পেলের পা থেকে বল তুলে নিলাম
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়
সালটা ১৯৭৭। এক দিন প্র্যাকটিস শেষে টেন্টে ঢুকেছি, ক্লাবের কর্ণধার ও জেনারেল সেক্রেটারি শ্রদ্ধেয় ধীরেন দে এসে হাজির। সচরাচর সকালে আসতেন না। আমাদের কোচ তখন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। ধীরেনদা প্রদীপদার সঙ্গে কী কথা বলে চলে গেলেন। প্রদীপদা আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, শোনো, পেলে কলকাতায় আসছেন। মোহনবাগানের সঙ্গে কসমস ক্লাবের একটা প্রদর্শনী ম্যাচের কথা চলছে। পেলের সঙ্গে খেলার সুযোগ! দারুণ চেগে গেলাম সবাই। ডিফেন্স, হাফ, মিডফিল্ড, প্রত্যেকটা পজিশন ধরে ধরে আলাদা আলাদা প্র্যাকটিস হচ্ছিল। গোলকিপার হিসেবে প্রদীপদা আমাকে বাড়তি সময় আর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তদ্দিনে জানা, কসমস চিন-জাপানে খেলে তার পর কলকাতায় আসছে, পেলে ফ্রি-কিকে দুটো গোল করেছেন। গোল দুটোর ভিডিয়ো দেখেছিলাম। প্রদীপদা আমাকে বললেন, এই ফ্রি-কিকটা কিন্তু পেলে মারবেন, বি কেয়ারফুল। প্রদীপদা নিজে ফ্রি-কিক মেরে মেরে আমাকে কিপিং প্র্যাকটিস করিয়েছিলেন।
২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭। ‘নিউ ইয়র্ক কসমস’ বনাম মোহনবাগান। ইডেনের মাঠে বল পায়ে ফুটবলের রাজপুত্র।
দেখতে দেখতে ম্যাচের দিন চলে এল। আমার বাবা সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রথম বাঙালি আন্তজার্তিক গোলকিপার। ১৯৩৬ সালের ভারতীয় দলের কিপার ছিলেন। কিন্তু আমার খেলার ব্যাপারে তেমন কিছু বলতেন না। সে দিন যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, বললেন, দ্যাখ, কসমস যদি ফ্রি-কিক পায়, তা হলে পেলেই কিন্তু মারবে। আর গোটা মাঠও পেলেকেই সাপোর্ট করবে। কারণ সবাই পেলেকে গোল করতে দেখতে চায়। তোকে একটাই কথা বলি, ডোন্ট গো ফর দ্য বল। চিন-জাপানে দুটো ম্যাচেই কিপার গোল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সেটা করিস না। বলটাকে আসতে দে তোর কাছে, সেই মতো রিঅ্যাক্ট কর।
বাইকে করে মাঠে এলাম। ইডেন গার্ডেন্স-এ ম্যাচ। লোকে লোকারণ্য। সকালে একটু বৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের কাছে সেটাই ছিল খানিক অ্যাডভান্টেজ। প্লেয়ারদের দুটো ড্রেসিং রুম পাশাপাশি, কিন্তু পেলের ঘরের দরজা বন্ধ। সবাই অপেক্ষা করছি পেলের জন্য। এর আগে মানুষটাকে টিভিতে, সিনেমায় দেখেছি। পেলের সিকিয়োরোটি গার্ডরা আগে মাঠে নেমে সব দেখে গেল। ওরা মাঠ দেখে খুব একটা খুশি হয়নি, পেলের ইনশিয়োর্ড করা পা নিয়ে ভাবছিল।
দুটো টিম একসঙ্গে মাঠে নামল। পেলেকে সেই প্রথম চাক্ষুষ দেখা। হাবিবদার একটা সংস্কার ছিল, মাঠে নেমে বলটা প্রথমে আমাকে পুশ করতেন। খেলা-শুরুর আগে পেলের সঙ্গে ছবি-তোলাতুলি চলছে, আমিও সেখানে। এ দিকে হাবিবদা দাঁড়িয়ে আছেন, আমাকে বল পুশ করবেন বলে। ফিরে এলে আমাকে প্রচণ্ড গালাগালি করলেন। তখন রেগে গেছিলাম, এ কী রে বাবা, পেলের সঙ্গে ছবি তুলব না একটা! কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ফুটবলের প্রতি কতটা প্যাশন থাকলে এ জিনিস সম্ভব। পেলের সঙ্গেও ছবি তুলতে গেলেন না, নিজের চিরকালীন ফুটবল-অভ্যেসে, আমার অপেক্ষায় একা দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঠে! আমাকে বল ঠেলে বলেছিলেন, বেটা, খেল্না পড়েগা। আচ্ছা খেলনে সে পিকচার অ্যায়সে হি উঠেগা!
পেলে প্রথমে গোটা মাঠটা জগ করলেন। আমরা দেখে মুগ্ধ! মনে হচ্ছিল, শরীরটায় যেন স্প্রিং দেওয়া। জাম্প, স্ট্রেচ, বেন্ড আমরাও করি, কিন্তু ওঁর সে-সবেও কী সুন্দর একটা রিদ্ম!
ম্যাচের দুটো মুহূর্ত আজও সবার মনে আছে। একটা পেলের বিখ্যাত ফ্রি-কিক। সুব্রত ভট্টাচার্য ছাড়া সবাই ওয়াল করেছিল। কিন্তু ওই কাদা-মাঠেই, ওই নিভিয়া বল-এই পেলে যে ইনসুইঙ্গারটা নিলেন, অকল্পনীয়! আমি যখন ডাইভ দিয়ে বলটা ধরলাম, বলটা লাট্টুর মতো স্পিন করছিল আমার হাতে। আর একটা, ওয়ান-টু-ওয়ান পজিশনে পেলের পা থেকে আমার বল কেড়ে নেওয়া। টনি ফিল্ড যখন বাঁ দিক থেকে সেন্টারটা করলেন, পেলে তখন প্রদীপ চৌধুরী আর সুব্রত ভট্টাচার্যের পেছনে। ওদের কাটিয়ে গোলের চার কি ছ’গজের মধ্যে বলটা ট্যাপ করলেন থাইয়ে, সেখান থেকে পায়ে। গোলে শুট করবেন, আমি একটা ফ্রন্ট ডাইভ দিলাম। গোলকিপাররা সাধারণত ফ্রন্ট ডাইভ পারে না। সে দিন কী ভর করেছিল কে জানে। ডাইভ দিয়ে ভাবছি, আমি কি বেঁচে আছি! তাকিয়ে দেখি, বল আমার কাছে, আর পেলে আমার সঙ্গে কলিশন এড়াতে ওই স্পিডে আমার ওপর দিয়ে জাম্প করে নেটের ভেতর। পেলে বলেই সম্ভব। আর কোনও প্লেয়ার হলে আমার ম্যাসিভ একটা ইনজুরি হতই। ওই মুহূর্তটা অনেক দর্শকও নাকি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন।
ম্যাচ ২-২’এ ড্র হল। আমাদের শ্যাম থাপা আর হাবিবদা গোল করেছিলেন। রাতে গ্র্যান্ডে ডিনার— আমাকে দেখেই পেলে বললেন, ওহ, দিস ইজ গর্ডন ব্যাঙ্কস, সেভ্ড হিজ টিম টুডে! আমি তো লজ্জায় মরি! কিন্তু পেলে তো পেলে-ই। বললেন, তোমার টিম আজ চার গোল খেতে পারত, তুমি বাঁচিয়ে দিয়েছ। আমার ফ্রি-কিকটা তো অবিশ্বাস্য সেভ করেছ! জিজ্ঞেস করলেন, ক’ঘণ্টা প্র্যাকটিস করো? আমি বাড়িয়ে বললাম, ছ’ঘণ্টা। পেলে বললেন, সিক্স আওয়ার্স? ইউ কান্ট বি আ গ্রেট প্লেয়ার। হ্যাভ টু প্র্যাকটিস এইট টু নাইন আওয়ার্স। মেডেল দেওয়ার অনুষ্ঠানে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়েছিলেন।
ক’মাস পরে, আমার অফিসের এক বড়কর্তার সঙ্গে ইউরোপে এক প্লেনযাত্রায় পেলের দেখা হয়েছিল। উনি নাকি বলেছিলেন, শিবাজী কেমন আছে? ওকে আমার সঙ্গে কনট্যাক্ট করতে বোলো। কিন্তু সে যুগে যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব ছিল। কী জানি, হয়তো বিদেশি কোনও ক্লাবে খেলতে পারতাম, যোগাযোগটা হলে! ’৯০ বিশ্বকাপেও আমার খোঁজ নিয়েছিলেন সাংবাদিক শ্যামসুন্দর ঘোষের কাছে। মাঝে তেরোটা বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু পেলে ঠিক মনে রেখেছেন আমাকে!
sibajibanerjee01@gmail.com
সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
বাজারে এল মাল্টিস্ক্রিন টিভি। এই টিভিতে একই সঙ্গে দুটো বা তিনটে বা চারটে স্ক্রিন থাকবে। মানে, রিমোটের একটি বোতাম টিপলেই, টিভির মধ্যে ততগুলো চৌকো চৌকো ভাগ হয়ে যাবে, যতগুলো দর্শক চাইছেন। এক একটি স্ক্রিনে আলাদা আলাদা চ্যানেল দেখা যাবে। এর ফলে বাড়ির কর্তাটি যখন তাঁর সাধের ওয়ার্ল্ড কাপ ম্যাচটি দেখবেন, তখন, একই সঙ্গে, গিন্নি তাঁর প্রিয় সিরিয়াল দেখতে পাবেন, মেয়ে আবার রণবীর সিংহের সিনেমা দেখতে পাবে ও ছোট ছেলেটি মহানন্দে কার্টুন চ্যানেল নিয়ে মেতে থাকবে। এত দিন ধরে টিভি দেখা নিয়ে যে ঝগড়া ও মনকষাকষি মধ্যবিত্ত পরিবারে লেগেই থাকত, যা থেকে কখনও কখনও বড় ধরনের অশান্তি হয়ে যেত, তা আর ঘটবে না। আবার, প্রত্যেকের পছন্দকে লাই দিতে গিয়ে, একটা বাড়িতে তিন-চারটে টিভি কেনার ঝক্কিও সামলাতে হবে না। এই টিভির নির্মাতা একটি জাপানি কোম্পানি, তবে কিছু দিনের মধ্যেই অন্য সব টিভিতেই এই সুবিধে-ফিচারটি অন্তর্ভুক্ত হবে বলেই বাণিজ্য ও বিনোদন মহলের ধারণা। একটাই ছোট ঝামেলা, ওই প্রত্যেকটা ছোট স্ক্রিনের ছবিকে জুম করার জন্য বা সাউন্ড বাড়ানো-কমানোর জন্য একটা করে মিনি-রিমোট থাকবে। অতগুলো রিমোট বাড়িতে থাকলে হারিয়ে যাওয়া বা গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি। এই টিভির দাম সাধারণ টিভির থেকে বেশি হলেও, দুটো টিভির দামের থেকে কম। প্রতিটি স্ক্রিনের জন্য আলাদা হেডফোনও রয়েছে। ফলে একসঙ্গে বসে টিভি দেখার সময় আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের আওয়াজ একসঙ্গে মিশে কর্কশ হইহই হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিজের হেডফোনে নিজের অনুষ্ঠানের শব্দটুকু শোনা যাবে। টিভি নির্মাতা সংস্থা রসিকতা করে বলেছেন, হেডফোন না নিয়ে নর্মাল স্পিকারে শুনতেও ভারতীয়দের অন্তত অসুবিধা হবে না। কারণ, তারা তো এখনই ফোন, চিৎকার চেঁচামেচি, মাইকের আওয়াজের মধ্যেই টিভি দেখতে অভ্যস্ত।
অঞ্জন চৌধুরী, রানাঘাট, নদিয়া
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
‘আদর্শ ধুয়ে জল খাইনি’
শান্তনু চক্রবর্তী
(অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় আর জায়গাটা ঠিকই ছিল। সর্দার সরোবর বাঁধ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সাধুবেট দ্বীপ। যেখানে মাস দুয়েক আগেই তাঁর জন্মদিনে ১৮২ মিটার উঁচু মূর্তির শিলান্যাস হয়েছে। ওখানে লোহা-পাথরের গাদার পাশেই তিনি। কিন্তু এ কী বেশ! খাটো ধুতির সঙ্গে গুজরাতি কৃষকের আঁটো কুর্তা, মাথায় ইয়াব্বড় পাগড়ি আর হাতে লাঠি!)
প্রতিবেদক: কেসটা কী হল মশাই? ছবিতে দেখা চেনা পোশাক ছেড়ে আচমকা গুজরাতি ভূমিপুত্রের বেশে? এই নাটুকেপনা, এটা কি মোদী সিনড্রোম?
বল্লভভাই পটেল: ধুর, ও সব সিনড্রোম-ফিনড্রোম কিচ্ছু না। এটা সোজাসাপটা ছদ্মবেশ! আমায় নিয়ে অ্যাত্তো বড় একটা কাণ্ড হচ্ছে, দেশ জুড়ে তাই নিয়ে এত হইচই— ভাবলাম, ব্যাপারটা একটু দেখেই আসি! আবার কেউ চিনে ফেললেও লজ্জা করবে, তাই একটু সাজগোজ! তবে মোদীর কথা তুললি বলেই বলছি, ছোকরা কিন্তু বেশ ফ্যাশনবাজ! অনেকটা আমাদের জওহরলালের মতো। আমাদের কালে স্টাইল বল, কেতা বল, ওই এক পিসই তো ছিল পাতে দেওয়ার মতো! আসলে বড়লোকের ব্যাটা— সেই কোন ছোটবেলা থেকে দামি কোট পরে বিলিতি ইসকুলে গেছে, ও ফ্যাশন জানবে না তো কে জানবে, ঝুমরিতলাইয়ার ঝম্পকলাল? কিন্তু চা-ওয়ালার ছেলে হয়ে মোদীও যা স্টাইল স্টেটমেন্ট দেখাচ্ছে, জওহরলালের চেয়ে কমতি যায় না!
প্রতি: আচ্ছা, এই যে আপনিও বেশ মোদী মোদী করছেন, ও দিকে মোদীও ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আপনাকে নিয়ে গায়ে-পড়া আদিখ্যেতা দেখাচ্ছেন, এমনকী আপনার জন্মদিনের দিনটাই যে ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুদিন, সেটা অবধি দেশসুদ্ধ লোককে ভুলিয়ে ছাড়লেন, এটার রহস্যটা কী? এটা কি ‘হম ভি গুজরাটি তুম ভি গুজরাটি’ গোছের কিছু, না অন্য হিসেব আছে?
পটেল: আরে এটা বুঝতে পারছিস না, নেহরু-গাঁধী পরিবারবাদ মোকাবিলা করার মতো কোনও জুতসই নেতাই নেই সংঘ-পরিবারে! তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ না, একা নেহরুরই যা ক্যারিসমা, এক্সপোজার, তার উলটো দিকে ওদের কাকে বসাবি? সাভারকর থেকে গোলওয়ালকর, হেডগেওয়ার থেকে দীনদয়াল উপাধ্যায়, এরা সব্বাই বড়জোর মেঠো বক্তৃতায় উসকানি দিতে পারত, বা নাগপুরের হেডকোয়ার্টার্সে বসে এ দেশের মুসলমানদের ধরে ধরে হিন্দু বানানোর ব্লুপ্রিন্ট ভাঁজতে পারত! জীবনে একটা মিউনিসিপ্যালিটি অবধি চালায়নি। ক্ষমতার চেয়ারে বসে, দেশ শাসন করার ওরা কী জানে? হ্যাঁ, ওদের দলে শ্যামাপ্রসাদ ছিল বটে, পার্লামেন্টে বেশ জমিয়ে ঝগড়া করতে পারত! কিন্তু ওই অবধিই! সব তোদের ওই কেজরীবালের ধাত! দায়িত্ব পেলেই কত ক্ষণে সব ছেড়েছুড়ে বিরোধী বেঞ্চে জুটে গলা ফাটাবে সেই মতলব! মোট কথা জওহরলালের সঙ্গে গ্ল্যামারে-বক্সে-পাবলিক ইমেজে টক্কর দেওয়ার মতো কোনও মেটিরিয়াল এঁদের ছিল না! এখন নিজেদের ভাঁড়ে মা ভবানী হলে অন্য শিবির থেকেই তো নেতা জোগাড় করতে হবে! আর বাম-ঘেঁষা নেহরুকে ঠিকঠাক টাইটটা দিতে পারে কেবল কংগ্রেসের ডানপন্থীরাই! মোদী রাজনীতিটা মোক্ষম বোঝে। তাই নেহরুর ‘প্যারালাল’ কাউকে দাঁড় করানোর জন্য ও কংগ্রেসের অন্দরেই ছানবিন করেছে। আর ডানেদের মধ্যেও যে সবচেয়ে রাফ অ্যান্ড টাফ, সবচেয়ে শক্তপোক্ত ‘ডান’, তাকেই বেছে নিয়েছে!
বল্লভভাই পটেল, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে।
প্রতি: মানে আপনার ডানপন্থীত্ব আপনি মেনে নিচ্ছেন?
পটেল: এটা আবার মানামানির কী আছে? আমি যে রাইটিস্ট, সেটা কি আমি বা আমার ভক্তরা কখনও লুকোতে গেছি? বরং জওহরলালের বামপন্থাটাই একটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব গোছের ব্যাপার। মার্কস-লেনিন-গাঁধী-হিউম সব জড়িয়েমড়িয়ে একটা ভ্যাবাচ্যাকা দশা। ও নিজেও দেখবি সব সময় ঘেঁটে আছে। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার-এর সময় মনে হচ্ছিল এই বুঝি যুদ্ধে যায়-যায়! জওহরলাল তখন এ দেশের কমিউনিস্ট, কংগ্রেস-সোশালিস্ট আর অন্য সব বামেদের যুক্তফ্রন্টের পয়লা মুখ। আবার গাঁধীজি কায়দা করে সুভাষ বোসের জুজু দেখাতেই সুড়সুড় করে আমাদের দিকে চলে এল! স্বাধীনতার পরে ওর প্রগতিপনা আবার উথলে উঠল। স্তালিনের টুকলি করে পাঁচসালা পরিকল্পনা, দুবলা শরীর আর খালি পকেট নিয়ে নির্জোট আন্দোলনে মাস্তানি— শেষে চিনের কাছে রামধোলাই খেয়ে যখন চোখ খুলল, তখন আর কিস্যু করার নেই! আমার রাজনীতিতে ও সব ন্যাকাপনা পাবি না! যখন যেটা দরকার সেটাই করেছি। আদর্শ ধুয়ে জল খেতে যাইনি। ওই জন্যেই হয়তো মোদীর আমাকে পছন্দ!
প্রতি: শুধুই কি তাই? না কি আপনার নরম হিন্দুত্বও একটা কারণ? এই তো আগের সাক্ষাৎকারেই নেহরু আমাদের বলেছেন, হিন্দুত্বের বিপদটা আপনি ততটা বোঝেননি। স্বাধীনতার পরে পরেই যখন দিল্লি আর তার আশেপাশে প্রায় ‘এথনিক ক্লেনজিং’-এর মতো করে মুসলমানদের কচুকাটা করা হচ্ছিল, ‘জিন্নাহ্-র সন্তানদের’ পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর বন্দোবস্ত চলছিল, দাঙ্গাবাজদের সামলাতে নেহরু নিজে রাস্তায় নেমেছিলেন, আপনি তখন সেই কোন মুল্লুকে গুজরাতের সৌরাষ্ট্রে সোমনাথ মন্দির মেরামতির কাজকর্ম তদারক করছিলেন। এতে কংগ্রেসি ধর্মনিরপেক্ষতার ডাল মে কুছ কালা, থুড়ি, গেরুয়া ছিটে লেগে গেল না?
পটেল: জওহরলাল যেন এ রকমই কী একটা লম্বা কাঁদুনি ভর্তি চিঠি লিখেছিল গোবিন্দবল্লভ পন্থকে! ও প্রথমটায় রাজেন্দ্রপ্রসাদকে ঠেকানোর অনেক চেষ্টা করেছিল, যাতে উনি কিছুতেই পুনর্গঠিত সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধনে না যান। সেটা যখন ধোপে টিকল না, তখনই পন্থজিকে এই চিঠি। কী তার ভাষা! যাঁরা এক সময় কংগ্রেস পার্টির বড় বড় থাম-খিলান এ সব ছিলেন, তাঁদের হৃদয়-মনের ইট-সিমেন্ট-চুন-বালিতে নাকি সাম্প্রদায়িকতার নোনা ধরে গেছে, এই সব আগডুম বাগডুম কত কী!
প্রতি: কথাটা কি খুব ভুল? সোমনাথের সংস্কার নিয়ে আপনাদের বাড়াবাড়িটা তো চোখে লাগবেই! গজনির মামুদের ভুল শুধরোনোর নামে এটা তো পরিষ্কার হিন্দু সেন্টিমেন্টকে তোল্লাই দেওয়া! বাবরি-রামজন্মভূমির প্রশ্নে বিজেপি তো এই তাসটাই অনেক বড় করে খেলল।
পটেল: খেলবার সুযোগটা কে করে দিল বল! নেহরু আর ওর দলবল সেকুলারিজ্ম, প্লুরাল সমাজ-ফমাজ বলে সারা জীবন আদিখ্যেতা করে গেল! আর ক্ষীরটা খেয়ে গেল বিজেপি। আরে বৈচিত্র-টৈচিত্র যেখানকার যা, সব থাকবে। রাত্তিরে কানে হেডফোন লাগিয়ে তুমি প্রেমসে বহুস্বর শোনো না! কে মানা করছে! কিন্তু সংখ্যাগুরু মানুষের মনটা তো বুঝতে হবে! আমি থাকলে অখণ্ড হিন্দু ভারতের স্লোগানটা কিছুতেই সঙ্ঘের স্যাঙাতদের হাইজ্যাক করতে দিতাম না। তোরা বাঁয়ে হেলা লিবারাল ন্যাকারা এ সব বুঝবি না। ‘হিন্দু’ শুনলেই তোরা দাঙ্গা ভাবিস। আরে যারা সংখ্যায় বেশি তাদের মতের একটা দাম থাকবে না! শোন, আমি এই দ্বীপে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছি, আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম, বিজেপির জন্মই হত না কোনও দিন। মোদী যে আমার মূর্তিটা বানাচ্ছে, সেটা ওই কৃতজ্ঞতার বশেই!
sanajkol@gmail.com