Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

আমাদের দেশের কিছু খাবারের আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার পিছনে যে সম্প্রদায়ের অবদান অনস্বীকার্য, সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অত্যন্ত প্রিয় এক পদ হল মুলগাতওয়ানি সুপ।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে যখন ইংল্যান্ডে ডাক্তারির মতো পেশাতেও বছরে হাজার পাউন্ড রোজগার খুব কম লোকেরই ছিল, ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে এসে বছরে সাহেবরা পাঁচ থেকে দশ হাজার পাউন্ড রোজগার করত। তাই ইংল্যান্ডের ছোকরা অবিবাহিত সাহেবদের কাছে এই দেশে চাকরির প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত লোভনীয়।

এই রকম কিছু ছোকরা ইংরেজ অফিসার মাদ্রাজ (তখন চেন্নাইয়ের এই নামই ছিল) শহরে পৌঁছে, খাওয়ার আগে সুপ পরিবেশন করার আদেশ দিলেন। খানসামারা পড়ল বিপাকে— ভারতীয় খাবারের সঙ্গে সুপের চল কোনও কালেই ছিল না। জিনিসটা কী, তার মর্মোদ্ধার করে তারা গোলমরিচের শরণাপন্ন হল। সেই আমলে দক্ষিণ ভারতে গোলমরিচ ছিল বাঙালি মাতৃকুলের নাক্স-ভমিকার মতো— সব রোগের দাওয়াই। ও দেশের আয়ুর্বেদাচার্যরাও গোলমরিচকে ঈশ্বরের এক মহান আশীর্বাদ বলে গণ্য করতেন। খানসামারা বুদ্ধি খাটিয়ে তেঁতুলজলে গোলমরিচ ফুটিয়ে পরিবেশন করল। সাহেবদের খেয়ে এতটাই ভাল লাগল, এই পথ্য নিয়মিত ভাবে সুপের পরিবর্ত হিসেবে পরিবেশিত হতে লাগল। মিলাগু-থানির (মরিচ-জল) সাহেবদের কাছে হয়ে গেল ‘মুলগাতওয়ানি’— যে ভাবে ‘দরওয়াজা বন্ধ করো’ সাহেবদের কাছে ‘দেয়ার ওয়াজ আ ব্রাউন ক্রো’ হয়েছিল।

খাঁটি সাহেবরা তো মহাখুশি হয়ে এটা খেতে লাগল, কিন্তু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পক্ষে এই রুগির পথ্যটি গলাধঃকরণ করা শক্ত হয়ে দাঁড়াল— কারণ তারা আচার-ব্যবহারে ঘোরতর সাহেব হলেও, শরীরে ভারতীয় রক্তও রয়েছে। এটা সেই সময়ের কথা যখন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের প্রতিপত্তি সাহেবকুলে অপরিসীম— তখনও ১৭৯১ সালের হাইতি -তে দাস বিদ্রোহ ও তার পরবর্তী ১৮০৬ সালের মুলাতো বিপ্লব হয়নি, ইংরেজরা চিরশত্রু ফ্রান্সকে বেগ দেওয়ায় জন্য স্পেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেন্ট দমিনিক দ্বীপের বিদ্রোহীদের সাহায্য করেনি। ক্ষমতা আর অর্থের লোভে অন্য দেশে সৃষ্ট নিজেদের বংশধরদের আপদ বলে ভাবতে শেখেনি। তখনও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উচ্চশিক্ষার বা বসবাস করার ব্যাপারে ইংল্যান্ডে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। সেই সময় ভারতে দিল্লি, মাদ্রাজ ও বম্বে (মুম্বইয়ের তখন এই নাম) তিনটে শহরেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরাই ছিল সদ্য এ দেশে পা ফেলা ছোকরা ইংরেজ অফিসারদের ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড। সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নির্দেশে খানসামারা এই ‘মিলাগু-থানির’-এ কিছুটা ভাত, সামান্য সবজি আর একটু মাংস মেশাল, পদটাকে সুস্বাদু করার জন্য। আর এই ভাবেই জন্ম হল মুলগাতওয়ানি সুপের।

নিজেদের সৃষ্ট সুপ পেয়ে উৎফুল্ল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা এত পরিমাণে এই সুপ খেতে লাগল, সাহেবরা মাদ্রাজবাসী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ‘মাল্স’ বলে ডাকত (যেমন শুঁটকি মাছ প্রীতির জন্যে বোম্বেবাসী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ‘ডাক্স’ বলে ডাকা হত)। তবে মাল্সদের এই সুপের প্রতি প্রেম কতটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, বোঝা যায়, যখন হায়দার আলির জেলে বসে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আকুল হয়ে লেখে, মুলগাতওয়ানি সুপের জন্যে তার মন কেমন করছে!

ফাউ— শব্দটা বড় আদরের ছিল। গোটা দশেক শিঙাড়া কিনেই দোকানদারদের দিকে হাত বাড়াতাম— ফাউ? ওটা যেন অধিকার। ফাউ শিঙাড়া খেতে খেতে আসছি, চিল এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল... এমন কত বার হয়েছে! হায় চিল! সোনালি ডানার চিল। সেই চিলও নেই, সেই ফাউও নেই।

এই ফাউ-প্রথার কল্যাণেই একটি প্রেমিকা ম্যানেজ হয়েছিল নেপালের। নেপালের এক ভাই ছিল ভুটান। ওদের আর একটা ভাই হলে সিকিম হত কি না জানি না। ওদের বাবার অকালমৃত্যুর পর স্টেশনারি দোকানে নেপাল-ভুটান দু’ভাই বসতো পালা করে। নেপাল বারকয়েকের চেষ্টায় হায়ার সেকেন্ডারি পাশ দিয়ে ফেলেছিল। ‘অনেক হয়েছে, আর না’ ভেবে কলেজে ভর্তি হয়নি। ও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দোকানদারি করত, ভুটান কলেজ যেত বলে তার পর, বিকেলের দিকটায় বসত। ফলে নেপাল মর্নিং স্কুলের মেয়েদের পেত।

স্কুলের ছুটির পর কেউ লজেন্স, কেউ চানাচুর, কেউ মিষ্টি পাঁউরুটি। আর ফাউ। এই সময়ে নেপাল ছোঁড়ার সত্যিকারের হৃদয় খুশ। হাত বাড়ালে পাবেই পাবে নিদেন পক্ষে লজেনচুষ। নেপাল ওর দোকানে রঙিন ফিতে, চুলের ক্লিপ, কুমকুম, সস্তার নেলপালিশ এ সবও রাখত, আর ওর দোকানে বালিকা-কিশোরীদের ভিড় লেগে থাকত। বিকেলে এই বালিকা-সমাগমটা থাকত না বলে ভুটানের খুব হিংসে হত। ও জেনেছিল, ওর দাদার এই বালিকাপ্রিয়তার কারণ ফাউ। তাই ও কাগজ সেঁটে দিয়েছিল ‘ফাউ বন্ধ’। নেপালের মা স্কুল ছুটির সময় দোকানে এসে বসে থাকত ‘ফাউ বন্ধ’-র নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে কি না, দেখার জন্য।

নেপাল ফাউ-কাতর বালিকাদের গোঁপের তলার মিষ্টি হাসি ছাড়া আর কিছু দিতে পারত না। এতদ্সত্ত্বেও দরাজ-দিল নেপাল ফাউ দেওয়ার বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কার করে। কেক কিংবা পাঁউরুটির মধ্যে মাছ-লজেন্স বা কাঠি-লজেন্স প্রবিষ্ট করিয়ে দিত। সবাইকে নয়, বাছাই কয়েক জনকে। এই বাছাইয়ের মধ্যে এক জন আবার ছিল বিশেষ বাছাই। ফেল-টেল করত বলে স্কুল ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। ওর মিষ্টি পাঁউরুটির পেট অপারেশন করে ভিতরে একটা প্রেমপত্র ঢুকিয়ে দিয়েছিল নেপাল। ব্যস, লিলি ফিট।

লিলি আর নেপাল এর পর থেকে গঙ্গার পাড়ে বাদামে, মোগলাই পরোটায়, ফুচকায়, সিনেমায়। আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে নেপালই প্রথম লাভার ফিট করার ক্যালি দেখাতে পেরেছিল। কী কায়দায় প্রেম করতে হয় জানার জন্য ওকে ফলো করেছি, গঙ্গার ধারের কংক্রিটের বেঞ্চিতে ওরা যখন বসে ছিল, পিছনে দাঁড়িয়ে নেপালের ডায়ালগ শুনে বুঝেছি প্রেমে ‘জীবন’ শব্দটার উচ্চারণ খুব জরুরি।

যেমন, ‘দেখো না, ও পারের আলোগুলো মনে হচ্ছে নিবছে-জ্বলছে। আসলে কিন্তু নিবছে না, মনে হচ্ছে। আমাদের জীবনও ওরম।’ কিংবা ‘এখন জোয়ারের জলে কাদা ঢেকে গেছে, আবার ভাটা হবে, কাদা বেরিয়ে যাবে। আমাদের জীবনও ওরম।’ কিংবা ‘বাদামের মধ্যে কতকগুলো পচা বেরিয়ে গেল। আমাদের জীবনও ওরম।’

ওরা ‘অশনি সংকেত’ দেখতে গিয়েছিল। ওদের পিছনের সিটে আমরা। ওই ছবিতে দুর্ভিক্ষ, চালের অভাব— এ সব ছিল এবং বারবার প্রজাপতি ওড়া দেখানো হয়েছিল। লিলি জিজ্ঞাসা করেছিল, বারবার প্রজাপতি উড়ছে কেন গো? নেপাল বলেছিল— আমাদের জীবনও ওরম। জীবন কেবল উড়তে চায়। এ সব হাই-থট। ব্যস, লিলি বুঝে গেল।

নেপালের এত ওড়াউড়ি ওর মা ভাল ভাবে নেয়নি। দোকানদারি থেকে নেপালকে অব্যাহতি দিয়েছিল। ফলে ভাব বাড়ল, সঙ্গে বাড়ল পকেটমানির অভাব। গত শতকের যুগলদের জন্য প্রকৃতি প্রদান করেছিল চিনেবাদাম আর বাঙালি মনীষা আবিষ্কার করেছিল ঝালনুনের পুরিয়া, যা রাখা থাকত কোনও এক জনের উরু অঞ্চলে। ধোঁয়া জড়ানো উচ্চমার্গের প্রেমবাক্য থ্রো করার জন্য সিগারেটও দরকার হত। নেপাল প্রেমিকার সামনে পুরো প্যাকেট বার করার র্যালা দেখানোর জন্য একটা চেনা দোকান থেকে পুরো এক প্যাকেট চেয়ে নিত। প্রেমালাপ চলাকালীন দু-একটি খরচ হত, প্যাকেটটা ফেরত দিয়ে ব্যবহৃত দু-একটি সিগারেটের দাম দিত।

এত কষ্ট করে প্রেম করেছে নেপাল, এবং বিবাহ। লিলিকেই। দোকানের স্বত্ব হারিয়ে কম বেতনের ছোটখাটো চাকরি করেছে নেপাল। লিলি একটি কন্যাসন্তান রেখে অকালে মারা যায়। তার পর নেপাল বালি-সিমেন্ট কিনে গঙ্গার ধারে বেশ ক’টা হেলান দেওয়া বেঞ্চি বানিয়ে দিয়েছে, লিলির স্মৃতিতে। গাছের গোড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে নতুন লিলিদের জন্য। গঙ্গার সৌন্দর্যায়ন উত্তর কলকাতায় শুরু হলে এ সব তাজমহল ধ্বংস হয়ে যাবে।

নেপালের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল— যা খাবি খা তোরা, পুরোটাই আমার, ফেরত দিতে হবে না। সিগারেটের সঙ্গে বিষাদ মেশানো হাসিও ফাউ দিয়েছিল নেপাল।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE