকে সাড়া দেওয়ার তাগিদ অনুভব করল না। দ্যুতির বয়স সাড়ে পাঁচ। আলমারির ওপরে বাপির বেশ কিছু বই রাখা ছিল। তার পাশেই দ্যুতির প্রিয় টেডি বিয়ারটা তোলা ছিল। দ্যুতি তার নাগাল না পেয়ে মামণিকে বলেছিল, ‘টেডিকে নামিয়ে দাও না!’ মামণি রাজি হয়নি।

স্বামী শিবপ্রদানন্দ

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০০:২৯
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

দুপুর থেকে আকাশের মুখ ভারী। গুমোট আবহাওয়া। দ্যুতি চুপচাপ বসে আছে। দ্যুতির মামণি কাজ করতে করতে ডাক দিল— ‘দ্যুতি’! কোনও সাড়া নেই। একটু আগে বকুনি খেয়েছে। তাই মামণির ডাকে সাড়া দেওয়ার তাগিদ অনুভব করল না। দ্যুতির বয়স সাড়ে পাঁচ। আলমারির ওপরে বাপির বেশ কিছু বই রাখা ছিল। তার পাশেই দ্যুতির প্রিয় টেডি বিয়ারটা তোলা ছিল। দ্যুতি তার নাগাল না পেয়ে মামণিকে বলেছিল, ‘টেডিকে নামিয়ে দাও না!’ মামণি রাজি হয়নি। দ্যুতি হোমটাস্ক না করার জন্য স্কুলের জুঁই ম্যাম মামণিকে কথা শুনিয়েছে। তাই মামণি বলেছিল, ‘তোর জন্য কথা শুনতে হয়েছে। আগে পড়া কর। পরে টেডি নিয়ে ভাবা যাবে।’ তার পর মামণি যখন দুপুরের খাওয়া সেরে কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত, তখন দ্যুতি একটা প্লাস্টিকের টুলে চেপে টেডিকে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে দ্যুতি টুল থেকে মাটিতে ধপাস! কয়েকটা বইও মেঝেতে ছিটকে পড়ল। অথচ টেডির নড়নচড়ন নেই। সে তখনও আলমারির মাথায় বসে। দ্যুতির তেমন আঘাত লাগেনি। তবে মামণি রেগে পিঠে একটা চাপড় দিয়েছিল। দ্যুতি কাঁদেনি। শুধু ফুঁপিয়েছিল। তার বুকের মধ্যে গুমরে উঠেছিল অভিমানের বাষ্প।

মামণি দুপুরে দ্যুতির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে বিফল হয়েছিল। দ্যুতিকে কোলে নিতে চেষ্টা করেছিল মামণি। দ্যুতি ছিটকে সরে গিয়েছিল। মামণি শুধু অসহায় চোখে দ্যুতির দিকে তাকিয়েছিল। অবশ্য দ্যুতির মন তাতে একটুও টলেনি।

আকাশটাও কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। একটু পরেই হয়তো কালবৈশাখী ছুটে আসবে। সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাবে। দ্যুতির গম্ভীর মুখ বাড়িটাকেও থমথমে করে দিয়েছে। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। দিদি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল। দ্যুতির দিদির নাম হৃদি। সে ক্লাস ফোরে পড়ে। দ্যুতির এখন কে জি। সামনের বছর ক্লাস ওয়ান হবে। দ্যুতি দরজা খুলে দিল। হৃদি একটু হেসে, দ্যুতির গালে হাত দিয়ে আদর করতেই কালবৈশাখী ঝড় শুরু হল। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুমুল বৃষ্টি। হৃদি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দ্যুতির মুখের দিকে তাকাল। দ্যুতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে। আর চোখ থেকে নেমে আসছে জল। হৃদি অনুমান করল, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

হৃদি স্কুল-ব্যাগ রেখে, মুখ, হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে দেখল দু’বাটি পায়েস আর দুটো প্লেটে কয়েকটা করে স্যান্ডউইচ রাখা আছে। মামণি চোখের ইশারায় দ্যুতিকে ডেকে নিতে বলে কাজের ছুতোয় পাশের ঘরে ঢুকে গেল। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। হৃদি ফোন ধরতে যাওয়ার আগে মিষ্টি গলায় ডাক দিল— ‘এই দ্যুতি, খাবি আয়।’ হৃদি ফোনে ‘হ্যালো’ বলতেই মামণির বন্ধু দীপালি আন্টির গলা পেল। দীপালি আন্টি বলল, ‘কেমন আছিস হৃদি? ফোনটা সুজাতাকে একটু দে তো।’ হৃদি সংক্ষেপে জবাব দিল, ‘ভাল’। তার পর গলা তুলে হাঁক দিয়ে বলল, ‘মামণি তোমার ফোন।’ ইতিমধ্যে দ্যুতি হৃদির পাশের চেয়ারে এসে বসেছে। পায়েসের বাটিটাও টেনে নিয়েছে তার দিকে। ফোনে কথা বলার সময় ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় এই দৃশ্যটা দেখে সুজাতা মুচকি হেসেছিল।

সে দিন ঝড়বৃষ্টি থামতে থামতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল। দ্যুতি আর হৃদির বাপি, মানে চিরন্তন সোয়া সাতটা নাগাদ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল। বাপির গাড়ির হর্ন দ্যুতি ভালই চেনে। তাই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়াল। বাপিকে মামণির নামে নালিশ করে আদুরে গলায় বলতে লাগল— ‘ও কেন আমাকে বকবে? ওর কি মা নেই? ও কথা না শুনলে ওর মা কি ওকে মারে!’ চিরন্তন বারান্দায় উঠতেই দ্যুতি গিয়ে তার কোলে উঠল। তার মাথাটা বাপির কাঁধে এলিয়ে দিতেই বাপি দ্যুতির পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে মা?’ দ্যুতি উত্তর দিল না। নিঃশব্দে কাঁদছিল শুধু। চিরন্তন দ্যুতিকে বলল, ‘যা তো মা, আজকের খবরের কাগজটা নিয়ে আয়। তোকে একটা খবর শোনাব।’

দ্যুতি তার বাপির জন্য খবরের কাগজ খুঁজে আনতে ছুটল। সেই ফাঁকে চিরন্তন পোশাক পালটে ফ্রেশ হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। দ্যুতি কাগজটা তার বাপির হাতে দিয়ে সোফায় বাপির গা ঘেঁষে বসল। চিরন্তন সেই খবরের কাগজের একটা পাতা দ্যুতিকে দেখিয়ে বলল, ‘এই হাতির খবরটা দেখেছিস?’ দ্যুতি নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না’। ততক্ষণে দ্যুতি বাপির কোলে উঠে বসেছে। দ্যুতি বাপিকে খুব ভালবাসে। মামণিকেও ভালবাসে, তবে বাপিকে একটু বেশি। কারণ, দুষ্টুমি করলেও বাপি বকুনি দেয় না। পিটুনি তো দূরের কথা।

চিরন্তন তার ছোট মেয়েকে বলল, ‘বাঁকুড়ার জয়পুর জঙ্গলের লাগোয়া একটা গ্রামে এক পাল হাতি এসেছিল। আমের বাগান, ধানখেত নষ্ট করে যাওয়ার সময় একটা মা-হাতি কী ভাবে দলছুট হয়ে যায়। তাকে দেখতে গ্রামের বিস্তর মানুষজন হাজির হয়েছিল। সেই ভিড়ের মধ্যে এক মহিলা তার ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে হাতি দেখতে গিয়ে বিপদে পড়েছিল।’ দ্যুতি জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বিপদ?’ ততক্ষণে সুজাতা কফি আর টোস্ট এনে চিরন্তনের সামনের একটা ছোট টেবিলে রাখল। দ্যুতি বাপির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সুজাতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের গল্প শুনছিল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে চিরন্তন বলল, ‘মা-হাতিটা কী মনে করে সেই মায়ের কোল থেকে বাচ্চা মেয়েটাকে শুঁড়ে জড়িয়ে তুলে নিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। মেয়েটির মা ‘আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও’ বলে কাঁদতে কাঁদতে হাতির পিছনে পিছনে ছুটতে লাগল। মায়ের কান্না শুনে হাতিটা একটু থমকে দাঁড়াল। তার পর পিছন ফিরে দেখল। তার পর একটা গাছের নীচে বালির ঢিবির ওপর শিশুটিকে সাবধানে শুইয়ে দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। মা ছুটে গিয়ে তার সন্তানকে কোলে তুলে নিতেই শিশুটির কান্না থেমে গেল।’

দ্যুতি তার মামণির মুখের দিকে তাকাতেই, মামণি তার দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে দিল। বাপির কোল থেকে নেমে সে মামণির কোলে আশ্রয় নিল। ঝড়, বৃষ্টি থেমে গেছে। তবু যেন আকাশের বুকে বিদ্যুতের দ্যুতি খেলে গেল।

হৃদি ততক্ষণে বাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া পুরনো একটা গান চালিয়ে দিয়েছে, ‘তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে...’। ঘরের জানলার পরদা উড়ছে। ঠান্ডা বাতাসে ভেসে যাচ্ছে ঘর-দুয়ার।

swami sibapradananda swami sibapradananda
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy